আলেখ্য — এ কী লাবণ্যে

গ্রন্থনা — বিকাশ শীল

 

সখী,    প্রতিদিন হায় এসে ফিরে যায় কে।
তারে   আমার মাথার একটি কুসুম দে॥
যদি     শুধায় কে দিল কোন্‌ ফুলকাননে,
মোর    শপথ, আমার নামটি বলিস নে॥
সখী,    সে আসি ধুলায় বসে যে তরুর তলে
সেথা    আসন-বিছায়ে রাখিস বকুলদলে।
সে যে   করুণা জাগায় সকরুণ নয়নে--
যেন     কী বলিতে চায়, না বলিয়া যায় সে॥
                       (গীতবিতান ৪৬২/২১৯)

 

   গানটি ১০ আশ্বিন ১৩০৪ সালে রচিত। নাগর নদীর (অধুনা বাংলাদেশ) ওপর বোটে ভ্রমণরত রবীন্দ্রনাথ গানটি রচনা করেছিলেন। গানটির মধ্যে আশ্চর্যসুন্দর প্রণয়-মুখরতা রয়েছে — যে মুখরতা একই সঙ্গে নীরব এবং প্রত্যাশী। কিন্তু এর চালটা বেশ হালকা, বেশ খানিকটা কৌতুকের আবহমন্দ্রিত। তবে এই গানটির প্রসঙ্গ-পটভূমি কলকাতার — নির্দিষ্টভাবে বলা যায় জোড়াসাঁকোর। এই ঘটনার ছোট্ট এবং তাৎপর্যপূর্ণ হদিশ আমরা পেয়ে যাই কবির ভাইঝি প্রমথ জায়া ইন্দিরা দেবীর জীবন কথায়,

“…ঐতিহাসিক সত্যর স্বার্থে স্বীকার করতেই হবে যে আমার পাণিগ্রহণের আগে পাণীপ্রার্থীর অভাব ছিল না। সবচেয়ে ‘রোমাঞ্চকর’ পূর্বপাত্র ছিলেন একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তি, যিনি অনেকদিন ধরে আমাদের ফটকের ওপারে মাঠের এক গাছতলায় আমাকে দেখবার জন্য এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন। পরে তাঁর নাম জানতে পারি এবং তাঁর দিদিভাইয়ের হয়ে আমাদের বাড়ী বলতেও এসেছিলেন…কিন্তু এ সম্বন্ধ মনোনীত হল না। রবিকাকা এই ঘটনাটা নিয়েই গানটি লেখেন।”

সুরযোজনা। গানটি গাওয়া হবে।

 (দুই)

 সদ্য গাওয়া গানটির শেষ চরণটি আমরা লক্ষ্য করব — যেন কী বলিতে চায়, না বলিয়া যায় সে॥

এই না বলার চাপ যে বিরহের বীজ বোনে, প্রত্যাশা পূরণের বিপরীতে গড়ে তোলে যে অনিবার্য একটি ভার, তাকে খুব কাছ থেকেই ছুঁতে পারি। এমনই বিরহকাতর আরেক রূপ আমরা দেখতে পাই পরের গানটিতে। খেয়াল রেখেছি এই গানটিও লেখা হয়েছে বোটে। আজাদপুর। ৮ আশ্বিন ১৩০৪। ইংরাজি ১৮৯৭, সেপ্টেম্বর শেষার্ধ। সুর কীর্তনের। এই গানটি কবিতা হিসাবে ‘যাচনা’/’কল্পনা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। মনে হওয়া স্বাভাবিক, এটি একটি বিশেষ আকুতির, নিবিড় ঘনিষ্ঠতার উচ্চারণ — ব্যক্তিক, বিশেষত নারীকেন্দ্রিক এর অভিমুখ। কেননা গানটিতে ‘চরণমঞ্জরীর’, ‘কনককঙ্কণ’, ‘অলকবন্ধন’, ‘ললাটচন্দন’, ‘অঙ্গসৌরভ’, ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। তথ্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আরেক মানসিক অভিঘাতকে জড়িয়ে আছে। রবীন্দ্র-সৃষ্টিতে সাজাদপুর কুঠিবাড়ি একটা বিশেষ উজ্জ্বল ভূমিকার দলিল। একদা পিতা মহর্ষির কল্পতরু হওয়াআর সূত্রে এই ‘সাজাদপুর’ কুঠিবাড়িটি রবীন্দ্রনাথের কাকার অংশ (গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর) অর্থাৎ অবন-গগনদের অংশে চলে যায়। আর এই চিরবিচ্ছেদের কথা মনে রেখে এই বিরহগভীর প্রেমগীতিটি তিনি রচনা করেন। রচনা করেন সাজাদপুর কুঠিবাড়ি থেকে শেষ বিদায় নেওয়ার বেলায়। সুতরাং নারী নয়, সাজাদপুর কুঠিবাড়ির জন্যই তাঁর এ হেন প্রকাশ —

 ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
     আমার মুখর পাখি-- তোমার
          প্রাসাদপ্রাঙ্গণে॥

 এবার ‘প্রাসাদপ্রাঙ্গণে’ কথাটি মনে রেখে আমরা বিখ্যাত এই গানটি পড়ে নিতে পারি। আগ্রহী-সুধীজনের মনে পড়তে পারে সুমিত্রা সেনের কন্ঠে এই গানটির অনবদ্য পরিবেশনা —

সুরযোজনা। গানটি গাওয়া হবে।

 ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
     আমার নামটি লিখো-- তোমার
          মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
     তাহার তালটি শিখো-- তোমার
          চরণমঞ্জীরে॥
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
     আমার মুখর পাখি-- তোমার
          প্রাসাদপ্রাঙ্গণে॥
মনে ক'রে সখী, বাঁধিয়া রাখিয়ো
     আমার হাতের রাখী-- তোমার
          কনককঙ্কণে॥
আমার লতার একটি মুকুল
     ভুলিয়া তুলিয়া রেখো-- তোমার
          অলকবন্ধনে।
আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে
     একটি বিন্দু এঁকো-- তোমার
          ললাটচন্দনে।
আমার মনের মোহের মাধুরী
     মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো-- তোমার
     অঙ্গসৌরভে।
আমার আকুল জীবনমরণ
     টুটিয়া লুটিয়া নিয়ো-- তোমার
          অতুল গৌরবে॥
                (গীতবিতান/৪৫৮-২১৬)

 

 (তিন)

 এবার যে গানটির কথা বলব তার উপলক্ষ শ্রীমতি অমলা দাশ। চিত্তরঞ্জন-ভগ্নী অমলা। সুকন্ঠী অমলা। অনেকেই জানেন রবীন্দ্রনাথ অনেক সময় বিশেষ কোনো একজনের জন্য, আবার কখনো কোনো প্রসঙ্গের প্ররোচনায় গান লিখেছেন। “চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না” গানটি অমলার জন্যই লেখা। আরেক সূত্র আমাদের বক্তব্যকে সমর্থন জানায়, সাহানা দেবী এক জায়গায় বলেছেন (স্মৃতির খেয়া), “আর একটি গান কবি মাসিমার গলার জন্যই রচনা করে দিয়েছিলেন — চিরসখা, ছেড়ো না…”। চার লাইনের এই গানটি ১৩০৫ ফাল্গুনে রচিত। চিরসখার কাছে তাঁর প্রার্থনা বড় আন্তরিক। কেমন ছিল সেই প্রসঙ্গ-পরিবেশ-গান রচনার-সুর ও কথার আশ্চর্য মেলবন্ধন কেমন ভাবে উৎসারিত হত তার একটি স্মৃতিধার্য তথ্যের শরণ নেবো—“অমলা দিদি প্রায়ই জোড়াসাঁকো যেতেন, কখনো কখনো দু/তিন মাসও থাকতেন। তখনকার দিনে(গুরুদেব) গান রচনা করতেন একেবারে সুর-কথা একসঙ্গে। বড়ো বারান্দায় পায়চারি করতে করতে গান রচনা যেই শেষ হলো, অমনি চিৎকার আরম্ভ করলেন। অমলা ও অমলা, শিগ্‌গিরি এসে শিখে নাও, এক্ষুণি ভুলে যাব কিন্তু। কবিজায়া মৃণালিনীর বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন অমলা দাশ। গানটি —

চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না।
সংসারগহনে নির্ভয়নির্ভর, নির্জনসজনে সঙ্গে রহো ॥
অধনের হও ধন, অনাথের নাথ হও হে, অবলের বল।
জরাভারাতুরে নবীন করো ওহো সুধাসাগর ॥
                                      (গীতবিতান ৪৭৮/২২৪)

প্রসঙ্গত বলি, এই সুকন্ঠী অমলা দাশ পরবর্তীকালে (প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়) রবীন্দ্রনাথের বহু গান এইচ এম ভি রেকর্ডে গেয়ে রবীন্দ্রসংগীতের প্রথম অ্যামেচার মহিলা শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। আরো, আমাদের খেয়াল থাকুক, সে সময় সম্ভ্রান্ত বংশের কোনো মহিলা শিল্পী রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথের গান গায় নি। জানা যায়, অমলা দেবী প্রায় ২১-২২টি গান রেকর্ড করেছিলেন।

সুরযোজনা। গানটি গাওয়া হবে।

 

(চার)

 পরের গানটি ১৩০০ ফাল্গুনের।


হৃদয়নন্দনবনে নিভৃত এ নিকেতনে।
এসো হে আনন্দময়, এসো চিরসুন্দর ॥
দেখাও তব প্রেমমুখ, পাসরি সর্ব দুখ,
বিরহকাতর তপ্ত চিত্ত-মাঝে বিহরো ॥
শুভদিন শুভরজনী আনো এ জীবনে,
ব্যর্থ এ নবজনম সফল করো প্রিয়তম।
মধুর চিরসঙ্গীতে ধ্বনিত করো অন্তর,
ঝরিবে জীবনে মনে দিবানিশা সুধানির্ঝর
                        (গীতবিতান ৩৭৫/১৮৫)

 আনন্দে আনন্দ। আনন্দ বুঝি সংক্রামক! চিরন্তন। এসো হে আনন্দময়, এসো চিরসুন্দর-জনিত আহ্বানের প্রসন্নতায় ভাস্বর পুজোমনস্ক নিবেদন। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৩২/৩৩ — ছোট মেয়ে মীরার জন্ম। “মধুর চিরসংগীতে ধ্বনিত করো অন্তর।” জানি, আনন্দের প্রতি অকাতর পক্ষপাত রবীন্দ্রনাথের আজীবন অর্জন। বলা হয়, তিনি ছিলেন আনন্দের একনিষ্ঠ উপাসক — সে আনন্দের চরিত্র বা প্রেক্ষিত কখনো ঔপনিষদিক, কখনো বা ব্যক্তিক অনুধ্যানে আন্তরিক। মনে রাখতে হয়, এই উৎসটির হদিশ আছে রামমোহন থেকে পিতা মহর্ষির প্রত্যক্ষ ভূমিকায়। তিনি নিজেই সে সবের রৌদ্রমনস্কতার সংবাদ দিয়ে গেছেন। তবু স্বীকার্য, উপনিষদ পর্বের অনেক আগে থেকেই আনন্দরসে বালক রবি কিশোর রবির অনুভব অকৃত্রিম ছিল — পরবর্তীকালে যেমন তিনি বলেছেন, এ রসের আরেক প্রকাশ অহেতুক ভালোলাগা, “লাগলো ভালো, মন ভুলালো — এই কথাটিই গেয়ে বেড়াই” অর্থাৎ নিরবিধি এই যে প্রাণের প্রকাশ, রূপান্তরেও যার প্রবাহ স্রোতমুখর — তাকে প্রণতি জানিয়ে কবি তা গানে বাঁধলেন, হৃদয়নন্দনবনে নিভৃত এ নিকেতনে… 

সুরযোজনা। গানটি গাওয়া হবে।

 

(পাঁচ)

আবার আনন্দের আরেক সদ্ভাব দেখি লাবণ্যে। চিত্তের সুপ্রসার ভূয়সী অনুভবের মাতনে মুখর হয়ে উঠতে চায়। বিষণ্ণ শোকাতুর ব্যক্তি-পিতার মগ্নতাকে কী এক আশ্চর্য বৈভবে প্রাণিত করে তোলে — অপাপবিদ্ধ প্রকৃতির অঢেল সুধা হাতছানি দেয় — অভ্যর্থনায় ওই নিসর্গ সুন্দর। ভাঙা মন ফের গেয়ে উঠতে চায়, ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে” গানটি নিশ্চিতভাবে বসন্তের। ফাল্গুন ১২৯৯ সালে রচিত।

 

একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে,
          আনন্দবসন্তসমাগমে ॥
বিকশিত প্রীতিকুসুম হে
          পুলকিত চিতকাননে ॥
জীবনলতা অবনতা তব চরণে।
          হরষগীত উচ্ছ্বসিত হে
                   কিরণমগন গগনে ॥
                             (গীতবিতান ৩৪৯/১৭৭)

 

 মনে রেখেছি, এমন একটি ‘আনন্দবসন্তসমাগমে’-র স্মৃতি আকস্মিক বিয়োগব্যথার অভিঘাতে সাময়িক হলেও মলিন হয়ে উঠেছিল। স্মৃতিভারাতুল কাতর লাবণ্যের মাঝে আমরা আরেক রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করি। জানা যায়, এ গানটি কেবল রবি ঠাকুরের প্রিয় ছিল না, অতি প্রিয় ছিল উজ্জ্বল বালক শমী ঠাকুরের। শান্তিনিকেতন আশ্রমের বীথিকুঞ্জে আম্রকুঞ্জে বালক শমীর উদার কন্ঠ ছিল আশ্রমিকদের নিত্য অভিজ্ঞতা। রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র শমীর অকাল প্রয়াণ ঘটে ৭ অগ্রহায়ণ ১৩১৪। মুঙ্গেরে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় শমী। রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, “শমী প্রায়ই এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ গেয়ে গেয়ে বেড়াচ্ছে।” আর এমন বিয়োগের আব্যবহিত কালে স্নিগ্ধ আত্মজের জন্য সন্তাপ জড়িয়েই পিতা রবি কবি রবি যদি বলতে পারেন, “শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাতে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়ে নি…” তাহলে, সেই শমী ঠাকুরের ঋতু বন্দনার যশ মনে রেখেই উদার কন্ঠে কেন আমরা গেয়ে উঠব না…এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ…

 সুরযোজনা। গানটি গাওয়া হবে।


কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, জনপদপ্রয়াসের সম্পাদক বিকাশ শীলের সঙ্গে
সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার সম্পাদক মৌসুমী ঘোষ, সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার অনুষ্ঠানে।