আলোসাগরের ঢেউগুলি – 

রাজীব কুমার ঘোষ 

 আলোচিত পত্রিকা

তবুও দৃষ্টান্তঃ গ্রন্থাগার পাঠ সংকট ও বর্তমান প্রজন্ম/জানুয়ারি ২০১৮/আমডাঙা উত্তর চব্বিশ পরগণা থেকে প্রকাশিত

সম্পাদকঃ বাপ্পাদিত্য জানা

এই সংখ্যায় বিশেষ সহযোগিতায়ঃ সইদুর রহমান, মনীষ চক্রবর্তী

পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৮০

মুদ্রিত মূল্যঃ ৭০ টাকা


তবুও দৃষ্টান্ত পত্রিকার ‘গ্রন্থাগার পাঠ সংকট ও বর্তমান প্রজন্ম’ এই বিষয় নিয়ে সংখ্যাটি একটি উল্লেখযোগ্য লিটলম্যাগাজিনচিত কাজ। সুখের কথা এই সংখ্যাটি ২০১৮ সালে প্রকাশিত হলেও এখনও পাওয়া যায়। একই সঙ্গে দুঃখের কথাও, এই ফুরিয়ে না যাওয়াটা হয়ত গ্রন্থাগার নিয়ে সার্বিক স্তরে আগ্রহ ফুরিয়ে যাওয়াটাও চিহ্নিত করে। পাঠক-লেখক-প্রকাশক-গবেষক সবাই জানেন গ্রন্থাগারগুলি আজ অস্তিত্বের সংকটে, সরকার মহোদয় তো জানেনই কিন্তু তা নিয়ে আদৌ কোনো চিন্তাভাবনা চলছে? হা হুতাশের বদলে আমরা কি সংকটকে বিচার করছি বা খুঁজে পাবার চেষ্টা করছি উত্তরণের রাস্তা? এই পরিস্থিতিতে তবুও দৃষ্টান্ত লিটল ম্যগাজিনের মুখরক্ষা করেছে তার সীমিত সামর্থ্য নিয়েই। সাধুবাদযোগ্য এই প্রচেষ্টা। বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ আছে এই সংখ্যায় এবং আগ্রহী পাঠক বিভিন্ন লেখায় খুঁজে পাবেন নানা তথ্য।

সুরঞ্জন প্রামাণিক তার প্রবন্ধে সাহিত্য পাঠের ক্ষেত্রে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে তার জন্য পণ্য-সংস্কৃতিকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন এই সংস্কৃতির সবচেয়ে বেশি ছাপ পড়েছে গ্রন্থাগারের উপর। ইতিহাসে গ্রন্থাগার ধ্বংসের কাহিনি উল্লেখ করে তিনি এও প্রশ্ন তুলেছেন গ্রন্থাগারের জ্ঞানভান্ডার তাহলে কি ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে না, জ্ঞানভান্ডারকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন গ্রেট ব্রিটেনে শ্রমজীবি মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতার দাবীতে যে Chartist আন্দোলন হয়েছিল তার অন্যতম প্রাপ্তি ছিল ‘পাবলিক লাইব্রেরি’ — জ্ঞানের একচেটিয়া ও কেন্দ্রীভূত মালিকানার বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক বিজয়। এই সময় সংসদীয় বাকযুদ্ধে প্রতিপক্ষের একটি যুক্তি যা নথীবদ্ধ আছে তা পড়লে আমরা হতবাক হয়ে যাই, “People have too much knowledge already: it was much easier to manage them twenty years ago; the more education people get the more difficult they are to manage.” প্রবন্ধের শেষে তিনি লিখছেন, “সঙ্কট মুক্তির কোনও উপায় নেই? কেবল আগুন ও উই থেকে বইগুলি বাঁচানোই হবে আমাদের কাজ আর প্রতীক্ষায় থাকা – নতুন চিন্তার খোঁজে বের হওয়া মানুষটি কখন আসেন!”



বইপড়ার সামাজিক অভ্যাস নিয়ে লিখেছেন সুরেশ কুন্ডু। বইপড়ার নানাবিধ কারণ থেকে কারা বই পড়েন, বইপড়ার প্রশ্নে বড়োরা যা যা অসুবিধা দেখান সেই আলোচনা ছুঁয়ে তিনি চলে গেছেন অতীত আর বর্তমানে বই পড়ার অভ্যেসের তুলনায়। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, “প্রতি বছর একটা অঞ্চলের যত সংখ্যক বাড়ি তৈরি হয় তার শতকরা নব্বই ভাগ বাড়িতে পারিবারিক উপাসনা গৃহ তৈরি হয়। কিন্তু পারিবারিক গ্রন্থাগার তৈরি হয় না কেন?”       

মানবেন্দ্র মন্ডলের প্রবন্ধে আমরা সার্থকভাবেই এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি যে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগার জ্ঞান-জগতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সময়ের মাঝে এক সেতু। পাঠকদের তিনি পাঁচ শ্রেণীতে ভাগ করে আলোচনা করেছেন। তিনি একই গ্রন্থাগার দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের বিশেষত নতুন প্রজন্মের প্রয়োজন মেটাবার কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার প্রস্তাব রেখেছেন।

ড. নিবেদিতা বিশ্বাস বিংশ ও একবিংশ শতাব্দর গ্রন্থাগার এবং তাদের চরিত্রগত পার্থক্য নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। সরকারি গ্রন্থাগার সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন তুলে দেওয়া হল,

“সরকারি লাইব্রেরি প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই মনে আসে এর বজ্রকঠিন এবং অদ্ভূত কিছু নিয়মাবলীর কথা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুষ্পাপ্র বইগুলি জেরক্স করার অনুমতি মেলে না, অনেক ক্ষেত্রে লাইব্রেরিতে বসে এই বইগুলো পড়াও যায় না। তাই একজন নিবিস্ট পাঠক বা অনুসন্ধানী গবেষকের পক্ষে কোনো দুরূহ বিষয় গবেষণা করার ক্ষেত্রে লাইব্রেরির উপরে আস্থা হারাতে হয়। আর যদি বা এইসব দুষ্প্রাপ্য বই পাওয়া যায় তা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে গবেষণা করার ক্ষেত্রে নিয়মের এত বৈচিত্র, এত কড়াকড়ি অনেকক্ষেত্রে তা সরকারি কারাগারকেও যেন হার মানায়। ফলে পাঠকও সমস্ত আস্থা বা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে একটা সময়।”
বলাই বাহুল্য এই অভিজ্ঞতা অল্পবিস্তর আমাদের সবারই আছে।

ত্রিপুরার গ্রন্থাগার নিয়ে একটি মূল্যবান লেখা লিখেছেন ড. দেবব্রত দেবরায়। তিনি দেখিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে গ্রন্থাগার আন্দোলন হয়েছে ত্রিপুরায় ঠিক সেইভাবে হয়নি। সরকারই সেখানে গ্রন্থাগারকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে ত্রিপুরাতে অন্য রাজ্যের মতো কোনো পৃথক গ্রন্থাগার বিভাগ নেই। মহকুমা পাবলিক গ্রন্থাগারগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে ত্রিপুরা সরকারের উচ্চশিক্ষা দপ্তর। তিনি বলেছেন শ্রমিকের সমস্যা, কৃষকের সমস্যা, বেকারের সমস্যা থেকে গ্রন্থাগার পাঠ সংকট এবং বর্তমান প্রজন্মের সমস্যাকে বিছিন্ন করে ভাবা উচিত নয়। তিনি সার্বিক সমাজ পরিস্থিতিকেই দায়ী করেছেন। বাঁকুড়া জেলার গ্রন্থাগার আন্দোলন নিয়ে স্বপন ঘোষের একটি প্রবন্ধ পুনরায় প্রকাশিত করা হয়েছে পত্রিকাতে। খুব মূল্যবান একটি প্রবন্ধ। বেশ কিছু পরিসংখ্যান পাঠক পাবেন এই প্রবন্ধটিতে।  

গ্রন্থাগার পরিষেবা নিয়ে লিখেছেন মানস কুমার ঘোষ। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের এক চুম্বকসার তিনি দিয়েছেন। ফরাসী সম্রাট ফ্রান্সিসের গ্রন্থাগার সংক্রান্ত নেওয়া পদক্ষেপের সঙ্গে তিনি বর্তমানের ‘ডেলিভারি অফ বুকস অ্যাক্ট’ তুলনা করে দেখিয়েছেন। বর্তমানে গ্রন্থাগারের বিভিন্ন পরিষেবাগুলি তিনি উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থাগার দিবস নিয়েও তার একটি সংক্ষিপ্ত লেখা রয়েছে। বাংলা বইয়ের দাম নিয়ে লিখেছেন কৃষ্ণেন্দু পালিত। বইয়ের দাম কম রাখার পক্ষে ও বিপক্ষের যুক্তিগুলি তিনি তুলে এনেছেন তার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন নিজের ব্যক্তি অভিজ্ঞতা। শেষে রয়েছে অশোক চট্টোপাধ্যায়ের কিছু মতামত। সেখানে তিনি বই পড়া কমে যাওয়ার পিছনে তিনিটি কারণ বলেছেন,

“প্রথমত সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের বাড়বাড়ন্ত। দ্বিতীয়ত, কম্পুটার এবং ইন্টারনেটের দৌলতে আয়াসরহিত সহজলভ্য প্রাপ্তির দিকে আসক্তি বৃদ্ধি। তৃতীয়ত, কর্পোরেট সংস্কৃতি এবং সরকারি সংস্কৃতির যূথবদ্ধতাজনিত প্রভাব”।

পত্রিকাটিতে শুধু  সীমিত পরিসরে কিছু প্রবন্ধ বা আলোচনা নয় অনেক পাঠক তাদের পাঠ অভিজ্ঞতা তুলে এনেছেন স্মৃতিচারণায়। লিখেছেন সব্যসাচী দেব, সুকুমার রুজ, দীপশিখা পোদ্দার প্রমুখ। রয়েছে আরো কিছু আলোচনা।

পরিশেষে বলা যায় নানা বিষয় সেভাবে আলোচিত না হলেও এই উদ্যোগ বড় কম নয়। আশা করা যেতেই পারে গ্রন্থাগারের সংকট নিয়ে আরো কিছু কাজ আমরা অপরাপর পত্রিকা থেকেও পাব। আমাদের চোখ ভিজে আসে সব্যসাচী দেবেরর উল্লেখ করা একটি ঘটনা পড়ে। বাগনান মহুকমার এক গ্রামীণ গ্রন্থাগারের ষাট বা সত্তর বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রবন্ধকার গিয়েছিলেন। আমরা জানতে পারি মাঝে মাঝেই দামোদরের বন্যায় ভেসে গেছে সেই গ্রন্থাগার এবং আশ্চর্য প্রতিবারই গড়ে তোলা হয়েছে তাকে নতুন উৎসাহে। বন্যাও যে গ্রন্থাগারকে লুপ্ত করতে পারেনি জানতে ইচ্ছে করে আজও কি সেই গ্রন্থাগার টিঁকে আছে এই নতুন পরিস্থিতিতে।

পত্রিকা সংক্রান্ত যোগাযোগ

Mobile no. 9836960287


রাজীব কুমার ঘোষ

চুঁচুড়ার রাজীব’ মানেই সহদেববাবুর ঘোড়া’, ‘ভীষ্মদেবের মৃত্যুমুহূর্ত’, ‘অনেক জলের শব্দ’, ‘টাওয়ার অফ্ সাইলেন্স’, ‘হিবাকুশার ছেলে’ বা ঘোষ স্যারের গল্পগুলি — বহুচর্চিতভিন্নমাত্রার কিছু গল্প। জন্ম ১৯৭৭পড়াশোনাবেড়ে ওঠা চুঁচুড়া-হুগলি-চন্দননগর। ১৯৯৭ সাল থেকে লিটল ম্যাগাজিন কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত এবং নিয়মিত লেখালেখি। সম্পাদিত পত্রিকা সাইন্যাপস্। আছে বেশ কিছু কবিতার বই। প্রকাশিত গল্প সংকলন ঘর ও দরজার গল্প’, ‘অনেক জলের শব্দ’, 'আমাদের আশাতীত খেলাঘর'গল্পের জন্য বারাসাতের বহুস্বর পত্রিকার পক্ষ থেকে পেয়েছেন ২০১৯ সালের অনন্তকুমার সরকার স্মৃতি পুরস্কার। অণুগল্পের জন্য ২০১৮ সালে চুঁচুড়ার গল্প সল্পের আটচালার পক্ষ থেকে পেয়েছেন উৎপল স্মৃতি পুরস্কার

          পেশায় বিজ্ঞান শিক্ষক। নেশায় পাঠক। প্রিয় অবকাশ যাপন — পাঁচশো বছরের পুরনো জনপদের অলিগলিতে সময়ের ভাঁজে ভাঁজে ঘুরে বেড়ানো।