গল্পকার সাদিক হোসেনের কলমে ইদ

আমার বাবা ছিলেন উৎসব বিমুখ একজন মানুষ। তা বিয়েবাড়ি হোক, বা ইদ, তিনি যারপরনাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতেন। জীবনের গতানুগতিকতার প্রতি এমন মোহ, আমি অন্য কারোর মধ্যে দেখিনি। ঠিক সকাল ৮টার রোদ গ্রিলের ফাঁক দিয়ে এমনভাবে ঘরের মধ্যে ঢুকতো, যেন মহা গ্রীবাধারী একজন উট, আমার বাবা সেইটা দেখতে পছন্দ করতেন। রেকর্ড প্লেয়ারে গান শুনতেন, আর ৪৫ আরপিএমের রেকর্ডটি ঠিক কোন্ জায়গায় গিয়ে বাধা পাবে, সেইজন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। একই গানে একই বাধা বারবার আঙুলের ডগা দিয়ে পার করে দিতে পারা ছিল তাঁর প্রিয় একটি নেশা। সেইকারণেই পাতাবাহার পছন্দ করতেন। ফুলের আকস্মিতা তাঁকে তটস্থ করে তুলত। 

    এমন উৎসবহীন বাড়িতে বড়ো হলেও, আমাদের ক্ষেত্রে ইদের আগমন শুরু হয়ে যেত কিন্তু প্রথম রোজার দিন থেকেই। রমজান মাস নাকি সংযমের, বই-এ এইসব পড়েছি, অথচ আমাদের লোভাতুর চোখ সবসময় ঘোরাফেরা করত জামাকাপড়ের নতুন ডিজাইনের উপর। কার ব্যাগি গেঞ্জি, কে ফুলটুস প্যান্ট কিনেছে, কার নর্থস্টার সত্যিই জ্যাকসন সদৃশ - এসব তো থাকত নখদর্পণে। যে প্রথমদিকে জামা কিনে ফেলেছে, দিন যত এগোত তার ইদ ফিকে হয়ে আসত। যেন সকলেই তাকে টেক্কা দিয়ে দিল। চতুর বালকেরা স্লগ ওভারের জন্য তৈরি। ২৭শে রোজার দিন মার্কেটিং-এ বেরোতো বাবা-মায়ের সঙ্গে।

    আর ছিল জাকাতের কাপড়। বড়বাজার থেকে কমদামি লুঙ্গি আর সুতীর শাড়ির গাঁটলি আসত। সেইসব গরীব মানুষদের জন্য। দু-একটা রোজা কেটে যাবার পর থেকেই, শুধু এলাকার লোক নয়, অনেকদূর থেকেও গরীব মানুষেরা আসতেন লুঙ্গি, শাড়ি, বাচ্চাদের জামাকাপড়ের আশায়। নগদ টাকাও দেওয়ার রীতি রয়েছে।  অনেককেই দেখেছি, ইদের পর মেয়ের বিয়ে, তাই জাকাতের টাকার সন্ধানে এসেছেন। কত অচেনা গ্রামের মাদ্রাসা চাঁদা তোলে এইসময়। এতিম বাচ্চারা নাকি ওখানে পড়াশোনা করে। সেইসব বাচ্চারা আমাদের থেকে অনেক আলাদা, নিশ্চয়। 

    এলাকার বড়োলোক বাড়িগুলোর উপর মাজিদে ইফতার পাঠানোর দায়িত্ব থাকতো। অবশ্য দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হতো। এক একদিন এক একটি বাড়ি ইফতার পাঠাত। সেইদিন মসজিদে যতজন ইফতার করবেন, তাঁদের প্রত্যেককে খাওয়ানোর দায়িত্ব সেই বাড়িটির। যেদিন আমাদের বাড়ির দায়িত্ব, সকাল থেকে দেখেছি, সেকী হুলস্থুল কাণ্ড। ফল কাটা হচ্ছে তো হচ্ছেই, সরবত বানানো হচ্ছে তো হচ্ছেই, তাছাড়া চিড়া-মুড়কি, ছোলাসিদ্ধ… এসব তো থাকতই। বড়ো বড়ো ডিশে করে সেইসব খাবার মসজিদে পৌঁছে দিতে হতো।

    ইদ চিরকালই আকস্মিকতার। দুদিন আগে থেকে জল্পনা কবে হবে! সাধারণ হিসেবে, আরবে যেদিন ইদ হয়, আমাদের ইদ হয় ঠিক তার পরেরদিন। কিন্তু তখন তো এতো টিভি চ্যানেল ছিল না, দেশের কোথায় কখন চাঁদ উঠবে এই নিয়ে ছিল রীতিমতো এডভেঞ্চার। পাক্কা খবর পেলে, পাড়ার পিচ্চিরা "ইদ মোবারক চাঁদরাত" স্লোগান তুলে জগৎ মাথায় তুলবেই। তখনি রোজার সমাপ্তি।

    চাঁদরাত ছিল আমার কাছে বিশেষ আকর্ষনীয়। একটি অলিখিত নিয়ম ছিল বাড়িতে, মগরেফের আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে আসি। তারপর হাত-পা ধুয়ে পড়াশোনা। শুধুমাত্র চাঁদরাতে সেই নিয়মে ছাড় পাওয়া যেত। তখন দিদিদের সঙ্গে স্টেশনে বেরোতাম। শেষদিনের টুকিটাকি কেনাকাটা। মেহেন্দি, লিপ্সটিক, সাবান, আতর… এইসব। দিদিদের সঙ্গে আমিও মেহেন্দি পরতাম। আশ্চর্যের বিষয়, আমার তালুতে খুব কম সময়েই রঙ ধরে যেত। ওদের সারারাত অপেক্ষা করতে হতো।    

    ইদের দিনে কে কত ভোরে উঠতে পারে, তা নিয়ে কী কম প্রতিযোগিতা করেছি? ভোরে উঠে কোনো কাজ নেই, তবু ভোরে ওঠা। মা উনুন ধরিয়ে রান্নায় বসতো, আমরা ঘুমচোখে তার পাশে বসে বসে রান্না দেখতাম। সকাল সাড়ে সাতটায় নামাজ। তার আগে রান্না শেষ। একসঙ্গে পুকুরে স্নান করতে কে না ভালোবাসে। নতুন সাবানের সুগন্ধে, এমনকি, মাছগুলোও গভীরে চলে যেত।

    বাবার সঙ্গে নামাজে যেতাম। বাবা চায়ের দোকানে তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসতেন। অবশ্য বেশ কয়েকবার সত্যিই নামাজ পড়েছি। তবে প্রতিবারই মসজিদে। ইদগাহে যাইনি।

    সারাদিন বাবা গান শুনতেন এরপর। মা ঘনঘন চা করত। পরোটা, সিমাইসহ একাধিক খাবারের প্রতি তখন আর আমাদের লোভ নেই।

    দিদিরা সাজছে। আমরাও সাজছি। এরপর অনন্ত রঙের বালক-বালিকায়, তাদের ছোটাছুটিতে এলাকায় পাখি ডেকে উঠবে। উঠবেই। তাছাড়া বেপাড়ার প্রেম তো আছেই।

    একজনের নাম ছিল ইদ মহম্মদ। আর একজন মোবারক মিয়া। তারা প্রেমঘটিত কারণে বোম্বে পালিয়ে গিয়েছিল। তাই "ইদ মোবারক" শব্দবন্ধটি নিয়ে বড়োরা খুব হাসাহাসি করত। সেই হাসিতে রহস্য ছিল বুঝতাম, তবে তা ভেদ করার মতো লায়েক তখনো হয়ে উঠিনি।

    ছোটোবেলার ইদ এইরকমই। 

    এখন আমি আমার বাবার মতো হয়ে উঠেছি। ৪৫ আরপিএমের বাধাটা আঙুলের ডগা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাই। কিন্তু মেয়েটি শোনেই না আমার কথা। সে এখন আমার ছোটবেলাকার চরিত্রে। সে এখন তার মায়ের ছোটোবেলাকার চরিত্রে। সশব্দে বেলুন ফাটাবেই। 🚫

সাদিক হোসেন

লেখক পরিচিতি
এই সময়ের উল্লেখযোগ্য গল্পকার। জন্ম ১৯৮১ সালের ১১ ডিসেম্বর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মহেশতলা অঞ্চলে। আই টি নিয়ে পড়েছেন, পরে গ্রাফিক মিডিয়া ও মাল্টিমিডিয়া চর্চা করেছেন। বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। 'সম্মোহন' গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ডলি মিদ্যা স্মৃতি পুরস্কার ও সাহিত্য আকাদেমি যুবা পুরস্কার। 

গ্রন্থ তালিকা

দেবতা ও পশুপাখি (২০০৭)
সম্মোহন (২০১০)
মোমেন ও মোমেনা (২০১১)
গিয়াস আলির প্রেম ও তার নিজস্ব সময় (২০১৩)
মোন্দেলা
হারুর মহাভারত

আপনার মতামত নিচে 
'আপনার মন্তব্য লিখুন' শীর্ষক বক্সে লিখে 
আমাদের জানান। 
লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকে 
পাঠকদের মতামতে। 🙏