পর্ব ৩

সমীর মুখোপাধ্যায় হুগলির প্রখ্যাত গল্পকার। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলেই বোঝা যায় তিনি এক জীবন্ত মুভি ক্যামেরা বিশেষ। তার ক্যামেরায় হুগলি-চুঁচুড়া জনপদের ফেলে আসা সময় আর বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের ছবি ধরে রাখা আছে। তার আত্মজীবনীটি সাইন্যাপস্‌ পত্রিকায় ২০১৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা ওয়েবে প্রকাশিত হয়ে আরো অনেক বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে আমরা আশা রাখি, তাই আমরা আবার এই ধারাবাহিক স্মৃতিকথাটি প্রথম পর্ব থেকে বৃহত্তর পাঠকদের কাছে উপস্থাপিত করছি। এবারে রইল তৃতীয় পর্ব।

পর্ব ৩

    যাই হোক শরিৎদা বলে গেলেন, প্রতি রবিবার তাঁর বাড়ির একতলায় বেলা পাঁচটা থেকে সাহিত্যসভা বসে। সেখানে যাওয়ার একটাই শর্ত। লেখা নিয়ে যেতে হবে। আরও দু'চারজন যাঁরা লেখা নিয়েই আছেন বা থাকেন তাঁরা আসেন। কবিতা, নাটক, গল্পপাঠ হয়। ওখানে তখন কবিতাপাঠ করতে আসতেন কবি ও সমালোচক প্রদ্যুম্ন মিত্রের দাদা কবি প্রণব মিত্র(সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা প্রকাশিত প্রদ্যুম্ন মিত্র স্মরণ সংখ্যায় এনার বিশদ পরিচিতি আছে। সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার ওয়েবে 'স্টোর' বিভাগ থেক পত্রিকাটি কেনার জন্য পাওয়া যাবে।  - সম্পাদক) পরে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের খ্যাতনামা অধ্যাপক হন। আসতেন ট্রেড ইউনিয়নের সম্পাদক এবং তুখোড় গল্প লেখক মনোরঞ্জন চক্রবর্তী। মাঝে মাঝে উদয় হতেন রামনবমীতলার কাছাকাছি বিখ্যাত বাড়ি, 'হরিধাম' থেকে, প্রায় রাজকীয় চেহারা, এই বয়সেই কাঁধে চাদর, ধোপদুরস্থ ধুতি পাঞ্জাবী পরণে, এই বয়সেই বেশ কিছু গ্রন্থের রচয়িতা - পরবর্তি জীবনে অধ্যাপক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়। মাঝে মাঝে প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ও আসতেন।
        একটা কথা বলতে ভুলেছি। আমাদের সে সময় অর্থাৎ আজ থেকে ৬০-৬২ বছর আগে 'লিটল ম্যাগাজিন' কথাটির কোনো অস্তিত্বই ছিল না। কিছু কিছু স্থানীয় পত্রিকা বার হতো অবশ্যই। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন জাতীয় তারা কিন্তু ছিল না। আমাদের সে সময় পত্রিকা বলতে 'অগ্রণী', যার সম্পাদক ছিলেন, কবি অরুণ মিত্র। তিনি সে সময় কমিউনিস্ট কবি হিসেবে পরিচিত। লিখতেন 'লাল ইস্তেহার'-এর মতোন দুর্দান্ত নাটকীয়, একান্ত কবিত্বহীন কবিতা। যদিও  ইনিই পরে লেখেন, 'আমরা পুষেছি আশা/বিহংগ সে দূর নভোচারী/মাটিতে ঝরেছে তার পালকচিকণ'। আসলে কবি তো। তাই শেষাবধি ফরাসি প্রতীকধর্মী সুররিয়ালিস্টিক কবিতায় ফিরে গিয়ে সৎ, পরিশ্রমী, পরিশুদ্ধ কবিতার আশ্রয়ে চলে গেলেন।
        'অগ্রণী', 'নতুন সাহিত্য', 'পরিচয়', ঘোষিত কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবিদের মুখপত্র, অন্য দিকে বুদ্ধদেবের 'কবিতা' এবং কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য্যের অনবদ্য পত্রিকা 'পূর্বাশা'। 'দেশ' পত্রিকা ছিল আমাদের কাছে জনরঞ্জক। উৎকৃষ্ট ম্যাগাজিন হিসেবে 'পূর্বাশা'র মূল্য ছিল আমাদের কাছে অপরিসীম।
        আমার মুদ্রিত প্রথম গল্পটি, যার নামটি আজ মনে নেই, সেটি 'জনসেবক' নামক বিখ্যাত কংগ্রেসি পত্রিকায় রবিবাসরীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এটা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য - লেখালেখির ব্যাপারে আমাদের বিন্দুমাত্র গোঁড়ামি ছিল না। যদিও পরবর্তী পর্যায়ে শরিৎ শর্মা ফ্যাসী বিরোধী লেখক সংঘের হুগলি চুঁচুড়া শাখার অঘোষিত সম্পাদক ছিলেন এবং এক সময় উত্তেজক ও দেশবন্দনা মুখর কিছু গানও রচনা করেন।
        হঠাৎ হঠাৎ-ই দেখা যেত সাহেবি ধরনের একটি মানুষ কে। তিনি আমাদের সাহিত্যসভায় কখনোই যোগ দেননি। এখানের কোনো অনুষ্ঠানে কোনো লেখা পড়েননি। শরিৎদাকে শরিৎ বলে ডাকতেন। প্রণবকে পছন্দ করতেন। ইনিই প্রফুল্ল গুপ্ত। (সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার 'প্রফুল্ল গুপ্ত স্মরণ সংখ্যা'য় পাঠক প্রফুল্ল গুপ্ত সম্পর্কে বিশদ তথ্য পাবেন। সাইন্যাপস্‌ ওয়েবের 'স্টোর' অপশনে পত্রিকাটি কেনার জন্য পাওয়া  যাবে। সম্পাদক।) শুনেছিলাম উনি নামকরা কন্ট্রাক্টর। প্রণব বলত, সাহিত্যের খাঁটি অনুরাগী। বেশ কিছুদিন পর উনি আমাকেও কলিজিয়েট স্কুলের পিছনে দত্তঘাট লেনে ওঁর বাড়িতে ওঁর গল্প শোনার জন্য ডাকতেন। সেখানে সন্ধ্যাকালীন জলযোগের সুন্দর বন্দোবস্ত থাকত - বলা বাহুল্য, যেহেতু আজীবন কুমার ব্রত নিয়েছিলেন সেহেতু তখনও কোনো মহিলা ঘরে আসেননি। উনি নিজেই পাঁপড় বা ডিম ভেজে চা বা কফি তৈরী করে, মুড়ি সহযোগে খাবার পরিবেশন করতেন। একটা বিশেষ ভঙ্গী ওঁর মনে পড়ছে। ওঁর লেখাতে প্রায়ই এ্যসটেরিক্স চিহ্ন থাকতো। উনি ওই শব্দটি অদ্ভুত ভঙ্গীতে, দাঁত চেপে চেপে উচ্চারণ করতেন। অতি সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষটির পাইপ-কামড়ানো অদ্ভুত ধরণের এ্যসটেরিক্স শব্দটি কখন ওঁর গল্পপাঠের মধ্যে বেজে উঠবে - এ ব্যাপারে আমি উচ্চকিত থাকতাম। শব্দটি উচ্চারণের পর উনি দু'সেকেন্ড চুপ মেরে যেতেন। তারপর পড়া চলত।
ছবি - সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা


       প্রায় প্রতিদিন সে সময় সকালের দিকে পুরানো ব্যানার্জি কেবিনে যেতাম। গিয়েই খোঁজ নিতাম ব্যানার্জিদার কাছে - নরেনের।
        নরেন, লম্বা মানুষটি, হাতে সর্বদাই মোটা মোটা বই, কাঁধে ব্যাগ। ও আসত ব্যানার্জি কেবিনে, ওর জন্যে নির্দিষ্ট থাকত একটা খোপ। তার ভেতর ঢুকে গিয়ে বার সাতেক, লিখতে লিখতে চা খেত, সঙ্গে এক বান্ডিল বিড়ি। আমি গেলেই বিড়ি এগিয়ে দিয়ে তোৎলাতে  তোৎলাতে বলত, 'এই যে সাহিত্যপ্রবর, সমরেশ বসুর পরই তো তোর জায়গা! এখন বিড়ি টান। একটার পর একটা টেনে যা। পরে মাল টানবি।' এই ছিল ওর আমার প্রতি উষ্ণতা জানানোর রীতি।
        একবার গল্প লেখার জন্য চুঁচড়ো শহরেই আমি কিছু মানুষের হাতে বেইজ্জৎ হই। ও তা শুনে মুচকি হেসে বলেছিল, 'শালা, এইবার তুই বিখ্যাত হবি। এইবার তোর বিখ্যাত হওয়া মারে কে!'
        নরেনের মুখে প্রথম শুনি র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্টদের কথা। ওর বাড়িতে গিয়ে দেখতাম র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট পার্টি বা দর্শনের প্রবক্তা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা, বড় বড় উকীলদের বাড়িতে যেমন মোটা মোটা বাঁধানো বই থাকে, তেমনি বড় বড় বাঁধানো ভল্যুম থরে থরে সাজানো। লেখাগুলির সবই ইংরাজিতে। কৌতূহলের বশবর্তী হয় বইগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে দেখেছি অধিকাংশ ভল্যুমগুলোর মার্জিনে লালকালিতে নরেনের মন্তব্য। নরেন প্রকৃত অর্থেই ছিল বইয়ের পোকা। ওর সে সময়ের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল মাদার গডেস্‌ নামক ঐতিহাসিক এক উপলব্ধি বা থিসিস। পরে এই থিসিস সাবমিট করে ও ক্যালকাট ইউনিভার্সিটির এনসিয়েন্ট হিস্ট্রি বিভাগে যোগ দেয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে ও হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট হয়।
        চুঁচড়ো শহর নরেনের মেধার কোনো খবরই রাখত না। তার কারণ একটাই, নরেন আমাদের মতো সভাসমিতিতে সাবলীল ছিল না। ও কথা ভালো করে বলতেই পারত না। তোৎলাতো। মৃত্যুর ঠিক এক সপ্তাহ আগে সোনার জলে লেখা এক অভিজ্ঞান পত্র বহন করে নিয়ে আসেন কিছু মার্কিন কর্তা। তাঁদের মুখেই জানতে পারি, নরেনের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সংক্রান্ত বইগুলি মার্কিন মুলুকের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠসংকলনভুক্ত। মৃত্যুর সামান্য কিছু আগে নরেন জেনে গেল, তার মেধার পুরস্কার তার স্বদেশবাসী না দিলেও বিদেশের গুণগ্রাহীরা তার সমাদর করেছে।
        আমার সামান্য ক্ষমতায় সে সময়র কিছু আগে 'দেশ' পত্রিকার সম্পাদক শ্রদ্ধেয় সাগরময় ঘোষের কাছে নরেনের প্রতিভার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি এবং সফল হই। তার ফলে 'দেশ' পত্রিকায় ওর দু'দুটো উল্লেখযোগ্য লেখা বার হয় এবং তা পন্ডিতমহলে আলোড়নও তোলে।
সাইন্যাপস্‌  পত্রিকায় প্রকাশিত স্মরণ বার্তা (সংকলন ১০)
        এই প্রসঙ্গে বলি, প্রধানত নাট্যকার, বিশেষ করে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র বেতার নাটকে চার চার বার প্রথম পুরস্কার প্রাপ্ত বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথা আমি 'দেশ' পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষকে বলি। উনি তখন নতুন লেখক খুঁজছিলেন। অনেকের মতো আমাকেও বলেন নতুন লেখকের সন্ধান দেবার কথা। আমি বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কথা বলি। এরপর বৈদ্যনাথ, সাগরদাকে বলার জন্য নয়, নিজের প্রতিভার জোরেই 'দেশ' পত্রিকায় হাসির গল্প লিখে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। 
সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার ঘরোয়া আড্ডায় বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় (২৯.১০.২০১১)
গৌর বৈরাগী গল্প পড়ছেন। বৈদ্যনাথবাবু পাশে শুনছেন। নিচে বসে গল্পকার বিমল গঙ্গোপাধ্যায়। 
সমীর মুখোপাধ্যায়ের পাশ থেকে ছবিটি তুলেছিলেন সম্পাদক।
    উনি খুবসম্ভত 'রবিবাসরীয় আনন্দবাজার' বা ছোটোদের 'আনন্দমেলায়' বিশেষ গল্প লেখেননি। 'দেশ' পত্রিকায় হাসির গল্প নিয়ে যে বারকতক গল্প সংকলন বেরিয়েছিল তার প্রত্যেকটিতে বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের উজ্জ্বল উপস্থিতি সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিল।
                                                                                (ক্রমশ)