ছোটোবেলা থেকেই একটা ব্যাপার এই সেদিন পর্যন্ত কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। রিলে রেসে প্রতিটি প্রতিযোগী ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে শুরু করলেও শেষ একই লাইনে করে কেন! একই লাইন থেকে শুরু করলেই বা অসুবিধা কি হতো?  সংরক্ষণ নিয়ে ইদানিং বয়ে চলা আলোচনাতে আজকাল এই রিলে রেসের লাইনটাই ভীষণ রূপকধর্মী হয়ে উঠেছে। এর সুবিধা, অসুবিধা ভালো-মন্দ সবটাই যেন এক একটি রিলে রেসের লাইন।

    আজকাল আলোচনায় সর্বদাই দুটি পক্ষ। এই দুটি পক্ষের অবস্থান আজকের নয়, কিন্তু এই সাদা আর কালোর মাঝখানে মোটা দাগের বিভেদটা এখন বড় উজ্জ্বল। এমনকি, বিভিন্ন সময় ভারতের বিচার ব্যবস্থার পর্যবেক্ষনেও এই দ্বিধাবিভক্ত সমাজের প্রতিফলন, প্রতিফলিত হয়েছে। সম্প্রতি মারাঠা সংরক্ষণ মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষন — “শিক্ষায়-চাকরিতে আর কতদিন ধরে সংরক্ষন চলবে?” এই মন্তব্য বিষয়টিকে আবার পাদপ্রদীপের আলোয় এনে ফেলেছে। বিচার ব্যবস্থার এই পর্যবেক্ষন কিন্তু নতুন নয়। বিভিন্ন মামলায় ভারতবর্ষের সুপ্রিম কোর্ট সহ বিভিন্ন কোর্ট নানা সময় ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। এ যেন, সংরক্ষণ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত সমাজেরই মতামত প্রতিফলিত হয়েছে মহামান্য আদালতের পর্যবেক্ষণে।    

দ্য ওয়াল থেকে সংগৃহীত

    মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে, সংরক্ষণ সম্পর্কিত আলোচনায় যে প্রশ্নগুলি বারবার চায়ের কাপে তুফান তোলে সে গুলোর দিকে একটু দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যাক।

১) উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চ চাকুরেদের বংশ পরস্পরায় সংরক্ষণ এর এই মচ্ছব আর কতদিন চলবে?

২) সমাজের পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর শ্রেণীর সংরক্ষণের ফলে কোনো সুবিধা হয়েছে কি? যদি হয়েই থাকে তাহলে স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও এই সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়ছে কেন?

৩) সংরক্ষণের সুবিধাভোগীরাই নিজ বর্গের এখনো অনগ্রসরদের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছে না তো?

৪) ভারতের উন্নতিতে এই সংরক্ষণ ব্যবস্থার নেতিবাচক প্রভাব নিয়েও অনেকে গভীরভাবে সঙ্গতভাবেই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। বিশেষত প্রকৃত মেধাবীরা উচ্চশিক্ষা ও চাকরিতে বঞ্চিত হওয়ার ফলে ‘দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি রুদ্ধ হতে বাধ্য’ বলেই তারা মত পোষণ করে থাকেন।

৫) জাতি ভিত্তিক সংরক্ষণ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিকভাবে ও শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া জনগন পর্যন্ত সুফল কি পৌঁছচ্ছে? উল্টে জাত পাত ভেদাভেদে এই ব্যবস্থা অনুঘটকের মতন কাজ করছে বলেই সংরক্ষণ বিরোধীরা মনে করেন।

৬) এই ব্যবস্থার ফলস্বরূপ আমরা জাতি বিদ্বেষ ও দাঙ্গার দিকে ক্রমশ আরো এগিয়ে যাচ্ছি না তো?

৭) সংবিধানের সমতার অধিকার লঘ্নিত।

৮) সবশেষে, দলমত নির্বিশেষে প্রায় সকলেই জাতি বা ধর্মের থেকে অর্থনৈতিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে সংরক্ষণের পক্ষে মতামত পোষণ করে থাকেন।

  এটা পরিষ্কার, বিরোধিতা করার সময় আমরা সংবিধান প্রণেতাদের এক সমমাত্রিক (egalitarian) সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার কথাটি একেবারেই ভুলে যাই। আমরা ভুলে যাই সামাজিক সমতার অর্থ শুধু মাত্র অর্থনৈতিক উন্নতি নয়, একটি অনুঘটক  মাত্র। সংবিধানের সংরক্ষণ সম্পর্কিত ধারাগুলি প্রণিধান সহকারে পর্যালোচনা করলে আমরা অনুভব করতে পারবো, সংরক্ষণ শুধুমাত্র কয়েকটি বিশেষ জনজাতি গোষ্ঠীকে বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদানের জন্যে অন্তর্ভুক্তি হয় নি, হয়েছিল, প্রতিটি ব্যক্তির সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে। 

    এটা ঘটনা, বর্তমানে এই চূড়ান্ত আক্রমনাত্বক প্রচার সর্বস্ব খবরের দুনিয়ায় সংরক্ষণকে ক্রমশ অর্থনৈতিক অন্যায্য সুবিধা হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে বা রূপ দেওয়া হয়েছে অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী যুগে দলিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণীকে যে সামাজিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে হতো তা একবিংশ শতকের শহুরে বাবুদের পক্ষে ধারনাতেই আসা একপ্রকার অসম্ভব। সেই অসম্ভব কে সম্ভব করার লক্ষেই এই প্রয়াস। যাতে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীও একটু এগিয়ে এসে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার সাহসটুকু অন্তত দেখাতে পারে। হাজার হাজার বছরের নিপীড়ন, নিষ্পেষনের পর যে সমস্ত জনজাতি উপজাতির জনগন,  মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় ভুলতে বসেছিল, স্বাধীনতার পর সংবিধান প্রণেতাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল তাদের সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, নিদেন পক্ষে ফেরাতে সাহায্য করা। সংবিধান প্রণেতারা বুঝেছিলেন পুরো জনজাতির সিংহভাগ জনগন যদি এই অপরিসীম হীনমন্যতায় ভোগেন, ভারতের মতো একটা দেশ সামনে এগোতে পারে না। 

    এখন অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে — সংরক্ষণ জাতিগত সামাজিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে কেন? একজন গরিব ব্রাহ্মণ কি একজন চাকুরিজীবি দলিতের থেকে উচ্চ সামাজিক অবস্থানে অধিষ্ঠিত? প্রশ্নটা কিন্তু অমূলক নয়। বিরুদ্ধ বাদীদের সব যুক্তিই যে কু-যুক্তি তা কিন্তু নয়। সত্যিই তো! প্রচুর পরিশ্রম করার পরেও অনেক কম মেধা সম্পন্ন কেউ সুযোগ পেয়ে জীবনের চলার পথে অনেক এগিয়ে যায়! রাগ-ক্রোধ-ঈর্ষা-বিদ্বেষ হওয়াটাই স্বাভাবিক। খুব বেশি অপপ্রয়োগ সমতার বদলে সামাজিক অসমতা ও জাতি দাঙ্গার দিকেও ঠেলে দিতে পারে দেশকে। এবিষয়ে শ্রীলঙ্কার ‘এল টি টি ই’ সম্পর্কিত সম্যসার কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। শ্রীলঙ্কার সম্যসা পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর ছিল না। সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত উচ্চশ্রেণীর জনগণকে বঞ্চিত করে পিছিয়ে পড়া ভূমিপুত্র দের অতিরিক্ত সুবিধা প্রদানের আনুষ্ঠানিক আয়োজনের মধ্যেই সমস্যার বীজ লুকিয়ে ছিল। 

    এখন আসুন আমরা বোঝার চেষ্টা করি এই যে ‘গেল গেল’ রব তা কি শুধুই কলরব নাকি পেছনে কোনো ভিত্তি আছে। বাস্তব আর জনশ্রুতির মধ্যে ফারাকটা ঠিক কতটা।

    ২০১১ সালের জাতিভিত্তিক আদমসুমারীর সাহায্য নেওয়া যাক। ২০১১ সালের আদমশুমারি বা সেন্সাস অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যা শতাংশের বিচারে নিম্নরূপ:

তফসিলি জাতি — ১৯.৫
তফসিলি উপজাতি         — ৮.৫
অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী — ৪১.১
সাধারণ জনজাতি         — ৩০.৮
অন্যদিকে সংবিধানে প্রদত্ত সংরক্ষনের হার:
তফসিলি জাতি — ১৫
তফসিলি উপজাতি — ৭.৫
অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী — ২৭
অর্থনৈতিক পিছিয়ে পড়া শ্রেণী — ১০
সাধারণ জনজাতি    — ৪০.৫
    তালিকা থেকে পরিষ্কার, জনসংখ্যার বিচারে সাধারণ জনজাতির জন্য তার সংখ্যার শতাংশের চেয়ে সংরক্ষণের হার অনেকটাই বেশি। উপরন্তু বেশিরভাগ সময় সংরক্ষিত জনজাতির সংরক্ষণের সুযোগ নিতে পারার অপারগতার কারণে সেই সুযোগ ও সাধারণ অসংরক্ষিত বলে গণ্য হওয়ার আইনি প্রণিধান তো আছেই।

বাজার চলতি ধারণা আর বাস্তবের মধ্যে ফারাকও বিস্তর। এই ‘গেল গেল’ কলরবের সংরক্ষণের যুগেও, মাত্র ত্রিশ শতাংশ সাধারণ জনজাতির জনগণের মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং সহ সমস্ত উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে প্রায় ৭০ শতাংশের উপস্থিতি। মিডিয়া হাউস কিংবা সরকারি, বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্র থেকে ব্যবসা বাণিজ্য সর্বত্র  অবস্থাটা ঠিক কী, স্রোতে না ভেসে শুধু নিজের অফিস বা চারিদিকটাই একবার চোখ বোলান। অবাক হবেন, বাস্তব অবস্থাটা প্রায় একই। প্রায় প্রতিটি আর্থ সামাজিক অবস্থানে দেশের ৩০ শতাংশ মানুষের হাতে ৭০ শতাংশ সম্পদ, চাকরি, ব্যবসা, বাণিজ্য। কলরবটা শুধুমাত্র কলরবই। বাস্তবের সঙ্গে সাদৃশ্য বড্ড কম।

  এখন প্রশ্ন হলো, এরকম যথাযথ চিন্তন ও মনন ছাড়া যথেচ্ছ সংরক্ষণে কার ভালো হচ্ছে?  একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোধগম্য হবে।  ২০১৭ সালে কানপুর আই আই টি-তে সংরক্ষণের সুযোগে যত ছাত্র ভর্তি হন তার প্রায় ৮০ শতাংশ ছাত্রকে একাডেমিক পারফরম্যান্স ইভালুয়াশন কমিটি বহিষ্কার করতে বাধ্য হন। কারণ আর কিছুই নয়, ভিত্তি অতীব দুর্বল হওয়ায় এই ৮০ শতাংশ অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছিল না। যে কয়েকজন নিজেদের টিঁকিয়ে রাখতে পেরেছিল তারা হয়তো বা ব্যতিক্রম অথবা অন্য সাধারণ বর্গীয়দের মতন সামাজিক অর্থনৈতিক সুযোগ পেয়েছে।

    সংরক্ষণ বিরোধিতায় সব থেকে বড় যুক্তি আসে প্রতিভার প্রশ্নে। ভারত তথা সারা বিশ্বে সংখ্যার হিসাবেই সমস্ত সুযোগ সুবিধার বিলি বন্দোবস্ত হয়, তবে এক্ষেত্রেই শুধুমাত্র প্রতিভার প্রশ্ন এত ব্যাপক আকার ধারণ করলো কেন? 

    আসলে আমরা প্রতিভার মোড়কে নিজেরদেরই সংরক্ষন চাইছি। আমরা বলতে চাইছি ৪০.৫ নয় আমার পুরোটাই চাই। যে বঞ্চিত, লাঞ্চিত সে থাকুক না যেখানে আছে সেখানেই। আমরা যারা উপযুক্ত পরিবেশ, পরিস্থিতি পেয়েছি এবং তার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পেরেছি, তারা কেন এই সব সর্বহারাদের জন্যে বঞ্চিত হব এক নিশ্চিন্ত জীবন থেকে! আমরা ভুলে যাই প্রতিভার বিচ্ছুরণ হয় উপযুক্ত পরিবেশ পেলে। আমরা ভুলতে চাইছি, দীর্ঘদিন ধরে আমরাই নানা ছল চাতুরিতে এই প্রাপ্য পরিবেশ থেকে এদেরকে বঞ্চিত করেছি। এখন যখন নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে এই বিশাল জনজাতি নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিতে চাইছে তখন আমরাই নিজেদের অসংরক্ষিত অনুভব করছি। হ্যাঁ, ঠিক ই শুনেছেন, আমরা এই প্রতিভার মোড়কেই নিজেদের জন্যে ১০০ শতাংশ সংরক্ষণ চাইছি।

  আচ্ছা, প্রতিভা বস্তুটি ঠিক কী, কী তার  অবয়ব — বিতর্ক বিস্তর। ‘প্রতিভা’ আর ‘প্রতিভার বিচ্ছুরণ’ এই দুইয়ের মধ্যে গুলিয়ে ফেলছি না তো? কোনো প্রান্তিক মানুষের যথেষ্ট প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও তার বিচ্ছুরণ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। উল্টোদিকে সমস্ত সুযোগ সুবিধা বারবার ব্যবহারের মাধ্যমে একজন সাধারণ বা মধ্যমেধার ব্যক্তিও মেধাবী হিসাবে পরিচিতি পেতে পারেন। আসলে আমরা মেধার মোড়কে আমাদের সামনের রাস্তা আরো আলোকিত করতে চাইছি। 

    মেধা বলতে ঠিক কী বুঝি আমরা? গোদা বাংলায় যিনি কোনো কঠিন কাজ খুব সহজে করতে পারেন তিনিই মেধাবী। আবার খুব স্বল্প যোগান, পরিসর বা সুযোগ সুবিধা সত্বেও সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে যিনি খুব সহজে অসাধ্য সাধন করেন তিনিই প্রতিভাবান। যেমন ধরুন মাঝে মাঝে শোনা যায় কোনো গ্রামীণ হাসপাতালের ডাক্তারবাবু উপযুক্ত সাধন ছাড়াই স্বল্প পরিসরে বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে কোনো জটিল অস্ত্রপচার সাফল্যের সঙ্গে সমাধা করেন, এই রকম নানা ঘটনা। কিন্তু কোনোদিন ভেবে দেখেছেন, মুর্শিদাবাদ অথবা বর্ধমানের অধিবাসীরা কোন অবস্থার মধ্যে বিশ্ব বিখ্যাত সিল্ক বা ডোকরার কাজ করেন! এরা কি প্রতিভাবান? এদের মধ্যে আবার অধিকাংশই পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর। যদি প্রতিভাবান হন তাহলে এই অধিবাসীরা সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত কেন? প্রশ্নগুলো থেকেই যায়। 

    দুজন অসম মানুষকে সমান হিসাবে দেখা কিন্তু নিষ্ঠুরতারই নামান্তর। একদিকে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, লাঞ্ছনার ফলে এক বিপুল সংখক জনগন অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে, তার ওপর আবার এখন সমানাধিকারের নামে তাদের আরো পশ্চাদগামী করার জন্য অনেকে উঠে পড়ে লেগেছেন। আসলে, লড়াইটা যাদের সব আছে তাদের সঙ্গে যাদের কিছুই নেই তাদের মধ্যে। ধরুন আপনার একটা সাইকেল আছে। আপনি তখন চাইবেন, পথচারীহীন পথ। আপনি সাইকেল থেকে মোটর সাইকেলের মালিক হলে, তখন সাইকেল আরোহী আপনার পথের কাঁটা, আবার যদি চার চাকার মালিক হয়ে বসেন, তখন . . . 

    চায়ের কাপে তুফান তুলে, পক্ষ অবলম্বনকারীরা একটা কথা খুব জোরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। ‘আর কতদিন?’ খুব যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন। উল্টো প্রশ্নটার ভার কিন্তু আরো বেশি। কেন এখনও আমরা একই সমতলে এসে পৌছালাম না? কেন একবিংশ শতকের কলকাতার আলোর প্লাবনের নিচের অন্ধকারে নালি পরিষ্কার করেন শুধুমাত্র পিছিয়ে পড়াশ্রেণীর জনগনই? অথচ, প্রতিটি মন্দিরে পূজারীর কাজটা কিন্ত . . . তাহলে এও কি আরেক সংরক্ষণ নয়?

    আসলে, স্বাভাবিক প্রবণতায় আমরা আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যর্থতার দায়, ভুক্তভোগীদের উপরেই চাপিয়ে দিয়ে হাত ধুয়ে মানসিক শান্তি পাই। দায় তো সরকারের ছিল। দায় তো সমাজেরও ছিল। সব থেকে বড় দায় ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের। আমরা কেউ সেই দায়িত্ব পালন করিনি। সরকার এমন কোনো ব্যবস্থা করেনি, যাতে, সংবিধান প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা এই পিছিয়ে পড়া শ্রেণী গ্রহণ করার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। তাই তো,  প্রান্তিক দলিত কোনো ছাত্র আই আই টি-তে ভর্তি হবার সময় সংরক্ষনের সুযোগে পেয়ে যান, কিন্তু ধরে রাখতে পারেন না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এর কথা যত কম আলোচনা করবেন তত ভালো। তারা যে এ ব্যাপারে জাতপাতহীন এক সমাজের কথা চিন্তাই করতে পারেন না, তা একবিংশ শতকের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। সমাজ যে স্বাধীনোত্তর পর্যায়ে খুব একটা এগোয় নি, তা রবিবারের পাত্রপাত্রী কলামে একবার চোখ বুলালেই পরিষ্কার হয়ে যায়। যার ফলে আমরা সব্বাই নিজের নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে চূড়ান্ত উদাসীন থেকে, সংবিধান প্রণেতাদের এক সাধু উদ্দেশ্যকে কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত করলাম। শুধু তাই নয়, উল্টে এখন সব দায় ভুক্তভোগী সম্প্রদায়গুলোর উপর চাপিয়ে চায়ের কাপে তুফান তুলে আত্মশ্লাঘা অনুভব করাও অভ্যেসে পরিণত করেছি। 

    এখন প্রশ্ন হলো, সংরক্ষণের ফলে পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক শ্রেণীর কি কোনোই উন্নতি হয়নি? হয়েছে। যে কোনো দলিত অধ্যুষিত গ্রামে গেলে দেখা যাবে খুব ছোট হলেও সংরক্ষনের সুবিধায় বলীয়ান একটি ক্ষুদ্র শ্রেণী তৈরি হয়েছে। যারা, নিজেদের অধিকার অবস্থান সম্বন্ধে আর সন্ধিহান নয়। কিন্তু এরা খুবই ক্ষুদ্র একটা শ্রেণী। এখন, এই ক্ষুদ্র শ্রেণী কে উদাহরণ হিসেবে সামনে রেখেই প্রতিনিয়ত ধারণা তৈরি করার প্রচেষ্টা হয়ে চলেছে যে, সমগ্র পিছিয়ে পড়া শ্রেণীই এক স্বর্গ রাজ্যের অধিকারী হয়েছে আর ভারতবর্ষ এক জাতপাতহীন সমাজে পরিণত।

    সমমাত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সমস্ত অবস্থানে সব পক্ষের উপস্থিতি অবশ্য প্রয়োজন। নিজের কথা, নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কথা, প্রয়োজন অপ্রয়োজনের কথা, নিজে ছাড়া অন্য কেউ জানে না। সাধারণ জনজাতির প্রতিনিধি হিসেবে, ক্ষমতার পরিমন্ডলে অবাধ যাতায়াতের খাতিরে, নিজের অসন্তুষ্টি, পাওয়া না-পাওয়ার খতিয়ান সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবার সুযোগ আমার আছে। সে অসন্তুষ্টির বহিঃপ্রকাশ, দেশের সর্বচ্চ আদালত থেকে পর্যবেক্ষনের আকারে আসতে পারে। সংরক্ষণের যাঁতাকলে আমার সন্তানের চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন চুরমার হলে আমার খারাপ লাগা স্বাভাবিক কিন্তু বাকি ৭০ শতাংশের প্রাথমিক শিক্ষার বোধই যে  রাষ্ট্র গড়তে ব্যর্থ, তার জবাবদিহি কে করবে? কারো কোনো দায় নেই!! কেউ কোনো দায় নেবেন না!!!

    আমার কাছে একটা ব্যাপার কিছুতেই পরিষ্কার নয়। ব্যক্তিগত পরিসরে পরিবারের কোনো সদস্য কোনো জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে, আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য  থাকে, তার রোগ নিরাময়, তার চিকিৎসার সময়কাল নয়। আমরা কি নিরাময় না হলেও, শুধুমাত্র সময়ের কারণে প্রিয়জনের চিকিৎসা বন্ধ করে দিই? সময়ের কারণে, চিকিৎসা বন্ধ তখনই সম্ভব, যদি, আমরা তাঁর, বেঁচে থাকার অধিকারটাই অস্বীকার করতে পারি। আমরা যদি বিশ্বাস করতে শুরু করি দেশের সমস্ত সম্পদের উপর শুধু আমাদেরই অধিকার, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণী থাকবে আমাদেরই অনুগ্রহে, তাহলে এরকম একটা চিন্তা আসা স্বাভাবিক। 

    জাতপাতহীন এক সমাজ আমরা সবাই চাই। জাতপাতকে সামাজিক ব্যাধি হিসেবেও সমাজের বৃহৎ অংশ মেনে নেয়। তাহলে সামাজিক ব্যাধির ক্ষেত্রে নিরাময়ের এই ওষুধ বন্ধের প্রয়াস, পিছিয়ে পড়া শ্রেণী সমন্ধে আমাদের মনোভাবটাকেই এক্কেবারে বেআব্রু করে দেয় না কি? আমি জানি না, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ, কী মর্মে, এই পর্যবেক্ষন ব্যক্ত করেছেন। তবে আমি বিশ্বাস করতে চাই, মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এই পর্যবেক্ষনের দ্বারা, সরকার সহ সব পক্ষকে, এক চেতবনি দিয়ে সতর্ক করেছেন — আর কতদিন, এই জাতপাতযুক্ত সমাজ বয়ে বেড়াবে ভারতবর্ষ। আর কতদিন, এই সব প্রান্তিক মানুষরা মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে। আর কতদিন, সমাজের প্রতিটি স্তরে, পিছিয়ে পড়া শ্রেণী সঠিক ভাবে, তার উপস্থিতির জানান দিতে অপারগ হবে। আর সেই সুযোগে, সাধারণ জনজাতি, শুধুমাত্র ধারণার উপর ভিত্তি করে, নিজ নিজ সংরক্ষণকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সফল হবে।

    এই পর্যায়ে এসে ছোটোবেলায় বাবার কাঁধে চেপে গ্রামের ফুটবল খেলা দেখার অভিজ্ঞতা হয়তো অনেকেরই আছে। ভাবুন তো সমান অধিকারের নামে সেদিন যদি বাবা আপনাকে মাটিতে নামিয়ে দিতেন!! আপনি খেলা দেখা তো পরের কথা, মাঠটাই দেখতে পেতেন না। আমরাও কি সমানাধিকারের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের সামনে একইরকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ব্যবস্থা করতে চাইছি? ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। আবার বলব, দুজন অসম মানুষকে সমান হিসাবে দেখা কিন্তু নিষ্ঠুরতারই নামান্তর। 🚫


আমরা চায়ের কাপে যে তুফান তুলি যে সমস্ত বিষয় নিয়ে
তার পিছনে আমাদের যে চিন্তা ভাবনা 
বা অনেকসময় যে চিন্তাভাবনাগুলো আমরা ধার করি সামাজিক মাধ্যম থেকে
সেগুলো নিয়েই যুক্তি ও তথ্যকে প্রাধান্য দিয়ে
ছদ্মনামের আড়ালে কলম ধরেছেন
কোনো লেখক নন,
সমাজকর্মী নন,
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন,
নিতান্ত একজন সাধারণ মানুষ।
যার একটিই পরিচয় -
তিনি ভাবতে চান, বিচার করতে চান।
জনৈক জগদ্বন্ধুর কলামে স্বাগত