আলোসাগরের ঢেউগুলি – ৬ 

রাজীব কুমার ঘোষ 

 আলোচিত পত্রিকা

তবু একলব্য : বাংলাদেশের কথাসাহিত্য (বিশেষ সংখ্যা), জানুয়ারি-মার্চ ২০২০

দি গৌরী কালচারাল এন্ড এডুকেশনাল অ্যাসোসিয়েশন সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্য গবেষণাকেন্দ্র প্রকাশিত ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণা পত্রিকা

কার্যনির্বাহী সম্পাদক : সুশীল সাহা

সম্পাদক : দীপঙ্কর মল্লিক

যুগ্ম সম্পাদক : দেবারতি মল্লিক ও তাপস পাল

পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৮১২

মুদ্রিত মূল্যঃ ৫৫০ টাকা


তবু একলব্য গবেষণা পত্রিকার ‘বাংলাদেশের কথাসাহিত্য’ সংখ্যাটি এই সময়ে কথাসাহিত্যের পাঠক ও তরুণ গবেষকদের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি সংখ্যা, সাহিত্যের ছাত্রদের কাছে তো বটেই। সত্যি কথা বলতে কী পশ্চিমবঙ্গের বহু পাঠকের কাছেই বাংলাদেশের কথাসাহিত্য নিয়ে খুব স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ ধারণা নেই। যাদের আছে তারা অনেক সময়েই এই অবস্থার জন্য পাঠকদেরই দায়ী করেছেন। পাঠকদের অবশ্যই দায় আছে জানার কিন্তু তারা কীভাবে তুলনামূলক সহজে বাংলাদেশের কথাসাহিত্য নিয়ে একটি মোটামুটি ধারণা পেতে পারে তার জন্যও উদ্যোগ প্রয়োজন। সেই ভাবনায় এগিয়ে এসেছে ‘তবু একলব্য’ লিটল ম্যাগাজিন। বর্তমান সংখ্যাটি আয়তনে বিপুল এবং মূল্য কম নয় বলে কেউ হয়ত এর লিটল ম্যাগাজিন অভিধা নিয়ে কটাক্ষ করতে পারেন কিন্তু ভালো কাজ করতে গেলে এবং অনেকটা পরিধি নিয়ে কাজ করতে গেলে আয়তনলাভ অনিবার্য। অনেকেই এই ধরণের গবেষণামূলক লিটল ম্যাগাজিনকে প্রকারন্তরে ব্যঙ্গ করেন ছাত্রদের জন্য নোটবুক বলে কিন্তু অনেক সময় তা মুড়ি মিছরির এক দর ঘটনায় পর্যবসিত হয়। মুড়িকে মিছরি থেকে আলাদা করতে হলে দুটিরই আস্বাদ গ্রহণ করতে হয়। বিনা আস্বাদে নিদান দেওয়ার এই প্রবণতা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে চলে। সেই আস্বাদ বিচারে বলা যায় বর্তমান সংখ্যাটি একটি অবশ্য সংগ্রহযোগ্য সংখ্যা।

        সর্বমোট ২১টি পর্বে পাঠকদের কাছে বাংলাদেশের কথাসাহিত্য ও কথাসাহিত্যিকদের উপস্থাপনা করার প্রয়াস করা হয়েছে। প্রথম পর্বে বিশেষ আলোচনায় আছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বিষবৃক্ষ নিয়ে হাসান আজিজুল হকের একটি প্রবন্ধ এবং নিজের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে সেলিনা হোসেনের প্রবন্ধ ‘সৃষ্টির নেপথ্যে স্রষ্টার ভাষ্য’।

হাসান আজিজুল হক ইলিয়াসের সৃষ্টি নিয়ে মন্তব্য করেছেন, “এতকাল সাহিত্যে দাপট দেখিয়েছে প্রেম, ভালোবাসা, মায়া, মমতা, বিশ্বাস, আস্থা এক কথায় যাকে বলে মানবিকতা। আর এই মানবিকতার অছিলায় আমাদের সাহিত্যে জঞ্জালের মতো ঢুকে পড়েছে খেলো ভাবপ্রবণতা। সন্দেহ হয়, ইলিয়াস আমাদের বলতে চান যে মানবিকতা আর মানুষতা এক জিনিস নয়। দয়া মায়া মমতা ভালোবাসাই কি মানব প্রকৃতির আসল পরিচয়? আর এগুলিকে সাহিত্যে পুজো করাই কি লেখকের একমাত্র কাজ? কে বলেছে এই সব আবেগ চূড়ান্তভাবে ভালো? নিষ্ঠুরতা, আক্রোশ, বিবমিষা কিংবা তীব্র ঘৃণাই বা সমান গুরুত্ব পাবে না কেন? . . . এদের কেউই ভালোও নয়, মন্দও নয়। এদের ভালো বা মন্দ বলা হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন উপযোগিতার দিকে লক্ষ্য রেখে। সুবিধে মতো। অতএব এগুলির উপর মূল্যবোধ আরোপ করতে লেখক বাধ্য নন।”

 নিজের লেখালেখি নিয়ে সেলিনা হোসেনের প্রবন্ধটি এই পত্রিকা থেকে অন্যতম মূল্যবান একটি প্রাপ্তি। তরুণ গল্পকারদের অবশ্যপাঠ্য। তিনি লিখছেন, “লিখতে লিখতে বুঝলাম লেখার জন্য অঙ্গীকার প্রয়োজন — প্রয়োজন সামাজিক দায়বদ্ধতা। শুধু শিল্পের জন্য নয়। মানুষের কথা মানুষের কাছে বলার জন্য লিখি — এই বলা কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো অপ্রত্যক্ষ। যা মানুষকে আনন্দ দেবে, ভাবিত করবে, সর্বোপরি তার বিবেকের তলদেশে একটি জিজ্ঞাসা জড়িয়ে রাখবে — যা তার ভালোমন্দ, শুভাশুভ বোধকে দিকনির্দেশনা দেবে। . . . এখনকার যা কিছু ভালো, যা কিছু গুরুত্ব বহনকারী তাকে উপস্থাপিত করতে হয় পরবর্তী প্রজন্মের সামনে, যেন কেউ ভুলে না যায় তার ঐতিহ্যকে . . .”

 বাংলাদেশের কথাসাহিত্য নিয়ে সামগ্রিক কিছু আলোচনা রয়েছে দ্বিতীয় পর্বে।

 পূর্ব-বাংলার কথাসাহিত্যের ভাষা নিয়ে লিখেছেন শহীদ ইকবাল। আলোচনায় তিনি তুলে এনেছেন বিভিন্ন গল্প এবং উপন্যাস, যেমন হুমায়ুন কাদিরের বিবেক গল্প, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘একজোড়া প্যান্ট ও অন্যান্য গল্প’, হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্প, আলাউদ্দীন আল আজাদের ‘শীতের শেষ রাত বসন্তের প্রথম দিন’ উপন্যাস, আবু ইসহাকের উপন্যাস ‘সূর্য-দীঘল বাড়ি’, সরদার জয়েনউদ্‌দীনের ‘অনেক সূর্যের আশা’ উপন্যাস, আবু রুশদের ‘নোঙর’ উপন্যাস, সেলিনা হোসেনের ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ উপন্যাস, শওকত আলীর ‘প্রাকৃতজন’ উপন্যাস, শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাস, জাহিরুল হকের ‘অগ্নিসাক্ষী’ উপন্যাস প্রভৃতি।

বাংলাদেশের উপন্যাসে নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবনচেতনা নিয়ে লিখেছেন আনিসুর রহমান। তার আলোচনা যে উপন্যাসগুলি নিয়ে আবর্তিত হয়েছে — শওকত ওসমানের ‘জননী’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’, শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সারেং বৌ’ ও ‘সংসপ্তক’ এবং আবু ইসহাকের ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’।

 শতবর্ষের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের উপন্যাসে গ্রাম-সমাজ নিয়ে লিখেছেন সুরজিৎ বেহারা। তার আলোচনায় যে সব উপন্যাস উঠে এসেছে — মোহাম্মদ নজিবর রহমানের ‘আনোয়ারা’, মোহম্মদ লুৎফর রহমানের ‘রায়হান’, কাজী আবদুল ওদুদের ‘নদীবক্ষে’, কাজী ইমাদুল হকের ‘আবদুল্লাহ’, সৈয়দ ওয়ালীউলাহের ‘লালসালু’, তাসাদ্দুক হোসেন-এর ‘মহুয়ার দেশে’, আবদুল গফফর চৌধুরীর ‘চন্দ্রদ্বীপেরর উপাখ্যান’, আহমদ ছফার ‘সূর্য তুমি সাথী’, সেলিনা হোসেনের ‘উত্তর সারথি’, হাসান ফেরদৌসীর ‘অন্যরূপ’, সৈয়দ সামসুল হকের ‘আয়নাবিবির পালা’, বশির আল হেলালের ‘শেষ পানপাত্র’, মঞ্জু সরকারের ‘প্রতিমা’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’। তিনি মন্তব্য করেছেন, “আসলে গত শতাব্দীর তিনটি প্রধান ভাঙন পর্বেই পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে নির্ভর উপন্যাসগুলি শোষণ ও অসহায়তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এখনও সেই ধারা অব্যাহাত। গ্রাম-বদলের চক্রান্তের পরিচয় হিসেবে এখনও নব্য-পুঁজিবাদ, নগরায়নের প্রসঙ্গে সত্য সেখানে।” তিনি গ্রামীন বাংলাদেশের অভিব্যক্তি ও রূপান্তরের অনুঘটক হিসাবে উপন্যাসগুলিকে তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশের ছোটোগল্পে বিভিন্ন বৃত্তিজীবী মানুষের কথা নিয়ে লিখেছেন বৈশাখী ব্যানার্জী। বিভিন্ন সাহিত্যিকদের রচনা থেকে তিনি তুলে এনেছেন বিভিন্ন বৃত্তিজীবী মানুষের উদাহরণ — উকিল, বাঁশি বিক্রেতা, জাহাজী, খালাসি, মাঝি, স্কুল মাস্টার, সাংবাদিক, মেয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা, পিওন, নীচু তলার কর্মচারী, কৃষক, কোচওয়ান, দারোগা, চৌকিদার, পশুর ডাক্তার, সিনেমার গেট কিপার, পতিতা, স্টেশন মাস্টার। তিনি লিখেছেন, “সকলেই তার পেশা ভালোবেসে নেয় না, কেউ নিতে বাধ্য হয়, কেউ অভাবে পড়ে নেয়। চাকরি করতে গিয়ে অফিসের বড়ো কর্তাকে খুশি রাখার আপ্রাণ চেষ্টা, কারোর বা আদর্শের সঙ্গে লড়াই, কারো বা সামান্য কারণে আদর্শচ্যুতি ঘটে। অনিয়মিত বেতন, চাকরি করতে গিয়ে নিজের পারিবারিক জীবনের ও ব্যক্তিজীবনের পাওয়া না পাওয়ার প্রভাব কাজে এসে যায়।”

বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে দেশভাগ নিয়ে লিখেছেন উৎকলিকা সাহু। তার আলোচনায় উঠে এসেছে সেলিনা হোসেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, তসলিমা নাসরিন, আল মাহমুদের বিভিন্ন রচনা।  এই বিষয়ে আরেকটি প্রবন্ধ লিখেছেন অচিন্ত্য দে।

বাংলাদেশের কমিক্স নিয়ে একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন অমৃতা চন্দ। তিনি লিখছেন, “বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের কমিক্সের সূচনা, ‘বিচিত্রা’ইয় প্রকাশিত রনবির ‘বারবারেল্লাহ’ এবং দৈনিক গণকন্ঠে প্রকাশিত ‘মহাকাশে মহাত্রাস’ দিয়ে। সাদা কালো দুনিয়ার পর যাঁর হাত ধরে বাংলাদেশের কমিক্সের যাত্রা শুরু তিনি হলেন মেহেদি হক।” তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধটি উপভোগ্য। পশ্চিমবঙ্গের কমিক্সের সঙ্গে তুলনায় তিনি মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের কমিক্সে নারী চরিত্রের ভিড় দেখা যায়।

আত্মজা ও একটি কবরী গাছ, খোয়াই নদীর বাঁকবদল, সুন্দর মানুষ, যুগলবন্দি আর মহাকালের খাঁড়া এই কয়েকটি গল্প নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন দীপঙ্কর মল্লিক

এরপর তৃতীয় পর্ব থেকে একুশতম পর্ব অবধি বাংলাদেশের ১৯ জন কথাসাহিত্যিককে নিয়ে রয়েছে একাধিক প্রবন্ধ এবং সৃষ্টির নানা দিক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা। এই কথাসাহিত্যিকরা হলেন — সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১০ টি প্রবন্ধ), আবু ইসহাক (৬ টি প্রবন্ধ), জহির রায়হান (২ টি প্রবন্ধ), শওকত আলী (৩ টি প্রবন্ধ), আল মাহমুদ (১ টি প্রবন্ধ), হাসান আজিজুল হক (১২ টি প্রবন্ধ), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (৮ টি প্রবন্ধ), সেলিনা হোসেন (২০ টি প্রবন্ধ), হুমায়ুন আহমেদ (৮ টি প্রবন্ধ), শহীদুল জহির (১ টি সাক্ষাৎকার এবং ১৪ টি প্রবন্ধ), তানভীর মোকাম্মেল (১ টি প্রবন্ধ), ইমাদুল হক মিলন (২ টি প্রবন্ধ), হরিশংকর জলদাস (৪ টি প্রবন্ধ), রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ (১ টি প্রবন্ধ), অনীক মাহমুদ (১ টি প্রবন্ধ), তসলিমা নাসরিন (১ টি প্রবন্ধ), নাসরীন জাহান (২ টি প্রবন্ধ), সিরাজুল হক (১ টি প্রবন্ধ), শওকত ওসমান (১ টি প্রবন্ধ)। এই বিস্তৃত আয়োজন পাঠককে পাঠশেষে ঋদ্ধ করে তোলে। স্বাভাবিকভাবেই পত্রিকার আলোচনায় সব প্রবন্ধ উল্লেখ করা একপ্রকার অসম্ভব ব্যাপার। তবুও আগ্রহী পাঠকদের জন্য কিছু উল্লেখ করা হল।


সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“আখ্যানময় সমান্তরালতার বহুল ব্যবহার তাঁর রচনাকে বিশিষ্ট করে তুলেছে ভিন্ন এক আঙ্গিকে।. . . ছোটোগল্পগুলির কথনশৈলীর লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে কী সাবলীল ছন্দে তিনি নির্মাণ করছেন এই সমান্তরাল প্যাটার্নগুলি।” (সীমা মাহাত)

“চাঁদের অমাবস্যা চেতনাপ্রবাহ রীতির উপন্যাস। ফলে এই উপন্যাসে কোনো সুসংবদ্ধ প্লট বা কাহিনি নেই। এর পরিবর্তে চরিত্রের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।” (বাসব দাস)

“মানুষ এইটুকু বুঝতে চায় না, পুঁজি মুনাফার সন্ধান করে বেড়ায়, দয়া-মায়া তার ধর্ম নয়, দরদ বা সহানুভূতি তার লক্ষ্য নয়, সাধারণের সুখ-দুঃখ নিয়ে তার মাথা উত্তেজিত নয়। এটা ঠিকই যে, আধুনিক সভ্যতা মানুষের সামনে অনেক অনেক স্বাচ্ছন্দ্যের রাস্তা খুলে মেলে ধরেছে। কিন্তু বেশ কিছুদিন স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগের পর আবার যদি আদিম যুগে ফিরতে হয়, তখন ট্রাজেডির শেষ থাকে না।” (কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাস প্রসঙ্গে রাধেশ্যাম সাহা)

“লাল সালু উপন্যাসে একদিকে যেমন আছে সমাজ-নৃতাত্ত্বিকতার পরিচয়, অন্যদিকে আছে ফ্রয়েডিয় মনোভাবনা যার ভিতর রয়ে গেছে লাল সালুর প্রাণকেন্দ্র। শিল্প-সংস্কৃতি, চিন্তা রুচি ও মানসিকতার দিক থেকে ওয়ালিউল্লাহর যে প্রকৃত অর্থে আধুনিক, তাঁর সৃষ্টি সেকথাই প্রমাণ করে।” (লক্ষ্মী সাহা)

“আসলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনাশৈলীর পরিধি সর্বদা আপাত সংকীর্ণতা থেকে বিস্তৃতির পথে ধাবিত হয়। কথনের প্রবহমানতায় দ্রুত বাস্তব ও কল্পনার মধ্যে স্থান পরিবর্তন হয়। যার ফলে বিষয়গত তাৎপর্য ক্রমে নির্দিষ্ট থেকে সামগ্রিকতা অতিক্রম করে বিশ্বজনীনতার পথ খোঁজে সংকীর্ণতার বেড়াজাল পেরিয়ে।” (সুবর্ণা সিকদার)


আবু ইসহাক বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“অনেক ভাঙনের পরেও শেষ অব্দি বেঁচে থাকে মনুষ্যত্ব — ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ তারই একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। ‘ভাতের লড়াই’তে যারা হেরে গেছে তারাই কিন্তু ভাঙা মেরুদন্ড দিয়ে সমাজ ও সভ্যতার মেরুদন্ড সোজা করে ধরবার চেষ্টা করে।” (মানস শেঠ)

“আবু ইসহাক তাঁর উপন্যাসে যে গ্রামজীবনের ছবি এঁকেছেন সেখানে আমরা দেখি গ্রাম্য মানুষের আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে ওঠে কোনো বহুমূল্য সম্পদ নয়, প্রকৃতির সৃষ্টি তালগাছ। সূর্য দীঘল বাড়ীর তালগাছটা গ্রামের মানুষের গর্বের বস্তু, তাদের বনেদিয়ানায় চিহ্ন” (সোনালী দাস)


জহির রায়হান বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“সমগ্র জীবনে তিনি আটটি উপন্যাস রচনা করেন এবং প্রত্যেকটি উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে রয়েছে বৈচিত্রের ভিন্ন ভিন্ন আস্বাদ . . . মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরিত্রের টানাপোড়েন, তাদের পাওয়া-না পাওয়ার বেদনা তাঁর অধিকাংশ রচনাকে এক অন্য মাত্রা দান করেছে।” (ফাহাদ আলম)


শওকত আলী বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“লেখক বাংলায় মুসলমান বিজয়ের সময়টিকে বেছে নিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে বাংলার ইসলামের প্রসারের কারণটিও খুঁজতে চেয়েছেন . . .তবে লক্ষণ সেন, বখতিয়ার খিলজি, কবি জয়দেব, হলায়ুধ মিশ্র প্রমুখ এই সময়ের কোনো পরিচিত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নায়ক হয়ে ওঠেনি। এই সময়কে ঘিরে এই সময়ের জনতাকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন ” (প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাস প্রসঙ্গে পম্পা মুখোপাধ্যায়)

আল মাহমুদ বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“তাঁর ছোটোগল্পগুলির ভিত্তি গ্রামজীবন। কখনো মুক্তিযুদ্ধ, দেশভাগ আবার মধ্যবিত্ত যাপনের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গেও তিনি গল্প লিখেছেন। মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বের সঙ্গে চাওয়া-পাওয়া, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সুখ-দুঃখ ইত্যাদির সূক্ষ্ম অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে তাঁর চরিত্ররা সব নির্মিত হয়েছে।” (বোধিসত্ত্ব ভট্টাচার্য)


হাসান আজিজুল হক বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

সংখ্যায় বেশি না লিখলেও দু’বাংলার সাহিত্যাকাশে যাঁরা জ্যোতিষ্ক, ছয়ের দশকের গল্পকার হাসান আজিজুল হক তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৬০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ দশকে প্রকাশিত অপ্রকাশিত সবমিলিয়ে মাত্র ৮০টি গল্প লিখে দেশ-কাল, সমাজ-রাষ্ট্রকে বদলে দিতে না পারলেও তিনি পেরেছিলেন একটি উপনিবেশ তৈরি করতে। হাসান আজিজুল হক যাকে বলেছিলেন ‘লেখকের উপনিবেশ’।” (শ্যামসুন্দর প্রধান)


আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“ইলিয়াস তাঁর স্বভাবসিদ্ধ পর্যবেক্ষণ শক্তি এবং নির্মোক বস্তুপ্রীতিকে ব্যবহার করে কথাসাহিত্যের জগৎ নির্মাণ করেছেন। সৃষ্টি করেছেন স্ল্যাং ব্যবহারের সমীচীনতা।” (বনমালী মাল)

“ঔপন্যাসিক নাম দেন চিলেকোঠার সেপাই, তবে চিলেকোঠা ছাড়া তো কঠিন তাদের জন্য। আখতারুজ্জমান ইলিয়াস সেজন্যেই সিজোফ্রেনিয়াগ্রস্ত করে ছাড়েন ওসমানকে। চিলেকোঠার সেপাই নাম দিয়ে লেখক কি ব্যঙ্গ করেছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে? কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণি যে চিলেকোঠার বাইরে যেতে পারছে না, তাদের দৌরাত্ম্য চিলেকোঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ লেখক কি সেই ইঙ্গিতই করেছেন?” (শহীদ ইকবাল)


সেলিনা হোসেন বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“ঐতিহ্যের পুননির্মাণ সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের অন্যতম বিশিষ্টতা। . . . অতীত ও বর্তমানের এই সহিতত্ত্বের সংযোগটির সূত্রে লেখিকা সমাজতাত্ত্বিক উপাদানকে, বৃহত্তর বিশ্বের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়টিকে সমান্তরাল পাঠকৃতিতে কৌশলী ভঙ্গীতে স্থান করে দেন।” (মিষ্টু সামন্ত)

“কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তাঁর কথাসাহিত্যে নারীকে একটা আলাদা দৃষ্টিতে দেখার প্রচেষ্টায় প্রচেষ্টিত। তাঁর . . . প্রভৃতি গল্পে নারী চরিত্রের গতানুগতিকতাকে ভেঙে ফেলার প্রয়াস লক্ষিত হয়েছ।” (মিহিরকুমার মন্ডল)


হুমায়ুন আহমেদ বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাজের স্তরভেদ মানুষের মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফেলে। হিমু এইসকল স্তরের মানুষের ভিতর যোগসূত্র মাত্র।” (অনুশ্রী সাহা)


শহীদুল জহির বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“মানুষের যোগাযোগের আকাঙ্খাটি তার অন্য অনেক কিছুর মতোই এক মৌলিক আকাঙ্খা। আর সেটি আছে বলেই আমরা ক্রমাগত যোগাযোগের চেষ্টা করে যাই। কিন্তু এ ছাড়াও এই গল্পের অন্য একটি গুরুত্ব আছে। শহীদুল জহির তাঁর অনেক লেখাতেই টাইম-ফ্রেমের ধারণাকে ভেঙে দিয়েছেন – অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎকে এক জাদুকরি ভাষায় মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে ফেলেছেন।” (আহমাদ মোস্তফা কামাল)


তানভীর মোকাম্মেল বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“বাংলা সাহিত্যে নদী নিয়ে লেখালেখির সংখ্যা কম না। তানভীর মোকাম্মেল এই নদীকে মাঝখানে রেখে বিভক্ত দুই দেশের রাজধানী ঢাকা ও কলকাতাকে নিয়ে লিখলেন এই উপন্যাস (দুইনগর)। যেখানে দেখালেন ‘সবকিছু হয়ে যাচ্ছে ভাগ/খাল বিল নদী জলাশয়’ –এর ছবি।” (শোভনলাল বিশ্বাস)


ইমাদুল হক মিলন বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“নিজের আত্মসমালোচনা ছিল মিলনের। পেশাদার ও জনপ্রিয় লেখক হিসেবে তাঁর ওপর চাপও ছিল আরো আরো লেখার। তিনি প্রকাশকের কাছে ও বাজারের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন; কিন্তু মনে মনে সব সময় চেয়েছেন সাহিত্যের কাছে দায়বদ্ধ হতে। লেখার মতো লেখা লিখতে।” (হামীম কামরুল হক)


হরিশংকর জলদাস বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“বর্তমান সময়ে বাংলা সাহিত্যে নিম্নবর্গের অন্যতম রূপকার হরিশংকর জলদাস। তার লেখার মাধ্যমে আমরা প্রান্তিক জীবনের যে বর্ণনা দেখতে পাই, তা আসলে হরিশংকর জলদাসের নিজের জীবনেরই স্মৃতি সঞ্চয়। তার মতে, অভিজ্ঞতা হলো সাহিত্য রচনার প্রধান হাতিয়ার।” (মোঃ আফরুক শেখ)


রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“আসলে রুদ্র মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যে বাংলাদেশকে দেখেছেন, সেখানে আশাবাদী গল্প লিখলে তা নিছক ইচ্ছাপূরণের গল্পে পর্যবসিত হতো। গল্পগুলি পড়তে পড়তে একটি বিষয় নজর না এড়িয়ে যায় না যে, কোনো গল্পে একটিও শিশু চরিত্র নেই। . . . প্রসঙ্গে এলেও তারা হয় মারা গেছে, নয়তো হারিয়ে গেছে। প্রথম গল্পটিতে তো মা নিজের ছেলেকে হত্যা করেছে। এই বিষয়টি আমাদের ভাবায়।” (দেবাশীষ দত্ত)


অনীক মাহমুদ বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“লেখক অস্তমিত জমিদার পরিবার কিংবা রাজীব-নির্বিন্ধ্যার প্রেম-প্রণয়, জীবন দুর্গতির বর্ণনায় নিজেকে সর্বদা নিরাসক্ত দর্শকের ভূমিকায় স্থাপন করেছেন। সহজ সরল শব্দচয়ন, সুন্দর অলংকার প্রয়োগ, কাব্যধর্মী গদ্যভাষার সৃজনে লেখকের কৃতিত্ত্ব প্রশংসনীয়। সব মিলিয়ে ‘সন্ধ্যার মেঘমালা’ উপন্যাসটি হয়ে উঠেছে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের কাহিনি ও চরিত্রদের অস্তমিত জীবন ইতিহাসের যথার্থ ইতিকথা।” (মৃদুল ঘোষ)


তসলিমা নাসরিন বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“তাঁর রচিত উপন্যাস ‘শোধ’ সেইরকমই এক নারীবাদী সাহিত্য রচনা। উপন্যাসটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ও মুসলমান পরিবারের কাহিনিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। . . . যা কেবলমাত্র বাংলাদেশ ও মুসলমান সমাজের নারীর ছবিকে তুলে ধরে না সমাজের সর্বস্তরের নারীর অবস্থানকে স্মরণ করায়।” (দীপিকা বাড়ই)


নাসরীন জাহান বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“ভাবাদর্শ ও মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ‘সোনালি মুখোস’ উপন্যাসে এক বিকল্প পরিসর নির্মাণের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। উপনিবেশোত্তর চেতনার প্রধান লক্ষণ হচ্ছে সমস্ত কেন্দ্রীভূত শক্তিকে প্রত্যাহ্বান জানানো। দীর্ঘদিন যারা পরিধিতে ছিলেন তাদের নিরুদ্ধ কন্ঠস্বরকে ঔপন্যাসিক অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে পাঠকৃতির কেন্দ্রে তুলে নিয়ে এসেছেন।” (বরুণজ্যোতি চৌধুরী)


সিরাজুল হক বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“তাঁর প্রায় প্রতিটি গল্পের মধ্যে মানব-মানবী আপন স্বভাবে ও স্বাতন্ত্রে ধরা দিয়েছে। সামাজিক আদর্শ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে যে তিনি উপেক্ষা করেছেন তা নয় বরং এসবের মধ্যে থেকেই নির্মাণ করতে চেয়েছেন মানুষের আখ্যান, যে মানুষ নৈতিক নয়, আবার নীতিদুষ্টও নয়; আদর্শিক নয়, আবার অনাদার্শিকও নয়; মূল্যবোধের পরাকাষ্ঠা নয়, আবার মূল্যবোধহীনও নয় – বরং রক্ত মাংসে একান্তই মানুষ।” (নবীনা দাস)


শওকত ওসমান বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত

“সেই প্রথম উপন্যাস ‘বণী আদম’ থেকে শুরু করে শেষ পর্বে রচিত ‘পতঙ্গ পিঞ্জর’ উপন্যাসে শওকত ওসমানের জীবনদৃষ্টি অবিচলিত এবং প্রতিবাদী চেতনায় অনির্বাণ। অন্য কোনও লক্ষ্যে তিনি কখনও লেখনী ধারণ করেননি। আজকের পৃথিবীর মানব-সভ্যতার সংকটকালে তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধা।” (সঞ্জীব মান্না)

     

পত্রিকা সংক্রান্ত যোগাযোগ

Mobile no. 9836733393

e-mail: tobuekalabya@gmail.com

Website: www. Tobuekalabya.com


রাজীব কুমার ঘোষ

চুঁচুড়ার রাজীব’ মানেই সহদেববাবুর ঘোড়া’, ‘ভীষ্মদেবের মৃত্যুমুহূর্ত’, ‘অনেক জলের শব্দ’, ‘টাওয়ার অফ্ সাইলেন্স’, ‘হিবাকুশার ছেলে’ বা ঘোষ স্যারের গল্পগুলি — বহুচর্চিতভিন্নমাত্রার কিছু গল্প। জন্ম ১৯৭৭পড়াশোনাবেড়ে ওঠা চুঁচুড়া-হুগলি-চন্দননগর। ১৯৯৭ সাল থেকে লিটল ম্যাগাজিন কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত এবং নিয়মিত লেখালেখি। সম্পাদিত পত্রিকা সাইন্যাপস্। আছে বেশ কিছু কবিতার বই। প্রকাশিত গল্প সংকলন ঘর ও দরজার গল্প’, ‘অনেক জলের শব্দ’, 'আমাদের আশাতীত খেলাঘর'। গল্পের জন্য বারাসাতের বহুস্বর পত্রিকার পক্ষ থেকে পেয়েছেন ২০১৯ সালের অনন্তকুমার সরকার স্মৃতি পুরস্কার। অণুগল্পের জন্য ২০১৮ সালে চুঁচুড়ার গল্প সল্পের আটচালার পক্ষ থেকে পেয়েছেন উৎপল স্মৃতি পুরস্কার

          পেশায় বিজ্ঞান শিক্ষক। নেশায় পাঠক। প্রিয় অবকাশ যাপন — পাঁচশো বছরের পুরনো জনপদের অলিগলিতে সময়ের ভাঁজে ভাঁজে ঘুরে বেড়ানো।