সাইন্যাপস্‌ অণুগল্প ৫ ।। অমৃতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

পুন্নিমার কাঁধে একটা বোচকা। 

    তার এক হাতে জ্বোরো স্বামী, অন্য হাতে ষোলো বছরের ল্যাংড়া মেয়েটা। গতি বড় ধীর।ওরা অন্ধকার থাকতে রাস্তায় নেবেছিল নিজেদের গাঁয়ের ভিটে ছেড়ে পালাতে। কোথায় যাবে জানে না,তাই রাত ফুরোলেও পথ ফুরোচ্ছিল না। ফুরিয়ে এসেছিলো কোচড়ে রাখা নুন মাখা রুটি আর তোবড়ানো বোতলের জল। এক রাত এক দিন হাঁটা হয়ে গেল দিল্লি আগ্রা হাই রোড ধরে, জন্মভিটে তবু কতটাইবা দূরত্ব পেলএখন সন্ধ্যা। 

    চটচটে থুতু গিলে পুন্নিমার মেয়ে বলল-

    'মা, টুকুন জল দে।'

    পুন্নিমা বোতল টা এগিয়ে দিতে, পুন্নিমার স্বামী ছোঁ মেরে বোতল উপুড় করে জলটুকু শেষ করেই হড়হড়িয়ে বমি ছিটিয়ে শরীর বাঁকিয়ে মাটিতে গড়িয়ে গেল। ক'বার দাপিয়ে একদম স্থির। 

    ডুকরে উঠলো পুন্নিমা। 

    গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলো মেয়েটা।

    আকাশে চতুর্দশীর চাঁদ তখন সবে ঘোলা হয়ে উঠে ধবধবে দাঁত কেলানোর অপেক্ষায়। 

    দুদিক ফাঁকা মকাই ক্ষেতের পাশে, কালো চকচকে জাতীয় সড়কে, বুদ্ধ বিশ্বাসী পুন্নিমার স্বামী ফুড়ুৎ করে নির্বাণ পেয়ে গেল!

    ল্যাংড়া মেয়েটা মরা বাপের ওপর সেই থেকে অজ্ঞান  হয়ে আছে- হয় খিদেয়, নয় শোকে। পুন্নিমা ওর হাত ছিটকে পড়ে যাওয়া বোচকাটা নিথর স্বামী-মেয়ের লাগোয়া করে, কোচড়ের শেষ রুটিটা চুপিচুপি বোচকার ওপর রেখে উঠতে যাবে - ঘ্যাচ্ করে একটা পুলিশের হাইওয়ে পেট্রোল কার ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেল।

    চমকে ওঠা পুন্নিমার মরা স্বামী ও অজ্ঞান পঙ্গু মেয়েটাকে ফেলে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা আর সত্যি হ'ল না। বরং মুহূর্তের এমন পালিয়ে যাওয়ার ভাবনায় কুন্ঠিত পুন্নিমা নাহক মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। 

    যেহেতু ডেথ কেস তাই পেট্রোল কার, লোকাল পুলিশ ডাকলো। 

    লোকাল পুলিশ, এম্বুলেন্স ডাকলো,ডোম ডাকলো।

    ডোম, ভ্যান ডাকলো, লাশ তুললো। 

    এম্বুলেন্স অজ্ঞান মেয়েটাকে চ্যাংদোলা করে তুললো।

    এতসব ডাকাডাকিতে অনেকটা রাতে গড়ানোয় সন্ধ্যা বড় করে ঘোমটা তুললো।

    বোশেখের গরমের হাওয়া ছুটলো। 

    ততক্ষণ লোকাল থানার পুলিশ পেট্রোলকারের পুলিশের সাথে কিসব ফিসফিসালো।

    ব্যস্ত সমস্ত কত ফোন এলো গেল চতুর্দিকে!

    তাতেই পুন্নিমার গ্রামের সেই জবরদস্ত লোক কজন, যাদের ভয়ে পুন্নিমারা সব পিছনে ফেলে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছিলো, তারাও হৈ হৈ করে দু দুটো গাড়ি ভর্তি ঠ্যাঙ্গাড়ে লোকজন নিয়ে চলে এলো। মুখে রামা হৈ। ওরা সবাই মিলে খোলা রাস্তায় অনেকক্ষণ হা হা হো হো দাঁত কেলালো।বোতল খেল। মাতলালো। 

    তারপর ওরাই ওদের প্রতিহিংসার আগুনে শেকতে পুন্নিমা বাল্মীকিকে ওদের গাড়িতে হিঁচড়ে টেনে তুললো।

    সবাই সব তুললো, খালি ধুলোমাটিতে পড়ে রইলো নুন মাখা গোল রুটি টা!

    বুঝি চাঁদের আলোয় ভিজিয়ে পিঁপড়েরা সারারাত খেয়ে যাবে সে পুন্নিমার রুটি?

    আর ‌একটা অন্তজ পরিবারের বরবাদ দৃশ্য দেখতে দেখতে আকাশে তখনও ফিনকি জোৎস্না লেগে থাকবে চতুর্দশীর চাঁদের গায়ে!

    খলবলে এত আলোয় চাঁদমুখো চতুর্থ স্তম্ভও হেলে থাকবে  সরমা মণ্ডলে!

    ...তবে কাল হবে বুদ্ধ পূর্ণিমা! 🚫


আপনার মতামত নিচে 
'আপনার মন্তব্য লিখুন' শীর্ষক বক্সে লিখে 
আমাদের জানান। 
লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকে 
পাঠকদের মতামতে। 🙏

অমৃতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার সম্পাদক
ছবি - সাইন্যাপস্‌

লেখক পরিচিতি

এক আশ্চর্য গল্পকার। আশ্চর্য এবং শক্তিশালী। তিন দশকের বেশি গল্প লিখছেন। অথচ গল্প সংকলন মাত্র একটি, বারোটি গল্পের সংকলন - বারো কিসিম (ডিসেম্বর ২০১৬)। গৌর বৈরাগী এই গ্রন্থটির ভূমিকায় লিখতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন শব্দগুচ্ছ - 'দারুণ দহনবেলা এসে বসেছে, গল্পের শরীর জুড়ে'। বর্তমান গল্পটি অণুগল্প হলেও এখানে সেই দহনবেলা উপস্থিত। এই গল্পকার গল্প চাইলে তবে গল্প দেন। দেবার সময় হিসেব করে দেন না যে কোথায় দিলেন। ২০০২ সালে সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার অক্টোবর সংখ্যায় অমৃতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল, 'জলধরের শেষ ইচ্ছে'। অসাধারণ একটি অণুগল্প। আমাদের ইচ্ছে আছে সেটি আবার পুনঃপ্রকাশের। উল্লেখযোগ্য গল্প 'ওজন যন্ত্র ও ভবদেব', 'ভাত মহাজন'। চন্দননগর গল্পমেলার পক্ষ থেকে ২০০১ সালে পেয়েছেন অনাদি স্মারক সম্মান।

গল্পগ্রন্থ
বারো কিসিম
প্রকাশ - ডিসেম্বর ২০১৬
প্রকাশক - মৃত্তিকা, ভদ্রকালী, হুগলি
মূল্য ১২০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৭৭৪৬৫৬৫৩

সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা ওয়েবে প্রকাশিত

অন্য অণুগল্পগুলি পড়ার জন্য
ক্লিক করুন 👉  সব অণুগল্প