সাইন্যাপস্‌ অণুগল্প ৭


যেমনভাবে আমরা প্রত্যয়ের কাছে যাই
রাজীব কুমার ঘোষ


আমি মাস্ক পরে দরজা খুললাম। বৃষ্টি বন্ধ হলেও, রাস্তায় জমা জল। দরজার সামনে বাইকের ওপর প্রলয়, পার্থ। আমি বললাম, ‘কী  ব্যাপার রে?’

    প্রলয় বলল, ‘রেডি হয়ে আয় আমরা বেরোবো

    এই লকডাউনে, ভরা করোনায় কোথায় যাব?’

     পার্থ বলল, ‘আমরা প্রত্যয়ের কাছে যাব।

     আমি চমকে উঠলাম, ‘কী বলছিস! পাগল হয়েছিস নাকি? প্রত্যয়ের কাছে যাবি মানে? ওর করোনায় চলে যাবার কথা আমিই তো তোকে ফোন করে জানিয়েছিলাম। তুই শুনে বললি, তোর হাত পা কাঁপছে। কেন এই বিচ্ছিরি রসিকতা করছিস?’

     প্রলয় বলল, ‘রেডি হয়ে জলদি আয়। প্রত্যয় অপেক্ষা করছে।

     আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ওরা কী বলছে! প্রলয়কে বললাম, ‘এই কী বলছিস? তুই তো আমাকে ফোন করে খবরটা দিয়েছিলিস! সকালবেলা, মনে নেই তোর? তুই বললি একটা খারাপ খবর আছে।

     দুজনে উত্তর দিল না, কেবল বলল, ‘চলে আয়।

     আমি জোর গলায় বললাম, ‘আমি কোথাও যাব না। প্রত্যয় কোথাও নেই। তোদের যেখানে যাবার যা। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। তৃতীয় ঢেউ আসছে। আমার কোমর্বিডিটি, হাই প্রেসার, হাই সুগার। কোন প্রত্যয়ের কথা বলছিস আমি জানি না। তোরা চলে যা, যেখানে যাবার।

     ওরা ওদের বাইকের স্টার্ট বন্ধ করেনি। ওরা হাল্কা হাল্কা চাপ দিচ্ছে একসিলেটরে। বাইকদুটো গোঁ গোঁ করছে। লকডাউনের ফাঁকা রাস্তায় আওয়াজটা নিজেই নিজেকে বাড়িয়ে তুলছে একটা ক্রুদ্ধ চিৎকারের মতো। ওরা এবার খুব চাপা স্বরে বলছে, প্রত্যয় অপেক্ষা করছে মন্ত্র জপের মতো বলেই যাচ্ছে ক্রমাগত। আমি মোহগ্রস্তের মতো ফিরলাম জামা কাপড় পরতে। ডাবল মাস্ক পরতে। স্যানিটাইজার নিতে। সত্যিই কি ওরা ... আমরা প্রত্যয়ের কাছে যাচ্ছি?

* * * * * *

মাথার ওপর ছড়ানো আকাশটা ভুটভটির নিচে জল হয়ে ছড়িয়ে আছে। আমরা আকাশের মতো ছড়ানো জলের ওপর ঘোলা স্রোত কেটে  চলেছি। আগা-গলুইতে প্রলয় বসে। মাঝে আমরা কজন। ভুটভুটি ভর্তি খাবার-দাবার, ওষুধ-বিষুধ, তেরপল, কিছু জামা কাপড় আর জলের বোতল। একটু দূরে একটা বাঁধ জেগে আছে। ওপরে অনেক লোক। আমি চোখের ওপর হাতের ছায়া দিলাম। আমি দেখতে চেষ্টা করছি ওদের মধ্যে প্রত্যয় কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। যেমনভাবে ও কোমরে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, যেমনভাবে ও মাথাটা বাঁদিকে কাত করে  রাখে, যেমনভাবে ও হাঁক পাড়ে অনেকদিন পর দেখা হলে, যেমনভাবে ও অস্থির হয়ে উঠলেই একটু দুলতে থাকে। অথবা ও-কি ওই আদুলগা লোকগুলোর মধ্যে? যারা ধুয়ে যেতে থাকা বাঁধটার গায়ে বুক লেপ্টে শুয়ে নিজেদের পিঠে ঢেউগুলোকে নিয়ে নিচ্ছে বাঁধটাকে বাঁচাতে? 

আমি নজরটা সরু করে ওকে খোঁজার চেষ্টা করছি আর আমার নজরটা কেবলই ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমি হাল ছেড়ে দিলাম। চোখের ওপর থেকে ছায়া সরিয়ে নিলাম। তাড়া কিসের। আর একটু গেলেই দেখা পাব। আমরা তো অন্তত যাচ্ছি, যেমনভাবে আমরা প্রত্যয়ের কাছে যাই। যেমনভাবে প্রত্যয় ওদের কাছে যেত। যেমনভাবে যায় প্রত্যয়রা, প্রত্যয়দের কাছেই। 🚫



রাজীব কুমার ঘোষ
‘চুঁচুড়ার রাজীব’ মানেই ‘সহদেববাবুর ঘোড়া’, ‘ভীষ্মদেবের মৃত্যুমুহূর্ত’, ‘অনেক জলের শব্দ’, ‘টাওয়ার অফ্ সাইলেন্স’, ‘হিবাকুশার ছেলে’ বা ঘোষ স্যারের গল্পগুলি — বহুচর্চিত, ভিন্নমাত্রার কিছু গল্প। জন্ম ১৯৭৭; পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা চুঁচুড়া-হুগলি-চন্দননগর। ১৯৯৭ সাল থেকে লিটল ম্যাগাজিন কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত এবং নিয়মিত লেখালেখি। সম্পাদিত পত্রিকা ‘সাইন্যাপস্’। আছে বেশ কিছু কবিতার বই। প্রকাশিত গল্প সংকলন ‘ঘর ও দরজার গল্প’, ‘অনেক জলের শব্দ’, 'আমাদের আশাতীত খেলাঘর'। গল্পের জন্য বারাসাতের বহুস্বর পত্রিকার পক্ষ থেকে পেয়েছেন ২০১৯ সালের ‘অনন্তকুমার সরকার স্মৃতি পুরস্কার’। অণুগল্পের জন্য ২০১৮ সালে চুঁচুড়ার গল্প সল্পের আটচালার পক্ষ থেকে পেয়েছেন ‘উৎপল স্মৃতি পুরস্কার’। 
পেশায় বিজ্ঞান শিক্ষক। নেশায় পাঠক। প্রিয় অবকাশ যাপন  পাঁচশো বছরের পুরনো জনপদের অলিগলিতে সময়ের ভাঁজে ভাঁজে ঘুরে বেড়ানো।

সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা ওয়েবে প্রকাশিত

অন্য অণুগল্পগুলি পড়ার জন্য
ক্লিক করুন 👉  সব অণুগল্প


আপনার মতামত নিচে 
'আপনার মন্তব্য লিখুন' শীর্ষক বক্সে লিখে 
আমাদের জানান। 
লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকে 
পাঠকদের মতামতে। 🙏