রাজীব কুমার ঘোষ
দাঁড়াবার জায়গা / বইমেলা সংখ্যা ২০২০ / বেলঘরিয়া, কলকাতা থেকে প্রকাশিত
পিনাকী ঠাকুর স্মরণে বিশেষ সংখ্যা
সম্পাদকঃ নারায়ণ শূর
কার্যনির্বাহী সম্পাদকঃ সুদীপ চক্রবর্তী
সহ-সম্পাদকঃ দেবকুমার চক্রবর্তী,
পিনাকী চক্রবর্তী
সামগ্রিক সহযোগিতায়ঃ তন্ময় চক্রবর্তী
প্রকাশকঃ দিব্যেন্দু ঘোষ
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ২১২
মুদ্রিত মূল্যঃ ১০০ টাকা
কার্যনির্বাহী সম্পাদক শুরুতেই জানিয়েছেন এই সংখ্যাটি পিনাকী ঠাকুরের জন্য দাঁড়াবার জায়গা পত্রিকার অর্ঘ্য। দাঁড়াবার জায়গা পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন কবি পিনাকী ঠাকুর। সময়ের আগেই তার চলে যাওয়া আর তার আগে তেরো দিনের এক ক্লান্তিহীন লড়াই। সেই কোন কিশোরবেলা থেকে লড়াই করে চলেছেন এই কবি। শেষবেলাতেও তিনি যোদ্ধা। পিনাকী চক্রবর্তী স্মরণ করেছেন শেষের সেই সময়কাল, “দাঁড়াবার জায়গার কার্যনির্বাহী সম্পাদক সুদীপ চক্রবর্তী গত ডিসেম্বরের তেইশে খুব সকালে মৃত্যুর থাবার ভেতর থেকে ডাকলেন, ‘পিনাকীদার স্ট্রোক হয়েছে, কল্যাণী জবাব দিয়েছে, আই সি ইউ অ্যাম্বুলেন্সে কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু সঙ্গের ডাক্তার বলছেন সে পর্যন্ত টিঁকবে না যদি না এক্ষুনি কোনও আধুনিক হাসপাতালে তোলা যায়’। আমার বাড়ি বারাকপুর, সেখানে একটি নির্ভরযোগ্য হাসপাতাল, টেকনোগ্লোবাল – সেখানেই চলে গেলাম, পৌঁছানো মাত্র চিকিৎসা শুরুর ব্যবস্থা করে অপেক্ষা করলাম। কিন্তু যে ঠাকুর এসে পৌঁছলো সে তখন বিসর্জনের স্রোতে পড়া পান্ডুর প্রতিমা . . .” পত্রিকার স্মৃতিচারণাগুলি পাঠ করলে পাঠক অনুধাবন করবেন কেন সম্পাদক বলেছেন, “কষ্ট গিলে নেবার আশ্চর্য ম্যাজিক জানতেন পিনাকীদা।”
কয়েকটি পর্বে ভাগ করা পত্রিকাটি ভরে উঠেছে স্মৃতিচারণায়, পিনাকী ঠাকুরের কবিতা বা কাব্যগ্রন্থের আলোচনায়, তার গদ্যের আলোচনায়, তার গল্পের আলোচনায়। আর সমস্ত পত্রিকাটি জুড়ে ছেয়ে আছে এক বিষাদের মেঘ।
কবির মা, মীরা ঠাকুরের বক্তব্যের অনুলিখন করেছেন চন্দ্রনাথ শেঠ। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল কবির পিতা, ডানলপ শ্রমিক বস্তি ও উদ্বাস্তু আন্দোলনের নেতা অমলকুমার ঠাকুরকে। তিনি বলেছেন কিশোরবেলায় চোখের সামনে দেখা এই হত্যার অভিঘাত কবির জীবন ও লেখায় ফিরে ফিরে এসেছে। তিনি বলেছেন, পিনাকীর লেখালেখি নিয়ে বলবে গুণমুগ্ধ পাঠকেরা, তার শুধু মনে ভাসছে বাড়িতে থাকলে সামান্য লাল-চা খাওয়ার অসামান্য আবদার, বোনের সঙ্গে খুনশুটি আর প্রতিদিন বাড়ি থেকে বার হবার সময় পা ছুঁয়ে প্রণাম।
নবনীতা দেবসেন সেই সময় লিখেছিলেন, “কৃত্তিবাসে সুনীলের ডান হাত, কবি পিনাকী ঠাকুর আজকে চলে গেলেন। তাঁর সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া হয়েছিল। এই নামে যে কোনও রোগ আছে, তাই-ই জানতুম না। . . .বার্ধক্যকে স্পর্শ করা দূরের কথা, তাঁর তো পুরোপুরি বাঁচাই হয়নি এখনও।”
কবীর সুমন লিখেছেন, “দেখা হলেই নরম একটা হাসি ক্লান্ত বিকেলের আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ত তাঁর মুখে — ধীরে ধীরে।”
এই হাসির স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন রামকুমার মুখোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, “পিনাকীর জীবনে নানা অনিশ্চয়তা ছিল, বঞ্চনার নানা ঘটনা ছিল, অসম্মানের ক্ষত ছিল কিন্তু সে সব কিছুকেই তার মতো করে সামাল দিত। অদ্ভুত একটা সারল্য ছিল পিনাকীর মধ্যে, অপ্রতিরোধ্য একটা বিনয়। সেটাই হাসি হয়ে মুখের ওপর ভেসে থাকত। সব কাঁটাকে তুচ্ছ করতে পারত কি না জানিনা কিন্তু গোলাপ হয়ে ওঠার একটা অদম্য প্রয়াস ছিল ওর মধ্যে।”
নারায়ণ শূর উল্লেখ করেছেন কবির শেষ যাত্রায় আর স্মরণসভায় মানুষের ঢলের কথা। বলেছেন কবি পেয়েছিলেন মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা। তিনি লিখছেন, “আসলে আমি দেখেছি বেশিরভাগ কবি সাহিত্যিক যাদের মূল শিকড় ছিল গ্রামে বা শহরতলীতে, অর্থাৎ যাদের মাটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল প্রথম দিন থেকেই তারাই হয়ে ওঠেন বিশাল হৃদয়ের প্রকৃত ভাল মানুষ এবং ভাল লেখক।”
সানন্দা গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণাতেও উঠে এসেছে ত্রিবেণী শ্মশানে সেই দিনটির ছবি, “আমি ত্রিবেণী শ্মশানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায়, দেখলাম বিরাট মিছিল . . . রাজকীয় শ্মশান প্রবেশ তাঁর . . . শরীর ঢাকা সাদা কাপড়ে, ট্রে থেকে শ্মশানের খাটে নামানোর সময় একটু যেন সরে গেলো তা, কী রাজকীয় চেহারা তাঁর! কী পৌরুষ! মনে হল এই তো ‘বসন্ত মস্তান’ শুয়ে আছেন. . .”
সৌরদীপ লিখছেন, “সদ্য কলেজনবিশ কবিতাপ্রয়াসীর কাছে পিনাকী ঠাকুর নামটাই তখন সেলিব্রিটি স্ট্যাটাস। লেখকের সঙ্গে পরিচিত হবার ঢের আগে তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত হবার চল তখনও ছিল। ফলত, বইয়ের তাকে বহু আগেই জায়গা করে নিয়েছে ‘সাত মিনিটের ঝড়’, ‘একদিন অশরীরী’, ‘বিপজ্জনক’, ‘হ্যাঁ রে শাশ্বত’ . . .”
খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে স্পষ্ট ও সোজা ভাষায় একটি প্রয়োজনী লেখা লিখেছেন কবি শিবাশিস মুখোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন,
“. . . দুটি জগত স্পষ্ট ছাপ রেখে গেছে পিনাকীর কবিতায়। একদিকে প্রোমোটারিতে গ্রস্ত ক্রমবর্ধমান মেগাসিটি, তার পালটে যাওয়া প্রযুক্তি আর প্রজন্মের পর্যবেক্ষণ যেমন পিনাকীর কবিতাকে করে তুলেছে স্মার্ট আর সমসাময়িক। অন্য দিকে মফসসলের বাংলা আর মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবন, বেকার কিংবা টিউশনি সম্বল যৌবন, ক্রমভঙ্গুর পুরনো ইমারত বা গঙ্গার ঘাটের ছলাৎছল তার কবিতাকে টেনে নিয়ে গেছে মন-কেমন করা এক গাঢ় উচ্চারণের দিকে।”কবি শ্রীজাত পিনাকী ঠাকুর স্মরণে তার কবিতাতেও লিখেছেন এই পংক্তি, “শরীরে লেগে থাকা মফসসল”।
কবি পিনাকী ঠাকুরের একটি স্বল্প পরিচিত ছবি (পত্রিকা থেকে) |
নবীন প্রজন্মের প্রতিভূ হয়ে ব্যান্ডেলের চমক মজুমদার যা লিখেছেন, কবির জায়গা বাঁশবেড়িয়া থেকে শুরু করে গঙ্গার ধারে হুগলি, চুঁচুড়া, চন্দননগর এই জনপদগুলির পরিপ্রেক্ষিতে তার চেয়ে বড় সত্য আর নেই। চমক মজুমদার লিখেছেন, “প্রাচীন এই জনপদটার সাম্প্রতিক সাহিত্যের ইতিহাসে পিনাকী ঠাকুরের মতো বৃহৎ বটবৃক্ষ আমরা পাইনি। বদলে গেছে এই শহরের মানচিত্র, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল এমনকি অর্থনৈতিক ভারসাম্যও। প্রতিটা শহরের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। বদলে যাওয়া এই শহরের সাহিত্য জগতে একটাই গন্ধ। ঠাকুরের পুজোয় যেমন একটা ধুনো-ফুল-ফল-প্রদীপের গন্ধ মেশানো সুবাস থাকে, ঠিক তেমনি ঠাকুরের গন্ধ। ধসে যাওয়া এ শহরে জেগে থাকা চিমনির মতো সুউচ্চ পিনাকী ঠাকুরের কীর্তি। শহর জোড়া পিনাকী ঠাকুরের সুবাস।” এই চিমনি হল বন্ধ হয়ে যাওয়া ডানলপ কারখানার কঙ্কালের অবশেষ। যে কারখানায় পিতার মৃত্যুর পর কবি কাজ করেছেন মনের সায় ছাড়াই। মনে পড়ে যায় ‘রোমান্টিক’ গল্পের লাইন, “রাহুলের যোগ্যতা ছিল একটা মৃত্যু। তাঁর বাবার মর্মান্তিক মৃত্যু।” সেই গল্পের নায়ক রাহুল বাবার মৃত্যুর পর কারখানায় বাবার চাকরিটা পেয়েছিল।
২০১৬ সালে দাঁড়াবার জায়গা থেকে প্রকাশিত পিনাকী ঠাকুরের গল্প আর ২০১১ সালে আনন্দ থেকে প্রকাশিত নভেলা ‘অকালবসন্ত’ নিয়ে আলোচনায় অয়ন চৌধুরি লিখছেন, “মধ্যবিত্ত মানুষের সারাটা জীবন দাঁড়িয়ে আছে একটা টানাপোড়েন (dilemma) বা অনিশ্চয়তার উপর। সেই অনিশ্চয়তা কখনও বেকারত্ব কখনও বা প্রেম আবার কখনও বা অভাব রূপে ফিরে আসে। কিন্তু যেটা ধ্রুবক হয়ে থেকে যায় সেটা হল এই অনিশ্চয়তা, টানাপোড়েন।” অয়ন চৌধুরি তার প্রবন্ধে দেখিয়েছেন কীভাবে পিনাকী ঠাকুরের গদ্যসাহিত্যে এই অসহায়তা, টানাপোড়েন, সামাজিক বোঝাপড়ার চিত্র চিত্রিত হয়েছে। তিনি বলেছেন জীবনকে আরও গভীরভাবে দেখতে শেখায় পিনাকী ঠাকুরের গদ্যসাহিত্য।
কৃষ্ণপদ দাস উল্লেখ করেছেন ‘উশীনর’ পত্রিকায় কবির প্রথম কবিতা প্রকাশের কথা। গৌতম দেবের লেখায় আমরা পাই উশীনরের কথা। ১৯৭৫ সালে উশীনরের প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় চন্দনগরের বুক থেকে। এখানেই প্রথম প্রকাশিত হয় পিনাকী ঠাকুরের কবিতা। যে কবিতার কিছু লাইন, “আসলে এখনও আমি সতেরো বছর ধরে/ লাইলাক্ ফুলকে দেখিনি। জানিনা এখনও/কি রকম সময়েতে ম্যান্ডোলিন বেজে ওঠে ঝলকে ঝলকে”। লেখক পরিচিতিতে লেখা হয়েছিল, “এই ছেলেটির হাতে বেশকিছু অশ্ববেগ চালনা করার শক্তি আছে।”
পিনাকী ঠাকুরের গদ্য শৈলী নিয়ে আলোচনা করেছেন দেবকুমার চক্রবর্তী কবির গল্প সংকলন ‘রোমান্টিক’-এর ছয়টি গল্প ধরে। ২০০৬ সালে পরম্পরা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ‘রোমান্টিক’। তিনি লিখেছেন, “গল্পের মধ্যেও পিনাকী ঠাকুর গেঁথে রাখেন সমসাময়িক সমাজ-রাজনীতির সনিষ্ঠ দলিল। তাই পাঠক নিজেকে এবং তার সময়কে আইডেন্টিফাই করতে পারেন . . .”। তিনি পিনাকী ঠাকুরের গল্পের কিছু সাধারণ বিশেষত্ব উল্লেখ করেছেন যেমন,
“তাঁর গল্পের মূল চরিত্ররা সকলেই বয়সে সদ্য যুবক। চরিত্রগুলি নিম্নবিত্ত সংসারের সংগ্রামে ছিন্নভিন্ন মানুষ। রুটিরুজির জন্য তাদের অকিঞ্চিৎকর জীবিকার সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছে বারবার। তাদের জীবনে প্রেম দানা বাঁধে, থিতু হয় না।”
পিনাকী ঠাকুরের প্রবন্ধের আঙ্গিকে লেখা গ্রন্থিত ছ’টি ছোটো ছোটো গদ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন সাগরিকা শূর। তিনি দেখিয়েছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আবেগের জোয়ারে রবীন্দ্রনাথের পাদপূজা করেননি কবি, বরং তুলে এনেছেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন যেমন, মধুসূদনের প্রতিভাশক্তির উৎস বুঝতে রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ পঁচিশ বছর লাগল কেন।
সৌভিক গুহসরকার আলোচনা করেছেন পিনাকী ঠাকুরের ‘অকালবসন্ত’ উপন্যাস নিয়ে।
শ্যামলী আচার্য একটি কল্পিত সাক্ষাৎকারে তুলে এনেছেন প্রয়োজনীয় বহু তথ্য ও কবির নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী। যেখানে কবি বলছেন, “. . . আমি বরাবর কবিতায় সংকেত পছন্দ করি। একটি শব্দ থেকে অনেক অর্থ বিচ্ছুরিত হবে। এমন কোনও বাঁকে নিয়ে যাবে, যা পাঠকের অজানা। এই সংকেত কিন্তু দুর্বোধ্যতা নয়। অকারণে ব্যবহার করা নয়। কিন্তু শব্দের মধ্যে একটা সংকেত থাকবেই।” একই ভাবে কিশোর ঘোষ লিখেছেন একটি অনবদ্য কাল্পনিক কথন যেখানে তিনি কবিকে বলছেন, “হতেই পারে আপনি আসল পিনাকী ঠাকুর না। চরম প্রতিভাবান অথচ সামাজিকভাবে অসহায় সেই পিনাকীকে আপনি বন্দি করে রেখেছেন। কোথাও, কোনও গুমঘরে। তাঁর সঙ্গে আপনার চুক্তি হয়েছে — আপনি তাঁকে খাওয়া-ঘুম দেবেন, বদলে সে দেবে দুর্দান্ত সব কবিতার মিছিল। এবং সেই পিনাকীর কবিতাগুলোই আপনি আপনার নাম চেপে গিয়ে ছেপে দিচ্ছেন। হতেই পারে আসলে আপনার নাম — অবদমন গুপ্ত।”
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী লিখেছেন, “পিনাকীদা বুঝিয়েছিলেন, পিউপা নয়, একজন কবির আসল মুক্তি প্রজাপতির ডানায়। পিনাকীদা বোঝাতে পারতেন। কারণ পিনাকীদার রোমরোমজুড়ে ছিল কবিতার ঈশ্বরেরা। শত অভিমান মনখারাপ ভ্যানিশ করে দিতে পারতেন তিনি।”
বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আলোচনা করেছেন সিগনেট প্রকাশিত পিনাকী ঠাকুরের কবিতাসমগ্র ১ নিয়ে। তিনি এই পাঠ অভিজ্ঞতাকে ‘ক্যালিডোস্কোপিক’ বলে বিবৃত করেছেন। এই প্রবন্ধটি পত্রিকার একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ। বিস্তৃত আলোচনার মধ্যেও তিনি প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের মূল স্পন্দনটি উল্লেখ করেছেন নিপুন সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। তিনি পরিশেষে লিখেছেন, “তাঁর লেখায় বহুবাচনিক একটি সত্ত্বার উপস্থিতি মেলে যে দেশ, কাল, প্রকৃতি, সময়, সমাজ, শোষিত মানুষ, বিপ্লবী সকলের বক্তব্য মনে রাখে।”
‘মৌসম’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রবন্ধটিও একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ। পিনাকী ঠাকুরের কবিতার লক্ষণ নিয়ে তিনি বলেছেন, “কথনের নিজস্ব জাদুভঙ্গিমা, স্বরের অনির্দিষ্ট ওঠা-পড়া — পাঠককে যা বিমোহিত, বিহ্বল, স্তব্ধবাক করে বসিয়ে রাখে মায়াবী, কিন্তু ভীষণ বাস্তবের মাঠে”। তিনিও বলেছেন, “মূলত শহরতলি বা মফসসলের নাগরিক-যন্ত্রণাকে পাটে পাটে মেলে ধরতে চান পিনাকী — সম্পূর্ণ ন্যাকামিবর্জিত তাঁর এই উন্মোচন।”
অদিতি বসুরায় আলোচনা করেছেন ‘কালো রঙের আগুন’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে। তিনি মন্তব্য করেছেন, “এ আদতে সাইবার যুগ। শেষ রোমান্টিকদের সময়। এবং এই সময়ে কবিই কেবল গোপনচারি। বাঘ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। গৃহস্থবাড়ি ছেড়ে গেছে চড়ুইপাখির বাসা। কৃষি জমির দখল নিচ্ছে শিল্প। উল্লেখ করেছেন কবির রচিত পংক্তি ‘মানুষ নিজের প্রজাতির মৃত্যুর জন্য যন্ত্রপাতি তৈরি করে নাম দিচ্ছে ডেভেলপমেন্ট’।"
উপাসনা সরকার আলোচনা করেছেন ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে। ‘ন্যুড স্টাডি’ কাব্যগ্রন্থের একান্নটি কবিতার জগৎ নিয়ে লিখেছেন কস্তুরী সেন। ‘জীবন বেঁধেছি হাতবোমায়’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে লিখেছেন শান্তনু দাস। চন্দ্রনাথ শেঠ লিখেছেন ‘হ্যাঁ রে শাশ্বত’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে।
রঙ্কু দাসের ‘পিনাকী ঠাকুরঃ কবিতার ঘরবাড়ি ও অন্যান্য’ প্রবন্ধটি একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য সমৃদ্ধ রচনা। কবির জীবন আর রচনার একটি ধারাবাহিক ক্রম আমরা পাই এই প্রবন্ধে। পত্রিকার অন্যতম সম্পদ।
পত্রিকাটিতে লিখেছেন আরো অনেকেই। সংকলিত হয়েছে পিনাকী ঠাকুরকে নিয়ে লেখা বেশ কয়েকটি কবিতা। লিখেছেন, সুবোধ সরকার, শ্রীজাত, তন্ময় চক্রবর্তী, পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়, শুভেন্দু পাল, মোহম্মদ শাহবুদ্দিন ফিরোজ, অভিজিৎ বেরা, রিমলী বিশ্বাস, ঊষসী ভট্টাচার্য, নিলয় নন্দী, অনিমা চরিত এবং সংবেদন চক্রবর্তী। রয়েছে কবির বেশ কিছু ছবির ফটোপ্লেট। পিনাকী ঠাকুরের সৃষ্টিকে যারা বুকে করে রেখেছেন তাদের জন্য দাঁড়াবার জায়গার এই অর্ঘ্যটি অবশ্যই সংগ্রহযোগ্য। প্রচ্ছদে রয়েছে বিপ্লব মন্ডলের আঁকা কবির মুখচ্ছবি আর পেছনের কভারে রয়েছে তৌসিফ হকের আঁকা মুখচ্ছবি। দুটি ছবিই অসাধারণ, ভালোবাসায় জারিত। তবে সংখ্যাটিতে অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল কবির জীবন ও সৃষ্টি সম্পর্কে একটি তথ্যপঞ্জী। আশা রাখা যায় ভবিষৎ সংস্করণে আমরা তা পাব।
পরিশেষে উল্লেখ করব শুভেন্দু পালের একটি কবিতা — ‘একদিন, অশরীরী’।
“বাঁশবেড়ে গলিতে গলিতে আজ
ওই যে আবার এক মুখচোরা হাওয়া
শরীর নেই, চিরসঙ্গী খিদেটিও নেই
আরও নিচু হাওয়াদের শ্লোক তবু
কেন যে এখনও খুঁজে ফিরছে তাঁকে
ঘামে ভেজা নতুন একটা লেখা শুনবে বলে!”
পত্রিকা সংক্রান্ত যোগাযোগ
e-mail: darabarjayga@gmail.com
Mobile no. 8420888930
রাজীব কুমার ঘোষ
‘চুঁচুড়ার রাজীব’ মানেই ‘সহদেববাবুর ঘোড়া’, ‘ভীষ্মদেবের মৃত্যুমুহূর্ত’, ‘অনেক জলের শব্দ’, ‘টাওয়ার অফ্ সাইলেন্স’, ‘হিবাকুশার ছেলে’ বা ঘোষ স্যারের গল্পগুলি — বহুচর্চিত, ভিন্নমাত্রার কিছু গল্প। জন্ম ১৯৭৭; পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা চুঁচুড়া-হুগলি-চন্দননগর। ১৯৯৭ সাল থেকে লিটল ম্যাগাজিন কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত এবং নিয়মিত লেখালেখি। সম্পাদিত পত্রিকা ‘সাইন্যাপস্’। আছে বেশ কিছু কবিতার বই। প্রকাশিত গল্প সংকলন ‘ঘর ও দরজার গল্প’, ‘অনেক জলের শব্দ’, 'আমাদের আশাতীত খেলাঘর'। গল্পের জন্য বারাসাতের বহুস্বর পত্রিকার পক্ষ থেকে পেয়েছেন ২০১৯ সালের ‘অনন্তকুমার সরকার স্মৃতি পুরস্কার’। অণুগল্পের জন্য ২০১৮ সালে চুঁচুড়ার গল্প সল্পের আটচালার পক্ষ থেকে পেয়েছেন ‘উৎপল স্মৃতি পুরস্কার’।
পেশায় বিজ্ঞান শিক্ষক। নেশায় পাঠক। প্রিয় অবকাশ যাপন — পাঁচশো বছরের পুরনো জনপদের অলিগলিতে সময়ের ভাঁজে ভাঁজে ঘুরে বেড়ানো।
0 মন্তব্যসমূহ