শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
এই পেজেই প্রকাশিত হবে উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে।
মাসের দ্বিতীয় আর চতুর্থ রবিবার।
সাম্প্রতিক পর্ব - পর্ব -১১ (৮ অক্টোবর ২০২৩ ) পড়তে হলে এখানে ক্লিক করতে হবে
পায়রাডাঙার অগ্রদ্বীপ চ্যাটার্জির কোনও এক বুড়ো ঠাকুমা ঠাকুরদা একসময় ওপারবাংলা থেকে এপারে পশ্চিমবঙ্গের কুপার্সে রিফিউজি হয়ে আসেন। তারপর তার চার পাঁচটি পূর্ব পুরুষ প্রজন্ম শ্রম জীবনযাপন করে সংসারে খানিকটা স্থিতি আনতে সফল হন। সেসব কথা অগ্রদ্বীপের বংশলতিকা দেখলে বোঝা যায়। ]
এখন অবশ্য সেসব দিন রাধামাধবের কৃপায় অতীত হয়েছে। এই কাহিনীর সময়ক্রম ২১৫৭ সাল।পায়রাডাঙা এখন সারা বিশ্বের একমাত্র নিউক্লিয়ার অটোমোবাইল প্রস্তুতকারক। অগ্রদ্বীপ সেখানকার প্রধান ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার ইঞ্জিনিয়ার। ভারতের এশিয়া ফাউণ্ডেশন বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে বিশেষত অনগ্রসর দরিদ্র তৃতীয় বিশ্বর কথা ভেবে।আমেরিকা এখন তেমনই এক তৃতীয় বিশ্ব। বিশেষ মিশনে সেই দেশে এশিয়া ফাউণ্ডেশনের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে অগ্রদ্বীপের পরিচয় হলো এথেনার সঙ্গে। এথেনা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ববিধ্বস্ত ঘরছাড়াদের মানবাধিকার নিয়ে লড়তে থাকা এক তরুণী সমাজকর্মী সাংবাদিক। সে বাংলা বলতে পারে। কারণ বাংলা এখন সারা বিশ্বর কথোপকথনের প্রধান আন্তর্জাতিক ভাষা।এশিয়া ফাউণ্ডেশনের সামন্ততান্ত্রিক আগ্রাসন ও আমেরিকা ব্রিটেনের মতো দরিদ্র তৃতীয় বিশ্বর দেশগুলির ভিতর এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এথেনা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়।কিন্তু অগ্রদ্বীপের সঙ্গে আলাপ হবার পর তার অতীত, তার ভাবনা ও উন্নত ভারতের সুপ্রাচীন ভারতদর্শন তাকে তার আন্দোলনে একটি নতুন দিশা দেখাতে পারল। পাঠক ভাবতে পারেন এ আখ্যান পাগলের প্রলাপ। কেউ কেউ এই উপন্যাস কল্পবিজ্ঞান ভাবতেই পারেন। কেউ কেউ আনতে পারেন বিতর্ক। কিন্তু এই উপন্যাস আগামীর কাহিনী। দিবানিদ্রা আর রাতের নিদ্রাহীনতার রোমান্টিকতা মিশ্রিত দুই ভিন্ন মেরুর মানুষ, অগ্রদ্বীপ আর এথেনার এক অপ্রমেয় ও অদম্য প্রেমের উপাখ্যান। হঠাৎ ঘটে যাওয়া এক বিস্ময়কর বুদবুদ।
আগের পর্বগুলি পড়ার জন্য
নিচে প্রথম পর্ব থেকে পড়তে হবে অথবা নির্দিষ্ট পর্বে ক্লিক করে যেতে হবে
।। পর্ব - ১ ।।
জীর্ণারণ্য টৌন
এই যে বিবরণ লিখতে চলেছি তার
উৎসস্থলের সূত্রধর আমি নই। সতীনাথবাবু। যদিও এই ঘটনার ঘনঘটায় কোথাও জিরানিয়া না
থাকাই স্বাভাবিক ছিল। নেইও। এ কাহিনির কেন্দ্রস্থলে পায়রাডাঙা জনপদ। জনপদের কোল
ঘেসে কারীকোশি নদীর মতোই বয়ে চলেছে মজাখাল। কেউ কেউ বলে একসময় তার নাম ছিল অঞ্জনা।
আধুনিক উপন্যাসের মতোই এই লেখনী কোনও 'হঠাৎ চমক' ধরে শুরু হতেই পারত। কিন্তু হলো না। তার কারণ সতীনাথবাবু।
আর তার জীর্ণারণ্য টৌন। 'টৌন' শব্দ 'টাউন' শব্দ জাত। কিন্তু এই কাহিনীর পায়রাডাঙা প্রসঙ্গে 'টোন' শব্দ প্রয়োগ
নিঃসন্দেহে বিশিষ্টার্থে কারণ এ শহর তাৎমাটুলি নয়। নয় ধাঙ্গরপল্লীও। নিন্দুকরা
গল্পের গরু গাছে চড়াতে দিব্বি বাসেন। আর গল্পকার সময়কে কল্পতরু চড়াতে। এই ঘটনার
ঘনঘটার উন্মেষ যে সময় সেই সময় নিরীক্ষণ করলে 'পায়রাডাঙা' কে নেহাত মফস্বল বলে নাক সিঁটকালে ভুগতে হবে। অবশ্য তাৎমারা
রয়েছেন এখনও, খুজে পেতে দু এক 'বুড়বক খিরিস্তান'এর সন্ধান মিলে যাওয়াটাও অসম্ভব নয়। কিন্তু যেটা বদলানো দরকার, তা হল এই গল্পর পাঠকের চোখ। আর দৃষ্টিভঙ্গির সমতল। কারণ এই
কাহিনীর সময়কাল দু হাজার একশো সাতান্ন সাল। পায়রাডাঙা সেখানে নগর কৃষ্ণনগর বা
মহানগর কলকাতার দাসানুদাস কোশভর জীর্ণারণ্য নয়। এই জনপদ এখন পৃথিবীর বৃহত্তম
পারমানবিক চলযানের প্রস্তুতকারক। এই সত্য নিরূপনের পথ মোটেই সুখকর নয় বলেই লেখার
শুরুতে সতীনাথবাবুর সান্নিধ্যের প্রয়োজন হল।
কিন্তু যেহেতু এই
লেখার উপস্থাপন খানিকটা প্রাক্তন ঔপনিবেশিক ভারতে আছড়ে পড়বে, তাই যৌক্তিক পরিকাঠামোর মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োগটি মাথায় রেখে
খানিকটা গৌরচন্দ্রিকার প্রয়োজন ছিল। যে সময়ে এই কাহিনীর অবতারণা, তার ঘটমান হবার আগেই পৃথিবী আরও একটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে।
আগের দুটি বিশ্বযুদ্ধর তুলনায় এই যুদ্ধ আরও ভয়াবহ ছিল কারণ বিশ্বের কোনও শক্তিই
তাঁদের পারমাণিক শক্তি প্রয়োগ করতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। প্রথমে রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো
ভেঙে যাবার পর ভাঙতে শুরু করল মানুষের সভ্যতার অস্তিত্বর পরিকাঠামো। চরম খাদ্যাভাব, আর বাস্তুহীন অতিমারী পরিবেশে ভেঙে গেল পরিবার, নৈতিক দেউল। যুদ্ধে পৃথিবীর তেলের ভাণ্ডার নিঃশেষিত হলে যখন
সব কিছু শোকস্তব্ধ শ্রাদ্ধবাসর হয়ে চলেছে, ঠিক সেই সময় চিরকাল নটা পাঁচটা গতে বাঁধা চাকরিতে অভ্যস্ত কাঁচড়াপাড়ার এক
কেরানি সুধন্য চট্টোপাপাধ্যায় তার ভুলে যাওয়া বিজ্ঞানসন্ধিৎসু মন নিয়ে হঠাৎ
পায়রাডাঙায় তার পৈতৃক কলোনিপাড়ার ভাগাড়ের ভিতর আবিষ্কার করলেন ইন্ডিয়াম ১১৬ আইসোটোপের
খনি। দৈনিক আবর্জনা, কলার খোশা, মরা কুকুরের লাশের নিচে এমন রত্নভাণ্ডারের দেখা মিলবে কে
জানত। সুধন্য পদার্থবিজ্ঞানে সোনার পদক পেয়েছিলেন। কিন্তু নটা-ছটার ব্যলান্স শিটের
কোথাও তার সেই স্পর্ধা হারিয়ে গিয়েছিল। ইন্ডিয়াম খনি তাকে আবার সেই সোনার
আত্মবিশ্বাসের দিনে ফিরিয়ে আনল। প্রাচীন ঔপনিবেশিক যুগের বিজ্ঞানবই খুললে দেখা
যাবে 'ইন্ডিয়াম' মৌলের তেজস্ক্রিয়তা
স্থিতিশীল করতে প্রয়োজন হত 'ক্যালিফোর্নিকাম'এর। সেখানে তৃতীয় আর প্রথম বিশ্বর এক অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব
লুকিয়ে ছিল। পায়রাডাঙার 'ইন্ডিয়াম ১১৬' একই সঙ্গে তেজস্ক্রিয় ও স্থিতিশীল। সুধন্যর কলোনিবাসীরা
যুদ্ধবিধ্বস্থ কলকাতা, কৃষ্ণনগর ও
অন্যান্য মহানাগরিক গরিমার প্রত্যাশা ত্যাগ করে তৈরি করলেন এমন এক ফিশন যন্ত্র যা
অনায়াসে 'ব্যাটারি'র মতো গাড়ির পিছনে
গুঁজে দিলেই গাড়ি একশো বছর আগে যেমন চলত, তেমনই চলবে। কলোনিতে লোকসংখ্যা বাড়ছিল। একে কি তাত্ত্বিকরা অনুপ্রবেশ আখ্যা
দেবেন?
আমার জানা নেই। অন্তত সুধন্যর তিন পুরুষ চারপুরুষ আগের যেসব
আত্মীয়স্বজন রাতারাতি তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে এই কুপার্সে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই শরণার্থীদের আতঙ্ক এই অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে নেই।
সুধন্য চট্টোপাধ্যায় আর তার কলোনিবাসী এভাবেই পায়রাডাঙাকে বিশ্বমানচিত্রে সাঙঘাতিক
প্রাসঙ্গিক করে তুললেন।
গৌরচন্দ্রিকা দীর্ঘ হলে পাঠক মূল কাহিনীর কেন্দ্রস্থল থেকে আগ্রহ হারিয়ে
ফেলবেন। তাই এইবার সরাসরি চলে আসে কাহিনীর মুহূর্তে। সুধন্য ফাউণ্ডেশনের আটাত্তরতম
তলার খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের জনপদের দিকে তাকিয়ে ছিল অগ্রদ্বীপ। অগ্রদ্বীপ
চট্টোপাধ্যায় সুধন্যর আশ্চর্য আবিষ্কারকে মাত্র ছাব্বিশ বছরের তরুণ কাঁধে এগিয়ে
নিয়ে চলেছে। এই পারমাণবিক অটোমোবাইল কারখানার মূখ্য শিল্পনির্দেশক সে। বারান্দা
থেকে অগ্রদ্বীপ দেখছিল পায়রাডাঙা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অনতিদূরেই পরীক্ষা
গবেষণার মাঠে ছোট্ট উড়ানের মহরা দিচ্ছে তার নতুন আবিষ্কার। ইন্ডিয়াম
তেজস্ক্রিয়তাকে জ্বালানি করে ছোট্ট টু সিটার গাড়ি বাতাসে ভেসে ওঠার চেষ্টা করছে।
এই পরীক্ষা সফল হলে পায়রাডাঙা ছুঁয়ে ফেলবে আরেক মাইলফলক। অগ্রদ্বীপের সামনে সাইফাই
সিনেমাতে দেখা আশ্চর্য শহরের মতোই বহুতল ভীড়। তিরই ভিতর 'সুধন্য ফাউণ্ডেশন' কারখানার কোল ছুঁয়ে বয়ে চলেছে শীর্ণ মজে যাওয়া অঞ্জনা নদী। এদেশ সতীনাথবাবুর
তাৎমাটুলি হলে এ নদী মরাকোশী হতো হয়তো, একথা আগেই বলেছি। মজাখালে কালচে রক্তের স্রোতের মতো ভেসে যাচ্ছে কারখানার
বর্জ্য পদার্থ। পায়রাডাঙার উন্নতি এই অবশ্যম্ভাবী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এড়িয়ে যেতে
পারেনি। ভাবতে ভাবতেই ভিতরে নিজের বিরাট বিলাশবহুল ঘরে ফিরে এল অগ্রদ্বীপ। ঘরের
কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে দূরে তার শৈশবের দিনগুলির মতোই দেখা যাচ্ছে এক চিলতে সবুজ।
ওই সবুজ অবশিষ্ট আমবনের ভিতরেই কোথাও রয়ে গেছে তার আদিবাড়ি। কুপার্স ক্যাম্প।
সেখানে বাবার মুখে শোনা তার বুড়ো ঠাকুমা বেতের ঝুড়ি বানিয়ে শহর কলকাতায় বিক্রি
করতে যেতেন। অগ্রদ্বীপের ঘরটি ধবধবে সাদা। সেখানে আসবাব তেমন নেই। ঘরের দুটি
মুখোমুখি দেওয়ালের একটিতে এই কর্মকাণ্ডের কাণ্ডারী 'সুধন্য চট্টোপাধ্যায়'র প্রকাণ্ড
তৈলচিত্র লাগানো। সুধন্য চট্টোপাধ্যায় অগ্রদ্বীপের
পিতামহ। অঙ্কনশৈলীর মুনশিয়ানায় সেই চিত্রে সুধন্য যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছেন।
অবশ্য সে প্রশংসা জানাবার মতো কোনও চিত্রকর এই মুহূর্তে চিত্রপ্রদর্শক পাবেন না।
কারণ ছবিটি কোনও মানুষের আঁকা নয়। দেশের শিল্পভাবনা, পটচিত্র, লোকজ শিল্প, সমস্ত কিছুই আপাতত গ্রাস করে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে
প্রযুক্তি। টেকনিক্যাল ভাষায় তার নাম 'আর্টিফিসিয়াল
ইন্টেলিজেন্স'। উন্নত দেশের লোকজ কুটিরশিল্পীরা
সেই যন্ত্রর সহচরের কাজ করে চলেছে। সেই প্রাণবন্ত তৈলচিত্রটির দিকে একদৃষ্টিতে
খানিক তাকিয়ে অগ্রদ্বীপ তার চেয়ারটির দিকে এগিয়ে গেল। অগ্রদ্বীপ তার বাবা ও মাকে
হারায় কলকাতায় বোমাবর্ষণের সময় খুব অল্প বয়সে। সে ছিল যুদ্ধের শেষের দিক। তখনও তার
দাদু সুধন্য এই পায়রাডাঙার আশ্চর্য আবিষ্কারটি করে উঠতে পারেননি। শুধু অগ্রদ্বীপের
মা বাবাই তো নয়। লাগাতার আটদিনের শেলিংএর পর কলকাতা ও তার শহরতলি জুড়ে প্রায়
আটহাজার লোকের মৃত্যু ঘটেছিল। অগ্রদ্বীপ ছুটি কাটাতে দাদুদিদার বাড়ি পায়রাডাঙা
এসেছিল। ঠিক যেন কোনও স্ক্রিপ্টেড উপন্যাসের মতোই। তারপর থেকে তার লেখাপড়া বড় হয়ে
ওঠা,
সবই তো সেই মামাবাড়িতেই। বাবার কাছে শোনা বুড়ো ঠাকুমা দাদুর
উদ্বাস্তু হবার কাহিনী আর মার হাতের মুগের জিলিপি ছাড়া তেমন কিছুই মনে নেই তার।
উল্টো দিকের
দেওয়ালে একটি প্রকাণ্ড মনিটর। এই মনিটরটি সৌরচালিত। সেখানে পিঁপড়ের তৈরি আঁকিবুকির
মতো অনেক গুলো রঙবেরঙের রেখা এদিক ওদিক আঁকা রয়েছে। সেখানে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা নিয়ে তৈরি সাউথ এশিয়া ফাউণ্ডেশনের
মুদ্রার দর প্রতি মুহূর্তে সিস্টেম বিশ্বর অন্য সভ্যতাগুলির সঙ্গে তুল্যমূল্য
বিচার করে দেখাছে। অগ্রদ্বীপ দেখল উত্তর আমেরিকা আর পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর ডলার
পাউণ্ড মূল্য সেখানে রীতিমতো ধুঁকছে। পায়রাডাঙার এই পারমানবিক কেন্দ্রের শেয়ার দর
বেশ ঊর্ধ্বমূখী। ভাবতে ভাবতেই ঘরে ঢুকে পড়ল সেবাস্তিয়ান। সেবাস্তিয়ানের আদিবাড়ি
মনট্রিলে। সেখান থেকে এশিয়া ফাউণ্ডেশনের বিশেষ উদ্যোগে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা ভারত
বাংলাদেশের মতো উন্নত দেশগুলিতে স্কলারশিপ নিয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ পায়।
সেবাস্তিয়ান যে বিষয়টি নিয়ে ট্রেনিং নিচ্ছে তার পোশাকি নাম 'জায়রোনমিক্স'। গতি
ঘূর্ণন আর তার প্রয়োগ নিয়ে তার গবেষণা। দুটো ছোট খাম হাতে সে স্পষ্ট বাংলায় বলল।
-স্যার। ওয়াশিঙটন আর নিউজিল্যান্ড থেকে দুটো চিঠি এসেছে।
মিস্টার বরিস বলেছেন, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব
রেস্পণ্ড করতে।
এই দেশে উচ্চশিক্ষা বা কাজ করতে হলে বাংলা ভাষা জানাটা বাধ্যতামূলক। আর তাতে
ক্ষতির আশঙ্কাও প্রায় নেইই। 'বাংলা' এখন ইংরাজিকে সরিয়ে পৃথিবীর একমাত্র ব্যবহৃত জনপ্রিয় ভাষা।
সেবাস্তিয়ানের কথায় অগ্রদ্বীপ ঘাড় নেড়ে শুধু বলল।
-ঠিক আছে। রেখে যাও। আমি দেখে নিচ্ছি।
বছর বাইশের সেবাস্তিয়ানকে চলে যেতে দেখে অগ্রদ্বীপ ভাবছিল। একসময় এই দেশ থেকে আমেরিকা পাড়ি দিত কতো নাছোড় মানুষ। খানিকটা বাড়তি সুখ আর নিরাপত্তার আশায়। আজ এই ২১৫৭ সালে সে ছবি যেন আমূল বদলে গেছে। ভারত এখন প্রথম বিশ্বর অন্যতম শক্তিধর দেশ। আর আমেরিকা তৃতীয় বিশ্ব। ভারতের প্রযুক্তিশিল্পে সেবাস্তিয়ানের মতোই অগুনতি বিদেশাগত অ্যাপ্রেনটিস কাজ করে চলেছে। আমেরিকায় কিছু বছর আগে এর বিরুদ্ধে শোচ্চার হয়েছিল একটি সংবাদপত্র। 'দ্য অ্যাপলিটিক্যাল'। অভিযোগের তির সুধন্য ফাউণ্ডেশনের দিকেও ছিল সেদিন। কিন্তু অগ্রদ্বীপ সেসবে বেশি পাত্তা দেয়নি। তার অফিসের আইনগত দিকগুলোর লেখভাল করে দেবলীনা গোমস। দেবলীনা একজন ঘোষিত তৃতীয় লিঙ্গর মানুষ। দেড়শো বছর আগে হলেও মানুষ এ নিয়ে গসিপ করত। কিন্তু এখন এইসব খোশগল্পর সুযোগ ফুরসত এদেশে কই? এখন শুধু কাজ আর কাজ। বর্ধিষ্ণু তকমা থেকে তার দেশ এখন 'বর্ধিত' তকমাধারী। চীন জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিও তাদের এই সংস্থায় গবেষণার কাজে যুক্ত হতে চায়।
চেয়ারে বসে টেবিলের ঘন্টা বাজিয়ে দেবলীনাকে ডেকে পাঠালো অগ্রদ্বীপ। তারপর ফাইলের পাতা নাড়তে নাড়তে বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে এল তার। পাশ্চাত্যের বিদেশিদের কি জিভে সলতে পাকানো আছে। তার নামের পদবিতে 'চট্টোপাধ্যায়' লিখতে গিয়ে লিখেছে 'চ্যাটার্জি'। ঠিক যেন এর আগে এই দেশে মনিব সাজার সময় জোর করে মেদিনীপুর হতো 'মিদনাপোর', বনগ্রাম বনে যেত 'বনগাঁও' আর রায়বাহাদুর হতেন 'রয়বহাদুর'। মনে মনে বিড়বিড় করল সে।'যতো সব অশিক্ষিতদের দল।' কিন্তু ফাইলের পাতা উল্টে তার এই ক্ষোভ খানিকটা স্তিমিত হল। একটি মানবিক আবেদন নিয়ে দুটি চিঠিই লেখা। সদ্য হাতেখড়ি প্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীর মতোই দুই দেশের প্রতিনিধি অগ্রদ্বীপকে চিঠি লিখেছে। দুটি চিঠির বিষয়বস্তুই এক। ভারত ও প্রথম বিশ্বর অন্যান্য উন্নত দেশের কাছে আমেরিকা আর নিউজিল্যান্ড সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছে। এর ভিতরে নিউজিল্যান্ডের চিঠিটি আংশিক পঠনযোগ্য হওয়ায় তার বয়ানটি তুলে ধরছি।
মাননীয়,
সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় অ্যাঞ্জেলার কারণে আমাদের বন্দর, বিমানব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। নাগরিকরা কর্মসংস্থানের অভাবে অন্য দেশে চলে যাবার কথা ভাবছেন। এমতাবস্থায় যদি ভারতের 'পায়রাডঙ্গা সুধন্য ফাউণ্ডেশন' কিছু জরুরি ত্রাণ বা অর্থনৈতিক সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে মানবতার জয় হবে।...
এইসব। চিঠি দুটি পড়ে অগ্রদ্বীপ ভাবতে লাগল। 'পায়রাদঙ্গা' লিখেছে সাহেবগুলো। নিজেদের গরিমা আর কিছু ধ্যানধারণা থেকে একচিলতে নড়বে না এরা। এতোদিন এটাই নিয়ম ছিল। এখন সে নিয়ম পালটেছে। পরিস্থিতি মানুষকে পরিবর্তিত হতে বাধ্য করে। এরাও গেল কয়েক বছরে বদলেছে। আরও বদলাবে। ভাবতে ভাবতে দেবলীনা ঢুকে এল ঘরে।
-আমেরিকা যাব। কাগজ তৈরি করো। একমাসের জন্য।
-আর এই চিঠির উত্তর?
-দিয়ে দাও দেবলীনা। বলো কাগজ তৈরি হলেই খুব শিগগির যাচ্ছি।
দেবলীনাকে ফাইলগুলো দিয়ে অগ্রদ্বীপ আবার তাকিয়ে রইল কাঁচের জানলার বাইরে। পরীক্ষামূলক গাড়িদুটি এখন বেশ শূন্যে ভেসে আসে। এই ডিজাইনটা 'সেফটি চেক' পাশ করে ফেললে আরেকটা মাইলফলক স্পর্শ করবে অগ্রদ্বীপ। কিন্তু সেইসব না ভেবে সে ভাবছিল আমেরিকা আর নিউজিল্যান্ডের আবেদনে কতোটা সাড়া দেবে তার ফাউণ্ডেশন! ভাবতে ভাবতেই উঁচু হাইরাইজের আড়ালে কুপার্সের একচিলতে সবুজ বিন্দুর দিকে চোখ চলে গেল তার। হাওয়ায় ভেসে আসছে কীর্তনের সুর। এই এত পরিবর্তনের ভিতরেও কিছু কিছু জিনিস এখনও অক্ষত রয়ে গেছে। এই সুর তাদের ভিতর একটি। দাদুর কাছে শুনেছে সে। গোপীনাথের কাছে মানত করেছিলেন তার বাবা সৌরভ আর মা শাশ্বতী। সেই কারণেই তার নাম সুধন্য রাখলেন অগ্রদ্বীপ। সন্ধ্যা বাড়লেই এই জনপদে অজস্র আলো জ্বলে ওঠে। এই আলো সকালে সঞ্চয় করা সৌরশক্তিচালিত। আকাশে লালনীল আলো জ্বেলে প্লেন ওঠা নামা করছে পায়রাডাঙা বিমানবন্দরের থেকে। আমেরিকা যাবার আগে একবার বিদিশার সঙ্গে কথা বলা দরকার। আমেরিকার নিরাপত্তাব্যবস্থা ভালো নয়। যখন তখন আগ্নেয়াস্ত্র হাতে জনগণ ঢুকে পড়ছে যেখানে সেখানে। কেমন যেন নৈরাজ্য-নৈরাজ্য ভাব। তার ভিতর আবার জর্জিয়ার কৃষ্ণাঙ্গরা আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। 'দ্য অ্যাপলিটিকাল'এ লেখা লাইনগুলোও ভাবাচ্ছিল তাকে। এই সব কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে বিদিশার জুড়ি নেই। দেবলীনা কাগজ তৈরি করতে করতে একবার অন্তত রাতে কথাটা বলে নেবে সে। সুর ভেসে এল।"ব্রজে এল গোপাল আমার। মথুরমোহন রূপ।" ভাবতে ভাবতে আটাত্তর তলা থেকে অগ্রদ্বীপ চ্যাটার্জি ক্রমশ মাটিতে নেমে এল।
।। পর্ব ২ ।।
গানহী বাওয়া
কৃষ্ণনগর টাউনের ঠিক যে এভি স্কুলের মোড়ে চিনের মিসাইল পড়েছিল, তার চারপাশের ভগ্নস্তুপের পাশে বিদিশার ক্লিনিকটা। বিদিশা মনোবিদ হলেও তার চিন্তাভাবনা আধুনিক নয়। আবার বস্তাপচা বললেও ভুল হয়ে যাবে। মন নিয়ে যেসব ধ্যানধারণা পাশ্চাত্য এক শতাব্দী আগে বিজ্ঞানের ওপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল, বিদিশা সেসব ভেঙে ফেলেছে। ভগ্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত কৃষ্ণনগরের বুকে বিদিশা পায়রাডাঙা শিল্পাঞ্চল আর 'সুধন্য ফাউণ্ডেশন' এর সহায়তায় তৈরি করেছে এক অভিনব গ্রিনহাউজ। সেখানে একপাশে আছে জিনল্যাব। কোনও ব্যক্তি বিদিশার কাছে চিকিৎসার জন্য এলে প্রথমেই সে তাকে ওই জিন ল্যাবের ভিতরে পাঠায়। জিনগত মিনচিত্র তৈরি হয়ে গেলে তারপর সে তাকে 'প্রমীলা' যন্ত্রে পাঠায়। প্রমীলা যন্ত্র তার নিজস্ব আবিষ্কার। এই যন্ত্র তাকে বিশ্ববিখ্যাত করেছে। অবশ্য ডিনামাইট আবিষ্কার কর্তার নামে পুরস্কার বা স্বীকৃতির ফাউণ্ডেশন এখন আর নেই। এখন বিশ্বে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় সম্মানের স্বীকৃতির নাম 'রামানুজন পদক'। বিদিশা দুই বছর আগে এই প্রমীলাযন্ত্রর জন্য সেই পুরস্কার পেয়েছে।
'প্রমীলাযন্ত্র' কী করে জেনে নেওয়া যাক। মানুষের জিনের ভিতর যে যে বিচ্চুতি বা অসঙ্গতির জন্য মানসিক রোগ, বিদিশার প্রমীলাযন্ত্র তা স্ক্যান করে বদলে সমতায় ফেলে দেয়। ফলে মুড়িমুড়কির মতো ওষুধ খাবার দিনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে অবশেষে। ধরে নেওয়া যাক প্রাগৈতিহাসিক একটি মনোরোগ। যার নাম স্কিৎজোফ্রেনিয়া। জিন ল্যাবে ধরা পড়ল সেই ব্যক্তির বাইশতম ক্রোমোজোমের একটি ছোট্ট অংশ নেই। বিদিশার প্রমীলাযন্ত্র অনায়াসে সেই বাদ যাওয়া অংশটি পূরণ করে ফেলবে। আর সেই মানুষটি রোগমুক্ত হবে। শুধু মনোরোগ কেন? কর্কটরোগ চিকিৎসাতেও এই যন্ত্র প্রয়োগ করছে বিদিশা। নামকরণটিও তার নিজের করা। বিদিশা তার বাবা মাকে দেখেনি কখনও। যুদ্ধপরবর্তী কলকাতার শিবিরে অন্যান্য সদ্যোজাতদের মতো সে বেড়ে উঠেছে। এই কারণেই বিদিশার নামের পরে কোনও পদবীও নেই। ক্যাম্পে একজন পাদরী সাধুবাবা ছিলেন। সবাই তাকে বলত 'গানহী বাওয়া'। কে জানে এর পিছনেও সতীনাথবাবুর কারসাজি আছে কিনা। গানহী বাওয়া তাদের মধুকবির মেঘনাদবধ কাব্য পড়ে শোনাতেন। সেখানে ইন্দ্রজিতের সহধর্মিণী প্রমীলা বিদিশার বিশেষ প্রিয় উঠেছিল। মধুসূদন লিখছেন,"ইন্দ্রজিতে জিতি তুমি, সতী, বেঁধেছ যে দৃঢ় বাঁধে, কে পারে খুলিতে সে বাঁধে।" প্রমীলার এই উর্যা বিদিশাকে প্রভাবিত করেছিল মেয়েবেলা থেকেই। তাই তার যন্ত্রর নাম হল প্রমীলার নামেই।
সকালে উঠে নিজস্ব ঘরে চায়ের
কাপে চুমুক দিতেই আবার মাথায় যন্ত্রণাটা ফিরে এল বিদিশার। যেন অজস্র বিষাক্ত সাপ
ফণা তুলে ছোবল মারছে তাকে। এই রোগ তার প্রমীলাযন্ত্রও সারাতে পারেনি এতোদিন। সে
জানে এর পর কী কী ঘটতে চলেছে। প্রথমেই তার দুই চোখ অন্ধকার হয়ে যাবে। তারপর
সেইখানে ভেসে উঠবে পরপর কয়েকটি দৃশ্য। আদিম সভ্যতা এদের 'প্রিমনিশন' বলত। কিছু বিদেশি
উন্নাসিক বিজ্ঞানী একে যুদ্ধপরবর্তী 'পোস্ট ওয়ার
সাইকোসিস'
বলে চালাতে চেয়েছিল। কিন্তু নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের
গণিতজ্ঞ জীববিদরা সেই তত্ত্ব হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের মতে এটা একটা দরজা। প্রাচীন
ইংরাজি ভাষায় যাকে বলা হয় 'পোর্টাল'। কোয়ান্টামজগতের অন্য কোনও সময় অক্ষ থেকে ভেসে আসা
সংকেত। বিদিশা মাথা দুইহাতে চেপে বসে পড়ল। পরপর দৃশ্যগুলো এগিয়ে আসছে তার দিকে।
প্রথমে সে দেখল স্ট্যাচু অফ লিবার্টি ধ্বসে পড়ছে। তার পরপর সাংহাই স্কোয়ার কেঁপে
উঠছে বিস্ফোরণে। একটা ছোট্ট বাচ্চাদের খেলার মাঠ। দূরে ভিক্টোরিয়ার পরি। হঠাৎ এক
অসহনীয় আলো। তারপর সব শেষ। একা সে একটা অন্ধকার ঘরে। তির রাতে ঘুম আসছে না। তারপর
একটা বাতি জ্বলা ঘর। বিপবিপ শব্দ চারিদিকে। একটা মুখোশপরা মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে তার
দিকে। এই লোকটা তার চেনা। আর তারপর একটা চেনা মুখ। অগ্রদ্বীপ। তারপর আবার অন্ধকার।
-ম্যাডাম। ম্যাডাম।
মদনের ডাকে সম্বিত ফিরে পেল
বিদিশা।
-কী হয়েছে?
-আর ইউ ওকে?
এমনিতেই এইসব দৃশ্য চোখের সামনে
এলে খানিকক্ষণ মাথার ভিতরটা দপদপ করতে থাকে তার। তার ওপর এই মদন ছেলেটাকে সে সহ্য
করতে পারে না।
-আবার ওপরচালাক হবার
চেষ্টা করছ মদন? বলেছি না সকাল সকাল আমার সঙ্গে
ইংরাজিতে কথা বলবে না? আমার দিনটা খারাপ
যায়।
মদন মাথা নিচু করে সলজ্জ মাথা
চুলকাতে থাকে।
-না। আসলে কাল রাতে
রোজিনার কাছে ওর অভিজ্ঞতার কথাগুলো শুনতে শুনতে...
-বুঝেছি। কী বলবে
বলো।
-সুধন্য ফাউণ্ডেশনের
কর্ণধার অগ্রদ্বীপ চ্যাটার্জি এসেছে আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আগে থেকে
অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেননি। তাই।
-পাঠিয়ে দাও। আর এই
নিয়ে কতো নম্বর?
-না মানে...
-বলছি। রোজিনা কতো
নম্বর?
-ইয়ে। গুনিনি তো
ম্যাডাম।
-ঠিক আছে। বিদায় হও।
উদুখল যতো সব।
মদন ছেলেটা এশিয়ার প্রথম বিশ্ব হবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মতো বেড়ে ওঠা একটি অপভ্রংশ। ইদানিং এদেশে একটা নতুন প্রবণতা এসেছে। উন্নততর জীবনযাত্রার লোভে ইউরোপ আমেরিকার মতো তৃতীয় বিশ্বর দরিদ্র নারীপুরুষ এই দেশের 'গোলাপী কার্ড'এর লোভে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হচ্ছে। মদন আগরওয়াল তেমনই এক সুবিধাভোগী কামুক পুরুষ। বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই। এদেশের নাগরিকত্ব পাইয়ে দেবার লোভ দেখিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু হাঁটুর বয়সি মেয়েদির সঙ্গে বিছানায় উঠেছে। মাঝেমাঝে বিদিশার মনে হয় মদনকে প্রমিলাযন্ত্রে পুরে ওর একটা ল্যাজ বানিয়ে দেয়। পরে ভাবে। লাভ নেই। পৃথিবী বদলে গেলেও আরশোলার মতো মদন আগরওয়ালরা থেকে যাবেই। ওদের বিনাশ নেই। উপেক্ষা করাই শ্রেয়।
মদন চলে যেতেই বিদিশা তার ল্যাপটপ খুলে 'ত্রিনেত্র যন্ত্র' দেখতে লাগল। আগে এর নাম ছিল 'সিসিটিভি ফুটেজ'। নাহ। কোনও অনধিকার প্রবেশ ঘটেনি কোথাও। দৃশ্যে
দেখা আলো ঘেরা বিপবিপ শব্দ করা অন্ধকার ঘরটিকে সে চেনে। দু একবার সে সেখানে
গিয়েছিল। আজ পর্যন্ত যা যা সে এইভাবে সংকেত হিসেবে দেখতে পেয়েছে, তা বাস্তবে ঘটেছে। আজকের এই ঘটনা বাস্তবে ঘটলে এই সংকেত
হাল্কাভাবে নেওয়া যাবে না কিছুতেই। ভাবতে ভাবতেই অগ্রদ্বীপ ঢুকে এল তার ঘরে। মুখে
ম্লান হাসি। বিদিশা এই দৃশ্যটাও দেখেছে তার ঘোরের ভিতর।
-কী খবর। হঠাৎ?
-এমনিই। একটা হঠাৎ
প্রয়োজন।
-সেই। প্রয়োজন ছাড়া
কবে এসেছ আমার কাছে। বলো।
অগ্রদ্বীপ খানিকটা ইতস্তত
করছিল। বিদিশার সঙ্গে তার সম্পর্কটা ভেঙে গেছে বছর দুয়েক। কারণ তেমন নেই।
কর্মব্যস্ততা। আধুনিকতার খেসারত দিয়ে অগ্রদ্বীপ আর বিদিশারা আসলে ব্যাক্তিসত্তার
বাইরে বেরিয়ে এক বৃহত্তর কর্মযজ্ঞে নিজেদের সঁপে দিয়েছে। তবু অগ্রদ্বীপ দেখল তার
মনের ভিতর পারমানবিক চুল্লির মতোই কোনও অনুভূতি কেঁপে চলেছে। বিদিশা মন পড়তে জানে।
অগ্রদ্বীপ সে প্রমাণ আগেও পেয়েছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়ার ফলে
কিছু মানুষের মস্তিষ্কের অগ্রভাগ, যাকে গোদা ভাষায়
জীববিদরা প্রিফ্রন্টাল করটেক্স বলে থাকেন, তা রীতিমতো পরিবর্তিত হয়ে এই সম্ভাবনা তৈরি করতে পেরেছে। অগ্রদ্বীপের অনুমান
সঠিক প্রমাণ করে বিদিশা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,"আরে ঠিক আছে নাগর আমার। বলে ফেল এই রাধিকা কী করিতে পারে?"
-একটা সিদ্ধান্ত।
-এশিয়ার 'সুধন্য ফাউণ্ডেশনের' কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছে আমেরিকা। তাই তো?
-ঠিক। কী করে বলো তো
বিদিশা?
-আপাতত এখানে বসো আর
আমার বানানো চা খাও।
চা টেবিল বিদিশার চেম্বারের এক
কোণায়। বানানোর বিশেষ কিছু নেই। একটা বোতাম টিপলেই পছন্দের পানীয় বেরিয়ে আসবে।
কাপে চা ভরতে ভরতে বিদিশার মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল। এটাও তার একটা আশ্চর্য
শক্তি। অগ্রদ্বীপকে আসতে দেখেই সে একঝলকে জেনে গেল আমেরিকার মানবাধিকারধর্মী চিঠিগুলোর
কথা। এই কৌশল তাকে প্রথম শেখান সেই পাদ্রী গুরুদেব গানহী বাওয়া। ধ্যান আর রাজযোগ
দিয়ে নিজের ভিতর অবচেতনে এক ত্বুরীয় অবস্থান তৈরি করা। বিদিশা সেটা আয়ত্ব করেছে।
খানিকটা প্রয়োগও করেছে নিজের রোগীদের উপর। গোঁয়ার ইউরোপের চিকিৎসকরা এখনও তাকে 'মাইণ্ডফুলনেস সাইকোথেরাপি' বলে। কিন্তু বিদিশা তার গবেষণাপত্রে এই যোগের নাম দিয়েছে 'পরমহংসযোগ'।
-তুমি যাচ্ছো
অগ্রদ্বীপ। তোমাকে ও দেশে যেতে হবে।
অগ্রদ্বীপ চায়ে চুমুক দেয়।
বিদিশার সঙ্গে বিচ্ছেদের পরেও একধরনের নাড়ির বন্ধন যেন রয়ে গেছে আজও। কতো সহজে বলে
দিল তাকে মেয়েটা। এই জন্যই তো আসা। কিন্তু মন বলছে তারও। বিদিশা ভাবছে কিছু একটা।
একটা দুশ্চিন্তা। সে তো পরমহংসযোগী নয়। হলে হয়তো সেই চিন্তার কম্পাঙ্ক ধরে ফেলতে
পারত।
-চলো। তোমাকে একটা
জিনিস দেখাই।
বিদিশা অগ্রদ্বীপের হাত ধরে
উভযানের দিকে নিয়ে গেল। এই 'উভযান'কে ইংরাজিভাষীরা প্রাকযুদ্ধের দিনে 'এলিভেটর' বলে চিনিয়েছিল।
উভযান দ্রুত গতিতে বিদিশার জিনল্যাব ভেদ করে পাতালের ভিতর নিয়ে চলল। পাতালের
ম্যান্টেলের পূর্বস্তরে একটা তাপহীন গবেষণাকক্ষের সামনে উভযান থেমে গেল।
গবেষণাগারটি একটি গ্রিনহাউজের মতো। বিদিশা অগ্রদ্বীপের দিকে তাকিয়ে বলল,'এসো'।
ভূগর্ভস্থ অন্ধকারে কৃত্রিম
পদ্ধতিতে সূর্য্যর আলো তৈরি করা হয়েছে কক্ষর ভিতর। সেই আলো দেখলে মনে হবে যেন পুরো
ঘর জুড়ে একচিলতে রোদ। ঘরের ভিতর টেবিলে সারবদ্ধ কাঁচের বয়ামের ভিতর মাটিতে বেড়ে
উঠছে নানান প্রজাতির গাছ। অগ্রদ্বীপ বিদিশার হাতের লেখা চেনে। কয়েকটি গাছের নাম
বিদিশা নিজে হাতে লিখেছে। কী নেই সেখানে! তেলেকোরা, নোয়ালতা, ফণিমনসা, গিরিফল। বিদিশা তাদের স্পর্শ করে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, অগ্রদ্বীপের মনে হল এই গাছগুলি কেউ আসলে গাছ নয়। বিদিশার
সন্তান।
-মাটির নীচে কেন
বিদিশা?
বিদিশা রহস্যময়ী চোখে
অগ্রদ্বীপের দিকে তাকিয়ে বলল,"মাটির ওপরের
পৃথিবীকে যে আমি বিশ্বাস করি না। সে যে শুধুই কেড়ে নিতে জানে!"
অগ্রদ্বীপ এর প্রত্যুত্তর দিতে
পারল না।তার কাছে এর কোনও উত্তর নেই। সে জানে বিদিশা কী বলছে। দুই বছর আগে ওই
মাটির উপরের পৃথিবীর প্রত্যাশা তাদের বিচ্ছিন্ন করেছে।
-তা ছাড়া এখানে অনেক
গাছ আছে যারা খুব স্পর্শকাতর। বাইরে বিশ্বযুদ্ধের পর আকাশেবাতাসে যে তেজস্ক্রিয়
বিকিরণ রয়ে গেছে, তা অশোক, পলাশ বা মাধবীলতা র চারা সহ্য করতে পারত না। আমরা অবশ্য সেই
বিষ বহন করছি শরীরে। সেটাই আমাদির নিয়তি। বিষ বহন করার অভ্যাস আমাদের হয়ে গেছে কী
বলো?
বিদিশা বলে চলে।
-এখানে যে গাছগুলো
দেখছ অগ্রদ্বীপ তাদের অনেকেই পৃথিবীর শেষ সদস্য। এক একটি নিশ্চিহ্ন প্রজাতি। আমি
তাই অতিরিক্ত সাবধানী হয়েছি।
প্রকাণ্ড ল্যাবের এপ্রান্ত থেকে
ওপ্রান্তে দ্রুত যাবার জন্য একটি চলযান রয়েছে। সেই চলযানের মৃদুমন্দ্র গতিতে চলতে
চলতে অগ্রদ্বীপ দেখছিল পৃথিবীর শেষ মেহগিনি, বার্জ, আকাশমণি তাকে ম্লান হেসে অভিবাদন
জানাচ্ছে। যুদ্ধে তাদের প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হলেও বিদিশা তাদের এভাবে মরিয়া রক্ষা
করে চলেছে।
-এই।
পিঠে স্পর্শ পেতেই অগ্রদ্বীপ
চলযান থামিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ল। বিদিশা সেই আগের মতো স্নিগ্ধ হেসে একটি অপূর্ব ফুল
তুলে দিল অগ্রদ্বীপের হাতে।
-এটা নার্গিস ফুল
অগ্রদ্বীপ। ঢাকা থেকে আনা। আজ ওই গাছের চারায় দুটি ফুল ছিল। একটি তোমাকে দিলাম।
-কিন্তু এই ফুল তো
স্থায়ী হবে না বেশিক্ষণ।
-এক সপ্তাহ এমনই
তরতাজা থাকবে। আমি আমার জৈব তরল স্প্রে করে দিয়েছি। ততক্ষণে তুমি অ্যাঞ্জেলা
বিধ্বস্ত আমেরিকায় পৌছে গেছ।
-যাবোই তাহলে? তুমি বলছ বিদিশা?
-হ্যাঁ। তোমার যাওয়া
দরকার। মানবতা ছাড়াও আরেকটা কারণ আছে। শুধু তোমাকেই বলতে পারি।
-কী?
-আমি আবার কয়েকটি
দৃশ্য দেখছি অগ্রদ্বীপ। বাওয়ার কাছ থেকে শেখা পরমহংসযোগ আমাকে এই অভিশপ্ত শক্তি
দিয়েছে অগ্রদ্বীপ।
-সেই কারণেই তোমার
চোখেমুখে চিন্তার ছাপ বিদিশা। কোন দৃশ্য। আমাকে বলো।
-মিনারের ঘর। কেউ
একটি সেখানে ঢুকতে চাইছে। লণ্ডভণ্ড করে দিতে চাইছে। আবার নৈরাজ্য। আবার একটা
অন্ধকার।
-মিনারের ঘর! সে তো
সুরক্ষিত। কে ঢুকবে সেখানে?
-জানি না। তাকে
চিনতে পারিনি। তবে আমার মন বলছে এর সূত্র খুঁজে পেতে হলে তোমার ওই নিউ ইয়র্ক
যাওয়াটা খুব জরুরি।
অগ্রদ্বীপ বিদিশার কথা বিশ্বাস
করে নিজের থেকেও বেশি। নিউ ইয়র্কের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ভালো নয়। দারিদ্র আর
খাদ্যাভাবে মানুষ রাস্তায় নেমেছে। পাড়ায় পাড়ায় নৈরাজ্য। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে
বিদিশার কথা মতো আরজান মিনারের যদি কোনও বিপদ হয়, তাহলে আবার এই বিপন্ন মানবসভ্যতার ভারসাম্য টলে যেতে পারে।
-তোমার কিছু হবে না
অগ্রদ্বীপ। আমি আছি তো। যে কাজে তুমি যাচ্ছ সেই কাজ একমাত্র তুমিই সম্পন্ন করতে
পারবে। আমি পারলে তোমাকে যেতে দিতাম না। বুঝলে বুদ্ধুরাম।
বিদিশাকে আলিঙ্গনের মুহূর্তে
অগ্রদ্বীপ বুঝতে পারল কোনও কিছুই যেন বদল হয়নি। পৃথিবীর শেষ বিন্দু জলকণার মতোই এই
পৃথিবীর বুকে বিদিশার এই নিবিড় চুম্বনমুহূর্তটুকু অবিনস্বর ভাস্বর শাশ্বত থেকে
যাবে। (ক্রমশ। পরের পর্ব ৯ এপ্রিল)
।। পর্ব ৩ ।।
পাখিপাহাড়ে আরজান মিনার |
বাদুড় বাদুড় পিত্তি
পাখিপাহাড়ের ঠিক নিচে বংশি ঝুনঝুনওয়ালার অফিস। খাতায় কলমে সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটে অবধি খোলা। কিন্তু অফিস বলে আদতে যা বোঝায়, এ তেমন অফিস নয়। আদতে একটি দোতলা বাড়ির একতলায় পাথর বসিয়ে লোহার গেট লাগিয়ে গনৎকারের অফিস করেছিল বংশি। বিশ্বযুদ্ধের গোলাগুলি এই অঞ্চলে তেমন না হওয়ায় আরও অনেক ছোট ঘরবাড়ির মতো বংশির অফিসটিও অক্ষত থেকে গেছে। অক্ষত থাকলেও তার ব্যবসার অবস্থা নেহাত ভালো নয়। যুদ্ধের আগে বংশির তৎকালীন রাজধানী নয়াদিল্লিতে বেশ নামডাক ছিল। তার গণনার বেশ কয়েকটা তুক্কা লেগেও গিয়েছিল। সে এক দিন ছিল বটে। টিভি খুললেই বংশির ছবি। বাইট দিচ্ছে। মোড়ে মোড়ে বংশির এজেন্ট। আজ আমেদাবাদ তো কাল তেলেঙ্গানা। কিন্তু বিধি বাম কে জানতো! যুদ্ধ সব ওলটপালট করে দিল। প্রথম প্রথম অবশ্য সে হাল ছাড়েনি। যুদ্ধের পর বিশ্বের সমস্ত শক্তিই যে ইংল্যাণ্ডের বাকিমহাম রাজবাড়ির হাতে পুনঃস্থাপিত হতে চলেছে একথা বলে সে সামান্য মাইলেজও পেয়েছিল। সেই মাইলেজই কাল হল। বংশি ঝোঁকের বশে বলে বসল এই ইয়ুরোপের সাদা চামড়ার জিন আসলে আদিপুরুষ শ্রীরামচন্দ্রর ইক্ষাকুবংশর জিন। সেই ফুটেজ দেখে রাতারাতি কিছু বিদেশী সংস্থা তাকে বিলিতি দাড়িকামানো ফোমের ব্র্যাণ্ড অ্যামবাসাডারও করে দিয়েছিল। সব ঠিক চলছিল। সবেতে বেমালুম ঘোল ঢেলে দিল পায়রাডাঙার ইণ্ডিয়াম ১১৬ খনি আবিষ্কার। নিজের মাথায় নিজে অনেকবার চাঁটি মেরেছিল সে সেইদিন। এতো জায়গা থাকতে পায়রাডাঙা! গুরগাঁও, গান্ধীনগর, নিদেনপক্ষে কাশ্মীর বা চিত্রকূট হলেও একটা বাত ছিল। সেখানে একটা বানর অসুর পরশুরাম বিশ্বামিত্র ভজে কাহিনী বানিয়ে খাওয়ানো যেত লোককে। কিন্তু ইয়ে কৌনসা গাঁও হ্যায় ভাই! পায়রাডাঙা। কোনও মানে হয়? কিন্তু পেট আর ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, কোনওটাই তিথি নক্ষত্র মানতে চায় না। ফলে বংশি ঝুনঝুনওয়ালাকে চলে আসতে হলো পুরুলিয়ার পাখিপাহাড়ে। যুদ্ধের পর দেশের বুকে যে বৈপ্লবিক প্রযুক্তিঝড় উঠেছে, তার নাগাল সে কিছুতেই পায় না। পাবে কী করে? তার পেটে তো মোটে ক্লাস ফোরের বিদ্যে। কিন্তু শ্রীরামজীর কৃপায় বুদ্ধি তার আছে। এই পাখিপাহাড়ের চূড়ায় আছে আরজান মিনার। এশিয়া মহাদেশের নিরাপত্তা ও শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু এই আরজান মিনার। যেখানেই শক্তি, সেখানেই ভয়। আর যেখানেই ভয়, সেখানেই ভক্তি। তাই বংশি আর দেরী করেনি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটুতে যন্ত্রণা বেড়ে চলেছে তার। আর দৌড়ঝাঁপ পোষায় না। তাছাড়া আগের মতো ধর্মেকর্মে তেমন বিশ্বাস নেই মানুষের। যুদ্ধের পর কতো মানুষের গণনা করতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছে সে। দরাম করে প্রশ্ন করে বসেছে কেউকেউ। "চোখের সামনে বাচ্চাদের কিণ্ডারগার্ডেন স্কুলটা বোমার ধোঁয়ায় পুড়ে ছাই হয়ে গেল। একটা শিশু জীবনের শেষ চিৎকারটা করবার সুযোগও পেল না। কোথায় ছিলেন তখন আপনার যুগপুরুষ? আপনার পীর পয়গম্বর?"
সেইসব মানুষের চোখে
জল দেখেছে বংশি। তাদের প্রশ্নর উত্তর ছিল না তার কাছে। আজও নেই। ওদের কারো মেয়ে,
কারো ছেলে, কারো নাতিনাতনি ওই কলকাতার স্কুলে
প্রথম পিরামিড আর কিউব খেলতে গিয়েছিল। শত্রুদেশের মিসাইল রেয়াত করেনি তাদের। একে
কয় কলিযুগ। কিসিকা নেহি শুনতা। হা সিয়ারাম। তাই রক্ষণশীল হয়ে গেছে সে। জমানো পুঁজি
নিয়ে আপাতত দোতলার ঘর। নিচে অফিস, উপরে ঘর। পরিবার তার নেই।
পাত্রীর অভাব ছিল না কমবয়সে। কিন্তু জন্মকুণ্ডলী মিলল না কিছুতেই। অফিসের নটা ছটা 'ফ্লেক্সিবল'।" মা লছমি কভি ভি আ সকতা
হয়।"মনকে বুঝিয়েছে সে। চব্বিশ ঘন্টার সার্ভিস। অসময়ে কোনও ব্যক্তি তার কাছে
এলে শুধু দরজার পাশে থাকা লালরঙের বোতামটা টিপে দিতে হবে। ব্যাস। ঘরে লাগানো
ডিজিট্যাল পর্দায় ফুটে উঠবে তার ছবি। বিশ্বাসযোগ্য লোক হলে খুলে যাবে দরজা। নীচে
বসানো হবে। ভোর সাড়ে চারটের সময় ঠিক তেমনই একটা ছবি ফুটে উঠল বংশির ঘরে। নাহ। এ তো
চেনা খরিদ্দার। ভক্ত আদমি। কিন্তু এতো ভোরবেলা! সে হোক। বাজার খারাপ। বংশি দরজা
খুলে দিল।
শশধর ঘোষ বরাবরই প্রতিটি বিষয় নিয়ে খুবই
খুঁতখুঁতে। নেহাত জরুরি কোনও কারণ না থাকলে সে দৈনিক শ্যিডিউল ভাঙে না। এই প্রথা
চলে আসছে সেই বন্দরের চাকরি জীবন থেকে। কলকাতা বন্দরে তার একসময় বিরাট দাপট ছিল।
মাফিয়া পুলিশ এক ঘাটে জল খেত। প্রতি চালানে দামী বিদেশী চুরুট বা সিঙ্গল মল্ট
বাঁধা থাকত তার। চাকরির পোশাকী নাম 'পোর্ট
সুপারভাইজার'। ছেলেটা তখন বাঙ্গালোরে পড়ছে। টাকার তো অভাব
ছিল না। শহরে দু দুটো আড়াইশো স্কোয়ার ফিট ফ্ল্যাট। ইন্টিরিয়ার করা। বন্দরে মানুষ
থেকে ইঁদুর, বেমালুম চালান হতে দেখেছে শশধর ঘোষ। অবশ্য
মানুষপাচারের কাটমানিটা সে তেমন ধারাবাহিকভাবে কখনোই খায়নি। একটিবার ছাড়া। সেইবার
কী যে হল। মেয়েটার অমন ডাগর চোখ। মণিপুর থেকে চালান হচ্ছে। সাবির আপত্তি করল না।
দুঘন্টার তো ব্যাপার। ব্যাস। ওই একবারই। কথায় আছে কুকর্মের ফল মৃত্যুর পরেও পিছু
ছাড়ে না। শশধরের ওই এক কুকর্ম তার ভিতরে ভয়ানক পশ্চাতাপের মতোই ঢুকিয়ে দিল ভয়।
স্কুলজীবনের বন্ধু শৌনক। তখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র। এখন যুদ্ধের পর কোথায় ছিটকে
গেছে কে জানে। কিন্তু সেদিন তাকে সেই ঘটনার কথা বলতে সে রেরে করে বলেছিল।
-করেছিস কী? প্রোটেকশন নিলি না?ভাইরাস ঢুকে গেলে?
ভাইরাসের একটা 'উইণ্ডো পিরিয়ড' থাকে। এক্কেবারে জানলার
মতো। ওইসময় কোনও লক্ষণ দেখেই বোঝবার উপায় নেই যে তিনি রোগীর শরীরে সেঁধিয়ে বসে
আছেন। দশ বছর তখন অনেক বড় সময় লেগেছিল শশধরের। কিন্তু যুদ্ধ ঘটে গেল। চাকরি গেল। ঘর
ভাঙা পড়ল। কলকাতা শহর ধ্বংস হলে বেঁচে থাকা সামান্য পুঁজি আর ছেলে বৌ নিয়ে শশধর
চলে এসেছিল পাখিপাহাড়ের নীচে। গেল কূড়ি পঁচিশ বছর তার শরীরের অজস্র জানলা দিয়ে কতো
অগণ্য কীট জীবানু নিষ্ক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু সেই ভয় তার এখনও কাটেনি। স্ত্রীর
চিকিৎসা চলছে পায়রাডাঙায়। দেশ বদলে গেছে আমূল। সবরকম শ্রমজীবি মানুষের বেতন
এক। খাওয়াদাওয়া শিক্ষাদীক্ষার খরচ
রাষ্ট্রের। ছেলেটা ছৌমুখোশ বানাচ্ছে পাশেই চরিদায়। আর শশধর তার ভিতর সেঁধিয়ে থাকা
ভয়টাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে পারছে না কিছুতেই। কী হারামিপনা করে গেল মাইরি শৌনকটা।
সেই ভয়ের দোসর নিয়েই শশধরের এখনকার জীবিকা আরজান মিনারের সদর গেট সামলানো। কিন্তু
এইমুহূর্তে তার চিন্তা আরজান মিনার নিয়ে নয়। অন্যকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে তার মনের ভিতর
কাল রাত থেকে।
দরজা খুলে যেতেই শশধর
নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে সন্দেহের চোখে চেয়ারগুলো পর্যবেক্ষণ করে নিল। ইতিমধ্যেই চৈনিক
সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে। সেও সলীল সমাধি হতে চায় না। এই সময়ে তার দাদুর দাদু বেঁচে
থাকলে কী বলত সে জানে। "ওরে ভয়ই তো মধ্যভিত্ত বাঙালির সব। সেই উদ্বাস্তু হওয়া
থেকেই ওই অনিশ্চয়তা আর ভয়কে আঁকড়ে ধরেই আমরা বেঁচে আছি।" কোনও মতে খান
সাতেকবার 'হরেকৃষ্ণ' আউড়ে
একটি কোনার সিটে বসল সে। আপাতত অপেক্ষা। ছৈলেটার বিয়ে হয়েছে গত মাসে। তখন বুঝতে
পারেনি। গরীব গুর্বো মেয়ে। দেখতে সুন্দরী। যুদ্ধোত্তর দেশে অনুষ্ঠানের তেমন চল
নেই। অবশ্য চল থাকলেও শশধরের মতো হাড়কিপটের 'ওয়ান পাইস ফাদার
মাদার'। মাঝেমাঝে নিজের অজান্তেই একটু ইংরাজি চলে আসে তার।
অবশ্য এসব প্রবৃত্তি সে মনের ভিতরেই রাখে। কীসব নৈরাজ্য চলছে চারপাশে। ইংরাজি
বললেই লোকে এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন কোনও অশিক্ষিত কথা বলছে। এই দেশ নাকি সারা
পৃথিবীর প্রাণকেন্দ্র। আর তার প্রাণকেন্দ্র ওই মিনার! আরে ছোঃ। তা কখনও হয়।
সাহেবদের গল্প বুড়ো খুড়ির কাছে শুনেছে সে ছোটোবেলায়। খুড়ি সে গল্প শুনেছিল তার
খুড়ির কাছে। সে খুড়ি শুনেছে তার খুড়ির কাছে। গল্পটা হল কী করে পরাধীন দেশে সাহেবরা
বেত মারত নেটিভদের। বেত জুতো মেরে কীভাবে আধখাওয়া চুরুট ফেলে যেত মারখাওয়া লোকটার
জন্য। আহা। দয়ার শরীর। ও চুরুটে টান দিয়ে নেটিভ ভুলে যেত বেত খাবার যন্ত্রণা। বড়
বুড়ি খুড়ির থেকে বুড়ি খুড়ি হয়ে সেই চুরুটের ধোঁয়ার তৃপ্তি সে দেখেছিল খুড়ির চোখে।
আহা। বন্দরে একবারও কোনও সাহেব দেখেনি সে। এমন পোড়া কপাল। আর এখন সেই সাহেবগুলো
বাঁধের নিচে চায়ের দোকান দিয়েছে। তাদের একজন খুব ভালো পিঁয়াজি ভাজে। ভেজে শালপাতায়
তুলে দিতেদিতে বলে,"এইডা আপনার জন্য আলাদা করিয়া
বানিয়েছি।" কী অবক্ষয় ! ভাবা যায়। দেবতূল্য মানুষগুলো এইভাবে এই অধঃপতন। ছিঃ।
-নমস্তে শশধরবাবু। কী
হলো আবার?
গেরুয়া চাদর আর কপালে গাঢ়
সিঁদুর লেপে বংশি ঝুনঝুনওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।
-নমস্তে। খুব বিপদ
ঝুনঝুনজি।
-বলিয়ে না।
শশধর বংশিকে বিশ্বাস করে। লোকটা
সত্যিই হাত দেখতে জানে। নাহলে যখন তার অমন অবস্থা, জোকার বিলাশবহুল আবাসন আর রাজারহাটের কমপ্লেক্স মিসাইলের আঘাতে ধুলোয় মিশে
গেছে, তখন পাখিপাহাড়ের নীচে বসে কেমন তাকে বলে দিয়েছিল ,'চিন্তা মত কিজিয়ে। আপকো নৌকরি মিল যায়ে গা। আপকে লড়কা কো ভি। 'জয় সিয়ারাম জয় মাকালী বলে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে শশধর বলে চলে।
-আপনার কথা মতো বিয়ে
তো দিলাম ছেলেটার। বহু ভী একদম যাকে বলে মালক্ষ্মী। কিন্তু ...
-কিন্তু কী শশধরবাবু?
-কাল রাতে হঠাৎ
দেখলাম। বৌমার বাম পায়ে কালো তিল। আমি আপনার ব্লগে দেখেছিলাম। মেয়েদের বাম পায়ে
তিল থাকা ভালো নয়। বারমুখো হয়। কী করি।
-বোলেন কি।
চটপট ভেবে নিল বংশি। ব্যাপারটা
জটিল। এই অঞ্চলে 'বিজ্ঞান সচেতন মঞ্চ'
বেশ তৎপর। এইসব বুজরুকি পাঁচকান হলে সোজা হাজত। এই বয়সে হাজতে যাবার
ইচ্ছা তার নেই। কিন্তু পকেটে কানাকড়ি নেই। যুদ্ধের আগের মতো ইলেকট্রিক বিলের
ঝঞ্ঝাট আপাতত নেই। সে সমস্ত কাজ সৌর আলোতেই সারা হয়ে যায়। কিন্তু পেট? সূর্যের আলো দিয়ে পেটের ক্ষিধে মেটানোর পদ্ধতিটা এখনও বের করতে পারেনি
ভারতের বিজ্ঞানীরা। যদিও অদূর ভ্যবিষ্যতে বোধহয় সেটাও বের হয়ে যাবে। সে যাই হোক।
আপাতত খরিদ্দার হাতছাড়া করা যাবে না।
-আপনার কথা আমি বুঝি
শশধরবাবু। জটিল সমস্যা। কিন্তু শিউজির কৃপায় ওর একটা হাল আমার জানা আছে।
শশধর খুব উৎসাহী হয়ে বলেন,"বলুন ঝুনঝুনজি। আমার একটাই ছেলে। ওর সামনে এইসব বললে কথা
বলা বন্ধ করে দেবে। কী জেনারেশন মাইরি। নারীপুরুষে ভেদ জানে না। যুদ্ধ আমাদের
সভ্যতা সংস্কৃতি সব কেড়ে নিল।"
বংশি গলা নামিয়ে বলল,"লেকিন কিসীকো বতানা মত।"
শশধর ঢকঢক ঘাড় নাড়ল। সে কারোকে
বলবে না। জমি তৈরি দেখে এইবার বংশি তার দানা ছড়াতে শুরু করে মাটিতে।
-এই স্থান খুব
পূণ্যস্থান আছে। এখানে সবার সব মাঙ্গলিক চিহ্ন শোধন হয়ে যাবে। ওই যে পাহাড়,
ওর চুড়োয় সীতামাইয়া তার পায়ের নূপুর ফেক গে গয়া থা অপহরণের সময়।
ঝুনঝুনওয়ালার দোতলা ভাড়ির একতলা
বসার ঘরের উত্তর দিকের কাঁচের জানলা দিয়ে পাখিপাহাড় আর আরজান মিনার দেখা যাচ্ছে
আবছায়া। শশধর মাথা চুলকায়। নয় নয় করে বছর দুয়েক হয়ে গেল সে মেইনগেটে আছে। কাজ
বিশেষ নেই। মিনারের সচরাচর কেউ যায় আসে না। তাছাড়া তাদের পোস্টের পর বাকি
চেকপোস্টগুলো সব যন্ত্রচালিত। ওই মিনারে নাকি একটা গিগাটন রোবট আছে যার কৃত্রিম
বুদ্ধি দিয়ে দেশের সমস্ত শাসনব্যবস্থার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। মিনারের উপরের
রাডার থেকে সংকেতের মাধ্যমেই জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেয় ওই রোবট। আলাদা
করে কারো যেতে আসতে হয় না। সে নিজেও কখনও যায়নি সেখানে। এই মিনার যে সীতামাইয়ার
হরণকাহিনীর সঙ্গে এতো ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, এটা
তারও জানা ছিল না। তবে এই রামায়ণকথার এক অদ্ভুত শক্তি আছে। যতই মনে সংশয় উঁকি দেয়, 'ধুর শালা। মালটা ঢপ মারছে' তখনই কোথা থেকে ভক্তি
চেপে বসে জটায়ুর ডানার মতো। ঝুনঝুনওয়ালার ধর্মভীরু বাঙালিদের এই দুর্বলতা জানত।
তাই মাছ টোপ গিলছে দেখে সে আরও বলে চলে।
-এই যে পাখিপাহাড়
দেখছেন না শশধরবাবু। এর নীচে আছে কিষ্কিন্ধানরেশ বালীর রাজবাড়ি। ওই মিনারের নীচে
খুঁড়লে বের হবে বিরাট শিউমন্দির।
শশধরের শরীরে আর কোনও ভয় নেই।
আহা। যুদ্ধের আগে একবার কেদারনাথ গিয়েছিল
সে। সপরিবারে। এই পাখিপাহাড়ের নীচে শিবলিঙ্গ। ভাবা যায়! ঘি সম্পূর্ণ গলেষগেছে বুঝতে পেরে
এইবার ঝুনঝুনওয়ালা বলে।
-শিউজি কীসে তুষ্ট হন
আপনি জানেন?
-কীসে?
ঝুনঝুনওয়ালা বিজ্ঞের মতো হাসে।
-ওই পায়রাডাঙার 'এশিয়াটিক সুধন্য ফাউণ্ডেশন' ভ্যবিষ্যর কী বুঝবে?
ভাগ্যরেখার কী বুঝবে? লক্ষ্মণ অলক্ষ্মণ সব
মহামন্ত্রে আছে। ওরা মহামন্ত্রের কী বুঝবে? কী বোলেন?
-কী করতে হবে আমাকে?
-মহাযজ্ঞ।
-কিন্তু তাতে তো গাছ
কাটা, আগুন ধোঁয়া বায়ুদূষণ?
-কুছু ব্যাপার নয়।
পারমিট লিয়ে লিব। বাদুড় মেধ যজ্ঞ। এক বাদুড় পকড়কে আমার কাছে লে আও। আমি তোমার
বৌমার দোষ কাটিয়ে দিব।
-আচ্ছা ঝুনঝুনজি। এতে
ওর বাচ্চাকাচ্চা হতে প্রবলেম হবে না তো।
-বিলকুল না। হাত
দিখাইয়ে জারা।
শশধরের হাতে বংশি কী দেখল কে
জানে। গদগদ বলল, "সাত দিন মে শুক্র আয়েগা
মঙ্গল মে। খুশি হি খুশি। সাতদিন টাইম। যান।"
ঝুনঝুনওয়ালার ঘর থেকে বেরিয়ে
বেশ নিজেকে হাল্কা লাগছিল শশধরের। দক্ষিণা মিটিয়ে সে আপাতত ভাবছিল যজ্ঞের জন্য
বাদুড় কোথা থেকে ধরা যায়। অবশ্য ডিউটিরুমে এক সুপারসনিক বিম গান আছে। এই অঞ্চলে
শাল গাছগুলোর পাতার আড়ালে বাদুড়ের অভাব নেই। ইভিনিং শিফটে একটাকে ঘায়েল করা যাবে
নাহয়।
ডিউটি জয়েন করতে মিনিট পাঁচেক
দেরি হয়ে গেল শশধরের। চোখের মণি হাতের আঙুল ছাড়াও আজকাল যন্ত্রে তাদের চিন্তার
তরঙ্গ পরখ করে নেয় সিস্টেম। এতে কারোকে
মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ মনে হলে মিনার কাজে যোগ দিতে অনুমতি দেয় না। প্রস্তুতি
সেরে ডিউটি করতে করতে বেলা গড়িয়ে গেল। একজন অস্ট্রেলিয়ান কটকটিভাজা-বিক্রেতা ঘুরঘুর
করছিল আশেপাশে। এই অঞ্চলে সচরাচর কেউ আসে না। কটকটি কিনে চিবাতে চিবাতে সে জানতে
পারল লোকটার নাম বরিস ওয়ার্নি। আদি বাড়ি অ্যাডেলেইডে। সেখানে এখন ঘোর খাদ্যাভাব।
তাই বাধ্য হয়েই সে অন্নসংস্থানের জন্য চলে এসেছে ভারতে। বেশ একটু 'প্রভু প্রভু' ভাব নিজের অজান্তেই যেন তার
মধ্যে ঢুকে বসল। বরিস চলে গেলে কটকটি চিবাতে চিবাতে শশধর সন্ধ্যার অপেক্ষা করছিল।
সন্ধ্যা আর সকালের গোধূলি বাদুড়শিকারের অনবদ্য সময়। ভাবতে ভাবতেই সে লক্ষ্য করল
তার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। হঠাৎ সে দেখল ডুরে কাটা লাল পাড় শাড়ি পরে একটি
আদিবাসী মেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। দিনের আলো পড়ন্ত। আর খানিক পরেই মিনারের আলো
জ্বলে উঠবে। মেয়েটা একেবারে সামনে চলে এসেছে। শশধর চেয়ারে বসতে বসতে টলে গেল
সামান্য।
-ইয়েস?
-চিনতে পারছেন?
-কে?
-সেই যে...
বুকের কাছে সামান্য আঁচলটা
সরিয়ে দিতেই শশধরের সবকিছু আবার মনে পড়ে গেল। মেয়েটার বাঁদিকের বুকের ঠিক উপরে
উলকিটা শশধর অনেক দিন বাদে দেখল। বন্দরে সেদিন সে জেনেছিল ওর অর্থ 'ওম মণুপদ্মেহুম'। হৃদয় পদ্মফুলের মতো
বিকশিত হোক।
-মনে আছে স্যার। আপনি
সেদিন আমাকে আদর করতে করতে পড়িয়েছিলেন।
আদিম সাম্যবাদ থেকে দাস প্রথা। তারপর সামন্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র
হয়ে সমাজতন্ত্র।
কী হলো শশধরের কে জানে? তাকে আবার ভয়টা আঁকড়ে ধরেছে। ভাইরাসের ভয়। ওই ঠোঁট সে চেনে। ও
ঠোঁট মণিপুরী ঠোঁট। ভাইরাস। ভাইরাস। 'আঁ আঁ' আওয়াজ বের হতে থাকে তার মুখ দিয়ে। তারপর মুখের কোণা দিয়ে গাঁজলা বেরিয়ে
আসে। শশধর দেখল মেয়েটা ঝুঁকে তার 'পরিচয়পত্র' তুলে নিচ্ছে। ওই কার্ডে যে তার আইডি সিগনেচার আছে। শশধর বাঁধা দিতে গেল।
পারল না। মেয়েটা ততক্ষণে তার ডিউটির সুপারসনিক বন্দুক তাগ করে তাকে ঘায়েল করে
ফেলেছে।
শশধরকে কাবু করতে তেমন বেগ পেতে
হল না নেপথিসের। কানে 'বিপবিপ' আওয়াজ আসতেই সে বলল।
-ডান।
ওপার থেকে ভেসে এল শব্দ।
-গুড জব।
শশধরের মস্তিষ্ক তরঙ্গ সে আগেই
হ্যাক করে রেখেছিল। রেখেছিল বলেই লোকটার ভয়ের মানচিত্র পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। বাকি
কাজটা সহজেই হবে হয়তো। নেপথিস দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ ধাপ নিরাপত্তা বেষ্টনী শশধরের 'আইডি সিগনেচার' দেখিয়ে পেরিয়ে গেল। এরপর
পঞ্চম ও চুড়ান্ত ধাপ।ওটা পার হলেই মিনারে ঢুকে পড়া যাবে। সামান্য চোখ বন্ধ করে
ভেবে নিল নেপথিস, তাকে পরপর কী কী করতে হবে। চোয়াল শক্ত করে
তারপর সে এগিয়ে গেল চুড়ান্ত বেষ্টনীর দিকে। সেই দরজার একপাশে আরজান শাহর মূর্তি।
দরজার উপরে বড় বড় করে লেখা।
"মানুষ বিনে আর
কিছু নাই"। (ক্রমশ। পরের পর্ব ২৩ এপ্রিল)
।। পর্ব ৪ ।।
ম্যানহাটন |
দুখিয়ার মা
ম্যানহাটানের বিমানছাউনির বন্দরে অগ্রদ্বীপের পারমাণবিক শক্তিচালিত বিশেষ বিমান পুষ্পক অবতরণ করতেই তার সহকারী অ্যালাবিমো সামান্য চঞ্চল হয়ে উঠল। এই চঞ্চলতার কারণ অগ্রদ্বীপ জানে। আসলে 'সুধন্য ফাউণ্ডেশন'এ কেউ যোগ দিলেই তার মনের মস্তিষ্কের মানচিত্র জরিপ করে ফেলে 'তথাগত' নামের একটি অত্যাধুনিক সফট্ওয়্যার। সেই সফট্ওয়্যার নিয়োগকারী অফিসারকে নিযুক্তর মস্তিষ্কের ভিতর ঘটমান অবচেতনকে মুক্ত করে দেয়। মনের ভিতরের অবরোধ উন্মুক্ত হয়ে যায়। মনোবিদ জর্জ ভ্যালিয়েন যাকে একসময় 'ডিফেন্স' বলেছিলেন, তা আর কার্যকরী থাকে না। অবরোধ সরে গেলে নিযুক্ত মানুষটি সদ্য ফোটা ফুলের মতোই প্রতিরোধহীন হয়ে যায়। অগ্রদ্বীপ অ্যালাবিমোর সেই ফাইল দেখেছে।
অ্যালাবিমোর আদিবাড়ি আফ্রিকার কঙ্গোতে। সেখানে এই
অধুনা আমেরিকার শ্বেতাঙ্গীরা একসময় অন্যায়ভাবে তার পূর্বপুরুষদের দাস বানায়।
কঙ্গোতে তখন হীরের খনি ছড়িয়ে রয়েছে। আমেরিকার ব্যবসায়ীরা সেই খনিগুলি খুব চতুরভাবে
লিজ নেবার নাম করে কিনে ফেলে। শুরু হয় শোষণ। অ্যালাবিমো তার এই পূর্বপুরুষদের কথা
শুনেছিল তার ক্যানসার আক্রান্ত মায়ের মুখে। শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীরা কঙ্গোর উর্বর
মাটিকেও শোষণ করতে ছাড়েনি। সেখানে ফলন হতো কমলালেবুর। ব্রাজিলের সাওপাওলোর ধাঁচে
একটি কমলালেবুশালায় কাজ করত অ্যালাবিমোর বাবা ও মা। ব্যাবসায়ীরা ফল বাঁচাতে
কীটনাশক স্প্রে করতেন কর্মীদের উপরেই। রাসায়নিক কীটনাশকের বিক্রিয়ায় অ্যালাবিমোর
মায়ের ফুসফুস বিষাক্ত হয়ে উঠল। তখন সে বালক। একটা বড় কলা ও তার খোসা সিদ্ধ করে চলত
সমস্ত দিনের আহারগ্রহণ। অ্যালাবিমোর মস্তিষ্কের অবচেতনিক মোটিফে সেই কষ্টের
ছবিগুলো দেখেছে অগ্রদ্বীপ। নিউইয়র্কের এই ম্যানহাটান শহরে একদিন মহাযুদ্ধ ও
আফ্রিকার মহান উত্থানের বেশ কিছুদিন আগে অ্যালাবিমোর বাবাকে পাঁচ কার্টন বিয়ারের
বদলে বেচে দেয় কঙ্গোর সেই বহুজাতিক সংস্থা। তারপর তার বাবা নিখোঁজ হয়ে যায়।
ম্যানহাটানে নাবামাত্র অঞ্চলের বিশিষ্ট মুনশি মানুষরা অগ্রদ্বীপকে অভ্যর্থনা জানাল। অগ্রদ্বীপ ভাবছিল। পাঁচশো বছর আগে এই কৃষ্ণাঙ্গ মুনশি আর ঈশোপারা ছিল আমেরিকার ম্যানহাটান দ্বীপের শাসক। এরপর ইয়ুরোপের আগ্রাসন তাদের তিলতিল করে পরাস্ত করেছিল, প্রতারিত করেছিলল, ধর্মান্তরিত করেছিল। ধীরেধীরে মুনশি, লেনাপ আর ঈশোপা গোষ্ঠীদের বোঝানো হয়েছিল তারা এই দ্বীপে উদ্বাস্তুর মতো। অনেকটা অ্যালাবিমোর বাবা মায়ের মতো। তবে মহাযুদ্ধর ধ্বংসলীলার পর ম্যানহাটান আজ ধ্বংস। এয়ারোড্রোম থেকে হাঁটতে হাঁটতে ছোট জীপের দিকে যেতেযেতে অগ্রদ্বীপ দেখল পথের দুপাশে ক্ষুধার্ত শ্বেতাঙ্গ মানুষগুলো ভিক্ষার থালা নিয়ে বসে আছে। অগ্রদ্বীপ মানুষের ভিতর সাদাকালো দেখে না। সে আরজান শেখের ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। লালন আর রামপ্রসাদে বিশ্বাসী।
মুনশির শীর্ষ নেত্রীর নাম ওটিম্বো। ওটিম্বো বলল, মূল ভূখণ্ডে ঢোকার আগে একটা ছোট সাহায্য অগ্রদ্বীপকে করতেই হবে। মুনশি সম্প্রদায় এখন নারীকেন্দ্রিক। যদিও ওদের মধ্যেও আর কোনও পদবী রাখবার প্রথা নেই। ওটিম্বো জানালো এক খ্রিস্টান ইহুদি যুদ্ধের সময় এই হাতে গোনা জীবিত মুনশি ও ম্যানহাটানবাসীর জন্য জীবন লড়িয়ে দিয়েছিলেন। সকলে তাকে নব্য ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল বলত।নাম জোসেফিনা।কোনো ভয়াবহতাই তাকে জীবনের সেই সেবার ব্রত থেকে বিচলিত করতে পারেনি।ক্রাইস্ট মিশন হাসপাতালের চিফ নার্সপদ ত্যাগ করে জোসেফিনা মানুষের ভিতর মিশে গিয়েছিল। এই জনপদের জীবিত মানুষের কাছে তিনি শুধুই একজন সেবিকা নন। তিনি একজন মা। অদম্য তার ইচ্ছাশক্তি। শুধু পারমানবিক যুদ্ধের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ তাকে নিষ্কৃতি দেয়নি। তার ফুসফুস শুকিয়ে গেছে। ওটিম্বোদের চিকিৎসক পরীক্ষা করে বলেছে, মায়ের জীবনরেখা সীমিত।আর মাত্র মাসখানেক। পৃথিবীতে বাংলাভাষা অন্যতম আন্তর্জাতিক ভাষার স্বীকৃতি পাওয়ায় অগ্রদ্বীপের তার সঙ্গে বাংলায় কথোপকথনে অসুবিধা হচ্ছিল না। ওটিম্বোও ভাঙাভাঙা বাংলায় কথা বলছিল। যেটুকু অসম্পূর্ণতা, তা কাটিয়ে দিচ্ছিল অ্যালাবিমোর আশ্চর্য ভাষান্তর করবার ক্ষমতা।
-এদেশে এখন নৈরাজ্য
চলছে। যে সভ্যতা ওরা তৈরি করেছিল, তা যে এক বিষফল, আমাদের পূর্বপুরুষরা তা বুঝেছিলেন। বুঝেছিলেন বলেই প্রতিবাদও করেছিলেন।
কিন্তু প্রযুক্তি তাদের সাময়িক হারিয়ে দিয়েছে। আজ এই দেশ ছন্নছাড়া। সুধন্য
ফাউণ্ডেশনের এই উদ্যোগকে আমরা কুর্নিশ জানাই। তবে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ার আগে
বিনীত অনুরোধ, আমাদের মাকে আপনি বাঁচিয়ে দিন।
-বেশ তো। কীভাবে বলুন?
-আপনাদের দেশে
কৃষ্ণনগরে বিজ্ঞানী বিদিশা এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। সে যন্ত্রে মানুষ একবার
ঢুকলে তার শরীরে তেজস্ক্রিয়তাজনিত ক্রোমোজোমের বিকৃত অসুখগুলি মুহূর্তে সেরে যায়।
জোসেফিনা আমাদের মা। তাকে ঘিরে এই মুনশি আর ঈশোপা জনজাতি বেঁচে আছে। আপনি একবার
তাঁকে আপনার দেশে নিয়ে যাবার চেষ্টা করুন।
অগ্রদ্বীপ মাথা নাড়ে। তার ডান
হাতে একসময়ের বিখ্যাত ইস্ট রিভার। এখন অধিবাসীরা তার নাম দিয়েছেন পূবালী নদী।
ম্যানহাটানের উঁচু উঁচু বাড়িগুলো ভূমিসাৎ হবার পর দূর থেকে দেখা যাচ্ছে স্ট্যাচু
অফ লিবার্টির মূর্তিটি। তার বাম হাত ভেঙে গেছে। কবি পাররা বলেছিলেন মাত্র কয়েক
শব্দে। "আমেরিকা হোয়ার লিবার্টি ইজ আ স্ট্যাচু"। সেই আমেরিকা আর এই
আমেরিকার অনেক তফাত। এই আমেরিকা গরীব। কিন্তু তার ভিতর আবার যেন প্রাচীন
মানবতাবোধগুলি ফিরে আসছে। আবার যেন 'লিবার্টি' পাথর ভেঙে মানুষ হয়ে উঠছেন।
ওটিম্বো অগ্রদ্বীপের উত্তরের অপেক্ষায় ছিল। তাই সে বলল।
-একবার তোমাদের মা
জোসেফিনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। সম্ভব?
-সম্ভব। অবশ্যই। চলুন।
ম্যানহাটানের ফিফথ অ্যাভিন্যিউ
দিয়ে অগ্রদ্বীপদের জিপটা যাচ্ছিল ধীরে। এই রাস্তা একসময় সারা পৃথিবীর সবচেয়ে দামী
বাড়িদের আশ্রয় দিয়েছে।তখন একটি ছোট একঘরবিশিষ্ট ফ্ল্যাটের ভাড়া ছিল মাসে দশ লক্ষ
টাকা। এখন সেই রাস্তার দুইপাশে ঝুপড়ি। অধিবাসীরা কোনও মতে জামাকাপড় মেলে ঘরের
সম্ভ্রম রক্ষা করছেন। ওদের অবশ্য ভারত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে অস্থায়ী
ছাউনি দেওয়া হয়েছে। একটি ছোট হাসপাতালও বানিয়ে দিয়েছে নেপাল। সেখানে সামান্য
শুশ্রুষা পাচ্ছে তারা। অগ্রদ্বীপ জীপে করে যেতে যেতে দেখল রাস্তার দুইপাশে
দেবশিশুর মতো বাচ্চাগুলি ছোটছোট বল নিয়ে গুলি খেলছে। তাদের নাক দিয়ে সর্দি গড়িয়ে
পড়ছে। সারা দেহে অপুষ্টির ছাপ। অথচ চোখগুলি যেন তারার মতো প্রাণবন্ত।
-সাম্প্রতিক টাইফুনের
পর ওরা আরো অসহায় হয়ে পড়েছে।
ওটিম্বো বলছিল।
-ঘরবাড়ি সব হারিয়েছে।
এশিয়া পাশে এসে না দাঁড়ালে ওরা নিশ্ছিন্ন হয়ে যেত। এরপর অগ্রদ্বীপদের জীপ পূবালী
নদীকে ডানহাতে রেখে যে ছোট্ট আটশো মিটার
রাস্তায় প্রবেশ করল, সে রাস্তার কথা সে ইতিহাসবইতে পড়েছে। এই
রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা মাত্র আটখানা ব্লক প্রায় একশোবছর ধরে পৃথিবীর অর্থনীতিকে শাসন
করেছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী স্টক এক্সচেঞ্জের ঠিকানা। এই আটশো মিটার নিয়ে
কতো উপন্যাস, কতো না সিনেমা। ইতিহাসের পাতায় এই রাস্তার নাম 'ওয়াল স্ট্রিট'। মহাযুদ্ধের পর বিশ্ব অর্থনীতির যে
অদলবদল হয়, তারপর এখন অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু এশিয়াতে শিফট
হয়েছে। অগ্রদ্বীপ দেখল আধভাঙা ওয়ালস্ট্রিটের নিচে ছোটছোট দোকান গড়ে উঠেছে। সেখানে
মুদী, চাল, জামাকাপড়, ছোট ছোট ইলেকট্রনিক সামগ্রী আর অজস্র গাছ বিক্রি হচ্ছে। ম্যানহাটানে মুনশি
ঈশোপারা শাসনভার নেবার পর প্রতিটি ঘরে অন্তত তিনটি বড় বড় গাছ থাকা আবশ্যিক।
-মহাযুদ্ধ যতোটুকু বা
নিস্তার দিয়েছিল, এই টাইফুন আর ঘূর্ণিঝড় সেটুকুও শেষ করে
দিল। অ্যামাজনের জঙ্গল এভাবে কেটে উড়িয়ে না দিলে আজ সাও পাওলো মরুভূমি হয়ে যেত না।
আর আমাদের দেশেও এতো বিপদ আছড়ে পড়ত না।
ওটিম্বোর কথায় সহমত হল
অগ্রদ্বীপ। মানুষটা ঠিকই বলেছে। বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও অ্যামাজনের জঙ্গল কেটে
ফেলল ব্রাজিল। তাতে যে জৈব আকর্ষণে সমুদ্রের আর্দ্র বাতাস মলয় পবন হয়ে মূল ভূখণ্ডে
ঢুকে আসতে পারত, তা চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল।
একঝলক ভেঙে যাওয়া ব্রুকলিন ব্রিজ দেখতে পেল অগ্রদ্বীপ। ওটিম্বোর কাছে শুনতে শুনতে
অগ্রদ্বীপের মনে হচ্ছিল সে যেন চুঁচুড়ায় এসেছে। সেই ডাচ সাহেবদের কপটতা। একসময়ের
লেনাপি সংস্কৃতি, তাদের সাধের রাজধানী লেনাপিহকিং, তাদের ভাষা দেলাওয়ারে কেমনভাবে বদলে গেল রাতারাতি। তারপর আমেরিকার বিপ্লব।
ম্যানহাটানের মুক্তি। মাঝেমাঝে ওটিম্বোর মুখে বাংলার ভিতরেই দেলাওয়ারি ভাষা উঁকি
দিচ্ছিল। হারলেম নদীর ধার দিয়ে যেতে যেতে অগ্রদ্বীপ ভাবছিল। ডাচ সাহেবদের কাছে ছিল
প্রযুক্তি। আজ তা আছে পায়রাডাঙায়। আজ তাদের কাছে পৃথিবীর শেষ প্রাণস্পন্দন রয়ে
গেছে। তারাও কি কখনো হঠাৎ অমন ডাচ সাহেব হয়ে উঠবে? নাহ।
কখনোই নয়। কিন্তু যদি হয়! যদি?
একটি প্রাচীন গথিক স্থাপত্যের সামনে অগ্রদ্বীপদের জিপ এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। বড় বড় থামযুক্ত বাড়িটি একসময় কোনও চার্চ ছিল হয়তো। এখন তার চারপাশ ঘিরে লেনাপি, ঈশোপা আর মুনশি যোদ্ধারা করা নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছে। অগ্রদ্বীপের কৌতূহল হল।
-এতো নিরাপত্তা কেন?
ওটিম্বো উত্তরে অদ্ভুত রহস্যময়
চোখে তাকিয়ে বলল,"আপনি কি ভাবলেন?
মহাযুদ্ধ আর ঘূর্ণিঝড়ের পর ওরা শান্ত হয়ে যাবে?"
-কারা?
-যারা চায়না মানুষ
সুখে শান্তিতে ভালোবাসায় মুড়ে থাকুক।
-কোন দেশ?
-দেশ নয়। ওদের কোনও
দেশ নেই। নাম আছে। একটাই নাম। সেসব বলব।তবে একটা সতর্কতা আপনাকে দিয়ে যাই। এখানে
কোথাও আমাদের নির্দেশ ছাড়া এদিকওদিক যেতে যাবেন না। সুধন্য ফাউণ্ডেশনের এই
মানবতামুখী পদক্ষেপ কিন্তু অনেক মানুষের বিষনজরবন্দী হয়েছে। আমরা সেখবর পেয়েছি। ওরা
আপনার ওপর আক্রমণ করবে। করবেই। তাই সতর্ক থাকবেন সবসময়। এখন ভিতরে চলুন।
বাড়িটির ভিতরে লম্বা করিডোর।
অ্যালাবিমো আর অগ্রদ্বীপ সেই করিডোর বেয়ে ওটিম্বোর পিছুপিছু হেঁটে চলল। করিডোরের
শেষপ্রান্তে ঘরের দরজা খুলতেই খাটের উপর শ্বেতশুভ্র দেবীর মতো এক নারীর দেখা পেল
অগ্রদ্বীপ। দেখামাত্র করজোড়ে প্রণাম করতেই সে মহিলা সামান্য হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, "এসো এসো শশাঙ্কপুত্র।"
ওটিম্বো হেসে বলল,"আমরা ওঁকে মারিয়াম বলেই ডাকি। মারিয়াম সব জানেন। ইতিহাস
ভূগোল জ্ঞান বিজ্ঞান। কী মারিয়াম?"
জোসেফিনা হাসেন। তারপর
অগ্রদ্বীপকে বলেন, "বোসো।"
অগ্রদ্বীপের এতক্ষণে মনে হলো সে
যেন পায়রাডাঙায় তার সেই অতিচেনাজানা কুপার্সক্যাম্পে আবার ফিরে এসেছে। মারিয়ামের
হাসি তার মায়ের হাসির মতো, তার স্পর্শ যেন
মায়ের স্পর্শ। ওটিম্বো মারিয়ামকে অগ্রদ্বীপের এখানে আসার কারণ আর বিদিশার প্রমিলা
যন্ত্রর কথা বোঝাচ্ছিল। জোসেফিনা সব শুনে বলল,"প্রযুক্তি। আবার
সেই প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তিকেই তো এই কারণে প্লেখানফ্ এতো ভয় করতেন।"
-কিন্তু প্রযুক্তি তো
শুধুই ধ্বংস করে না। সে তো উত্তরণও শেখায়। নয় কি মারিয়াম? অগ্রদ্বীপ
বলে।
-তা ঠিক। ঠিকই বলেছ।
মারিয়াম হাঁফ নেন সামান্য।
অগ্রদ্বীপ বুঝতে পারে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। জোসেফিনা সামলে নিয়ে আবার বলতে
থাকেন।
-এ যুগে পদার্থ উবে
গেছে, এমন কথা বলা ঠিক হবে না। সবসময়ই সংকটকে অগ্রগমনের সংকট
ভাবলেও বিপদ, আবার বিনাশের ভাবলেও বিপত্তি। একটা ব্যালান্স
দরকার। পদার্থ আর তেজের। আগে এদের ভিতর প্রাচীর ছিল। এখন নেই। ঠিক যেন সত্য অসত্য
বা ভালো মন্দর ভিতরের প্রাচীর। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে জগতে কোনও অলঙ্ঘ্য
ধ্রুবনির্দিষ্ট সীমারেখা নেই।
অগ্রদ্বীপ এইসব কথা বিশ্বাস
করলেও এতো সুন্দর করে ভাষায় তা কখনো কারোকে প্রকাশ করতে পারেনি কখনো। যতো সে শুনছে, মারিয়ামের প্রতি তার আস্থা বাড়ছে। নির্ভরতা বাড়ছে।
-আপনাকে আসতে হবে
আমাদের দেশে। কৃষ্ণনগরে। আপনাকে সুস্থ হতে হবে। মানুষের জন্য।
জোসেফিনা হাসলেন শুধু।
অগ্রদ্বীপ অ্যালাবিমোকে নিয়ে উঠে এল। অ্যালাবিমোর ভিতরে প্রাথমিক চঞ্চলতা অনেকটা
কমে এসেছে। বোধহয় এই লেনাপি ঈশোপা ও মুনশিদের ভিতর সে তার হারিয়ে যাওয়া
পূর্বপুরুষদের খুঁজে পাচ্ছে। ওদের বেশভুষা চলন চালন যেন সেই পাঁচশো বছর আগেকার।
অথচ তাদের বুদ্ধি ও পাণ্ডিত্য আরও একশো
বছর এগিয়ে। এই বাড়িটির নাম 'ডোম'। ডোম থেকে বেরিয়েই ওটিম্বো বলল, আপাতত আপনি
বিশ্রামকক্ষে যান। হারলেম নদীর পাশে আপনাদের দুজনের রেস্টরুম করা হয়েছে। চারজন
দেহরক্ষী সবসময় থাকবে আপনাদের সঙ্গে। তবুও সতর্ক থাকবেন। কাল সকালে আমরা 'দোজো' তে আলোচনা করব কীভাবে এই বিপদে আপনি আমাদের
সাহায্য করবেন।
অগ্রদ্বীপ মাথা নেড়ে
বলল।"এক কাজ করুন। আমি বিদিশাকে খবর দিচ্ছি। মারিয়ামকে আমার পুষ্পকে করে আমার
দেশে পাঠিয়ে দিন। উনি ভালো নেই। বিদিশার যন্ত্র ওকে সুস্থ করে দেবে।"
-সে হবে। নিরাপত্তা
নিশ্চিত না করে কিছুতেই মারিয়ামকে সরানো যাবে না। আরও দুদিন সময় লাগবে। আপনি
চিন্তা করবেন না। আপনাকে পেয়ে ম্যানহাটানবাসীরা মনে বল পেয়েছে অনেক। আমরা জানি
আপনারা আমার পাশে আছেন। এখন আপনি বিশ্রাম নিন।
হারলেম নদীর তীরে পাতার ছাউনি
দেওয়া দুটি ঘর প্রস্তুত হয়েছে। চারপাশে লেনাপি সৈনিকদের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা।
অগ্রদ্বীপ নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখল শীতল হাওয়া তার গা স্পর্শ করছে। অথচ ভিতরে
কোনও শীততাপযন্ত্র নেই। পুরোটাই প্রাকৃতিক। পুরোটাই বায়বীয়। হারলেমে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে অগ্রদ্বীপের মনে
হলো সে যেন চূর্ণীনদীর পাড়ে বসে আছে। চারপাশ যেন রক্তিম আভায় স্নান করছে। একসময় এই
ম্যানহাটানেই রাষ্ট্রপুঞ্জর আপিস ছিল। আজ তা ধ্বংস হয়েছে। ওটিম্বো বলছিল সেখানে
একটা বড় নার্সারি হয়েছে। তার মাঝেই 'দোজো'। সেখানে মাছি গলবার উপায় নেই। কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কাল সেখানে
অগ্রদ্বীপকে পৃথিবীর নানা প্রান্তের দেশনায়কদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ভাবতে ভাবতে
সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে অগ্রদ্বীপ হারলেম নদী দেখতে ঘরের বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিল।
ঠিক তখনই ঘটে গেল ঘটনাটা।
প্রথমে মনে হচ্ছিল জলকণার ভিতর
গোধূলির আলোআঁধারি। কিন্তু সামান্য স্পষ্ট হতেই অগ্রদ্বীপ দেখল সেগুলো কোনও আলোকণা
নয়, হারলেম নদীর ভিতর লুকিয়ে থাকা সাবমেরিনির
ধাতব গা থেকে বিচ্ছুরিত সূর্যের আলো। সাবমেরিনগুলি কয়েক মুহূর্তে মাথা উঁচু করতেই
অগ্রদ্বীপ বিপদ বুঝতে পারল। লেনাপি সৈনিকরা সেদিকে এগিয়ে যেতেই সেই সাবমেরিন থেকে
এক তীব্র শব্দতরঙ্গ ভেসে এল। সৈনিকরা মূর্তির মতো নিথর পাথর হয়ে ধপ করে মাটিতে পড়ে
গেল। অগ্রদ্বীপ পাশেই অ্যালাবিমোর ঘরের দিকে দৌড়ে যেতেই সাবমেরিনদের থেকে এক
আশ্চর্য আলো অ্যালাবিমোর ঘরের উপর পড়ল। অগ্রদ্বীপ সময় পেল না। অ্যালাবিমোর পাতার
ঘর দাউদাউ করে জ্বলছে। অগ্রদ্বীপের পাও টলছে। তীব্র একটি শব্দ যেন শূলযন্ত্রর মতো
তার মাথার ভিতর ক্রমশ প্রবিষ্ট হচ্ছে। সে চেষ্টা করলেও আটকাতে পারছে না। দুহাতে
কান চেপে বসে পড়বার মুহূর্তে হঠাৎ অগ্রদ্বীপ শুনতে পেল, পাশেই
মালবেড়ি ঝোপ থেকে এক নারীকণ্ঠ তাকে ডাকছে।
-কাম হিয়ার এখানে
আসুন। জলদি।
শরীরের শেষ শক্তি নিয়ে
অগ্রদ্বীপ ঝোপের দিকে ঝাঁপ দিল। শূন্যে উড়তে উড়তে অগ্রদ্বীপ দেখল হারলেমের গোধূলি
ক্রমশ ঘন অন্ধকার রাতে বদলে যাচ্ছে।
।।
পর্ব ৫ ।।
আরজান মিনার |
ফুলঝরিয়ার খেদ সংক্রান্ত
ভাদুড়ীমশাই লেখার সময় হয়তো এতোটা এগিয়ে ভাবেননি। তার ফুলঝরিয়ার সোমত্ত উত্তমাঙ্গর অনুপাতে নিম্নাঙ্গ পা দুটি অপুষ্ট ছিল। ফুলঝরিয়ার জন্য তাই শিউজি মরা ভুড়ো শিয়ালের পেট চিরে গরম গরম নাড়িভুঁড়ির ভিতর পা ঢুকিয়ে বসে থাকার বিধান দিয়েছিল। কিন্তু ফুলঝরিয়া কি তখন জানত, তার খেদোক্তি কেউ দুশো বছর বাদেও তার মস্তিষ্ক র ভিতরে বয়ে বেড়াবে! বিদিশা যখন প্রথম গানহী বাওয়ার কাছে শিষ্যা হয়ে গিয়েছিল, তখন এমনটা হতো না। কিন্তু ধীরে ধীরে বাওয়া তাকে মন্ত্র দিল, মনোবৈজ্ঞানিক সেই পদ্ধতি শেখালো যার মাধ্যমে অপরের মুখটি নিরীক্ষণ করলেই তার অবচেতনে প্রবিষ্ট হওয়া যায়। গানহী বাওয়া সেই শক্তিকে বলতেন 'পরমহংসযোগ'। আর সেই যোগ বিদিশার ভিতর প্রতিস্থাপিত হবার সাথে সাথেই বিদিশার ভিতর ফুলঝরিয়ার মতোই খেদের উদ্রেক হলো। ফুলঝরিয়ার দুটি পা লিকলিকে। আর বিদিশার মনের ভিতরের দুটি তরঙ্গ। হঠাৎ হঠাৎ যেন এক তীব্র বৈদ্যুতিক শক্তিতে ঝনঝন করে বাজতে থাকে তারা। কাজ করা যায় না তখন। চোখের সামনে অদ্ভুত সব দৃশ্য ভেসে আসে। সে দৃশ্য সে কখনও নিজের চোখে দেখেনি, বিশ্বাস করেনি। অথচ সে জানে সে সব সত্যি।
দু আড়াই বছর আগে এই ঘটনা যখন প্রথম ঘটে, বিদিশা বুঝতে পারেনি তার গভীরতা। তখন অগ্রদ্বীপের সঙ্গে তার দেখা হত মনেমনে। মাঝে মাঝে মনের বাইরেও। একদিন যুদ্ধবিধ্বস্ত কলকাতার লুটিয়ে নড়া অক্টারলোনি মনুমেন্টের পাশেই নামনাজানা চাদোকানে ঘটনাটা ঘটেছিল। অগ্রদ্বীপ তার নতুন আবিষ্কারের গবেষণাপত্র পড়ে শোনাচ্ছিল। শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে ভাবছিল বিদিশা।এমন একটি সফ্টওয়্যার যা প্রথমেই মানুষের মনের প্রতিরোধ সরিয়ে অবচেতনের মানচিত্র তৈরি করে নিতে পারবে। এই প্রযুক্তি কোনও বার্লিন বা টেক্সাস থেকে নয়, হদ্য পায়রাডাঙ্গার অগ্রদ্বীপ চ্যাটার্জির মস্তিষ্কপ্রসূত। গবেষণাপত্র পড়া শেষ করে অগ্রদ্বীপ সেদিন জিজ্ঞাসু চোখে বিদিষাকে প্রশ্ন করেছিল।
-কেমন লাগল বিদিশা?
-দুর্দান্ত। কোনও সংস্থা ইন্টারভ্যিউ নেবার সময় লক্ষ লক্ষ প্রশ্ন ছুঁড়ে শুধু এইটাই জানতে চায়, যে সেই ইচ্ছুক প্রার্থী আসলে কতোটা সংস্থার প্রতি নিবেদিত হবে। সেই প্রশ্নে অনেক ফাঁকফোকর থাকে। সেই ফোঁকর দিয়ে চোরাপথে ঢুকে পড়ে অবাঞ্ছিত বিশ্বাসঘাতকতা। তোমার এই প্রযুক্তি সেই ফোকরগুলো বুঝিয়ে দেবে সন্দেহ নেই। কিন্তু...
-কিন্তু কী বিদিশা?
-দুটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মনের ভিতর।
-কী? বলো?
-তুমি বললে এই প্রযুক্তি মানুষের মনের প্রতিরোধ বা 'ডিফেন্স' সরিয়ে অবচেতনকে আলোচনার জন্য খুলে দেবে। তাই তো?
-ঠিক তাই।
-আমার প্রশ্ন, এই অবচেতনটাই কি সব! তাকে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষ তার বোধি দিয়ে যে তার নিজস্ব পথটুকু বেছে নেয়, সেটুকর কি কোনও মূল্যই নেই? উদাহরণ দিই। ধরা যাক। একটি মানুষ। তার জন্মগত খুনে স্বভাব। আগে যাকে ওদেশের মানুষ 'টাইপ বি' বলত, আমরা বলি 'আগ্রাসী'। সে তার আগ্রাসনকে মনের প্রতিরোধে নিয়ন্ত্রণ করে একজন সফল তিরন্দাজ হলো। এটা তো তার একধরনের উত্তরণ। নয় কী? আমার তো মনে হয়, যার জন্ম থেকেই এই আগ্রাসন ছিল না,তার পক্ষে এই কাজ যতোটা সহজ হতো, তার তুলনায় এর কাজটি শতগুণ কঠিন। আর কঠিন বলেই তা কৃতিত্বর দাবী রাখে। তুমি কী বলো? সংস্থার সংকটের সময় তার কর্মচারিরা যদি উত্তরণের পথ না দেখাতে পারে, তাহলে সেটা সংস্থার দুর্বলতা নয়?
অগ্রদ্বীপ ভেবেছিল সেদিন। ভগ্নপ্রাপ্ত শহীদমিনারের উপর বসে একটি মধ্যবয়স্ক মানুষ রুটি চিবাচ্ছে। সে দৃশ্য দেখতে দেখতে সে বলেছিল।
-তুমি ঠিক বলেছ বিদিশা। অবচেতনটাই সব নয়। কিন্তু এই সফট্ওয়্যারে আপাতত এই বোধ সংযুক্ত করা অসম্ভব। কী করি?
-কী আবার করবে? প্রযুক্তির কাজ প্রযুক্ত হওয়া। একে প্রযুক্ত করো। কিন্তু তারপর উত্তরণের পথ নিরীক্ষণ করতে তোমাদের মধ্যবিত্ত ক্যশিয়ার দাসবাবুর মতো কারোকে রেখো, যে জীবনে সিঙ্গিমাগুর, গলব্লাডার গেঁটেবাতের সমান্তরালে জিপিএফ বা মাসিক কিস্তি সামলেছেন। তার মতো দার্শনিক ইম্যান্যুয়েল কান্টও হতে পারেননি। বুঝলে বাবুরাম?
বেশ চলছিল কথোপকথন। লোকটি রুটি খেয়ে উঠে চলে যাবার পর দুটো ফ্রক পরা বাচ্চা মেয়ে মনুমেন্টের ওপর উঠে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছিল। তাদের পরণের ফ্রক শতচ্ছিন্ন। মুখে কালিঝুলি মাখানো। চিনেবোমার বারুদের গুঁড়ো হাতে আঙুলে। কিন্তু তাদের মুখের হাসি দেখে কে বলবে সেসব কথা! ভাবখানা এমন যেন কিছুই হয়নি। এই বিরাট অক্টারলোনি মনুমেন্টটা যেন তাদের মেয়েখেলার বিষয়।
-কী নাম দেওয়া যায় বলো তো?
-কী করে জানবে ছেলে হবে না মেয়ে?
-ধ্যাৎ। আমি সফ্টওয়্যারটার কথা বলছি। জিন সেঙ বলছিল একটা নাম দিতে।
-জিন সেঙ মানে তোমার সেই চৈনিক বিজ্ঞানী বন্ধু?
-চৈনিক নয়। ওর দেশ তাই ওয়ান। যদিও চিন সে দেশ দখল করেছে তিব্বতের মতো। কিন্তু সেখানকার মানুষ এখনও নিজের 'ওয়াইট পাণ্ডা' ভাবে। ওয়াট পাণ্ডা মানে 'তাই ওয়ান'।
-ও কী বলছে?
-বলছিল গৌতম বুদ্ধর স্পর্শ থাকলে ভালো হতো। এই প্রযুক্তি তো আমার একার নয়। অর্ধেক আমার, আর অর্ধেক জিন সেঙের। জিন সেঙ বৌদ্ধ। ও এখনও দলাই লামাকে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে তিনি বেঁচে আছেন। অনেকটা আমার সুভাষের মতো।
-বুঝলাম।
-তাহলে?
-তথাগত।
-কী?
-ওই সফ্টওয়্যারের নাম দাও 'তথাগত'। একদিকে এই নাম সফ্টওয়্যারকে ডিফাইন করবে। অন্যদিকে তার 'বোধি' প্রযুক্ত সফ্টওয়্যারের দুর্বলতা ও তার উত্তরণের সধ্ধানের ক্ষেত্রেও পরীক্ষককে ওয়াকিবহাল রাখবে। কী?
-একদম ঠিক।
মনুমেন্টের স্তুপের উপর তখন কয়েকটি ছেলে আর মেয়ে একসঙ্গে খেলছে। দূর থেকে দেখে বোঝা মুশকিল কে ছেলে কে মেয়ে!
-কিন্তু বিদিশা, তুমি তো তোমার দ্বিতীয় সংশয়ের কথা বললে না?
বিদিশা খানিকটা ভেবেছিল।আর ঠিক তখনই ফুলঝরিয়ার মতো তার মস্তিষ্কের ভিতরেও সে তীব্র বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বেজে উঠেছিল। একবার অস্ফুটভাবে 'আঃ' বলেই সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গিয়েছিল মাটিতে।জ্ঞান ফিরতে কৃষ্ণনগরের হাসপাতাল আর বিপবিপ করা স্নায়ুযন্ত্রর ভিতর পেয়েছিল নিজেকে।
সেদিন অগ্রদ্বীপকে তার মনের ভিতর ওই 'তথাগত' সফ্টওয়ার ঘিরে দ্বিতীয় সংশয়টির কথা বলতে পারেনি বিদিশা। বলতে পারেনি কারণ মাটিতে পড়ে যাবার আগের মুহূর্তে সে কয়েকটা দৃশ্য ভেসে আসতে দেখেছিল। দৃশ্যগুলো খণ্ডে খণ্ডে তাকে দেখিয়েছিল অগ্রদ্বীপকে। প্রথম দৃশ্যে অগ্রদ্বীপকে জড়িয়ে রয়েছে এক শ্বেতাঙ্গী। অজানা মুখ। দ্বিতীয় দৃশ্যে অগ্রদ্বীপের উপর অজস্র আগুনের গোলা আছড়ে পড়ছে। ঠিক যেমন মহাযুদ্ধের সময় ঘটেছিল। আর তৃতীয় দৃশ্যে বিদিশা নিজেকে দেখতে পেরেছিল। অগ্রদ্বীপ আর সে মুখোমুখি। ঠিক যেমন ডুয়েল খেলতে যাবার সময় দাঁড়ায় মানুষ। দুজনের হাতেই অস্ত্র। এই দৃশ্য দেখার পর বিদিশার চারদিক অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল। অগ্রদ্বীপের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে দিল সে। কিন্তু মনের ভিতর সংশয়টা রয়েই গেল।
গতকাল অগ্রদ্বীপ চলে যাবার পর অনেক ভেবেছে সে। তার সেই সংশয়ের সঙ্গে আরজান মিনারের বিপদের কি কোনও যোগাযোগ আছে। ভাবতে ভাবতে বিদিশা তৈরি হয়ে নিল। একবার অন্তত পাখিপাহাড় যাওয়া দরকার তার। তার মন বলছে, সেখানে নিশ্চিত কোনও একটা বিপদ ঘটেছে। বেরোবার সময় প্রমিলাযন্ত্র তালাবন্দি করে দিল সে। মদনের ভরসা নেই। সে নামেই বিজ্ঞানী। আসলে তার ধ্যানজ্ঞান জুড়ে শুধুই গোলাপি কার্ড। দরজায় দাঁড়িয়েছিল রিমঝিম। রিমঝিমের আসল নাম ছিল 'রিঞ্জেন'। তার দিদিমা ইউক্রেনের মারিওপলে রুশ আক্রমণের সময় ভারতে পালিয়ে আসে। সেই থেকেই তারা কৃষ্ণনগরনিবাসী। রিমঝিম মেধাবিনী। সে মনে মনে এখনও বিশ্বাস করে একদিন তার মাতৃভূমি মারিওপল এই সাম্রাজ্যবাদের বদলা নেবে। যদিও মহাযুদ্ধের পর এখন সেই ক্রেমলিনিয় দম্ভ ধুলোয় মিশে গেছে। তবু।
বিদিশা রিমঝিমের এই জেদি মনকে শ্রদ্ধা করে। তাই তাকেই প্রমিলাযন্ত্রর দায়িত্ব দিয়ে বলে গেল, "আমি সংকেত না দেওয়া পর্যন্ত কেউ যেন উভযান বা প্রমিলাকক্ষে না যায়। মনে থাকবে?"
রিমঝিম ঘাড় নাড়তেই বিদিশা 'সম্পাতি'তে চড়ে বসল। 'সম্পাতি' একটি ছোট্ট ত্রিনেত্রর মতো দেখতে তেজস্ক্রিয় বায়ুযান। তার চলমান শক্তি সরবরাহ করছে সুধন্য ফাউণ্ডেশনের 'ইণ্ডিয়াম ১১৬'। 'সম্পাতি' খুব অল্প সময়ের ভিতর সামান্য দূরত্বর রাস্তা পার করে দিতে পারে।
বিদিশা সম্পাতিতে বসে পাখিপাহাড়ের কোঅর্ডিনেটগুলো ভরে দিল। আজ তার মাথার ভিতর ঘনঘন যেন সেই অসহ্য যন্ত্রণা আঘাত করে চলেছে। যন্ত্রণাটা অনেকটা তীক্ষ্ণ তিরের ফলার মতো। তার মাথার ভিতর করটেক্স, এপিকরটেক্স, মেডুলা ভেদ করতে চাইছে। পারছে না। সম্পাতি আকাশে উঠতেই অবশ্য সেই তীব্রতা সামান্য থিতিয়ে এল। অগ্রদ্বীপ ঠিকঠাক মানহাটান পৌছলো কিনা কে জানে! অগ্রদ্বীপের থেকে সে যে এইভাবে সরে এল, তা কি হঠকারিতা হয়ে গেল? এক অজানা আশঙ্কা? নাকি ভালোবাসাবাসি করা মানুষের মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা সেই চিরকালের 'সবহারানোর ভয়'! কে জানে!
মহাযুদ্ধের পর টানা একসপ্তাহ অ্যাসিবৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীতে। ফসল, বন, বাগানের সমস্ত গাছ সেই বৃষ্টিতে চিরকালের জন্য শুকিয়ে গেছে। তবু মানুষের অদম্য ইচ্ছাশক্তির শেষ নেই। মাটি কামড়ে তারা বাঁজা জমিকে উর্বর করতে চাইছে আবার। চারপাশে প্রবল খাদ্যাভাব। কী খাবে মানুষ? কীভাবে বাঁচবে? ভাবতে ভাবতে বিদিশা দেখল নিচে পাখিপাহাড়ের বেশ খানিকটা দূরে একটা বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সবুজ ধানক্ষেত। দুশো বছর আগে এই অঞ্চলে কাকপক্ষীও আসত না। তিরধনুক হাতে খালিগায়ে আদিবাসিদের চলাফেরা করতে দেখলে শহরের মেমসাহেব আর বাবুমশাইরা পয়সা আর বিয়ারের বোতল ছুঁড়ে দিত। আজ সে দিন পালটেছে। সেই আদিম মানুষগুলোই চোখে আঙুল দিয়ে সভ্যতাকে তার অস্তিত্ব চিনিয়ে দিয়েছে। ধানক্ষেতের একপ্রান্তে একটা ছোট জমকালো সার্কাসের তাঁবু। শহর থেকে ঘরহারানো মানুষরাও তাদের মতো করে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। একসময় ইয়োরোপের স্যুইডেন নরওয়েতে যেভাবে টিউলিপ আর ড্যাফোডিলের ক্ষেতের সামনে সাইকেল লাগিয়ে লোকে সেলফি তলত, ঠিক সেইরকম এই ধানক্ষেতকে ব্যাকগ্রাউণ্ডে রেখে লোকজন সেলফি তুলছে। সেই ভিড়ে বিদেশী লোকজনের সংখ্যাই বেশি। তারা হয়তো বুঝেছে এই মুহূর্তে টিউলিপের থেকে পৃথিবীর ধান গম শস্যর বেশি প্রয়োজন। মহাযুদ্ধের পর মৃত পৃর্বপুরুষ ও কাছের মানুষদের বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্যে টিউলিপের তোড়া দিতে দিতে তারা হয়তো ক্লান্ত হয়েছে। বিদিশা সেই তাঁবু ছাড়িয়ে খানিকটা দৃরে একটা টিলার পাশে তার সম্পাতিকে ভূমিষ্ঠ করে মেইন গেটের দিকে এগিয়ে গেল।
বিদিশার মাথার ভিতর যেন কোনও শেল বিঁধে আছে। ফুলঝরিয়ার মতো সেও যেন আর দুই পায়ে হাঁটতে পারছে না ঠিক মতো। হাতড়ে হাতড়ে আরজান মিনারের সদর গেটে সুরক্ষাকক্ষে গিয়ে বিদিশা থমকে দাঁড়াল। ঘরের ভিতর সুরক্ষকর্মী শশধর ঘোষ অচৈতন্য হয়ে পড়ে রয়েছে। তার ঠোঁটের কোণা দিয়ে সরু থুতু মেশানো রক্তের ফিতে শুকিয়ে এসেছে। ঘড়ি দেখল বিদিশা। সকাল দশটা। লোকটা গতকাল রাত থেকে এখানে পড়ে রয়েছে। অর্থাৎ পুরো একরাত আরজানমিনার অরক্ষিত ছিল। দরজায় আলতো চাপ দিতেই খুলে গেল সেটি। বিদিশা সামান্য টলতে টলতে পাখি পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেল আরজান মিনারের দিকে। ঘড়িতে অগ্রদ্বীপের সংকেত। 'পৌঁছেচি'। সে তো গতকাল। আজ এই সংকেত এতো পরে। কেন! কী হচ্ছে! ভাবতে ভাবতে মিনারের গেটের কাছে পৌছে আবার থমকে গেল বিদিশা।
মিনারের দরজার উপর লেখা "মানুষ বিনে আর কিছু নাই"। তার পাশেই ভিতরে ঢোকার সুরক্ষাকোড যন্ত্র। দেখেই বোঝা গেল এই যন্ত্রে কেউ বারবার কোড অতিক্রম করে মিনারে ঢোকার চেষ্টা করছিল। এর অর্থ, তার দেখা দৃশ্যগুলি নেহাত অমূলক নয়। সুরক্ষাস্তম্ভে হাত রেখেই বিদিশা বুঝতে পারল, অনুপ্রবেশকারী যে বা যারাই হোক, তারা প্রথম দুটো স্তর পার করলেও চুড়ান্ত স্তর পার হতে পারেনি। কী করে পারবে? আরজান মিনার সারা পৃথিবীর প্রাণকেন্দ্র এশিয়া ফাউণ্ডেশন এর নিয়ন্ত্রক কৃত্রিম বুদ্ধিচালিত প্রোগ্রাম। তাকে যদি কেউ করায়ত্ত করে, তাহলে পৃথিবীতে আবার নৈরাজ্য নেমে আসবে। এটাই ছিল বিদিশার মনের ভিতর 'তথাগত' কে ঘিরে তার দ্বিতীয় ভয়, যার কথা সে অগ্রদ্বীপকে বলতে পারেনি। 'তত্ত্বমসি'। মনের ভিতর পরপর তিনবার উচ্চারণ করল সে। পরমহংসযোগে এটি একটি চুড়ান্ত ধাপ। উচ্চারণশেষে বিদিশা দেখল তার মাথার ভিতরের ঘোর কেটে যাচ্ছে। তথাগত কৃত্রিম। ঠিক তেমনই আরজানমিনারের সুরক্ষাবলয়টিও। যেকোনও কৃত্রিম বোধি, সে যতো শক্তিশালীই হোক না কেন, সে গণিতের উপর নির্ভরশীল হবেই।আর যে গণিতের সমাধান থাকে, তাকে ভেদ করবার সূত্রও অবশ্যই থাকে। বিদিশা ভরসা করতে পারেনি। তার মনে হয়েছিল কেউ না কেউ ওই 'তথাগত' যেকোনও মুহূর্তে ক্র্যাক করবেই। করবে বলেই যখন আরজান মিনারের সুরক্ষা বলয় তৈরির চুড়ান্ত আলোচনাসভায় তার ডাক পড়েছিল, সে আর কোনও গাণিতিক সমীকরণের শরণাপন্ন রাখেনি নিজেকে। আরজান মিনারের প্রথম দুটি ধাপ ভেদ করলেও তৃতীয় ধাপটি সরাসরি বিদিশা তার মস্তিষ্কর সঙ্গে সংযুক্ত রেখেছে। এই চুড়ান্ত ধাপ পার হতে গেলে অণুপ্রবেশকারীকে তার মনের ভাব পড়ে ফেলতে হবে। আর বিদিশার মন মানুষের মন। সে ভালোবাসতে জানে। তাই সে গণিত মানে না।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করল বিদিশা। গভীরভাবে মস্তিষ্কতরঙ্গ দিয়ে দিল্লী ও চেন্নাইতে বার্তা পাঠিয়ে দিল। কেন এতক্ষণ আর্জানমিনার অসুরক্ষিত রেখে মানুষ রক্ষী যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হল। বার্তা পাঠাবার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন আদিবাসী রক্ষী এসে বিদিশাকে প্রণাম জানাল। তাদের দেখে সামান্য হেসে বিদিশা বলল।
-এই মিনার শুধুই একটা ঘর নয়। এই মিনার এই বেঁচেবর্তে থাকা অবশিষ্ট মানবসভ্যতার হৃৎপিণ্ড। একে প্রাণ দিয়ে রক্ষা করতে হবে আমাদের।
আদিবাসীদের মধ্যে একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের কঠিন পরীক্ষাও তো পার করা কম কথা নয়। একবারে তা ভেদ করতে না পারলে যে তরঙ্গর বৈদ্যুতিক প্রবাহ বয়ে যাবে আততায়ীর শরীরে, তাতে নিমেষে নশ্বর দেহ ছাই হতে বাধ্য। অথচ আশপাশে কোনও তেমন পদক্ষেপের চিহ্ন নেই। বিদিশাও ভাবছিল। কে বা কারা? ভাবতে ভাবতেই একটি আদিবাসী পাশের বাগানের ঝোপ থেকে একটা আধপোড়া লাল পাড় সাদা আদিবাসী শাড়ি নিয়ে এল। শাড়িটি দেখতে দেখতেই রাষ্ট্রীয় বাহিনী চলে এল পাখিপাহাড়ে। বিদিশা মনে মনে ভাবল। গণিতকে করায়ত্ত করে অস্বীকার করার নাম সভ্যতা। ঠিক যেমন শৈলীকে হস্তগত করে ভেঙে ফেলবার নাম শিল্প। ভাবতে ভাবতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রধান সত্যমকে বিদিশা বলল।
-আপনারা আরজান মিনারের সুরক্ষা তিনগুণ করে দিন। আমি ভিতরে গিয়ে দেখে আসি। সব ঠিক আছে কিনা।
আবার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করল বিদিশা। কয়েকসেকেণ্ড পর দরজা খুলে গেল। ভিতরের অন্ধকার ঘরে নিজে থেকেই আলো জ্বলে উঠল। আর চেনা একটি কণ্ঠস্বর বলে উঠল, "এসো বিদিশা। আমি তোমারই অপেক্ষা করছিলাম। এসো।"
।। পর্ব ৬ ।।
বাচ্চা বেলদার
অগ্রদ্বীপ অনেকক্ষণ চারপাশে কী কী ঘটছে, কিছুই বুঝতে পারেনি। যখন তার জ্ঞান ফিরল, সে দেখল খোলা আকাশের নীচে সে শুয়ে আছে। অনতিদূরে এক প্রকাণ্ড ঈগলপাখির মূর্তি। ঈগলটি প্রাণপণে যেন মাটি আঁকড়ে রয়েছে। মাথার পিছনটা চিনচিন করছিল সামান্য।
অগ্রদ্বীপ ভাববার চেষ্টা করছিল শেষ কী কী ঘটেছে তার সঙ্গে। সেই হাভসন নদী থেকে উঠে আসা অসংখ্য রহস্যময় যোদ্ধা। ওটিম্বো এখন কোথায় কে জানে! ওরা কারা ছিল। উঠতে গিয়ে ঘাড়ের কাছটা টনটন করে উঠল তার। আর ঠিক তখনই একটি অতিচেনা নারীকণ্ঠ খুব কাছ থেকে বলে উঠল।
-এখনই উঠবেন না। আর একটু বিশ্রাম নিন। এই খোলা আকাশ, সবুজ ঘাস আর গরীব মানুষের দিলদরিয়া মন আপনি আপনার প্রথম বিশ্বে পাবেন না।
অগ্রদ্বীপ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তার অনতিদূরে এক শ্বেতাঙ্গী সুন্দরী তন্বী বসে আছে। যদিও তার মুখে চোখে সংগ্রামের কাঠিন্যের চিহ্ন সুস্পষ্ট। তবু তার বরফের মতো নীল দুটি চোখের মণিতে শুধুই শীতলতা নেই, এতোটুকু আশ্রয় রয়েছে যেন। এই মেয়েটিই শেষ মুহূর্তে তাকে ওই রহস্যময় আততায়ীদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।
-আমি এখন কোথায়?
-একসময় দক্ষিণ ম্যানহ্যাটানে এই অঞ্চল ছিল সবচেয়ে পশ। পর্যটকদের এগারো হাজার টাকা টিকিট কেটে ঢুকতে হতো এখানে। হাডসন নদীর পারে এই পার্কটির নাম ছিল 'ব্যাটারি পার্ক'। আমি খুব ছোটবেলায় এখানে একবার খেলতে এসেছিলাম। তখনও মহাযুদ্ধ হয়নি। যাক সে কথা।
অগ্রদ্বীপ গায়ের ধুলো ঝেড়ে উঠে বসে।
-গতকাল আপনি না থাকলে কী হতো কে জানে! কে আপনি?
-আমার নাম এথেনা। মহাযুদ্ধের পর সবহারানো এক সামান্য সাংবাদিক।
এথেনা নামটা চেনা লাগল অগ্রদ্বীপের। কোথায় যেন শুনেছে! ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল তার। 'দ্য অ্যাপলিটিক্যাল' এর সেই আর্টিকেলটা। সারা বিশ্বর উপর এশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লেখা সেই নিবন্ধে এথেনার নাম ছিল।
-আপনি তো চমৎকার বাংলা বলেন?
এথেনা তার বিস্ফারিত নীল চোখ নিয়ে হাডসন নদীর মতোই তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সেই চোখের দিকে তাকালে হয়তো কারো মনে হবে এডগার অ্যালান পোর কোনও রহস্যময়ীর চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। খানিক স্তব্ধ থেকে এথেনা বলল।
-সারা বিশ্বজুড়ে এখন তো একটাই ভাষা। বাংলাভাষা। আগে যেমন ছিল ইংরাজি। ঠিক তেমনই। প্রতিদিন একটা করে ভাষা খেয়ে ফেলছেন আপনারা।
-তা কেন?আমাদের ভাষা তো সহনশীল?
-তাই কী? আপনাদের লিপি আশ্রয় করে যারা কথা বলে, তাদের কথা মনে রাখেন আপনারা? কুড়মিদের ভাষা? রাজশাহীর ভাষা?
-বুঝলাম। আপনি প্রতিবাদী। আপনার লেখা আমি পড়েছি। আপনি তো এশিয়া ফাউণ্ডেশনের বিরুদ্ধে।
-যে কোনও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমি। আগ্রাসন শুধু কেড়ে নিতে জানে।
-হুম।
ব্যাটারি পার্কে একটু একটু রোদ ফুটে উঠেছে। ঈগলের স্থাপত্যটির নীচে লেখা 'ইনটু দাই হ্যাণ্ডস। ও লর্ড।'আতলান্তিকে মহাযুদ্ধের আগে ঘটে যাওয়া বিশ্বযুদ্ধর সময় তলিয়ে যাওয়া ছশো আমেরিকার সৈনিকের প্রতি ভাস্কর আলবিনো মানকার তৈরি স্থাপত্য। মনে মনে ভাবল অগ্রদ্বীপ। কোনও দেশ সভ্য ও অগ্রবর্তী প্রমাণ করতে হলেই মূর্তি বানাতে শুরু করে। মানুষের কথা ভুলে মূর্তি বানানোর ভিতরেই যেন লেখা আছে উন্নতির জয়গাথা। তার দেশ ভারতবর্ষও একদিন মূর্তিতে মূর্তিতে ভরে গিয়েছিল। তারপর মহাযুদ্ধে তারা বিলীন হয়েছে।
-গতকাল ওরা কারা ছিল?
-ইশতারের সাধক। মৌলবাদী শক্তি।
-কিন্তু মৌলবাদী শক্তি তো আমরা মহাযুদ্ধর পর ধ্বংস
করেছিলাম।
এথেনা সকৌতুকে তাকিয়ে থাকে অগ্রদ্বীপের দিকে।
-ধ্বংস করেছিলেন? তাই বুঝি?
-হ্যাঁ। আমাদের 'আরজান মিনার' এখন তো সারা পৃথিবীর নিয়ন্ত্রক। একটা সমূচ্চ
সফ্টওয়্যার যা কোনও মানুষের ইচ্ছাশক্তির অধীনে নয়।
এথেনা হেসে ওঠে অগ্রদ্বীপের কথায়।
-তাই বুঝি? তা আপনার এই মিনারটিকে নিয়ন্ত্রণ ঈরছে কে শুনি? কোনও মহাজাগতিক ম্যামথ?
-মানে?
- মানে এই মিনারটিও তো মানুষেরই তৈরি। নয় কী? আর মানুষের স্বভাবের যে বিবর্তনধর্মী জিন, তার ভিতরে শিকড় গেড়ে বসে আছে মৌলবাদ।
- সকলেই তো মৌলবাদী নন?
- সে সংখ্যা যৎসামান্য। আসলে সব মানুষই ভিতর ভিতর মৌলবাদি। মিল্টন পড়লে দেখবেন পুরুষ মৌলবাদ। এক নারী ফল খেতে চাইবার আকাঙ্ক্ষাই সভ্যতার সর্বনাশের কারণ। ফিরদৌসী পড়লে বুঝবেন দেশপ্রেম,পতাকাও একধরনের মৌলবাদ। আর বেদব্যাস বা মহাভারত পড়লে বুঝবেন নীতিপ্রিয়তা সংস্কারপ্রিয়তাও কতো বড় মৌলবাদী চিন্তা। আপনি কী নামে ডাকছেন সেই মৌলবাদকে, সেটা জরুরি নয়। বামপন্থী মধ্যবিত্ত বাঙলাদেশের প্রাচীনমনস্ক মানুষ পুতুলপুজো বা ঈশ্বর বিশ্বাস না করলেও লেনিন বা মার্ক্স বিশ্বাস করেন। এনারাই তাঁর কাছে দেবমূর্তি। অলঙ্কারপ্রিয় কবি কালিদাসের 'কুমারসম্ভব' বা অ্যারিস্টটলের 'পোয়েটিক্স' এর বাইরে আসতেই চান না কিছুতেই। মৌলবাদী নয়? আর আপনি বলছেন মহাযুদ্ধের পর 'আরজান মিনার' বানিয়ে আপনারা মৌলবাদকে নিশ্চিহ্ন করেছেন? মৌলবাদ তো নিশ্চিহ্ন হবার ছিল না! সে শুধু খানিক স্তব্ধ হয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছে। এটুকুই।
-কী চায় এরা?
-বলছি সে কথা। তবে আপাতত এখানে আর আমাদের থাকা যাবে না। চলুন আমার সঙ্গে।
-আর ওটিম্বো?
-ওকে আর পাবেন না। ওর পরিবর্তন ঘটে গেছে।
-মানে?
-মানে ইশতারের সৈনিক ওকে মৌলবাদী করে ফেলেছে। আপনাদের দেশ আজ পৃথিবী শাসন করছে ঠিকই, কিন্তু তার ভিতরে এখনও কিছু কিছু গহ্বর থেকে গেছে যা সারা পৃথিবীর পক্ষে বিপজ্জনক। বৈজ্ঞানিক বিদিশার প্রমীলা যন্ত্রর মূল নকশা ওদের হাতে এসেছে। আমরা খবর পেয়েছি। চলুন এখন।
-কোথায়?
- আদিরেণ্ডাক পাহাড়ে। এই নদী বরাবর গেলেই দুদিনে আমরা সেখানে পৌঁছে যাব।
-কী আছে সেখানে?
-আমাদের বেস ক্যাম্প। জঙ্গলের ভিতর। চলুন।
হাঁটতে থাকে অগ্রদ্বীপ। চারপাশে মানুষ জন ছেড়ামেরা কাপড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদেশের দারিদ্র্য দেখে অগ্রদ্বীপের মনে হচছিল তার পূর্বপুরুষদের কাছে সে শুনেছিল, একসময় পায়রাডাঙা জনপদও এমনই ছিল। মহাযুদ্ধর পর এই দেশের বড় বড় মূর্তিগুলো সব ভেঙে গিয়েছে। সেখানে তেরপল টাঙিয়ে মানুষ ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে অস্থায়ী ছাউনি করেছে। ম্যানহাটানের সরকার উদ্যোগ নিয়ে হাডসন নদীর উপর বাদা বন আর মাঙগ্রোভ লাগাবার পরিকল্পনা করছে। এথেনা ঠিকই বলেছে। উন্নতি হলে দেশ মূর্তিতে ভরে যায়। আর অনুন্নত দেশ হলে সেখানে আর মূর্তি থাকে না। বরং জড়ো হয় মানুষ।
ছোট ছোট ডুলি করে অগ্রদ্বীপরা হাডসন নদীর গা বেয়ে আদিরেণ্ডাক পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলল। অগ্রদ্বীপ চারপাশের প্রকৃতি, মানুষ ও তার বিপন্নতা দেখতে দেখতেই এথেনার কথাগুলো ভাবছিল। সত্যিই যদি মৌলবাদী শক্তি আবার কায়েম হয় পৃথিবীর বুকে, তাহলে আর এই সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় থাকবে না। মহাযুদ্ধর পর বাতাসে অক্সিজেন কমে গেছে সাত শতাংশ। জ্বালানি নেই। আছে শুধু পায়রাডাঙা ও সুধন্য ফাউণ্ডেশনের ইন্ডিয়াম ১১৬র চালিকাশক্তি। একই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছিল তার মনের ভিতর। সে কেন নিশানা হল ওদের? ভাবতে ভাবতে একসময় তারা ইরি নালার কাছে পৌছে গেল। এই নালা একসময় নিউ ইয়র্ক থেকে পণ্যসামগ্রী বন্দরের দিকে নিয়ে আসতে সাহায্য করত। এখন সে নালা শুধুই মরা সোঁতা। চারপাশে আগাছা জন্মে আছে। এখানে রাতে ছাউনি ফেলতে হবে ঘোষণা করল এথেনা।
এখানে যখন তখন বরফ পড়তে শুরু করে। একসময় হাডসন নদীর জলে বাস করত নীল রঙের মাছ আর অজস্র নীল কাঁকড়া। জলদুষণের পর তারা ইতিমধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়েছে। এখন নদীর লবণাক্ত জল পানের অযোগ্য। এথেনা সহকর্মী রক্ষীদের বুঝিয়ে দিচ্ছিল কীভিবে নজরদারি করতে হবে। দেখতে দেখতে অগ্রদ্বীপের মনে হচ্ছিল এ যেন সেই ধাঙরটুলির ডাইনিবুড়ি আকলুর মা। 'অসময়ের ফসল' যেন। অদ্ভুত প্রাণশক্তি ভিতর ভিতর। মহাযুদ্ধর ঠিক আগে অজস্র সংখ্যা আর যুক্তির মারপ্যাঁচে ভালোবাসা সহমর্মিতা অনুকম্পা হারিয়ে যেতে বসেছিল। মহাযুদ্ধর পর সংখ্যা আর সূচক নতুন করে প্রতিস্থাপিত হতে সেই মানবিক আবেদনগুলো হয়তো এখনও সম্পূর্ণ হারিয়ে যায় নি। 'ইশতার' সম্পর্কে অগ্রদ্বীপ জানে। পৃথিবীর আদিমতম দেবতা। কেউ বলতেন তিনি পুরুষ। কেউ বলেন তিনি দেবী। গিলগামেশে ইশতার একজন ভালোবাসার দেবী। তার শক্তিতে পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে। এই ইশতার আবার যুদ্ধের দেবীও। সুপ্রাচীন সুমেরু সভ্যতায় তাঁর পূজার প্রচলন ছিল। এই ২১৫৭ সালে তার অনুরাগী বা অনুরাগিনী একদল মানুষ যে আবার নতুন করে মাথা চারা দিয়ে উঠবে কে জানত।
এথেনা বাইরের অন্ধকার উপেক্ষা করে তার দুই সহযোদ্ধা মেয়ের সঙ্গে একটা বনমোরগ রোস্ট করতে দিল। অগ্রদ্বীপের সবকিছুই যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। উপরে আকাশে তারা ফুটে উঠছে একেএকে। কিছু খসে পড়া তারা মনের ভিতর কুসম্ভাবনার জন্ম দিচ্ছে। অগ্রদ্বীপ ভাবছিল।সে কি তবে এখন এই এথেনাদের হাতে বন্দী। এদের জবানবন্দি কতোটা বিশ্বাসযোগ্য! ভাবতে ভাবতেই অগ্রদ্বীপ বুঝতে পারল অন্ধকারের ভিতরেই তার পাশে এথেনা এসে বসেছে।
-ভিতরে চলুন। আপনার তাঁবু তৈরি। কী এত ভাবছেন?
-ভাবছি আমিই কেন? আমি তো সাধারণ একটা উদ্ধারকাজে এসেছিলাম।
- এখানকার মুনশি ইশোপা সৈনিকরা কী বলাবলি করছে জানেন?
- কী?
- ওরা বলছে আপনি দেবদৃত। ওদের কাছে আপনি শেষ আশা। আর সেই কারণেই আপনি ইশতার আরাধকদের লক্ষ্য। আপনি জীবিত থাকলে ওদের আন্দোলন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
- কী করলাম আমি?
- জানেন। আমার বুড়ো দাদু ছোটবেলায় গল্প বলত। আপনাদের এশিয়ার কপিলাবস্তু আর গৌতম বুদ্ধর কথা। দাদু বলত এশিয়ার মানুষ যা পারে, তামাম ইয়ুরোপ আমেরিকা তা পারে না।
- কী পারে?
-নিঃস্বার্থ ভালোবাসতে। আপনাদের এশিয়ার মানুষদের ভিতর আবেগটা খুব বেশি।
-আপনার পরিবার?
-মহাযুদ্ধর সময় পেন্টাগনে যখন দুটো পারমাণবিক বোমা আছড়ে পড়েছিল, তখন সেখান থেকে আশপাশের তিন চারটে ছোট জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। আমার পরিবার তেমনই একটি শহরে ছিল।
-ওহ। আমি দুঃখিত।
-দুঃখিত হবার কিছু নেই মিস্টার অগ্রদ্বীপ। আমি তখন কেমব্রিজে জার্নানিজম পড়ছি। সেই কারণে আই ওয়াজ সেভড।
-বুঝলাম। আচ্ছা। একটা কথা বলুন তো। মাত্র একটা মহাযুদ্ধ সব অদলবদল করে ফেলল?
এথেনা তাকিয়ে থাকে অগ্রদ্বীপের দিকে। আকাশের তারার আলোয় তার চোখের কোণা মুক্তোর মালার মতো চিকচিক করে ওঠে।
-কিছু তো অদলবদল হয়নি। যা আপনি দেখছেন, প্রত্যক্ষ করছেন, তার প্রতিফলন হল আপনার দর্শন। মহাযুদ্ধর আগে আপনাদের কাছে আমার দেশ, ইয়োরোপের দেশকে প্রথম বিশ্ব বলে দেখানো হতো। প্রথম বিশ্ব মানেই অনেক অনেক সেনা, যুদ্ধবিমান, রাস্তার মোড়ে রকমফের মনিষীদের মৃর্তি। এইসব দেখিয়ে আপনাদের বোঝানো হতো, এটা প্রথম বিশ্ব। আপনারাও নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিলেন সেসব। একবারও জানতে চাননি এই দাবী কোন ভিত্তিতে? কী আছে এই দেশগুলোতে যা আফ্রিকাতে নেই, এশিয়াতে নেই, লাতিন আমেরিকায় নেই। আসলে ওটা একটা পর্দা। ব্রিটেনে চিকিৎসকরা মাসের পর মাস মাইনে পাচ্ছেন না, জার্মানি, সুইডেন, নরওয়েতে যখন তখন অন্যর বাচ্চা কেড়ে নিচ্ছে রাষ্ট্র শিশুপ্রতিপালনের নাম, আমেরিকায় বেকারত্ব বাড়তে বাড়তে একসময় আত্মহননের চরম শিখর স্পর্শ করছে। আপনারা তথ্য দেখেও দেখেননি। মহাযুদ্ধর পর শুধু বদলে গেল আয়নাটা। এখন আমাদের আপনাদের দেশ, প্রযুক্তির প্রতিফলন দেখিয়ে প্রথম বিশ্ব বোঝানো হচ্ছে। আমরা কেউ বুঝলাম না, বিশ্বর প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হয় না। বিশ্ব আসলে একটাই। এবার চলুন।
অন্ধকার ওক ম্যাপেল গাছের পাতা বেয়ে ঝুরি বরফ খসে পড়ছে পায়ের কাছে। দূরে তাঁবুর দিকে যেতে যেতে অগ্রদ্বীপ এথেনাকে বলল।
-আপনি তো এশিয়া ফাউণ্ডেশনের বিরুদ্ধে?
-কে বলল?
-তাহলে? আপনি কার বিরুদ্ধে? পক্ষেই বা কার?
-আমি মানবতার পক্ষে। মৌলবাদিতা আর সবরকমের আগ্রাসনের বিপক্ষে। এবার চলুন। কাল ভোর ভোর বের হতে হবে ।
অগ্রদ্বীপ ঘাড় নেড়ে এথেনার সঙ্গে তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেল।
।। পর্ব ৭।।
তন্ত্রিমাছত্রি ও জনৌ
অন্ধকার একটু একটু করে কেটে যাচ্ছে আরজানমিনারের
কন্ট্রোলরুমের ভিতর। বিদিশা প্রথমে একটি ছায়ামূর্তি দেখতে পেল। ক্রমশ সেই
ছায়ামূর্তি বদলে গেল চেনা এক মানুষে। কপালের বাঁদিকে পরিচিত ক্ষতচিহ্ন।
প্যালেস্টাইনে কয়েকজন হামাস শরণার্থীকে বাঁচাবার সময় বোমার শেলে তৈরি সেই ক্ষত।
হাতে দণ্ড। কেউ বলে ওটা একটা জয়সাটিক। শূন্যের ভিতর একটা সার্কিট তৈরি করে ভূপর্যটন
নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র। পরণে পরিচিত গেরুয়া। মুণ্ডিত মস্তক। হয়তো ভাদুড়ি মশাই
একেই দেখেছিলেন স্বপ্নে। বা হয়তো দেখেননি। দেখা আর অদেখার ভিতর কেটে গেল
চুয়াত্তরটি বছর। তবু বিদিশা তাকে চিনতে ভুল করল না।
-গানহী বাওয়া! আপনি এখানে?
গানহী বাওয়া হাসলেন সামান্য।
-আমি গানহী বাওয়া নই বিদিশা। আমি আরজানমিনারের মূল চালিকাশক্তি। মূল হার্ডওয়্যার প্রোগ্রাম 'বীরবাহু'।
কিন্তু এ কী করে সম্ভব! এটা বিদিশার আরজানমিনারে প্রথম প্রবেশ নয়। কিন্তু এর আগে 'বীরবাহু'কে সে এক বিরাট মহীরূহের আকারে দেখেছিল। এই রূপান্তর কীভাবে হল? তবে কি কেউ তাদের এই সিস্টেম 'ওভাররাইড' করে ফেলেছে। গানহী বাওয়া আসলেন।
-মিথ্যে ভাবছ বিদিশাই। আরজানমিনারে তোমার শেষ দিনের উপস্থিতির কথা ভাবো। এশিয়া ফাউন্ডেশনের সমস্ত জনপ্রতিনিধির সম্মতিতে তুমি তোমার এই মিনারের পঞ্চম ও শেষতম সুরক্ষাবলয় তৈরি করেছিলে। মনে পড়ে?তোমার সেই সিদ্ধান্তের ফলেই আজ মিনার ও বিশ্বসার্বভৌমত্ব রক্ষা পেয়েছে।
বিদিশার সেদিনের কথা মনে আছে। চুড়ান্ত সেই সুরক্ষাস্তরে তার মস্তিষ্কের তরঙ্গকে পরমহংসযোগে সে যুক্ত করেছিল সিস্টেমের 'তথাগত' সফ্টওয়্যারে।
-কিন্তু, সে তো...
-ভেবে দেখ বিদিশা। এই গভীর সঙ্কটের সময়ে তুমি কি আমাকেই মন থেকে দেখতে চাইছিলে না? তোমার মনের ভিতর পুঞ্জীভূত জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর খুঁজতে আমাকেই তো ডাকছিলে। নয় কি? ধরে নাও আমিই গানহী বাওয়া। তোমার গুরুমহারাজ।
বিদিশা ঘাড় নাড়ে। বীরবাহু সঠিক বলছে। এই মুহূর্তে গুরুদেব ছাড়া আর কারো কাছে তার প্রশ্নর উত্তর নেই। প্রণাম করে বিদিশা অবশেষে বলে।
-ওরা কারা ছিল? কে বা কারা?
-নেপথিস ও তার এশিয়া ইউনিটের যোদ্ধারা।
-কে এই নেপথিস?
-সিরিয়ার আইসিস জঙ্গিদের আস্তানায় বেড়ে ওঠা এক নাবালিকা। যে নাবালিকা শিশু বয়স থেকে যৌনদাসী হিসেবেই বড় হয়েছে। মৌলবাদ তাকে শুধুই যোনি শিখিয়েছে। কিন্তু সে তার বুদ্ধির মেধায় সেই শৃঙ্খল ছিন্ন করে তার পরবর্তী স্তরে পা রাখতে পেরেছে। আজ সে ইশতারপন্থীদের সবচেয়ে বড় ও ভয়ানক হাতিয়ার।
-ইশতারপন্থী! কিন্তু মহাযুদ্ধের পর আমরা তো মৌলবাদের অবসান ঘটিয়েছিলাম?
গানহী বাওয়া হেসে ওঠেন।
-ও তোমাদের মনের ভুল বিদিশা। মৌলবাদ ধ্বংস হয় না। থেকে যায়। প্রকৃতির ভিতর থাকলে মৌলবাদ থাকবেই। যে প্রমিলাযন্ত্র নিয়ে তুমি কাজ করে চলেছ, সেই যন্ত্র কী করে। মৌলবাদী প্রকৃতির বিদ্রোহ ঘোষণা করা জিনগুলিকে আবার পূর্বাবত মৌলবাদী করে তোলে। নয় কি? মৌলবাদের বিরুদ্ধে আরোপিত আরেক মৌলবাদ। ভুল বললাম।
বিদিশা মাথা নাড়ে। বাওয়া ঠিকই বলছেন। প্রকৃতি মানুষের ক্রোমোজোমের সংখ্যা তেইশ জোড়ে বেঁধে রেখেছেন। তার এদিকওদিক হলেই বিপর্যয়। এও তো একধরনের মৌলবাদ। বটেই তো! কিন্তু ইশতারপন্থী! বিদিশা স্মৃতির অতলে তলিয়ে দেখেছে। সুমেরুর এই প্রাচীন দেবীর কোনও অনুগামী দল আজও পৃথিবীতে আছে বলে তার জানা ছিল না।
-কী চায় ওরা?
-পরিবর্তন।
কিন্তু মহাযুদ্ধ ও পাশ্চাত্যশক্তির আধিপত্য ধ্বংসের পর আরজানমিনার স্থাপনই তো ছিল পরিবর্তনের অন্যতম সূচক। গানহী বাওয়া বিদিশার মনের কথা বুঝতে পারে।
-পরিবর্তনকাঙ্খা তো ক্ষতিকর নয়।দ্বন্দ্ব ও পরিবর্তনচিন্তা ছাড়া বিকাশ অসম্ভব। এখন এই দ্বন্দ্ব বৈর দ্বন্দ্ব না অবৈর দ্বন্দ্ব, সেকথা ভাবতে হবে আমাদের। তোমার মস্তিষ্কের ভিতরেও এই অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে বলেই নেপথিস আজ তোমার সুরক্ষাস্তর ভেদ করতে পারেনি। এই প্রচেষ্টা বহুদিন ধরে চলে এসেছে। তোমার মাথার ভিতর চিন্তা ক্র্যাক করার চেষ্টা। আরজানমিনার প্রতিষ্ঠার বহুবছর আগে থেকেই। প্রতিটি প্রচেষ্টা তোমার মাথায় একটি অন্তর্ভেদী তরঙ্গ নিক্ষেপ করেছে, যা তুমি প্রতিরোধ করেছ ঠিকই, কিন্তু ফুলঝরিয়ার মতোই সেই প্রতিরোধ তোমাকে বিপন্ন করেছে।
বিদিশার হঠাৎ মনে পড়ে যায়। অক্টারলোনি মনুমেন্টের ভগ্নস্তুপের সামনে কথা বলতে বলতে কয়েকবছর আগে তার সেই হঠাৎ মূর্ছা যাওয়া, বা ঘনঘন মস্তিষ্কে তীব্র ব্যথার অনুভূতি তাহলে নেহাতই কাকতালীয় নয়।
-ওরা তবে জানত আমার চিন্তা তরঙ্গ হবে আরজানমিনারের শেষ প্রতিরোধ? সময় এগিয়ে জানত?
-জানতোই তো। মহাযুদ্ধের পর আমরা জেনেছি, সময় প্রতিগমন কোনও সময়যন্ত্র দিয়ে হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। সময় পরিভ্রমণ একমাত্র সম্ভব চিন্তার তরঙ্গর মাধ্যমে।
-এই অন্তর্দ্বন্দ্বর পরিণতি কী?
গানহী বাওয়া হাঁটতে হাঁটতে কন্ট্রোলরুমের ভিতর চলে আসেন। হাত দিয়ে বিদিশাকে অনুসরণ করতে ইঙ্গিত করেন। বিদিশাও সেইদিকে এগিয়ে চলে। কন্ট্রোলরুমের মধ্যিখানের চেয়ারে বিদিশাকে বসতে বলে গানহী বাওয়া। বিদিশা বসলে আশপাশের মনিটরে ফুটে ওঠে ছবি। বীজ ও গাছের ছবি। গানহী বাওয়া বলে চলেন।
-পরিবর্তন মানেই কি বিকাশ? ভেবে দেখ বিদিশা। ডিম থেকে মুরগীর জন্ম হলো। তাতে ডিমের খোলা, ডিমের কুসুমের মৃত্যু ঘটল। এই পরিবর্তনে একটি প্রাণীর বিকাশ ঘটল। এও এক পরিবর্তন। আবার ডিম সিদ্ধ করে তা খাবারে বদলে গেলে সেখানে মুরগির প্রাণসম্ভাবনা লুপ্ত হলো। ডিমের এও এক পরিবর্তন। এখানে কিন্তু বিকাশ নয়, বিনাশ রয়েছে। চারপাশে চেয়ে দেখ বিদিশা।
বীজ থেকে চারাগাছ উৎপন্ন হওয়াটাও একটা পরিবর্তন। সেই চারাগাছ একসময় বীজের সমস্তটুকু নিঃশেষ করে তার খোলটিকে ধ্বংস করে বেড়ে ওঠে। যে বীজে অঙ্কুরের সম্ভাবনা লালিত হয়, অঙ্কুর তাকেই প্রথম বিনষ্ট করে। তোমাদের এই আরজানমিনার আসলে একটা বীজ। এই বীজের ভিতর আগামী সভ্যতার মুক্ত শ্রেনীহীন এক সমাজের সম্ভাবনা অঙ্কুর লুকিয়ে আছে। কী?
বিদিশার দুই চোখ ছলছল করে।
-তবে কি একদিন সেই সমাজগঠনে এই মিনার ধ্বংস হয়ে যাবে?
-যাবেই তো। সেটাই তো কাম্য। মহাযুদ্ধের পর যা সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রতিবিম্ব, উত্তরণ নয়। উত্তরণের পথ এখনও বাকি। সেই উত্তরণের পথে হাঁটতে গেলে এই আরজানমিনারকে ধ্বংস হতেই হবে একদিন। কিন্তু...
-কিন্তু?
-সঠিক মুহূর্তে বিদিশা। আমাদের পাখির ডিমের কথা ভুললে চলবে না। এসময় প্রস্তুতির। সতর্ক থাকতে হবে যাতে এই অন্তর্দ্বন্দ্ব বিনাশ ডেকে না আনে।
-কারা এই ইশতারপন্থী?
-ধর্ম নিয়ে মাতামাতির যুগকে আজ আমরা 'ধর্মান্ধ মধ্যযুগ' বলেছিলাম। আজ থেকে দেড়শো বছর আগে পৃথিবীর সমাজবিজ্ঞানীরা একে 'আধুনিক' যুগ বলে ভুল করেছিল। মহাযুদ্ধর পর যখন সেই যুগের আপাত অবসান ঘটল ও প্রতিবিম্ব বিশ্বর স্থাপন ঘটল, তখন আগের সেই নানান মৌলবাদী ধর্মাবলম্বী একত্রিত হয়ে ইশতারপন্থী হল। তারাও চায় আরজানমিনারের পরিসমাপ্তি। কিন্তু তাদের লক্ষ্য 'বিকাশ' নয়, 'বিনাশ'।
-বাওয়া। আমি এখন কী করব?
-পরিস্থিতি ভালো নয় বিদিশা। ম্যানহাটানে অগ্রদ্বীপের শান্তিপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।ওর ওপর ইশতারপন্থী মৌলবাদীরা আক্রমণ করেছে। সে এখন নিরুদ্দেশ। জীবিত না মৃত কে জানে! তবে এখবর পায়রাডাঙ্গার 'সুধন্য ফাউণ্ডেশনে'র কেউ জানে না। তোমার কাজ এই 'ফাউণ্ডেশন'এর ভারসাম্যরক্ষা করা। আরজানমিনার ফতোয়া দিচ্ছে। যতক্ষণ অগ্রদ্বীপের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, সুধন্য উদ্বোগের সমস্ত প্রশাসনভার তুমি সামলাবে। এই মুহূর্তে পায়রাডাঙার 'ইণ্ডিয়াম ১১৬' মাইনগুলি রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
-আর?
-আরজানমিনারের রক্ষক আদিবাসী টুডু, বোরো, জারোয়া ও রাষ্ট্রীয় রক্ষাবাহিনী সত্যমকে নেতৃত্ব দিয়ে মিনারের পক্ষে একটি বিকল্প দল তৈরি করো। রিমঝিমকে নিয়ে নাও। ওর মারিওপলের দগদগে স্মৃতিগুলো আজও জীবিত।
-কিন্তু এও কী একধরনের মৌলবাদ নয়? মৌলবাদকে আটকাতে মৌলবাদ?
বিদিশার প্রশ্নে অদ্ভুত রহস্যময় হাসেন গানহী বাওয়া।
-তোমার এই প্রশ্নের উত্তর তুমি অবশ্যই পাবে বিদিশা। তবে এখন নয়। আপাতত ধরে নাও তাইই। কারণ এই মুহূর্তে এই সমস্যার কাঙ্ক্ষিত সমাধান মৌলবাদ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারবে না তুমি। ভালো থেকো। আরজানমিনার অক্ষুণ্ণ থাকলে আমাদের আবার দেখা হচ্ছে।
আটমাস আগে গানহী বাওয়া একটি ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। তাই তিনি খাতায় কলমে আজও জীবিত। মিনার থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বিদিশার চোয়াল শক্ত হলো। মিনার লক করে বের হতেই সত্যম তাকে স্যালিউট করল। বিদিশা সুরক্ষা আরও বাড়িয়ে দিতে বলল মিনারের। আর পায়রাডাঙায় তার সঙ্গে সুলেমানকে যতো শীঘ্র সম্ভব দেখা করতে বলল।
রিমঝিমের পূর্বপুরুষদের বাস যেমন ছিল মারিওপলে, সুলেমানের বুড়ি ফুফার ফুফা ছিল রোহিঙ্গা অধ্যুষিত আরাকানে। পরে তারা চলে আসে বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হিসেবে। সেখানেই দুই পুরুষ। সুলেমানের জন্ম হয় বাংলাদেশের চট্টগ্রামেই। তারপর মহাযুদ্ধের পর সেও বৃহত্তর এশিয়াবাসী। এখানে আলাদা করে কারোকে কোন দেশের, চিহ্নিত করা কঠিন। সকলেই যেন ঘরছাড়া, পদবিহারা। উদ্বাস্তু।
বিদিশার আলাদা করে সুলেমানকে তলব করার কারণ ছিল। সুলেমান এইসময়ের একজন দক্ষ ট্র্যাকার। গেল কিছু দিন কে বা কারা এশিয়া ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে, তা যন্ত্র দিয়ে বের করা একমাত্র সুলেমানের পক্ষেই সম্ভব। সম্পাতিতে উঠতে উঠতে কতোগুলো চিন্তা ঘিরে ধরছিল তাকে। অগ্রদ্বীপের ওপর আক্রমণ হবে, একথা সে তো জানত। তবু জেনে তাকে কেন পাঠালো আমেরিকা? তবে কি মনে মনে সেও নিয়তিবাদী হয়ে উঠল। গানহী বাওয়া ফিরে যাবার সময় দ্বান্দ্বিক দার্শনিকদের সেই অমোঘ সূত্র মনে রাখতে বলেছেন বিদিশাকে।'পরিমাণ থেকে গুণ। আর গুণ থেকে পরিমাণের ভারসাম্য ভুলো না বিদিশা।' আরজানমিনার ধ্বংস হলে সভ্যতাকে আরেকটা মহাযুদ্ধর দিকে ঠেলে দেবার সাহস আর কোনও কূটনীতিবিদের নেই। মহাযুদ্ধর পর পৃথিবী থেকে সমস্ত রঙ মুছে গেছে। সারা পৃথিবী যেন শুধুই সাদা কালো আর খয়েরি ধ্বংসস্তূপে মোড়া। পরিমাণের সেখানে খামতি নেই। বরং খামতি রয়েছে গুণে। সাদা কালো সেপিয়া ঢঙে পৃথিবীর বুক থেকে যেন সব রঙ হারিয়ে গিয়েছে। আরজানমিনারকে রক্ষা করতে পরিমাণগত সুরক্ষা দেখবে সত্যম। আর গুণ প্রত্যক্ষ করবে সুলেমান। এই সব ভাবতে ভাবতেই বিদিশা সম্পাতি চালু করে দিল। এখনই তাকে ফিরতে হবে কৃষ্ণনগর।
কৃষ্ণনগরের ফিরে অবশ্য রিমঝিমকে দেখে খানিকটা নিশ্চিন্ত হল বিদিশা। মেয়েটা প্রমীলাযন্ত্র সুরক্ষিত রেখেছে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকতে বিদিশা তাকে আরজানমিনারের বিপদের কথা বলল। বলল নেপথিসের কথাও। নেপথিসের কথা শুনে রিমঝিম কেমন আনমনা হয়ে গেল। তবে কি নেপথিসকে চেনে রিমঝিম। আরজান মিনারের বীরবাহু গানহী বাওয়ার আদলে কিন্তু এই রহস্যময়ীর পরিচয়সংক্রান্ত কোনও তথ্যই দিতে পারেনি। বেসমেন্টে চ্যিউইং গাম চিবাচ্ছিল মদন। মাঝেমাঝে মনে হয় এই 'মদন' হবার স্বপ্নই হয়তো দেড়শো বছর আগেকার বাংলার যুবসমাজ দেখেছিল। চারপাশে কী ঘটছে, বেখেয়াল। শুধু ভোগ ভোগ আর ভোগ। বিরক্ত বিদিশা তার কক্ষে উঠে এল। মুখে চোখে জল দিয়ে টেবিলে হাত রেখে ভাববার চেষ্টা করল। কে এই নেপথিস? এই ধূসর গোলকে আবার নতুন করে আগুন জ্বালাতে চাইছে কে? কার হয়ে কাজ করছে সে ?ভাবতে ভাবতে ভাবনাগুলোকে একমুখীন করতে চাইছিল সে। হঠাৎ বিদিশার কানের ভিতর স্পষ্ট এক নারীকণ্ঠ বলে উঠল।
-বলো বিদিশা। কী জানতে চাও?
-কে তুমি?
-কেন? যাকে তুমি খুঁজছ?
-নেপথিস!!
-ঠিক তাই।
-কী চাও তোমরা?
-কেন? গানহী বাওয়া বলল না তোমায়? পরিবর্তন।
কারেন্ট খেয়ে ওঠার মতো শিউরে উঠল বিদিশা। তবে কি 'বীরবাহু' সফ্টওয়্যারটা 'হ্যাক' করে ফেলেছে ওরা? এই স্বর কীভাবে শুনতে পাচ্ছে সে?
-মস্তিষ্ক তরঙ্গ এক হয়ে গেছে আমাদের বিদিশা। মাঝখানে শুধু একটা সরু ফিতে।
-তোমার তরঙ্গ আমার সঙ্গে মিলবে কীকরে নেপথিস? তুমি আর আমি যে বিপরীত।
-মিলবেই তো। তোমার বাওয়া কী বলল? মৌলবাদ বনাম মৌলবাদ। এই তো সার্থক অন্তর্দ্বন্দ্ব। ঠিক না?
-না। তুমি জানলে কী করে আরজানমিনারের ভিতরের কথা?
-বাহ রে! জানব না? ওই মিনারে যা যা শুনেছ, সব তো আমরা যা তোমাকে শোনাতে চেয়েছি, তাই।
-মানে?
-মানে আরজান মিনার আমরা দখল করে নিয়েছি বিদিশা। ওই দখলদারির তুরুপে শেষ তাস ছিল তোমার চিন্তাতরঙ্গ বিদিশা। ওটা সমাধান হতেই ঘটনাটা জলভাত হয়ে দাঁড়ালো।
-অত সহজ নয়। আমি সতর্ক করছি এক্ষুণি...
-পারবে না। পারবে না বিদিশা। তুমি আর আমি আসলে এক। আমরা দুজনেই ভিতরভিতর মৌলবাদী। তুমি সেটা দেখাও না। আমি দেখাই।
-মিথ্যে। মিথ্যে।
বিদিশা উঠতে গেল। কিন্তু পারল না। তার মাথার ভিতর এক তীব্র যন্ত্রণা তাকে অচল করে দিল। ধপ করে টেবিলের পাশেই মেঝেতে পড়ে গেল সে। তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। তারপর ধীরে ধীরে ঘন কালো অন্ধকার নেমে এল চারদিকে।
সামুয়রের বোন
ছাইরঙের ডানাওলা বকদের সাদা
বকেরা দেখতে পারে না। ভাদুড়ীবাবু এই উপমা এনেছিলেন এই সত্য বোঝাতে যে বাবুভাইয়ারা ঠিক একই যে কারণে
তাৎমাধাঙ্গরদের সঙ্গে থাকতে পারে না। তারই মধ্যে হঠাৎ ঢোঁড়াই রচয়িতা নিয়ে এলেন এক
আশ্চর্য চরিত্র। 'ফুটফুটে ফরসা, নীল চোখ, কটা চুল, মুখে বিড়ি, চোখেমুখে কথা, দরকারের চাইতে বেশি চটপটে;। তার আসল নাম স্যামুয়েল। চলতি মুখফিরতি নাম 'সামুয়র'। তার শুয়োরের কুচির মতো খাড়া অবাধ্য
চুল। তার বাপ জেমসন সাহেব নীলকুঠিপড়তি যুগে পাঁউরুটি কারখানা খুলে শেষমেশ স্নানের
ঘরে ক্ষুর দিয়ে আত্মহত্যা করে 'গলাকাটা সাহেব' বনে যায়। সেই সামুয়রের কোনও বোন আদপে ছিল কিনা সত্যিই জানা নেই, তবে যদি বা থাকত, বা ভাদুড়ীমশাই তাকে তাঁর কল্পনা ও মেধাশক্তিতে সৃষ্টি করতেন, তাহলে তার উপস্থিতি অনেকটাই হতো নেপথিসের মতো।
যদিও নেপথিসের সঙ্গে সামুয়রের অনেক মিল থাকলেও বেশ কিছু অমিলও রয়েছে বৈকী। নেপথিসের বাবা 'গলাকাটা সাহেব' কিনা, সেকথা সে জানে না। যে সময় প্রত্যঙ্গপাচারকারী দল যুদ্ধকালীন অরাজকতার সুযোগ নিয়ে তাকে তার ঘর থেকে তুলে আনে, সে সময় তার মাত্র দুই বছর বয়স। এতোগুলো বছরে মানুষের মস্তিষ্কের প্রভূত বিবর্তনের পরেও শৈশবের প্রথম দুই একবছরের স্মৃতি আজও মেঘাচ্ছন্নই থেকে যায়। নেপথিসের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তার বাবা কে? মা কে? নেপথিস জানে না। প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেত প্রথম প্রথম। সে হন্যে হয়ে তাদের উত্তর খুঁজত। তারপর ধীরে ধীরে সে সেই প্রশ্নের পিছনে ধাওয়া করা বন্ধ করে দিল। সঙ্ঘ তাদের শিখিয়েছে। এই পৃথিবী 'ইশতার'এর পৃথিবী। তারা সবাই ইশতারের সন্তান। ইশতার তাদের মাটি থেকে গড়ে তুলেছেন। সেই মাটিতেই তাকে একদিন বিলীন হতে হবে। নেপথিস তাই আজ নিজেকে বুঝিয়ে চলে। ইশতারই তার পিতা। ইশতারই মাতা। চোখ বন্ধ করলে সে শুধু দুটো কালো হাত তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে। সেই হাতের মালিক 'গলাকাটা' কিনা নেপথিস জানে না। সামুয়রের মতোই ফুটফুটে তার গায়ের রঙ। কিন্তু নেপথিস তার মতো চোখেমুখে কথা বলে না। তার কথোপকথন মনের ভিতর। মনের ভিতরের তরঙ্গ দিয়ে সে আশপাশের মানুষের মনের তরঙ্গস্রোতের অনুরণন সম্পন্ন করতে পারে। সেটুকু পারে বলেই তাকে সঙ্ঘ এতোটা মান্যতা ও গুরুত্ব দেয়।
তবে সামুয়রের মতো তারও নীল চোখ, কটা চুল, চটপটে ভঙ্গি আর অবাধ্য স্বভাব। আর
তার জীবনে 'গলাকাটা সাহেব'এর স্মৃতি না থাকলেও আছে এক অসহনীয় দুঃস্বপ্ন। লেবাননের
স্মৃতি। দুই পা শিকল দিয়ে বাঁধা। একটি একটি দানব ঢুকে আসছে তার ভিতর। মিশে যাচ্ছে
তার রক্তে আর এক অদ্ভুত যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠছে তার সমস্ত শরীর। প্রথম প্রথম নেপথিস
গুনছিল সেই দানবের সংখ্যা। এক দুই তিন চার। ক্রমশ সে সংখ্যা হারিয়ে ফেলল। পরের
দিকে দানবরা দয়াশীল হয়ে উঠেছিল। তাই তার দুই পা তারা আর শিকলে বেঁধে রাখত না। প্রথম
প্রথম সে দিন গুনত। তারপর সে দিনের গুণতিপথ হারিয়ে ফেলল। দানবেরা রোজ আসত।
প্রতিদিন প্রতিরাত। আলাদা করে নেপথিস আর কোনও শিকলের উপস্থিতির প্রয়োজন বোধ করত
না। তার শরীর থেকে যন্ত্রণা মুছে গেছে। 'না' বলবার শক্তি মুছে গেছে। সে যেন এক যন্ত্র। দেয়ানেয়ার
পণ্যদ্রব্য। তার হাতবদল আদানপ্রদান যেন নারীর চিরকালীন ভবিতব্য। সব ধর্ম বর্ণ
জাতি। অন্ধকূপকেই জীবনের গন্তব্য বেছে নিয়েছিল নেপথিস। ঠিক তখনই ইশতারপন্থীরা
লেবানন আক্রমণ করল। নেপথিসের জরায়ু বাদ দেওয়া হয়েছে। কমনীয়তার সমস্ত প্রসাধন বাদ
দিয়ে তাকে রোবট তৈরী করতে চেয়েছিল লেবাননের যুদ্ধক্ষ্যাপা শাসক। ইশতারদের আক্রমণে
মুক্তাঞ্চল স্থাপন হলে অনেকদিন পর নেপথিস সূর্য দেখেছিল। প্রাণভরে সেই সূর্যের আভা
সে মেখে নিয়েছিল তার সমস্ত গায়ে। তারপর একদিন মহর্ষি তাকে দীক্ষা দিলেন। কে এই
মহর্ষি?
কেউ জানেনা। কেউ কেউ তাকে আদিগুরু বলে। তার মুখ ঢাকা থাকে কালো কাপড় দিয়ে। কতো
বয়স মহর্ষির, একথাও ইশতারপন্থীদের অজানা। তবে
মহাসমারোহের সময় ইশতারপন্থীরা জানে, একমাত্র মহর্ষিই পারে প্রতিটি মস্তিষ্কতরঙ্গকে এক সূত্রে বেঁধে বার্তা দিতে।
সেই বার্তা এক এবং একমাত্র ইশতারের বার্তা। মহর্ষি একদিন নেপথিসকে বুঝিয়েছিল শরীর নয়, তার আসল শক্তি তার মস্তিষ্কতরঙ্গে। সেই দৈর্ঘ্যে সে
আরজানমিনার আক্রমণ ঈরেছিল মহর্ষির নির্দেশেই। চুড়ান্ত স্তরে গিয়ে হোঁচট খেয়েছিল
সে। বিজ্ঞানী বিদিশা সুরক্ষার শেষ বেষ্টনী নিজস্ব মনতরঙ্গের সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন।
সেই বন্ধনী খুলতে গেলে বিদিশার সঙ্গে তার এমন কোনও যোগসূত্র পেতে হবে যা তাদের
দুজনকে সমতায় আনবে। নেপথিস বিদিশাকে অনুসরণ করছিল।ইশতারফৌজের গুপ্তচরেরা নজর রাখছিল
তার প্রতিটি পদক্ষেপের। অবশেষে সেই যোগসূত্র পাওয়া গেল। একটি সংকটময় তরঙ্গদৈর্ঘ্য
যা মাঝেমাঝেই বিদিশা আর নেপথিসের অবচেতনকে নাড়িয়ে তোলে। একটা সংশয়। ভয়। দুর্বলতা।
নিজের ভিতরের মমত্বকে উপেক্ষা না করতে পারার দুর্বলতা!
বিদিশার সঙ্গে কথা সেরেই নেপথিস আবুতাহেলকে বার্তা দিল। আরজানমিনার হ্যাক করে ডাটাবেস বের করে আনতে হবে। এই মুহূর্তে এখানে আর তেমন কোনও কাজ নেই। তাছাড়া সেদিন আরজানমিনার আক্রমণের সময় প্রতিরক্ষাবাহিনী ও বিদিশা হঠাৎ চলে আসায় পালাতে হতো তাকে। সেই সময়ে লাল পাড় সাদা শাড়ি কোনও মতে ছেড়ে পালাবার সময় পাথরে ঠোক্কর খেয়ে পড়ে যাওয়ায় সামান্য চোট লেগেছে তার। এই মুহূর্তে তার শুশ্রুষার প্রয়োজন।
মেদিনীপুরের মকরামপুর শহরে
পূর্বভারতের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল। সেখানকার শল্যবিভাগের প্রধান ধনঞ্জয় মাহাত
ইশতারপন্থী। আবু তাহেল যেমন এই অঞ্চলে সশস্ত্র বিপ্লবের দিকটি দেখছে, ধনঞ্জয় দেখছে স্বাস্থ্য বিষয়টি। এখনই তাকে মকরামপুর যেতে
হবে। নেপথিস দেরি করল না।
স্থানীয় পোশাক পরলে নেপথিসকে বেশ লাগে। কে বলবে সে একহাতে গুলি চালিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে পারে! মহাযুদ্ধের পর এখন মফসসলেই সভ্যতার সমস্ত চালিকাশক্তি লুকিয়ে। আরজানমিনার থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ছোটাগুমা স্টেশন। সেখান থেকে সৌর ও ইন্ডিয়াম চালিত ট্রেনে মকরামপুর পৌছোতে লাগবে সতেরো মিনিট। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নেপথিস তেমনই এক ট্রেনে উঠে ফাঁকা সীট দেখে বসে পড়ল। বসতে গিয়ে তার পরণের ঘাঘড়াটি সামান্য হাঁটুর উপর উঠে গিয়েছিল। তার উন্মুক্ত উরুর দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একজন মাঝবয়সী লোক। মনেমনে ভাবে নেপথিস, 'দ্যাখ। দ্যাখ হারামি। প্রাণখুলে দ্যাখ ইতর।' সেই ঘিনঘিন করা দানবগুলো যেন এক সেকেন্ডের জন্য মনে পড়ে গেল তার। মহাযুদ্ধের পর সভ্যতার যতোই পরিবর্তন বা মিররিং হোক, পুরুষের দৃষ্টি যেন কিছুতেই পালটাবে না। একঝলক এই অবধি লিখে আমার মনে হল, সামুয়র নয়। নেপথিসের দরকার ছিল একটি বোন বা দিদির। যাক সে কথা। চলযান ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলেছে মকরামপুর। নেপথিস তার কবজির ঘড়িতে দেখছিল জেনারেল আবু তাহেল আরজান মিনারের নথি বের করছে একে একে। নথিতে স্পষ্ট এশিয়া ফাউন্ডেশনের সাম্রাজ্যে কোথাও কোথাও বিদ্রোহের অঙ্কুর লুকিয়ে আছে।
মহাযুদ্ধের পরেও আরাকান বা কিন্দাহার শান্ত হয়নি। সেখানকার মৌলবাদী সংগঠনদের
চিন্তার ধরণ ইশতারপন্থীদের কাজে আসতে পারে। যুদ্ধবিধ্বস্ত চিনের ভিতর আগ্রাসী
তাইওয়ানের আধিপত্যর বিরুদ্ধে সংগঠন তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞানী বিদিশা ও
রাষ্ট্রের সুরক্ষাবাহিনী কী হাত গুটিয়ে বসে থাকে। কীভাবে ইশতারপন্থীরা রুখে দেবে
তাদের প্রতিরোধ। ভাবতে ভাবতে মকরামপুর পৌছলো সে।
মকরামপুর হাসপাতালে ধনঞ্জয়কে পেতে
অসুবিধা হলো না নেপথিসের। কৃত্রিম বুদ্ধির প্রয়োগ স্বাস্থ্যব্যবস্থায় শুরু হবার পর
থেকে রোগীপ্রতি চিকিৎসকদের অনুপাত এখন অনেকটাই কমে এসেছে। এতে রোগীরা একদিকে যেমন
অনেক বেশি সময় ও মনোযোগ পাচ্ছেন, অন্যদিকে তেমনই
চিকিৎসকও তার কাজে অনেক বেশি করে মন দিতে পাচ্ছেন। নেপথিস নিজের নাম আঞ্চলিক ভাষা
নিয়ে 'লক্ষ্মী' দিয়েছিল। জরুরি
বিভাগে হাসপাতালের রোবটিক বাহু তাকে পরীক্ষা করে ডাক্তার ধনঞ্জয় মাহাতর ঘরে পাঠিয়ে
দিল। ধনঞ্জয় একটি ছোট বাচ্চার পেট স্ক্যান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। নেপথিসকে আসতে দেখে
বসতে বললেন। তারপর বললেন।
-ইশতারের রহমত দেখ।
বিবর্তন হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্কের। এই ছেলেটির মস্তিষ্কে মোট চারটি টেম্পোরাল লোব।
যদিও প্রাথমিক রোগের উপসর্গ খিঁচুনি। তবু চারটি টেম্পোরাল লোবের অর্থ বুঝতে পারছ।
এই বাচ্চাটি বড় হলে কতোটা মেধাসম্পন্ন হবে।
নেপথিস বুঝতে পারে। ইশতার সঙ্ঘে
প্রশিক্ষণের সময় তাদের মনোযোগ দিয়ে মানুষের শারীরবিদ্যা পড়ানো হয়েছে। মস্তিষ্কের
টেম্পোরিল লোব মানুষের সৃষ্টিশীল ভাবনা ও তার প্রয়োগচিন্তার জন্ম দেয়। সাধারণত
মানুষের মস্তিষ্কে দুটি টেম্পোরাল লোব থাকে। এই চারটি লোব থাকার ঘটনা যুগান্তকারী
নিঃসন্দেহে।
স্ক্যান দেখার পর ডাক্তার
ধনঞ্জয় মাহাত নেপথিসের পায়ের চোট দেখলেন।
-সামান্য কার্টিলেজে
চোট। ঠিক হয়ে যাবে তিন দিনে। অবশ্য আমাদের হাতে প্রমীলাযন্ত্রটি এসে গেলে এইরকম
চোট সারাতে লাগবে কয়েক সেকেন্ড। সামনের সপ্তাহেই সে যন্ত্র আমাদের হবে।
নেপথিস অবাক হয়। প্রমীলাযন্ত্র
তো এখন কৃষ্ণনগরে। সে যন্ত্র এখানে আসবে কী করে। নেপথিসের দোলাচল আন্দাজ করে
ধনঞ্জয় বলেন।
-তোমরা আরজানমিনার
জয় করেছ খবর পেয়েছি। ওর মাইন্ডডিস্ক আমরা কব্জা করার সাথেসাথেই প্রমীলাযন্ত্রর
সম্পূর্ণ কার্যকরী সার্কিট আমাদের নির্দেশে চলবে। ইশতারপন্থীরা প্রমীলাযন্ত্র
কব্জা করলে সেটা হবে একটা বড় জয়।
-তারপর?
-নিয়ম হবে। কড়া
নিয়ম। ওই যন্ত্রে কেউ চিকিৎসা চাইলে তাকে ইশতারপন্থী হতে হবে।
-পরিবর্তন?
-হ্যাঁ। এটাই আমাদের
সামগ্রিক লক্ষ্য। সারা পৃথিবীর মানুষকে ইশতারপন্থী করব আমরা এইভাবে।
-কিন্তু তাহলেই কী
আমাদের ভিতরে সব বিভেদ বিরোধ থেমে যাবে? ইরাকের ইশতারপন্থীদের সঙ্গে ইরানের ইশতারপন্থীর যুদ্ধ, খারখিভের ইশতারপন্থীদের সঙ্গে ডনেস্কের যুদ্ধ, মেক্সিকোর ইশতারপন্থী বনাম তিজুয়ানার ইশতারপন্থী... এসব তো আজও চলছে। নয়কি?
-ওগুলো বিচ্ছিন্ন
ঘটনা। সামগ্রিক পরিস্থিতি পালটে গেলে অমনটা আর ঘটবে না।
-আর যারা এই শর্তে
রাজি হবে না?
-তারা
প্রমীলাযন্ত্রর চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবে।
কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল নেপথিসের।
মহর্ষি বলেছিলেন, ইশতারের আরাধনা
করলে পৃথিবীতে বিভেদ মিটে যাবে। কিন্তু ধনঞ্জয়ের আগ্রাসী বক্তব্যে নেপথিস
অস্বস্তিকর বিভেদ দেখতে পাচ্ছিল। সে বিভেদ আরও ভয়ানক, আরও বীভৎস। কিন্তু নেপথিসের এই চিন্তা তার মনের ভিতর
বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।ধনঞ্জয় মাহাত বললেন।
-চলো এবার। মহরষি
মহাসমারোহ ডেকেছেন।
-কাছেই। মোঘলমারি।
জায়গাটা সুপ্রাচীন এক
বৌদ্ধবিহার। মকরামপুর থেকে বেশি দূরে নয়। ধনঞ্জয় মাহাত তার নিজস্ব বায়ুযানে
নেপথিসকে নিয়ে চলল। প্রাচীন গুপ্তযুগের বৌদ্ধবিহার বর্তমান যুগে এক অত্যাধুনিক
গুপ্তসভার আয়োজনক্ষেত্র। ধনঞ্জয় তার যান একজায়গা নিরাপদে রেখে পকেট থেকে একটি
ট্যাব বের করলেন। তারপর তার উপর তিনবার গ্রিক অক্ষর 'ফাই' লিখলেন। সঙ্গে
সঙ্গে বিহারের মাঝখানের দরজাটি একপাশে সরে গিয়ে একসারি সিড়ি দেখা গেল। নেপথিস আর
ধনঞ্জয় সেই সিড়ি দিয়ে নীচে নেমে এল। নেপথিস ভাবছিল। বিনাশের জন্য যে বিজ্ঞান, যে উন্নতি, তার ধারা গঠনের
ধারার থেকে অনেক বেশি ক্ষীপ্র। প্রাচীন জার্মানিতে এক বিশ্বযুদ্ধে যেমন নতুন নতুন
প্রযুক্তি মানুষ আবিষ্কার করেছিল দ্রুত শুধু নিধনের জন্য। এই মোঘলমারিতে স্থানীয়
বীর রাজা ও তার সৈনিক বিরাট মোঘল বাহিনীকে তাদের রক্ত আর বীরত্ব দিয়ে রুখে
দিয়েছিলেন। যে বৌদ্ধবিহার শান্তির প্রতীক, ইশতারপন্থীরা তাকেই তাদের যুদ্ধের রণকৌশলকক্ষ বানিয়েছে। দ্রুততায়, ক্ষীপ্র প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে।
-এসো সেবকগণ।
মহর্ষি কেন্দ্রে বসে রয়েছেন।
তার পিছন থেকে মৃদু আভা ফুটে উঠছে স্নিগ্ধ জোছনার মতো। তার মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা।
তিনি জলদগম্ভীর স্বরে বললেন।
-অভিনন্দন যোদ্ধাগণ।
আমরা আরজানমিনার জয় করতে পেরেছি। পৃথিবীতে আবার আমাদের শাসন কায়েম হবে।
আবুতালেব পাশেই বসেছিল। সে হাত
তুলে বলল।
-ওরা কিন্তু
প্রতিরোধ তৈরি করছে। গোয়েন্দা বিদিশা এই জয়ের কথা জানেন।
-চিন্তা করো না। বিদিশাকে থামাবার পরিকল্পনা আমি করেছি। তোমরা শুধু সংকেতের অপেক্ষা করো। আমাদের পরবর্তী লক্ষ্য প্রমীলা যন্ত্র আর পায়রাডাঙার 'ইন্ডিয়াম' খনি। পৃথিবীবাসী চিনুক আমাদের। আমরাই শ্রেষ্ঠ।
সকলেই উঠে দাঁড়িয়ে মহর্ষিকে
অভিবাদন জানায়। নেপথিসও দাঁড়ায়। কিন্তু কেন যেন তার মনের কোণে কোনও অজানা সংশয়
দানা বাঁধতে থাকে।
।। পর্ব ৯।।
ধানকাটনীর দেশে
প্রায় মধ্যরাতে নদীবরাবর হাঁটতে
হাঁটতে অগ্রদ্বীপরা অবশেষে পৌছে গেল আদিরেণ্ডাক পাহাড়। ভাদুড়ীমশাই হলে লিখতেন।'সোনার পাহাড়গুলো প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কালো হাতির মতো দেখতে
লাগে'।কিন্তু মহাযুদ্ধের পর নতুন প্রজন্ম হাতি শুধুই ইতিহাসবইয়ের
পাতায় দেখেছে। আধুনিক সময়ে হাতি নিশ্চিহ্ন। তাই অন্ধকারে এইসময়ের কারো, ওই পাহাড়গুলো দেখলে ঘুমন্ত যুদ্ধের ট্যাঙ্ক মনে হবে।
অগ্রদ্বীপের সামনেই হেঁটে চলেছে এথেনা। তাদের আশপাশে তার অনুগামীরাও অত্যন্ত
সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে। এই আদিরেণ্ডাক পাহাড়ের ঠিক মাঝখানের উপত্যকায় এথেনাদের বেস
ক্যাম্প। এক সময় সারা পৃথিবী এই উপত্যকাকে সোনার 'অ্যামাজন' জনপদ নামে জানত। সেখানকার
স্বর্ণোজ্জ্বল অপরূপ নারীদের বীরগাথা নিয়ে চারিদিকে কতো গল্পগাথা, কতো না সুপারহিরো স্টোরি। যুদ্ধবিধ্বস্ত সৈনিকদের মাঝে এক
জ্যোতিরময়ী নারী অলৌকিক ঢাল নিয়েএগিয়ে যাচ্ছেন শত্রুপক্ষের দিকে। কিন্তু মহাযুদ্ধর
পর আর সেই কল্পনার অবকাশ নেই। বেস ক্যাম্পে পৌছোনোর খানিক আগে এতক্ষণের সঙ্গী
হাডসন নদীটি বাঁক নিয়ে সরে গেছে। পাহাড় থেকে সমতলে নামতেই উপত্যকার কেন্দ্রে বসে
থাকা তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল এক বছর চব্বিশের যুবক। এথেনাকে দেখে হাত মেলাল। এথেনা
সৌজন্যবিনিময় সম্পন্ন করার পর অগ্রদ্বীপের দিকে তাকিয়ে বলল।
-অগ্রদ্বীপ
চ্যাটার্জি। হোলোদোমোর প্রদেশে আপনাকে স্বাগত জানাই। ওর নাম আবদুল্লা। আমাদের এই
প্রদেশের সমস্ত প্রতিরক্ষার ভার ওর হাতেই। আর আবদুল্লা, তুমি তো ওনাকে চেন।
আবদুল্লা সম্মতি জানিয়ে হাত
মেলায়।
-চলুন ভিতরে।
পাহাড়ের উপর থেকে দেখে
তাঁবুটিকে যতোটা ছোট লাগছিল, ভিতরে ঢুকে ততোটা
ছোট লাগল না। মহাযুদ্ধের সময় শেলিংএ বিপর্যস্ত মানুষকে আশ্রয় দিতে মরিয়া রাষ্ট্র
যে উদ্বাস্তু শিবির তৈরি করেছিল, হোলোদোমোরের
কেন্দ্রে তেমনই এক প্রকাণ্ড শিবির। অগ্রদ্বীপরা যে সময় পৌছেচে, সেসময় নৈশভোজের সময়। তাঁবুর ভিতর প্রকাণ্ড টেবিলে সারিবদ্ধ
বসে আছে নানান বয়সের মানুষ। এথেনা বলল।
-চলুন খেয়ে নেওয়া
যাক।
সারা সকালজুড়ে সঞ্চয় করে রাখা
সৌরশক্তি দিয়ে আলোকিত করা হয়েছে তাঁবুর ভিতরটুকু। আলাদা করে জ্বালানি কেনবার
সামর্থ হোলোদোমোর প্রদেশে কারো নেই। তাঁবুর
একপ্রান্তে একটি প্রকাণ্ড রুটির তালের মতো দেখতে পাথর। অগ্রদ্বীপ এথেনা আর
আবদুল্লার পাশেই বসে পড়ল। অগ্রদ্বীপ দেখল সকলে সেই প্রান্তস্থিত পাথরটির দিকে
তাকিয়ে প্রার্থনা করছে। এই অদ্ভুত দেবতার মূর্তি অগ্রদ্বীপ কখনও দেখেনি। তার দেশে
বড় বড় চিন্তাবিদরা শুধু মস্তিষ্কের স্মৃতি আওড়ে দাবি করেন জগতের সবটুকু উৎপত্তিই
ভারতভূমে। তার দেবদেবীর আধার থেকেই জগতের দেবদেবীর রূপরূপান্তর। কিন্তু এই
দেবতামূর্তি অগ্রদ্বীপ দেখেনি এর আগে। সকলে প্রার্থনা শেষ করলে কয়েকজন
স্বেচ্ছাসেবক গোছের মানুষ প্রত্যেকের হাতে একটি করে রুটি দিয়ে গেল। অগ্রদ্বীপ সেই
রুটি নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখছে দেখে আবদুল্লা কৌতুক করে বলল,"খেয়ে নিন। ঠাণ্ডায় শক্ত হয়ে গেলে আর খেতে পারবেন না।"
খাওয়া শেষ হলে সকলে তাদের যে
যার নির্দিষ্ট তাঁবুতে ফিরে গেল। এথেনা মুচকি হেসে বলল।
-কেমন লাগল ডিনার?
-ভালো। তবে আমরা
এশিয়াতে সাপারে এমন স্বল্পাহার করি না।
-এটা স্বল্পাহার নয়।
রেশনিং। সারাদিনে দুটি রুটি বরাদ্দ মাথাপিছু। এটা এশিয়া নয় স্যার। আমেরিকা। এখানে
কোটি কোটি লোক অনাহারে কাতরাচ্ছে। মহাযুদ্ধের পর মাইলের পর মাইল গমক্ষেত বাঁজা হয়ে
গেছে। রাশিয়া পশ্চিমি দুনিয়ার শস্যাগারগুলি ধ্বংস করে দিয়েছে। সাইলোতে থেকে থেকে
পচে গেছে টনটন গম দানা। কোথা থেকে রুটি পাবে মানুষ? এটাই তো একশো বছর আগে আপনারা চাইতেন? তাই না? যাতে পশ্চিম কষ্ট পায়, না খেয়ে মরে?
অগ্রদ্বীপের কথা আটকে যায়।
এপ্রশ্নর উত্তর সে কীভাবে দেবে? কোন যুক্তিতে!
এথেনা যা বলছে তা তো রুঢ় বাস্তব। সত্যিই তো একদিন প্রাচ্য এশিয়া আর আফ্রিকা
পাশ্চাত্যকে এই খাদ্যভাণ্ডারের জন্যই ঈর্ষা করত। সোমালিয়া, লেবানন, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মানুষ ভাবত পাশ্চাত্যে অফুরন্ত শস্যভাণ্ডার রয়েছে। কিন্তু সে নাহয় হলো।
অগ্রদ্বীপ অবাক হচ্ছিল অন্যকারণে। মহাযুদ্ধর পর সাত মহাদেশের যৌথ কমিটি সিদ্ধান্ত
নিয়েছিল যে সারা পৃথিবীর মানুষের খাদ্যসুরক্ষার জন্য প্রতিটি দেশে একটি রাষ্ট্রীয়
খাদ্যভাণ্ডার তৈরি হবে। একসময় আমেরিকা এমনই এক উদ্যোগ নিয়েছিল। তার নাম ছিল 'ওয়ার্লড ফুড প্রোগ্রাম' বা 'ডব্লু এফ পি'।
মহাযুদ্ধের পর আমেরিকার অর্থনীতি ধ্বসে পড়লে এশিয়া ফাউন্ডেশন এই উদ্যোগভার হাতে
তুলে নেয়। সেই উদ্যোগের নাম 'মিশন লিচ্ছবি'। প্রাচীন ভারতে 'লিচ্ছবি' সভ্যতা যেমন রাষ্ট্রশস্যাগার রাখত। সেই মিশন পৃথিবীর সমস্ত
মহাদেশে পৌঁছে যাবার কথা ছিল। তবে কি এশিয়া ফাউণ্ডেশনের সেই মিশন ব্যর্থ হয়ে গেল?
এথেনা আর আবদুল্লা অগ্রদ্বীপকে
তাদের প্রদেশের হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। হোলোদোমোর প্রদেশে বর্তমান নিবাসী
আড়াই হাজার উদ্বাস্তু। এদের অনেকে নিউ ইয়র্ক বা ওয়াশিংটন ডিসির উচ্চপদস্থ আমলাদের
বংশধর। এছাড়াও রয়েছে লাতিন আমেরিকা থেকে কোকোমাফিয়াদের ভয়ে পালিয়ে আসা মানুষ। আড়াই
হাজার প্রদেশবাসীর জন্য যে হাসপাতাল, তার তত্তাবধানে আছেন ডাঃ জনাথন। জনাথন মহাযুদ্ধের সময় রেড ক্রসের হয়ে কাজ
করছিলেন। তার ভিতর হঠাৎ ইশতারপন্থীরা তাকে অপহরণ করে। কিছুবছর অকথ্য নির্যাতিত
হবার পর একদিন হাডসন নদীর তীরেই ফেলে দেওয়া হয় তার নিথর শরীর। স্বাভাবিকভাবেই
অত্যাচারীরা ভেবেছিল জনাথন মৃত। সেই সময় এথেনা আবদুল্লা ও হোলোদোমোরের
স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তাকে উদ্ধার করে। এখন সে এই অস্থায়ী হাসপাতালে নিরন্তর সেবা
করছে আর্তদের। হাসপাতাল তাঁবুতে পা রাখার ঠিক আগে এথেনা অগ্রদ্বীপের কানে কানে বলল,"জনাথনকে কোনও কিছু উত্তেজনাপ্রবণ প্রশ্ন করবেন না?"
অগ্রদ্বীপ অবাক হল। 'উত্তেজনাপ্রবণ' শব্দটির অর্থ তার কাছে পরিষ্কার হল না। সে কথা বুঝে এথেনা বলল, "জনাথন মাদকাসক্ত। ইশতারপন্থীরা তাকে আপ্রাণ পরিবর্তন করার
চেষ্টা করেছিল। এই সব ক্ষেত্রে ওরা সাধারণত তাদের বন্দীদের উপর নানান মাদক প্রয়োগ
করে। জনাথনও তার ব্যতিক্রম নয়। দুর্ভাগ্যবশত, তাকে উদ্ধার করতে পারলেও যে সব যৌগ তার শরীরে ঢুকে গেছে, তারা তার শরীরে জিনগত পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এই বিকৃতি থেকে
মুক্তি দিতে পারত একমাত্র আপনাদের প্রমীলাযন্ত্র। কিন্তু সে এখন আমাদের ধরা ছোঁয়ার
বাইরে। তাই উত্তেজিত হলে জনাথন অন্য মানুষ হয়ে যায়। সাবধান করে দিলাম।"
অগ্রদ্বীপ মাথা নাড়ল।
হাসপাতালতাঁবুতে বেড হাতে গোণা। বেশির ভাগ রোগীই মেঝেতে শুয়ে। স্যালাইন চলছে। পাশ
কাটিয়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতে সারা মুখ দাড়িগোঁফ সর্বস্ব মাঝবয়সী একজন লোক উঠে
দাঁড়াল।তার পরণের অ্যাপ্রণ বা গলার স্টেথো দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় ইনিই এই
ক্যাম্পের চিকিৎসক। মুখে সামান্য হাসি আনবার চেষ্টা করে বলল, "আসুন এথেনা। আবদুল্লা। আসুন অগ্রদ্বীপ। "
অগ্রদ্বীপ বুঝল তার ডাটা 'এআই' আগেই পৌঁছে দিয়েছে
সর্বত্র। আবদুল্লা বলল।
-ডক্টর। আজ এতো ভীড়
কেন?
জনাথন চিন্তিত হয়ে বলল,"সংক্রমণটা বাড়ছে। যতোটা আশা করেছিলাম, তার থেকে অনেক বেশি।"
অগ্রদ্বীপেরও কৌতূহল বাড়ল।
-কীসের সংক্রমণ?
-ইরাপ টু
ট্রান্সক্রিপ্ট ভ্যারিয়েন্ট পালমোনারি ইয়ারসিনিয়াসিস। একসময় পৃথিবীর
স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা যাকে বিউবোনিক প্লেগ বলে চিনত।
অগ্রদ্বীপ চমকে ওঠে। ইতিহাস
বইয়ের 'ব্ল্যাক ডেথ'এর স্মৃতি
ভেসে ওঠে তার চোখের সামনে। কিন্তু প্লেগ তো নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। আবার সে ফিরে এল
কীকরে?
-প্লেগ? কীকরে?
জনাথন ঘোলাটে চোখে অগ্রদ্বীপের
দিকে তাকায়। এথেনা অগ্রদ্বীপকে ইশারা করে থামতে বলে। কিন্তু জনাথন এগিয়ে আসে।
-খুব তো খুশি হচ্ছেন
আপনারা। তাই না। প্রথমে খাদ্যসংকট করলেন। তারপর তেজস্ক্রিয় মহাযুদ্ধ। তারপর আমাদের
অন্ধকারে ফেলে রেখে এখন করুণা দেখাতে এসেছেন? শুধু প্লেগ নয়। ম্যালেরিয়া, কলেরা। আমাদের সব
আছে। আপনারা জিতে গেলেন অগ্রদ্বীপবাবু। ঠিক যেমনটা আপনাদের দেশের সাধুবাবারা
বলেছিল হবে। এখন খুশি?"
জনাথন এগিয়ে আসছিল অগ্রদ্বীপের
দিকে। আবদুল্লা ওকে বাধা দিল। আর ক্যাম্পে তেমন কথা হলো না। বাইরে বেরিয়ে
অগ্রদ্বীপ বলল, "প্লেগের তো একটা ভেক্টর লাগে।
এক্ষেত্রে সেই বাহক কে?" আবদুল্লা বলল।
-মুশিক।
-ইঁদুর তো হলো।
কিন্তু কোথা থেকে?
-যে সে ইঁদুর নয়
এরা। মিউটেটেড ইঁদুর। এক একটির ওজন তিল চার কিলো। মহাযদ্ধর আগে ওডেসা বন্দরে যে
অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল, তার পর ইউক্রেনের
সাইলোবন্দি সমস্ত শস্য ইঁদুর খেয়ে নেয়। তারপর পরমাণু যুদ্ধ। এই যুদ্ধে একদিকে
মানুষের শরীরে প্লেগনিরোধী 'ইরাপ২' ট্রান্সপোর্টার মিউটেট করে গেল, অন্যদিকে সেই ইঁদুরগুলির ভিতর তেজস্ক্রিয়তায় এমন প্রভাব পড়ল, যে তাদের গতিপ্রকৃতি পালটে গেল। এই 'মুশিক' আমাদের খুব শিগগিরই
শেষ করে দেবে। এক একটি মুশিক একা সাত আটটা মানুষের খাদ্যচাহিদা সমান গম খায়। আবার
তারাই প্লেগ ছড়াচ্ছে।
-আশ্চর্য!
অগ্রদ্বীপ মূল তাঁবুর দিকে আসতে
আসতে নিজের ভিতরের হতাশা গোপন রাখতে পারল না। আবদুল্লা এর ভিতরেই হঠাৎ তার পেজার
দেখল। এখানকার কম্পাঙ্ক বাইরে ইশতারপন্থীরা যাতে না ধরতে পারে, সেই কারণে হোলোদোমোরে সবাই পেজার ব্যবহার করে। অগ্রদ্বীপের
মনে হল,
সভ্যতা যেন উল্টো পথে হেঁটে চলেছে। আবদুল্লা পেজার দেখে বলল,"উত্তরের মিনার থেকে সংকেত আসছে। একবার যেতে হবে আমাকে।
আপনারা কথা বলুন। আমি আসছি।"
আবদুল্লা চলে যেতেই এথেনা বলল।
-আপনার আশ্চর্য হবার
কারণটি জানতে পারি?
-মিশন লিচ্ছবি। নাম
শুনেছেন?
এথেনা ঘাড় নাড়ে।"এশিয়া
ফাউণ্ডেশনের উদ্যোগ। মহাযুদ্ধের পর পৃথিবীতে খাদ্যাভাব রুখে দেবার চেষ্টা। শুভ
উদ্যোগ। কিন্তু বাস্তবায়িত হলো না।"অগ্রদ্বীপ বলল।
-সেটাই আমার অবাক
হবার কারণ। কেন বাস্তবায়িত হলো না?
-কারণ ইচ্ছাকে কর্মে
পরিণত করতে গেলে যে সংযোগের প্রয়োজন ছিল, এশিয়া ফাউণ্ডেশনের তা ছিল না। আপনারা আপনাদের দর্শন, মন্ত্রবল আর আত্মধীশক্তিচয়নের আড়ালে ভুলে গিয়েছিলেন,আমাদের এই সভ্যতার ভিত সৎকে পুজো করার ভিতর নয়, অসৎকে প্রতিহত করার ভিতর। 'মিশন লিচ্ছবি'র ফাণ্ড লাতিন
আমেরিকা আর মেক্সিকোর কোকেন মাফিয়ারা ইশতারপন্থীদের জন্য মাদক প্রস্তুতে কাজে
লাগিয়ে ফেলেছে। যে ধানজমিতে শস্য ফলতে পারত, সেখানে লালিত হচ্ছে ওপিয়াম। আমরাই আমাদের ঘুম ডেকে আনছি ক্রমশ।
-আর খাদ্যাভাব?
এথেনা ম্লান চোখে তাকিয়ে বলে,"সেটাও কী আমরাই ডেকে আনিনি? আজ থেকে একশো বছর আগেও বছরে নশো একত্রিশ নিযুত রুটি পাতে তুলে না খেয়ে
ডাস্টবিনে ফেলে নষ্ট করেছি আমাদের পূর্বপুরুষেরা। আমাদের অগ্রজদের পাপের খেশারদ
আমরা আজ দিচ্ছি মিস্টার অগ্রদ্বীপ। এই যে মৌলবাদ, এইযে ইশতারপন্থী। এদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র কি জানেন? রুটি!
অগ্রদ্বীপ ভাবতে থাকে। এর আগে
একশো পয়ত্রিশ বছর আগে এক অতিমারী পৃথিবীর অর্থনৈতিক মানচিত্র তছনছ করে দিয়েছিল। আজ
এতো বছর পর আমেরিকায় এসে এই বিউবোনিক প্লেগ সংক্রমণ দেখে ভয় হচ্ছে তার। আবার কী
তবে আরেক মহাযুদ্ধ আসতে চলেছে? ভাবতে ভাবতে নিজস্ব
তাঁবুর দিকে এগিয়ে এল দুজন। এথেনার চোখে জল।
-আপনি কাঁদছেন?
-আমি হেরে যাচ্ছি
অগ্রদ্বীপবাবু। খিদের খাছে হেরে যাচ্ছি। আমাদের হোলোদোমোরে যতোটুকু রুটি বাকি আছে, মেরেকেটে একমাস চলবে। এদিকে আপনার এশিয়ায় ইণ্ডিয়াম খননের পর
কৃষিজ জমি বদলে যাচ্ছে কলকারখানায়। এখানে কৃষিজমি কোকো আর কোকেন মাফিয়াদের দখলে।
অস্ট্রেলিয়া পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেছে। শস্য আমদানী বন্ধ। এখানে সাড়ে
সাতশো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রয়েছে। ওদের মুখে একমাস বাদে কী তুলে দেব বলতে পারেন
অগ্রদ্বীপবাবু?
-ভয় পাবেন না। উপায়
বের হবেই।
-জানি। আপনার উপর
আমার বিশ্বাস আছে।
-হোলোদোমোর। প্রথমে
নামটা শুনেই কেমন ভয় করছিল। পরে এসে দেখলাম, এখানকার মতো শান্তি যেন আর কোথাও নেই।
-হোলোদোমোর তো ভয়
পাবার মতোই শব্দ। নয়? এর অর্থ অনাহারে
নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। ১৯৩২ ভুলে গেলেন? ইউক্রেনের সেই মন্বন্তর। সেই সব মৃত্যুর খবর, যা ক্রেমলিন কখনও প্রকাশ্যে আসতে দেয়নি। ভুলে গেলেন?
তাঁবুতে যেতে ইচ্ছে করছিল না
অগ্রদ্বীপের। এথেনা যা বলছে তা সত্য। পরম সত্য। অনাহারে নিশ্চিত নিঃশেষ হতে চলেছে
এরা। তাকে কিছু একটা করতে হবে। করতেই হবে। হোলোদোমোর উপত্যকার মাঝখানে একটা ভেঙে
পড়া যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষ ছিল। তার উপর লতাপাতা উঠে সেটা একটা সবুজাভ ঢিবির
আকার নিয়েছে। অন্ধকার আকাশে তারাদের আলোয় সেই ছায়া দেখে মনে হচ্ছে কোনও রমণী পাশ
ফিরে শুয়ে আছে যেন।
-একবার যাবেন ওইদিকে?
-কেন? বিশ্রাম নেবেন না?
-যা বললেন, ঘুম আসবে না এথেনা। চলুন।
-বেশ। চলুন।
ঢিবির উপর উঠে পা দুলিয়ে বসল
দুজন।
-পরিবারকে মনে পড়ে
না আপনার?
-পড়ে। ভাসাভাসা।
বোনের কথা। বাবা মায়ের কথা।
-আপনার বোন ছিল?
-যমজ ছিলাম দুজন।
আমি আর লরা।
-তারপর। কী হলো?
-তখন আমরা দুজনেই
খুব ছোট। হাল্কা মনে আছে। লরা একদিন হারিয়ে গেল। এমন ঘটনা তখন ঘরে ঘরে ঘটছে।
চারপাশে যখন তখন সাইরেন বেজে উঠছে। মানুষজন তড়িঘড়ি সর্বস্ব ছেড়ে বাঙ্কারে ঢুকে
পড়ছে। তেমনই এক দিন দৌড়োদৌড়ির ভিতর লরা কোথায় হারিয়ে গেল। বাবা মা অনেক খুঁজল। পেল
না।
আকাশের তারার আলো এথেনার গালে
ফুলের রেণুর মতো লেগে আছে যেন। অগ্রদ্বীপ ভাবছিল। মহাযুদ্ধের পর মহামারী। তার
খাদ্যাভাব। গৃহযুদ্ধ। কীভাবেটিকে থাকবে এই
সভ্যতা?
-আপনারাও যে
ঈশ্বরবিশ্বাসী জানতাম না?
এথেনা অবাক হয়ে তাকায়।
-ঈশ্বরবিশ্বাসী? কে বলে?
- ওই যে খাবার সময়
আপনারা প্রার্থনা করলেন?
-ঠিক বলেছেন। তবে
আপনারা দেবতার মূর্তিটি ভালো করে দেখেননি। দেখলে বলতেন না।
-কেন?
-ওটা কোনও দেবতা নয়।
ওটা একটা রুটি। মহাযুদ্ধে ঝলসে যাওয়া রুটির ডামি। কোনও ধ্বংসপ্রাপ্ত বার্গার
পার্লার থেকে সংগ্রহ করা। এখানে মহাযুদ্ধের আগে একটা অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ছিল।
হোলোদোমোরে একজনই আরাধ্য দেবতা। সে হল রুটি। সে তুষ্ট হলেই আমার এ জনপদ বেঁচে
থাকবে আরো কয়েকটা দিন। পৃথিবীতে তার চেয়ে বড় দেবতা আর কী কেউ আছে অগ্রদ্বীপবাবু?
অগ্রদ্বীপ সজল চোখে তাকিয়ে থাকে
শুধু।
।। পর্ব ১০।।
দুলদুলি ঘোড়ার উৎসবে
প্রমীলাযন্ত্রর সামনে দাঁড়িয়েছিল বিদিশা। তার পাশেই রিমঝিম। কথা মতো এটুকু সময় কারোকে এই যন্ত্রর ধারেকাছে আসতে দেয়নি সে।যন্ত্রর ভিতর এক বৃদ্ধ মানুষ ছিলেন। তাঁর শরীরে রক্তের ভিতর কর্কটরোগ। ক্রনিক লিম্ফয়েড লিক্যিমিয়া। যন্ত্র তার কাজ শেষ করতেই যন্ত্রর পর্দায় ফুটে উঠল লেখা, 'রোগ প্রতিহত'। যন্ত্র থেকে বের হতে হতে বৃদ্ধ মানুষটি বিদিশা ইর রিমঝিমের উদ্দেশ্যে হাত তুলে বললেন, "আমার ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই। পরমপিতা তোমাদের মঙ্গল করুন। "বিদিশা মুখে সামান্য হাসি আনার চেষ্টা করল। তারপর বৃদ্ধ মানুষটি বেরিয়ে গেলে রিমঝিমকে সেই চেম্বারে ঢোকার সব দরজা বন্ধ করে দিতে বলল। রিমঝিম জিজ্ঞাসু মুখ করতেই বিদিশা বলল,"উপায় নেই বিদিশা। যা বলছি তাই করো। আজ আর কোনও কেস নিও না।"
দরজা বন্ধ হতেই বিদিশা মাটির উপর বসে দুই হাত আসনের মতো দুই হাঁটুর উপর পেতে চোখ বন্ধ করল। বেশ কিছুক্ষণ ভ্রুকুঞ্চিত করে সে যেন কী চিন্তা করছিল। হঠাৎ প্রমীলা যন্ত্রর ভিতর একটি 'হোম হোম' আওয়াজ শুরু হল। তারপর যন্ত্রর ভিতর থেকে কুলকুল করে ধোঁয়া বের হতে শুরু করল। বিদিশা চোখ খুলতেই শঙ্কিত রিমঝিম তার দিকে তাকিয়ে রইল। বিদিশা উঠে পড়ে বলল, "ঘাবড়িও না রিমঝিম।আমি যা করলাম জেনেবুঝেই করলাম।"
রিমঝিমের দোলাচল যেন কাটতেই চাইছিল না। বিদিশা ল্যাব বন্ধ করে বেরিয়ে আসছিল। রিমঝিম তাকে অনুসরণ করে আসতে আসতে ভাবছিল। তবে কি প্রমীলাযন্ত্র বিকল হয়ে গেল চিরতরে? কেন! সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিদিশা বলল।
-ঘাবড়ে যেও না রিমঝিম। আরজানমিনার দখল করার পর ওদের পরবর্তী নিশানা প্রমীলাযন্ত্র। আমার সঙ্গে নেপথিসের মস্তিষ্কতরঙ্গ সংযুক্ত হয়েছিল। নেপথিস আমার জীবনের অনেক গোপন তত্ত্ব জেনে গেছে যেমন, আমিও তেমনই ওদের অনেক গোপন পরিকল্পনা জেনে ফেলেছি। ওরা এই যন্ত্র কবজা করে ইশতারপন্থী মৌলবাদ প্রচারের কাজে লাগাত। এখন আর তা পারবে না।
-কিন্তু এতো বড় একটা আবিষ্কার।
রিমঝিমের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বিদিশা। তারপর ধীর স্বরে বলল।
-চোখ বন্ধ করে দেখ রিমঝিম। মানুষের আবিষ্কার আসলে একটা মনস্তাত্ত্বিক নির্মাণ। তাকে প্রযুক্ত হবার আগে মনের ভিতর নির্মিত করতে হয়। তাই তো?
রিমঝিম ঘাড় নাড়ে। বিদিশা বলে চলে।
-প্রমীলাযন্ত্র আরও উন্নত হবে এবার। আমি একটি মাইক্রোচিপ আবিষ্কারের কথা ভেবেছি। সেই চিপ প্রতিটি মানুষের শরীরে ট্রান্সডারমাল ইমপ্লান্টের মতোই ঢুকিয়ে দেব। তাতে মানুষ নিজেই নিজৈর ইচ্ছাশক্তির বলে তার শরীরের জিনগত ত্রুটি শুধরে নিতে পারবে।
-কিন্তু কেউ যদি শোধরাতে না চায়? তখন? কেউ যদি জেনে বুঝেই নিজেকে শেষ করতে চায়?
রিমঝিমের চোখে জল। বিদিশা বোঝে রিমঝিম কষ্ট পাচ্ছে। তার কাঁধে হাত রেখে বলতে থাকে।
-আজ থেকে শোয়া দুশো বছর আগে ফ্রয়েডসাহেব বলেছিল 'ইরোস' আর 'থ্যানাটস'। সৃষ্টি আর ধ্বংসের রহস্য। প্রাগৈতিহাসিক সেই তত্ত্ব কিন্তু এখনও সমান প্রাসঙ্গিক। এই সিদ্ধান্ত আমাদের। আমরা কোনটা নেব আর কোনটা নেব না। ভেঙে পড়লে চলবে না রিমঝিম। মন শক্ত করো। তোমার পূর্বপুরুষদের মারিওপল যেন আবার ফিরে না আসে তার ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের। আমার ওপর ভরসা রাখো। আমি সব ঠিক করে দেব।
-আমাকে কী করতে হবে?
-প্রথম। কোনও মতেই পায়রাডাঙার ইণ্ডিয়াম খনি ওদের হস্তগত হতে দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সত্যম তোমার সঙ্গে থাকবে। আর থাকবে সুলেমান। এমন কোনও যান্ত্রিক চাবি তৈরি করো যা কেউ ভাঙতে না পারে।
-বেশ। আর?
-প্রমীলা যন্ত্রর বৈকল্যর কথা ওদের জানতে দেওয়া চলবে না। এই গোপন সত্য একান্তভাবে তোমার আর আমার।
-আর?
-আর নিজেকে বাঁচিয়ে রেখো রিমঝিম। ওরা তোমার মস্তিষ্কতরঙ্গ হ্যাক করতে চাইবে। তখন মাথা ভার হয়ে উঠবে তোমার। সেই সময় তিনবার 'তত্ত্বমসি' শব্দটি উচ্চারণ করবে মনের ভিতর। এই কৌশল আমাকে গানহি বাওয়া শিখিয়েছিলেন। তোমাকে দিয়ে গেলাম।
-তুমি এখন কোথায় যাবে বিদিশা?
-মদন আগরওয়ালের সঙ্গে দেখা করতে। মদনের সম্পর্কে জ্যাঠামশাই, অক্ষয় মালহোত্রা বিদর্ভদেশে থাকে। তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হওয়াটা প্রয়োজন।
-অক্ষয় মালহোত্রা? সে তো উন্মাদ! তার দেশে কারোকেই প্রবেশাধিকার দেয় না। কীসব অদ্ভুত ধ্যানধারণা নিয়ে থাকে! তার কাছে গিয়ে কী হবে?
-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে রিমঝিম। অক্ষয় উন্মাদ হতে পারেন। কিন্তু তার তার ওই গোঁড়ামির প্রতি বিশ্বাস অটুট। কোনওভাবে যদি সেটাকে আমি সামান্য পরিবর্তন করতে পারি তাহলেই আমার কাজ হয়ে যাবে।
-সাবধানে থেকো বিদিশা।
-তুমিও সাবধানে থেকো রিমঝিম।
প্রমীলা যন্ত্রে উঠবার আগে বিদিশা আর রিমঝিম পরস্পর পরস্পরকে জরিয়ে ধরে থাকল কিছুক্ষণ। দুজনের শরীরের ওম মিশে যাচ্ছিল একে অপরের ভিতর। দুজন দুজনের ওষ্ঠাধর স্পর্শ করেই সরে এল।
-আমাদের আর দেখা হবে না বিদিশা?
-হবেই তো। আরেকটা নতুন পৃথিবী তৈরি করব আমি। আরেকটা কথা। দেবলীনা গোমস। অগ্রদ্বীপ চ্যাটার্জির ব্যক্তিগত আইন বিশেষজ্ঞ। ওকে বলো সুধন্য ফাউণ্ডেশনের সমস্ত নথি লুকিয়ে ফেলতে। মনে করে বলবে।
বিদিশা সম্পাতিতে চড়ে বসল। আকাশে উড্ডীন হতেই সে দেখল রিমঝিম নীচে তার দিকে চেয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে। সামান্য হেসে বিদিশা উত্তরদিকে পাড়ি দিল। মদন দেওঘর সংলগ্ন কোনও জায়গায় রয়েছে। ট্র্যাকার তাই বলছে। মদনকে সব তথ্য বলা যাবে না। তবু বিদিশা উপায়হীন। গানহীবাওয়া বলেছেন। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে সব শেষ হয়ে যাবে মৌলবাদের হাতে। অক্ষয় মালহোত্রার অধিনস্ত অঞ্চলে পৃথিবীর একমাত্র সোনার খনি রয়েছে। যদিও সেদেশের শাসক অক্ষয় ও তার সহচরদের দাবী এই সোনার খনি বিদর্ভদেশের একধরনের দ্বিপদী বাইসনের মুত্র থেকে উৎপন্ন হয়েছে। লক্ষ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা খরচ করে অক্ষয় মালহোত্রা সেখানে ল্যাব বানিয়েছেন। এই দ্বিপদী বাইসনদের মুত্র সংরক্ষিত করে তার থেকে ডিস্টিলেশন পদ্ধতিতে সোনা বের করার চেষ্টা করে চলেছে ওই দেশের পদার্থবিদরা। অন্য সময় হলে বিদিশা এদের উন্মাদই বলত। কিন্তু এমুহূর্তে সে নিরূপায়। ইশতারপন্থীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেলে তৈরি করতে হবে এক বিশ্বব্যাপী বাহিনী। সত্যম অধিনস্ত রাষ্ট্রীয়বাহিনী সেইকাজে যথেষ্ট নয়। আর প্রয়োজন 'ওমযন্ত্র'র। পৃথিবীর আদিমতম ব্রহ্মনাদ। বিদিশা শুনেছে ইশতারপন্থীরা একধরনের সুপারসনিক শব্দতরঙ্গযন্ত্র ব্যবহার করছে। সেটা প্রতিহত করতে পারে একমাত্র ওই ওমযন্ত্র। কিন্তু সেটুকু পেতে গেলে অক্ষয় মালহোত্রাকে যুক্তিতে হারানো খুব প্রয়োজন। হাতে সময় নেই বেশি। অগ্রদ্বীপের কী হলো কে জানে! কোনও খবর নেই। সে কি এখনও জীবিত?
দেওঘর পেরিয়ে চুনারের দুর্গর কাজে এসে মদনের ট্র্যাকার নিভে গেল। এই দুর্গেই তবে মদন রয়েছে। দুর্গে সম্পাতি নাবিয়ে বিদিশা মদনকে কথাযন্ত্রে ধরার চেষ্টা করল। দুতিনবারের চেষ্টার পর সফল হলো বিদিশা। একটু ব্যস্তসমস্তভাবেই ওপার থেকে মদন আগরওয়ালের গলা ভেসে এল।
-বলুন ম্যাডাম।
-একটু দরকার ছিল। জরুরি দরকার।
-আমি কৃষ্ণনগর আসব?
-না। আমি এসেছি। আপনি কোথায়?
-আপনি এসেছেন! কোথায়?
-চুনার দূর্গে। কোথায় আপনি?
সামান্য স্তব্ধতা কাটিয়ে মদন আবার বলে উঠল।
-দূর্গের ভিতর সুরঙ্গপথ দিয়ে বিচ রিসর্টে চলে আসুন। আমি আসছি।
সুরঙ্গপথ ট্র্যাকার চালু করতেই পেয়ে গেল বিদিশা। সেই পথ বেয়ে যেতে যেতে একসময় তা মিশে গেল গঙ্গার তীরে। বিদিশা ভাবছিল। একসময় এই দূর্গ কতো প্রতিরোধ, আত্মত্যাগ, গুপ্তহত্যা, দেশাত্মবোধ দেখেছে। উন্নত হবার পর প্রথম বিশ্বের ভারতে সেই চুনার দূর্গ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ন্যুড রিভার বিচের প্রবেশদ্বার। নদীপারে সেখানে প্রতিটি নারীপুরুষ নগ্ন। কোথাও কোথাও প্রকাশ্য মৈথুনও চলছে। বিদিশা চোখ ঘুরিয়ে নিল। দেশ যতো প্রথাগত ধারনায় উন্নত হবে, মানুষ ততো নগ্ন হবে। নগ্ন হবে তার আদিমতম প্রবৃত্তি। আশ্চর্যের কী! পাশে একটি বার কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল বিদিশা। সেখানে কোনও মতে একটা তোয়ালে জরিয়ে মদন দাঁড়িয়েছিল। হতচকিত হয়ে সে একটা টেবিলটুল এনে বিদিশাকে বসতে বলল।
-ম্যাডাম। আপনি এখানে?
-একটু দরকার ছিল। জরুরি। গবেষণার কাজ।
-ওহ। বলুন না।
-অক্ষয় মালহোত্রা। আপনার দূর সম্পর্কের জ্যাঠামশাই। একবার দেখা করতে হবে। বিদর্ভদেশের পাসপোর্ট লাগবে আমার।
-কেন? হঠাৎ?
মদন মাথা চুলকাতে থাকে। বিদিশা সমস্ত কিছু ওর সামনে ভাঙল না। ইশতারপন্থীদের কথা একে বলাটাও নিরাপদ মনে করল না বিদিশা।
-গবেষণার কাজ। ওনার দ্বিপদী বাইসনের মুত্র থেকে সোনা উৎপন্ন করার গবেষণা তো যুগান্তকারী। এই বছরের রামানুজন পদকের ব্যাপারে ওনার এই আবিষ্কার বিশিষ্টজন বিবেচনা করছেন।
-ওহ।
বেশ গদগদ মনে হল মদনকে।
-হয়ে যাবে ম্যাডাম। একটা দিন সময় দিন। বিদর্ভদেশের নিয়মকানুন একটু আলাদা তো। ওরা তিথি নক্ষত্র ছাড়া কোনও পদক্ষেপ নেয় না। কাল সুরথ একাদশী। কাল ওরা পাসপোর্ট দিয়ে দেবে। আমি আপনার এখানে থাকার ব্যবস্থা করছি। অসুবিধে হবে না। আর যদি রাতে আপনার কোনও সঙ্গী প্রয়োজন হয়, আমাকে বলবেন। কথাটা বলেই জিভ কাটল মদন। হঠাৎ ভুল করে বেরিয়ে গেছে মুখ দিয়ে। কিন্তু বিদিশা গম্ভীর হয়েই থাকল। কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাল না।এই মুহূর্তে তার মদনকে প্রয়োজন।
সন্ধ্যা হতেই ট্র্যাকার বন্ধ করে দিল বিদিশা। দূর্গের একটি প্রাসাদোপম ঘরে বিদিশার থাকার ব্যবস্থা করেছে মদন। যদিও মনে মনে বিদিশা জানে, এই দূর্গে বেশিক্ষণ সে নিরাপদ নয়। এই ঘরে একসময় শের শাহ সুরী বা মহারাজা হীমুর মতো বীর যোদ্ধারা বাস করেছে। তিনশো বছর আগের দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ, যাকে তখনকার ইতিহাসবিদরা 'বিদ্রোহ' বলে ভুল করেছিল, সেই যুদ্ধের যোদ্ধারাও এই প্রাসাদে লুকিয়ে ছিলেন। সেই ঘরের জানালা দিয়ে সান্ধ্য আসরে গঙ্গার তীরে শুধুই মদের ফোয়ারা আর নির্লজ্জ যৌনতা দেখছিল বিদিশা। এই উন্নত স্বাধীনতার কথাই ইতিহাসের পাতায় থাকা বীর যোদ্ধারা ভেবেছিলেন কী না কে জানে। নারী পুরুষ একে একে তাদের সঙ্গী বদল করছে। চারপাশের সংকট, দুর্যোগ, অনাহার, কোনও কিছুই তাদের স্পর্শ করছে না। এ দৃশ্য দেখলে ভাদুড়ীমশাই কী লিখতেন কে জানে! হয়তো দুলদুল ঘোড়ার উৎসবের কথা লিখতেন। কবরগা অবধি হেলেদুলে আসা নরকটিয়াবাগের নবাব সাহেবদের দুলদুল ঘোড়ার মিছিল। ধুলো আর ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে দেখা 'চাঁদির' মেয়ে চুনারের নদীপারের বালুরাশিতে নগ্ন দৌড়ে বেড়াচ্ছে। দলছুট নারীপুরুষ শনিচরার বৌয়ের মতোই যেন মাদক আর যৌনতার নেশায় পায়ে তিনগাছা করে 'সিলবরের পৈড়ী' পরে আছে। ভাদুড়ীমশাই ওকে বলতেন 'জার্মান সিলভারের মল'। বিদিশা চোখ ঘুরিয়ে নিল। তার মাথার ভিতরটা দপদপ করছে। অক্ষয় মালহোত্রা গোঁড়া হলেও তার মস্তিষ্কের অবচেতনে একধরনের বিরল বৈজ্ঞানিক ঝলক আছে বলেই বিদিশার দৃঢ় বিশ্বাস। আপাতত সারারাত তার ঘুম আসবে না। ওই ঝলকটুকুই এখন তার সম্ভাবনার শেষ আশার দীপক।
।। পর্ব ১১।।
মরণাধারের কাঠের সাঁকো
হোলোদোমোরের উত্তর মিনারের উপর
দাঁড়িয়ে আবদুল্লা দেখতে পেল আদিরেণ্ডাক পাহাড়ের উত্তর শিখর বেয়ে জোনাকির মতো এক
সারি মানুষ নেমে আসছে। অন্ধকারে দূরবীণ যন্ত্রেও এর বেশি দেখা অসম্ভব। তবে লেজার
টেলিস্কোপে চোখ রেখে আবদুল্লা দেখতে পেল ছিন্নভিন্ন জামাকাপড় পরে একদল মানুষ
লোটাকম্বল সম্বল করে পাহাড়পর ধরে হোলোদোমোরের দিকে নেমে আসছে। তাদের সকলের সামনে
রয়েছে এক দীর্ঘদেহী উজ্জ্বল বর্ণের নারী। সে তার হাতে একটি রাবাব বাজিয়ে সুর করে
গান গেয়ে চলেছে। পিছনে পাইড পাইপার গল্পের মতোই মন্ত্রমুগ্ধ মানুষ হেঁটে চলেছে।
মেয়েটিকে আবদুল্লা চিনতে পারল না। তবে সমবেত এই মানবমিছিলকে তার ইশতারপন্থী আক্রমণ
মনে হল না। মানুষগুলি অভুক্ত। অভুক্ত মানুষ দেখলেই আবদুল্লা বুঝতে পারে। তাদের
চোখের কোণের কালি কাজলের থেকেও কালো, চোয়াল জাহাজের নোঙরের চেয়েও কঠিন, আর দৃষ্টি নজরমিনারের মিনারের থেকেও তীক্ষ্ম। নাহ।ইশতারপন্থীদের সে দেখেছে। এই
মানুষগুলি অন্যরকম। দেখা যাক।
হোলোদোমোর শিবিরের দরজার সামনে
এসে মশালধারী মিছিলটি দাঁড়িয়ে পড়ল। আবদুল্লা মিনারের উপর থেকে জিজ্ঞেস করল, "কারা তোমরা? কী চাও?" কিন্তু মিছিলের কেউ উত্তর দিতে পারল না। তখন রবাব হাতে
মেয়েটি বলে উঠল, "ওরা কেউ কথা বলতে পারে না জনাব।
ওরা জন্ম থেকেই বাকরুদ্ধ।"
-কী চান আপনারা?
-আশ্রয়। আমরা
দেশহারা উদ্বাস্তু। অনেকদিন অভুক্ত হেঁটে চলেছি। হোলোদোমোরে আশ্রয়ের আশায় এসেছি।
-আপনার এই কথার
প্রমাণযোগ্যতা কী?
মেয়েটি একটু ভেবে বলল, "আপনাদের শিবিরের সুপ্রিম কম্যাণ্ডার এথেনাকে বলুন, আমি লরার খবর এনেছি।"
আবদুল্লা ইতস্তত করে এথেনাকে
পেজার করল বটে, কিন্তু তার মনের ভিতর থেকে সংশয় কাটল
না। তবু অভুক্ত মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে আবার ভিতর থেকে তার মন বলে উঠল, না। এরা ইশতারপন্থী নয়। কিন্তু সে নিরুপায়। হোলোদোমোরের
দরজা একা খুলে দেবার অনুমতির অধিকার তার নেই। আপাতত এথেনার জন্য অপেক্ষা করতেই
হবে। ভাবতে ভাবতেই তার পেজার বীপ করে উঠল। এথেনার উত্তর। "দরজা খুলে ওদের
ভিতরে অতিথি তাঁবুতে আশ্রয় দেবার ব্যবস্থা করো। আমি আসছি।" পেজার পেয়ে আবদুল্লা
দ্বাররক্ষীদের দরজা খুলে দিতে বলল।
হোলোদোমোরে আসবার পর থেকে অগ্রদ্বীপ
বারবার অনুভব করছে, এখানকার এই
জীবনযাত্রা স্লথ হলেও জীবন্ত। এথেনার সঙ্গে কথোপকথনের ভিতরে হঠাৎ পেজারটা বেজে উঠতেই সে উঠে দাঁড়াল।
-একবার উত্তর
মিনারের দিকে যেতে হবে আমাকে। আপনি বিশ্রাম করুন।
-না। চলুন। আমিও
যাব।
-বিপদ থাকতে পারে
কিন্তু।
অগ্রদ্বীপ উত্তর না দিলেও তার
চোখের ভাষা পড়ে নিতে এথেনার দেরি হলো না। "বেশ। চলুন" বলে সে দ্রুত
হাঁটতে শুরু করল। উত্তর মিনার পৌছোতে পৌছোতে আকাশে ভোরের আলো ফুটে উঠছে। সেখানে এক
প্রকাণ্ড তাঁবুর বাইরে আবদুল্লা দাঁড়িয়ে ছিল। এথেনাকে দেখেই সে বলল, চলুন ভিতরে। অগ্রদ্বীপ ভিতরে ঢুকে দেখল নানান বয়সের শতাধিক
মানুষ মাটির উপর বসে আছে। সেই দলে সদ্যোজাত যেমন আছে, তেমনই আছে আশি ঊর্ধ্ব বৃদ্ধা। সকলেই রুটি আর জল নিয়ে বসে
আছে। সদ্যোজাতর মা তার সন্তানকে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর চেষ্টা করছে। এথেনা সেই
মানুষের সারির ভিতর এগিয়ে গেল তাঁবুর এক প্রান্তে। সেখিনে কয়েকটি তরুণীপরিবেষ্ঠিত হয়ে একটি
দীর্ঘাঙ্গী অপরূপ সুন্দরী মেয়ে রবাব বাজিয়ে গান গাইছে। এথেনাকে তার কাছে নিয়ে এল
আবদুল্লা। অগ্রদ্বীপও পিছু পিছু এল।
-কী নাম তোমার?
-নূর।
-তোমরা কারা? এরা কেউ কথা বলছে না কেন?
-আমরা উত্তর মেরুর
শরণার্থী। মেরুগলে যাবার পর মেরুপ্রদেশ দখল নিয়েছিল চিন। সেখানে উত্তর ইয়ুরোপ থেকে
বহু মানূষ অন্নসংস্থানের আশায় ছুটে গিয়েছিল। সুইডেঅঁ, সুইজারল্যাণ্ড, নরওয়ে বেলজিয়াম থেকে সেখানে কলোনি তৈরি করেছিল আমাদের পূর্বপুরুষরা।
মহাযুদ্ধের সময় আমাদের মেরুপ্রদেশ দখল নিল রাশিয়া। শুরু হল অত্যাচার। হেলিকপ্টার
করে মেয়েদের তুলে নিয়ে ধর্ষণ শুরু হল, কলোনি থেকে রাতারাতি বহু মানুষ উধাও হয়ে গেল। তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গহীন লাশ মিলল
কিছুমাস পরে। বাধ্য হয়েই তারা পালাবার মরিয়া পথ খোঁজা শুরু করে দিল। আমাদের
পূর্বপুরুষরা প্রথমে জলপথে গ্রীনল্যাণ্ড হয়ে কানাডা আসার চেষ্টা করেন। যাঁরা
পারলেন,
তাঁদের উত্তরসূরিরা হলাম আমরা।
-হোলোদোমোরের কথা
জানলে কী করে?
নূর জ্যোৎস্নার মতোই হেসে উঠল।
-হোলোদোমোরের কথা কে
না জানে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই মানুষ আগ্রাসী শক্তির হাতে কষ্ট পাচ্ছে, তারাই আপনাদের হোলোদোমোরের কথা জানে।
-কী জানে?
-জান্নাত।
এথেনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
অগ্রদ্বীপ এথেনার ভিতরের হতাশা ও কষ্টর কারণ বুঝতে পারে। এই শিবিরে ইতিমধ্যেই রুটি
ও খাদ্যভাণ্ডার বাড়ন্ত। সেখানে এতোগুলি শরণার্থীকে কীকরে আশ্রয় দেবে এথেনারা। তবু
ভিতরকার সেই হতাশভাব গোপন করে এথেনা বলল, "বেশ।ওরা এখানে থাকুক কিছুদিন। আপনিও বিশ্রাম করুন। শুধু একটাই সতর্কতা। আমাদের
নির্দেশ ছাড়া এই শিবিরের বাইরে বের হবেন না কেউ।"
অতিথি শিবির থেকে বের হয়ে
প্রার্থনাতাঁবুর দিকে এগোচ্ছিল অগ্রদ্বীপ এথেনা আর আবদুল্লা। হঠাৎ তাঁবুর ভিতর
থেকে এক অদ্ভুত সুর ভেসে এসে স্তব্ধ করে দিল এথেনাকে। অন্যমনস্ক লাগছিল তাকে।
অগ্রদ্বীপ এথেনার সেই দোলাচল দেখে বলল, "কী ভাবছেন এথেনা?"
-এই সুর খুব চেনা।
ছোটবেলায় কোথায় যেন শুনেছি!
বেলা বাড়ে। মধ্যাহ্নে রুটি
বিতরণের আগে জনাথন এসে এথেনাকে জানাল, আজ তার তাঁবুতে আরও তিনজনের প্লেগে মৃত্যু হয়েছে। জনাথনকে অস্থির লাগছিল।
হোলোদোমোরের কেন্দ্রে একটি ঢিবির মতো চাতাল আছে। কোনও এক সময়ে এই চাতাল পেন্টাগনের
গুপ্ত বাঙ্কার ছিল। সেখানে জরুরি মিটিং ডাকা হল পরিস্থিতির কথা ভেবে। অগ্রদ্বীপও
সেই মিটিংএ আমন্ত্রিত। আর ছিল নূর। নূরকে অগ্রদ্বীপ মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। তার কাছে
এই মুহূর্তে 'তথাগত' সফ্টওয়্যার নেই, তবু সে বুঝতে পারে
এই মেয়েটির ভিতর এক অদম্য জীবনী শক্তি আছে। যৌথমিটিংএ এথেনারা এই খাদ্যসংকট ও
ইশতার আক্রমণ প্রতিরোধ কীভাবে করবে আলোচনা করছিল।তারই ভিতর এক ফাঁকে নূরের পাশে গিয়ে বসল অগ্রদ্বীপ। তাকে
দেখেই নূর বলল।
-আপনাকে আমরা সবাই
জানি। আপনি এশিয়া দেশের মশিহা।
-কে বলে এ কথা?
-সবাই বলে। আমরা
বলি।
একথা সে আগেও এথেনার কাছে
শুনেছে। কিন্তু এই বিশ্বাসের ভিত খুঁজে পায়নি। তার এখন না আছে শক্তি, না সামর্থ্য। তবু মানুষ ভাবে সে মশিহা। সত্যিই মানুষের
বিশ্বাসের অতল মারিয়ানার চেয়েও বেশি রহস্যময়। প্রসঙ্গ ঘোরাতেই অগ্রদ্বীপ প্রশ্ন
করল।
-মেরুপ্রদেশের মানুষ
কথা বলতে পারে না কেন?
নূর উদাশ হয়ে দূরে আদিরেণ্ডাক
পর্বতসারির দিকে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। তারপর বলে।
-একনায়কতন্ত্র যখন
মানুষের প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নিতে থাকে, তখন এক সময়ে সে কথা বলতে ভুলে যায়। প্যাভলভ পড়েননি? যা কিছু আমরা শিখেছি, সেসবই একদিন ভুলে যেতে পারি। মেরুপ্রদেশের মানুষের ওপর দুই প্রজন্ম ধরে
একনায়করা তাদের ওপর অত্যাচার ও একাধিপত্য চালিয়েছে। এমন সময় গেছে, যখন ন্যুনতম জীবননির্বাহের প্রয়োজনটুকু বললেও তাদের কপালে
জুটত মৃত্যুদণ্ড। সেই ভয়ে ও অবশেষে অবদমনে একদিন ওরা সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ওদের
পরবর্তী প্রজন্ম প্রতিবাদের ভাষাটাই জানে না। ওরা শুধু জানে ভয়ের ভাষা।
-কিন্তু নূর। আপনি
তো কথা বলতে পারেন?
-তার কারণ এই রবাব।
নূর রবাবটি কোলে টেনে নিয়ে
টুঙটুঙ করে বাজাতে থাকে। আর তখনই অগ্রদ্বীপ দেখতে পায় এক আশ্চর্য ঘটনা। নূরের
বাদ্যযন্ত্রর সুরে ঢিবির পাথরে আটকে থাকা মুহ্যমান একজোড়া ঘাসফুল চারা হঠাৎ সতেজ
হয়ে দুলতে শুরু করল। নূর বলে চলে
-এই রবাব আমি
পারিবারিক সূত্রে পাই। আব্বার কাছে শুনেছি, আমার পূর্বপুরুষের কেউ এই রবাব নিয়ে এসেছিলেন আফগানিস্তান থেকে। সেই মানুষটি
খলিলুদ্দিন খলিল আর রুমির ভক্ত ছিলেন। এই রবাব বংশানুক্রমে আমার হাতে আসে। আব্বা
নিজে আমাকে রবাব বাজানো শেখান।
-কিন্তু রবাবের
সঙ্গে আপনার বাকশক্তি না হারানোর কী সম্পর্ক?
-পৃথিবীতে সুরের
থেকে বড় প্রতিবাদ আর কোনও কিছু কি হয়? আব্বা কবি ছিলেন। সেকথা জানতে পেরে রাশিয়ার শাসকরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। আব্বা
হারিয়ে গেল। আমিও মেরুপ্রদেশে লুকিয়ে ফেলেছিলাম এই রবাব। তারপর এদেশে এসে দেখলাম
রবাব বাজালে আমার কথার বাঁধন আটকাচ্ছে না আর। জানেন অগ্রদ্বীপ, আমার বারবার মনে হয়, পৃথিবীর কোনও শাসক মানুষের প্রতিবাদের ভাষা যদি বা আটকাতে পারে, প্রতিবাদের সুর কখনও আটকাতে পারে না। সুর অপ্রতিরোধ্য। হয়তো
সেই কারণেই পৃথিবীর ইতিহাসে সব প্রতিবাদের স্বর গান হয়ে গেছে।
-বাহ। ভারী সুন্দর
বললেন।
অগ্রদ্বীপ দেখল তার অজান্তেই
কখন এথেনা তাদের আলোচনায় যোগ দিয়েছে। 'সুরের
অপরিসীম শক্তি। তার প্রতিবাদ প্রকৃতির ফলনে, পাতার ফুটে ওঠায়। 'কিন্তু অবাক হই
একটি বিষয়ে নূর। আপনার সুর খুব চেনা চেনা লাগে আমার।'
নূর হাসে। বলে না কিছু। সভা
ভেঙে যায়। অগ্রদ্বীপ যাবার আগে দেখল পাথরের উপর ঘাসফুলের চারা অনেকটাই যেন বেড়ে
উঠেছে।
রাতে রবাব নিয়ে নূর অপূর্ব গান
শোনালো। সে গান শুনে অগ্রদ্বীপের মনে হল সেই সুরে তার দেশের মাটির গানের সুরের
আশ্চর্য মিল! কখনও সে যেন খুলনা, কখনও হায়লাকাণ্ডি, কখনও বোলপুর, কখনও বস্তার, কখনও কোভাল্লামের
স্বর শুনতে পেল। এ কী করে সম্ভব। এথেনাকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল, "নূর যা গাইছে তা পৃথিবীর উৎসসঙ্গীত। ঠিক যেমন সপ্তস্বর থেকে
জন্ম নিয়েছিল ছটি রাগ। ষড়জ থেকে ভৈরব, ঋষভ থেকে মালকৌশ, গান্ধার থেকে
হিন্দোল,
মধ্যম থেকে দীপক, পঞ্চম থেকে মেঘ আর ধৈবত থেকে শ্রীরাগ।
-এ তো মম্মট আচার্যর
প্রাচীন সঙ্গীত রত্নমালার সূত্র। এই সূত্র আপনি জানলেন কী করে এথেনা?
এথেনা ম্লান হয়ে তাকিয়ে দেখে
অগ্রদ্বীপকে।
-যে সঙ্গীত একদিন
আপনাদের ভূখণ্ডকে অনন্য করেছিল, তাকে রেনেসাঁ পাগল
য়োরোপীয় সভ্যতা চিনতে পারেনি, একথা যেমন ঠিক, ঠিক তেমনই তৃতীয় ঔপনিবেশিক সভ্যতা থেকে উন্নত প্রথম বিশ্বে
পদার্পণ করে আপনারাও সেই স্বর ও সুরের শক্তি ভুলতে বসেছেন। একসময় আমাদের দেশের
ফেলে দেওয়া জিনিস আপনারা কুড়িয়ে নিতেন। এখন আপনাদের উন্নত দেশজ সঙ্গীত সপ্তস্বর রাগরাগিণী
পরিত্যাগ করেছে। আমরা সেগুলো গ্রহণ করলাম। মন্দ কি?
মৃদু স্বরে গাইছে নূর।
অগ্রদ্বীপ আশ্চর্য হয়ে দেখল, নূরের গান গাইবার
সময় তার দেশের শব্দহীন বাসিন্দারাও মৃদু মৃদু গুণগুণ করছে। প্রার্থনা ঘরে সবাই যেন
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছে কোনও জাদুবলে। আপনমনেই অগ্রদ্বীপ বলে উঠল, "আশ্চর্য!" এথেনা সচকিত হয়ে বলল,"কী?"
-আপনার কথা যদি ঠিক
হয়,
তাহলে নূর নিষাদে তার গান গেয়ে চলেছে। নিষাদ তো সঙ্গীত
রত্নমালা অনুসারে নিঃসন্তান রাগ। এর অর্থ এই গান ভারতীয় রাগরাগিণী কোনও বইতে লেখা
নেই!
-ঠিক।
রাত সঘন হতে সঙ্গীতপরিবেশনা শেষ
করল নূর। সায়াহ্নভোজের পর সকলে যে যার নিজের তাঁবুতে ফিরে গেল। এথেনা আর অগ্রদ্বীপ
আবার সেই টিলার দিকে এগিয়ে গেল। নিঝুম রাতাকাশে অসংখ্য জোনাকীর মতো তারা। চাঁদের
আলতো আস্তরণ।কিছুক্ষণ পরে তাদের সঙ্গে নূরও যোগ দিল।
-কেমন লাগলো আমার
গান?
-অপূর্ব।
অগ্রদ্বীপ জিজ্ঞেস করল,"এ রাগ আগে কখনও শুনিনি। এ কোন রাগ?" নূর বলল।
-আমার আব্বা আমাকে
এই রাগ শিখিয়েছিল। আব্বা শিখেছিল তার আব্বার কাছ থেকে। আব্বা বলত এই সুরে গান করত
আল্ত্রামিরা ভিমভেটকার গুহামানবরা। ভাবুন তো। পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই উপজাতি।
দেখা নেই সাক্ষাৎ নেই। অথচ দুজনের চিন্তাতরঙ্গর কেমন মিল। আব্বা আমাকে তেমন একটি
লিপিও শিখিয়েছিল। পৃথিবীর আদিম লিপি। সব মানুষের মনের ভাষা।
এথেনা আকাশের দিকে তাকিয়েছিল।
হঠাৎ বলল, "আবদুল্লা বলছিল আপনি লরার ব্যাপারে কিছু জানেন। কী জানেন?"
নূরের মুখে তারার আলো পড়ে তাকে
আরও রহস্যময়ী করে তুলল। সে বলে চলল।
-আমরা প্রথমে যে
উদ্বাস্তু শিবিরে ছিলাম, সেখানকার কিছু তরুণ
ছেলে একদিন ইশতারদের কব্জা থেকে একটি ছোট্ট শিশু আর তার বৃদ্ধা দাইমাকে উদ্ধার
করে। দাইমা বেশিদিন বাঁচেননি। তবে মৃত্যুর তিনি বলে যান ওই শিশুর নাম 'লরা'। ওর একটি যমজ বোন
আছে। তার নাম এথেনা। লরা আমাদের সঙ্গেই বেড়ে ওঠে। তখন চারপাশে মহাযুদ্ধের আবহ।
লরাকে ছোটবেলা ওই একই সুর গুণগুণ করতে শুনেছিলাম। আমার আব্বা ওই সুর শুনে চমকে
উঠেছিলেন। তার সুর আর ওই সুরে কি আশ্চর্য মিল।
-তারপর?
-তারপর লরা বেড়ে
উঠছিল। হঠাৎই একদিন ইশতারপন্থীরা আমাদের আক্রমণ করল। লুটপাট করে ফিরে যাবার আগে
তারা লরাকে নিয়ে গেল।
-কিন্তু লরাকে তারা
দেখে চিনল কী করে?
-তার চোখের মণির রঙ
দেখে। হালকা সবুজ। অবিকল আপনারই মতো এথেনা।
অগ্রদ্বীপ দেখল এথেনা
কাঁদছে। নিজের সহোদরা বোনকে হারাবার যে বেদনা সে এতোদিন বুকের ভিতর চেপে রেখেছিল, সেই যন্ত্রণা আবার তার চোখে মুখে ফিরে এসেছে!
-তারপর?
-তারপর লরা কোথায়
আমরা আর কেউ জানি না। তাছাড়া এর পরে পরেই আমরা মেরুপ্রদেশে চলে আসি। উপায় ছিল না।
পরে আপনার কথা জানতে পারি। জানতে পারি আপনি হোলোদোমোরে আছেন। ছবিতে আপনার ছবি দেখে
নিশ্চিত হই, আপনিই লরার বোন। এটুকুই বলার।
আর কথা হল না তেমন। যে যার
নিজের তাঁবুর দিকে ফিরে গেল।
সারারাত ঘুম এল না অগ্রদ্বীপের।
বারবার একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার ভিতর। ইশতারপন্থীরা পার্শ্ববর্তী প্রদেশ
আক্রমণ করেছে। আবদুল্লা বলছিল, হোলোদোমোরের এই
শিবিরের কথা তাদের আর অজানা নেই। আক্রমণের জন্য মাত্র বাহাত্তর ঘন্টা সময় আছে
হাতে। এদিকে শিবিরে খাদ্যের পরিমাণ ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। শিবিরের পশ্চিমপ্রান্তে
শিবিরের স্বেচ্ছাসেবকদের শস্য ফলাবার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।মাঠের পর মাঠ, বাঁজা হয়ে পড়ে আছে। কী হবে তারপর? তারাও কি শরণার্থী বনে যাবে? মহাযুদ্ধের পর গোটা পৃথিবীটাই কেমন শরণার্থী শিবির বনে গেছে। কারো কোনও শিকড়
নেই,
নিজস্ব ঠিকানা নেই, পদবী নেই, ভাষা নেই। গোটা পৃথিবীর মানুষের একটাই
অ্যানথেম। উদ্বাস্তুর অ্যানথেম। ভাবতে ভাবতে অগ্রদ্বীপ রাতভর জেগে রইল। ভোরবেলা
তাঁবু থেকে বেরিয়ে সে শিবিরের পশ্চিমদিকে হেঁটে গেল। ভাদুড়িবাবু এসময়ে থাকলে কী
লিখতেন কি জানি! হয়তো কুয়াশায় ঢাকা ক্ষেতের ভিতর শিবিরের আলোগুলো জোনাকি বলে
বর্ণনা করতেন। তার ভিতরে স্বপ্নরাজ্যের মরণাধারের কাঠের সাঁকোর মতো হয়তো টিম টিম
করে জ্বলে থাকত পায়রাডাঙার সুধন্য ফাউণ্ডেশন। অগ্রদ্বীপ ভাবছিল গতকাল নূরের গানে
জেগে ওঠা ঘাসফুলের ঘটনাটুকু কি বাস্তব ছিল, নাকি কল্পনা। কী এমন আছে নূরের গানে যা সকলকেই স্বপ্নাবীষ্টের মতো টেনে
নিচ্ছে। মূক বাক্য ফিরে পাচ্ছে, জড় বাঙ্ময় হয়ে
উঠছে! ছটি স্বরের একটি সুর। অর্থাৎ ষাড়ব। তার দেশজ। অথচ অগ্রদ্বীপের দেশে এখন শুধুই
পাশ্চাত্য বিটমিউজিক আর হারমোনিক প্রোগ্রেশনের চল। অথচ তাদের ফেলে দেওয়া দেশজ
সংস্কৃতি তুলে নিয়েছে আমেরিকা ব্রিটেনের মতো পিছিয়ে পড়া দেশ। প্রাচীন ভারতীয়
সঙ্গীতশাস্ত্র অনুসারে ষাড়ব পরিবেশন রোগমুক্তি,
হতাশামুক্তি ও চিন্তামুক্তি ঘটায়।
হঠাৎ একটা সম্ভাবনার কথা মনে আসতেই আনন্দে সচকিত হয়ে উঠল সে। হ্যাঁ। একবার এথেনাকে
জানালেই হয়। আরও দুদিন সময় আছে হাতে। একটা শেষ চেষ্টা করা যাক না।
(ক্রমশ। পরের পর্ব ২২ অক্টোবর)
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী ছবি ফেসবুক থেকে |
লেখক পরিচিতি - শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তীর জন্ম কলকাতায় ১৯৮০। কিন্তু শহর কলকাতার সঙ্গে তাঁর বিশেষ যোগাযোগ নেই।বাল্যকাল থেকেই যাপনের সিংহভাগ কেটেছে মফসসলের অলিগলি ভগ্নদেউল আর বনবিথির ভিতর। সেই সূত্র ধরেই কখন লেখালিখির শুরু। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'আকাশপালক' প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। দ্বিতীয় কবিতার বই 'শিকারতত্ত্ব' সাহিত্য একাদেমি যুব পুরস্কারের চুড়ান্ত পর্যায়ে মনোনীত হয়। প্রথম উপন্যাস 'কাকতাড়ুয়া' প্রশংসিত ও আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। মূলত লিটল ম্যাগাজিনে লিখলেও নানান বাণিজ্যিক পত্রিকাতেও লেখা প্রকাশিত হয়ে চলেছে। অতিথি সম্পাদক হিসাবে কিছুদিন সামলেছেন একটি দৈনিকের সাহিত্যের পাতা। সম্পাদনা করেন 'শামিয়ানা' সাহিত্যপত্র। প্রিয় নেশা - ফিল্ম, নাটক, সঙ্গীত ও ভ্রমণ। প্রিয় অবসরবিনোদন মনোবিজ্ঞান চর্চা।
পেশাগতভাবে তিনি একজন গ্রামকেন্দ্রিক মনোবিজ্ঞানী।
আকাশপালক (প্রকাশনা - পাঠক। ২০১৪)
শিকারতত্ত্ব (প্রকাশনা - আদম। ২০১৪)
আড়বাঁশির ডাক (প্রকাশনা - দাঁড়াবার জায়গা। ২০১৬)
জনিসোকোর ব্রহ্মবিহার (প্রকাশনা - পাঠক। ২০১৮)
www.synapsepatrika.com
1 মন্তব্যসমূহ
পড়লাম। দুর্দান্ত শুরু! ... এমনও হতে পারে, হতেই পারে। আসতে থাকুক
উত্তরমুছুন