।। আলোচনা ।।

সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা ।। গ্রন্থ আলোচনা ১।।
আলোচিত গ্রন্থ (গল্প সংকলন) : অনেক জলের শব্দ
লেখক : রাজীব কুমার ঘোষ
আলোচক : আনসারউদ্দিন

রাজীবের গল্পে জলতরঙ্গের সুর।। আনসারউদ্দিন

রাজীব কুমার ঘোষ ও আনসারউদ্দিন
ছবি - সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা

 বিশিষ্ট সাহিত্যিক আনসারউদ্দিন ২০১৮ সালে রাজীব কুমার ঘোষের অনেক জলের শব্দগল্প সংকলন প্রকাশের পর একটি লিখিত পাঠ প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন সাইন্যাপস্‌ পত্রিকাকেসেই লিখিত আলোচনাটি সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার প্রথম ওয়েব সংখ্যায় প্রথম আলোচনা হিসাবে প্রকাশিত করা হল। প্রথম আলোচক আনসারউদ্দিন।

     তবার(২০১৮) চুঁচুড়ার গল্প-সল্পের আটচালায় বসে থাকার সময় হঠাৎ করে একটি বই আমার হাতে এসেছিল। বইটির নাম "ঘর ও দরজার গল্প", লেখক রাজীব কুমার ঘোষ। পেশায় বিজ্ঞানের শিক্ষক, নেশায় সাহিত্যযাপন এবং সাইন্যাপস্ পত্রিকার সম্পাদক। বলা ভালো এর আগে রাজীবের গল্প সম্বন্ধে আমার বিশেষ ধারণা ছিল না। বইটি হাতে পাবার পর একদিন অগোছালো পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কতগুলো লাইন ক্যারক্যার করে চোখে বিঁধে গেল। এমন হলে তো পড়তেই হয়। পড়তে শুরু করলাম। প্রথম গল্প পড়েই চমকে উঠলাম। তারপর একে একে অন্যান্য গল্প। ভাবলাম এভাবেও কি জীবনকে ধরা যায়! সাধারণভাবে যেভাবে গল্প লেখা হয় রাজীবের গল্পের নির্মাণ তার থেকে স্বতন্ত্র। গল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে তার অঅনুকরনীয় জীবনদর্শন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। এমন মুগ্ধতা খুব কম লেখকই পাঠকের কাছ থেকে আদায় করে নিতে পারেন।

প্রশ্ন হল রাজীব যেভাবে গল্প লেখে সেভাবে কি খুব বেশি আশা করা যায়। গল্প তো শুধু লেখা নয়, নির্মাণেরও। কাহিনীর অনুপুঙ্খ বর্ণনার ব্যতিরেকে তার মধ্যে যে জীবন সত্য লুকিয়ে থাকে সেই জীবন সত্যকে পাঠকের দরবারে তুলে ধরাই একজন লেখকের কাজ। রাজীবের গল্প সেই জীবনসত্যের সন্ধান দেয়।

 একথা বলার মূল অনুষঙ্গ হল সম্প্রতি রাজীব কুমার ঘোষের আরেক গল্পগ্রন্থ পাঠের অভিজ্ঞতায় পুষ্ট হলাম। গল্প সংকলনটির নাম "অনেক জলের শব্দ"। এতে বড়, ছোট, অণুগল্প সহ মোট তেরোটি গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে। এই তেরোটি গল্প শুধু গল্প নয়, এগুলির মধ্য থেকে উঠে এসেছে আমাদের সমাজ, সাহিত্য, সভ্যতা, শিক্ষা ও ভৌগলিকতা। তার সঙ্গে লক্ষ্য করেছি আমাদের যাপিত জীবনের ক্ষয় অবক্ষয় আর ভাঙা গড়ার ইতিহাস।

 সংকলনের প্রথমেই আছে নাম গল্প " অনেক জলের শব্দ"। এ গল্পে অংশুমান ভট্টাচার্য নিজেকে ভূগোলের শিক্ষক হিসাবে পরিচয় দিলেও আসলে তিনি তা নন। হারিয়ে যাওয়া নদীর খোঁজে বেরিয়েছেন তিনি। কিছুদিন আগে কলেজ স্ট্রিটের পুরানো বইয়ের দোকানে পাওয়া একটা নাটকের বই তাঁকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করে। বইটির নাম 'প্রবীরার্জুন'প্রথম পাতায় লেখা ছিল নাম সহ ঠিকানা - শ্রীজীতেন্দ্রনাথ ঘোষ, পাঁচশিমূল, বর্ধমান, সন ১৩৭৪ ; এই সূত্র ধরে পাঁচশিমূলে আসা তাঁর। বইটির পিছনের মলাটের ছেঁড়া অংশে কালি পেনে লেখা, "ভালুকা নদীর কোন চিহ্নই বর্তমানে নাই। একটি নদী বিস্মৃতির অতলে নিমজ্জিত হইল।" নদীর মতো আমাদের জীবন প্রবাহের নিয়ত খাত বদল হচ্ছে তা এই গল্পের পরতে পরতে অনুভূত হয়। বারিধি, মেঘনা চরিত্রগুলো তো নদী থেকেই উঠে আসা। ভালুকা নদীর মতো অনেক নদী কেন্দ্রিক মানুষের জীবনের ইতিহাস লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। গল্পের শেষে রাজীব লেখে, "ভুলে যাওয়া নদী খোঁজা একটা মানুষ চলে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে ঠিক নদীর মতন। আমি দাঁড়িয়ে আছি ভালুকা নদীর কবেকার মরা খাতে...

     দ্বিতীয় গল্প "টাওয়ার অফ সাইলেন্স"। এই গল্প চুঁচুড়া কেন্দ্রিক বিভিন্ন ঘটনার কোলাজ। রাজীব মৌসুমীর ব্যক্তিগত অংশগ্রহণ গল্প নির্মানের ক্ষেত্রে অন্যরকম গতি এনে দিয়েছে। প্রফুল্ল গুপ্তের মত একজন সাহিত্যিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পেয়ে যাই বিমল কর, দিব্যেন্দু পালিত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, দেব দুলাল, কবিতা সিংহ প্রমুখ বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের। পেয়ে যাই গল্প সল্পের আটচালার গড়ে ওঠার ইতিহাস। নামকরণের ইতিহাস। এর সঙ্গে আরো অনেক পত্র পত্রিকার কথা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এ গল্পের মূল চরিত্র প্রফুল্ল গুপ্তকে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে আরো অনেক সাহিত্যচর্চার ইতিহাস। তবু এই মানুষটিকে লেখালেখির জগত থেকে সরে আসতে হয়। এটাই বেদনার।

 "মাটি, বাধা উচ্চতা" এই সময়েরই গল্প হলেও কয়েক প্রজন্ম ধরে গল্প আবর্তিত। তমালবাবুর একটা সময়ে বাইক কেনা দূরের কথা সাইকেল কেনার সামর্থ্য ছিল না। সময়ের নিরিখে পিছিয়ে পড়ছেন তিনি এগিয়ে যাচ্ছে ছেলে বিমান। সে মোটরবাইকে চড়ে। পুরনো বাইকের পরিবর্তে নতুন মডেলের বাইক কেনে সে। অথচ তমালবাবু পড়ে থাকেন সেই সাবেক যাপনে। নদী আকাশ বাতাস পাখি বৃষ্টি এসব তো বড় উদ্বায়ী। মোটরবাইক তেমনিই একটি যানবাহন। তিনি বাইকের গ্রাউন্ড ক্লিয়ারেন্স মাপতে চান। নাতি বলেছিল ওয়ান সিক্সটি এম এম। তা কি মোটর বাইকের সিটের উচ্চতা ধরে? এসব হিসাব নিকাশের মধ্যেই তমালবাবুর মনে হল — খোকা এখন প্লেনে — প্লেনের ক্লিয়ারেন্স কত হয়? মনে হয় সেটা মিলিমিটারে নয়, মিটারে মাপা হয়। আর এখন প্লেনটা নিশ্চই হাজার ফুট ওপরে। কোনও স্পিড ব্রেকার আজ বিমানটিকে বাধা দিতে পারবে না। তমালবাবুর আঙ্গুল দাগ পেরিয়ে চলেছে উঁচুতে আরো উঁচুতে . . .

 অসাধারণ এই গল্প রাজীবের। খুব সাধারণভাবে শুরু করা এই গল্প জীবনের হিসাব নিকাশ উল্টোপাল্টা করে বিমান বা প্লেনের মতোই অসাধারণ উচ্চতায় নিয়ে যায়।

 'কালো মেঘের দিন' একটি প্রতীকি গল্প। এ গল্পে রবি ঠাকুরের গাড়ি হাম্বার সেডানের কাহিনী উঠে আসে। গাড়ি যেন কোম্পানীর মালিক টমাস হাম্বার হয়ে কথা বলছে। রাজীব এক জায়গায় লিখছে, "হাম্বার সাহেবের কথার মাঝে কল্পনা করছিলাম দৃশ্যটা। যেন দেখতে পাচ্ছিলাম হাম্বার সাহেব সারা গায়ে ধূলো মেখে ওই থামলেন। নামছেন রবীন্দ্রনাথ।" রাজীবের বর্ণনায় গাড়ি আর গাড়ি থাকে না, হয়ে ওঠে টমাস হাম্বার আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেমে আসার বিমূর্ত ধারণা বড়ই মূর্ত হয়ে ওঠে।

 এছাড়া 'অনন্তে যে কথা আছে', 'বন্দর' কিংবা 'আলাপ' গল্পে সময়ের মূল্যবোধের কথা উঠে এসেছে। অনাদিমামার রেডিওতে কত শত আলোকবর্ষ পার হওয়া শব্দ তরঙ্গ ধরা পড়ছে। কিংবা 'বন্দর' গল্পে এই একবিংশ শতাব্দিতেও একটা নৌকা সারাইয়ের মিস্ত্রির খোঁজ বড় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যার যাত্রী বলতে একটা ছবি আর যাত্রাপথ অনির্দিষ্ট। এ গল্পের শরীর নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের মোড়কে। এসেছে আলিপুর বোমা মামলার কথা, 'ধর্ম' আর 'কর্মযোগীন' পত্রিকার কথা আর বিপ্লবী ঋষি অরবিন্দের কথা। আমরা কি জানতাম তিনি অমরেন্দ্রবাবুর তত্বাবধানে চাঁদপাল ঘাটে এসে পৌঁছেছিলেন!

 আজ স্বাধীন দেশে বাস করেও আমাদের লক্ষ্যহীন যাত্রাপথ। একই নৌকায় সওয়ার হয়েও পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস, হিংসা হানাহানি। আমরাও কি 'বন্দর' গল্পের মতো কুয়াশাচ্ছন্ন রাতের সমুদ্রের দিকে ভেসে যাচ্ছি না?

 রাজীবের গল্পের একটি অভিনব ব্যাপার হল, খুব স্বাভাবিক এবং হালকা চালে শুরু হওয়া গল্প নির্মিতির সূত্রে এক বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছে যায়। তেমনই একটা গল্প হল 'নটরাজ'রুদ্রর মাধুরী দীক্ষিত, রবিনা ট্যান্ডন, ঊর্মিলা মাতন্ডকর, করিশ্মা, শিল্পা শেঠির সঙ্গে স্বপ্নের নাচ দিয়ে যে গল্পের শুরু সেই নাচই বাস্তবের মাটিতে সত্য হয়ে ওঠে গণেশ টকিজের মোড়ে ভেঙে পড়া উড়ালপুলের মধ্য দিয়ে। সম্প্রতি পরপর বেশ কয়েকটি উড়ালপুল ভেঙে পড়া আর কিছু অসহায় মানুষের মৃত্যু, কংক্রিটের মধ্যে আটকে থাকা মানুষের গোঙানি কাতরানি বারবার স্মৃতিতে ফিরে আসছে। সরকার আর রাজনৈতিক দলের তরজা শুনতে শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। এই তরজার মধ্যে শাবানা বানুরা প্রত্নবস্তু হয়ে মিশে থাকে মহেঞ্জোদারোর মত মৃত নগরীতে। রাজীব লেখে, "টি ভি চলছে। টি ভি থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে কংক্রিটের চাঙ, টুকরো দেহ। ঝলকানো ছবি খেলা করছে ঘরে। শব্দ ঝরে ঝরে পড়ছে। রুদ্রর মনে হল এতদিনে সে সঠিক নৃত্য খুঁজে পেয়েছে। শিবপদ ভঙ্গীতে দাঁড়াল রুদ্র। সেই কবেকার দেখা তান্ডব নৃত্যের মুদ্রাগুলো আজ স্মরণ করছে সে।"

 রাজীবের এই গল্প সংকলন সমন্ধে যে আলোচনা তা আমার ব্যক্তিগত পঠন প্রতিক্রিয়া। তবু নিজের উপর আস্থা রেখেই বলছি বইটি পাঠের পর তন্নিষ্ঠ পাঠক আমার সঙ্গে সহমত হবেন। আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস আর ফেলে আসা যাপনচিত্র রোমন্থন করতে করতে 'অনেক জলের শব্দ' শুনতে পাবেন। যে শব্দ শুনতে হলে কান পাততে হবে মাটিতে। এই মাটি থেকেই রাজীব কুমার ঘোষের নির্মাণ শুরু হয়, নেহাৎ কল্পকথা বা গল্পকথা দিয়ে নয়।

 


 অনেক জলের শব্দ

রাজীব কুমার ঘোষ
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০১৮
প্রকাশক : দ্য কাফে টেবল
১০৪ পৃষ্ঠা, মুদ্রিত মূল্য ১২৫ টাকা
প্রচ্ছদ একতা ভট্টাচার্য

 পাঠক বইটি সম্পর্কে আগ্রহী হলে আমাদের ওয়েব সাইটের হোম পেজে গিয়ে SYNAPSE STORE বিভাগে দেখতে পারেন