তথাগত মৌলিকের গুচ্ছ কবিতা

তথাগত মৌলিকের কবিতাগুচ্ছ

১০টি কবিতা

 

শুধু বসে থাকা

 

যেভাবে ময়দানব
জঙ্গল কেটে ইন্দ্রপ্রস্থ
গড়ার বরাত পেয়েছিল
ঠিক সেই ভাবেই যেন
শিকড় সমেত উপড়ে ফেলা হচ্ছে
লাখোলাখো মানুষের জীবন-জীবিকা
পৃথিবীটা কার বাপের?
মাঝেমাঝে সীমান্তের কাঁটা তারেরা
খেলায় মাতে
দুদিক থেকেই ছুটে আসে
বারুদের ঘ্রাণ
মেঘের আড়াল থেকে
দূরবীন লাগিয়ে নজর রাখছে কেউ
অর্থনীতির ভগ্নস্বাস্থ্য
নিম্নগামী উন্নয়নের সূচক
তবু প্রেস বিবৃতি দিয়ে
দুনীতিগ্রস্থ নেতা জানান
সব ঠিক আছে
অতএব মেনে নিতে হবে সবকিছু
 
সুদীপ্ত বল —
কিভাবে কে ঠেকাবে সভ্যতার
এই অধঃপতন?
আমাদের শুধু বসে থাকা
হাঁটু গেড়ে?
যদি কিছু অলৌকিক ঘটে কখনও!!


তাদের কথা
 
যাদের সাথে কথা বলছ
তারা তোমার কথা শুনছে
ওদের চোখের দিকে তাকালে
বুঝতে সেখানে কোনো ছায়া নেই
ওরা তর্ক করেনা অযথা
অপেক্ষায় ঘরে বসে থাকে।
তুমি ক্লান্তিতে কথা থামিয়ে দাও
ওরা চলে যায় নিজের খেয়ালে
ওদের মনের কথা বোঝোনি একেবারেই।
তোমার জানা নেই কিভাবে বদলাবে
ওদের জীবন প্রনালী
তোমরা ঈশ্বরের কথা শোনাও
আমাদের বিভাজন শুধু
মুখের ভাষায়
আর সব একই রকম।


ভিনদেশী
 
কী আশ্চর্য দেখো
এমন এক অসম্ভব দেশে
আমরা সকলে অস্বাভাবিক বাঁচি
আমরা তো আনুগত্য স্বীকার করি নি
অথচ দেখো জালিয়াত এবং দস্যু
নির্দিষ্ট পোশাক পরার অনুমতি পেয়ে
অনায়সে পতাকা ওড়াবার
অধিকার পেয়ে দাপায় চোখের সামনে
কি করে সুখী হব বল
এইসব রীতিনীতি
আমি মেনে অভ্যাস করতে রাজি নই
তোমাদের ভাষা ও জীবন প্রনালী
আমি মনে রাখতে চাই না
আমাকে কি ভিনদেশী বলতে চাও?


নতুন সকাল
 
সারাদিন তাপের প্রখরতা ছড়িয়ে
সূর্যও গেল আঁধারে হারিয়ে
এখন তো জানা হয়ে গেছে
প্রতিটি আঁধার পেরিয়ে সূর্য জেগে ওঠে
আর তখন নতুন সকাল আসে
কিছুতেই আগের সাথে মেলাতে পারিনা।
এই তো দেখলাম কাদায়
নবীন পায়ের ছাপ
এ কার পদচিহ্ন চিনতে পারিনি
শিউলি — সকালঘেরা উঠোন পেরিয়ে
নদীতে নাইতে যাওয়া প্রয়োজন ছিল
নিগ্রহ যা পেয়েছি এতদিন
সেইসব ভুলেই।


তোমার কাছেই যাব
 
স্বপ্নের মধ্যেও জেগে ওঠে রক্তদাগ
কিভাবে যে এসেছি এখানে?
ঘুমন্ত নিঃশ্বাসে পাই
রক্তের আঁশটে গন্ধ
কিভাবে জলপ্রপাত থেকেও
ঝরে পড়ছে তাজা রক্ত?
 
আমি ঘুম ভেঙে তোমার কাছে ছুটে যাব
অসম্মান জ্বলে পুড়ে গেছে
যতপারো তিরস্কার কোরো
মেনে নেবো সব
তবু তোমার কাছেই যাব।
সব অহংকার আমার
তোমার নদীজলেই ভাসাব।
 
 
অপারগ
 
শৈশব তো কেটেছে হেসেখেলে
সামান্য বড় হয়ে যখন
মর্যাদা পেতে চেয়েছি
চোখের সামনে রণভূমি ভেসে উঠেছে
এখন যা দেখছো এই দেহ
কুঞ্চিত, পরিত্যক্ত, নিরাসক্ত
আশা করি বোঝাতে পেরেছি
যুদ্ধজয় তো দূরের কথা
নিজেকে কোনো সন্ধ্যায় বীরসুলভ
করে সাজাতেও পারিনি কোনোদিন।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই
নিক্ষিপ্ত হয়েছি নিয়ন্ত্রণহীন কাজে
না চাওয়া পথেই।

 
   
হতে পারি নি
 
রাজতন্ত্রের শিকড় ছিঁড়ে
আমাদের নীল আকাশে
ওড়ার কথা ছিল।
সম্ভাবনা৷ যে ছিল না একদম
একথা বলতে পারি না।
সাদাকে সাদা আর
কালোকে কালো বলার অধিকার
হাতের মুঠোতেই ছিল
উচ্চকণ্ঠে বলার কথা ছিল
দুনিয়ার সাতশো কোটি
মানুষকে জানানোর অধিকার ছিল
অথচ এক বেসুরো বাদ্য নিয়ে
ক্রমাগত ভয়ংকর অদ্ভুত সুর
বাজিয়ে চলেছি
অহেতুক বাক্যের ঝংকারে
নির্বোধের মত আশংকা
জাগাচ্ছি মানুষের অন্তরে
হয়তো উচিত ছিল
বিপ্লবীদের কাতারে দাঁড়ানোর
সব শক্তি দিয়ে মাথার ওপরের
সর্বগ্রাসী কালো ছায়া সরানো।
অথচ দেখো একজন কালো কৃষকও
হয়ে উঠতে পারি নি।


হাঁটছি
 
শুরু থেকেই হেঁটে চলেছি
শেষের দিকে, গন্তব্যে।
অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়েও
হাঁটা থামাতে পারি নি
কখনও ফেলে আসা পথের দিকে
ফিরে তাকিয়াছি যদি,
সে খুব সামান্যই।
সংক্ষিপ্ত করতে চেয়েছি যাত্রাপথ
আশেপাশের চোরা গলি পথ
জলে প্লাবিত জেনেও বাড়িয়েছি পা
বাম দিক ঘেঁষে চলতে গিয়ে
ডান দিকের মানুষগুলোর
দিকে তাকাইনি কেন?
সামনের দোলা সাঁকো পেরিয়ে
যতই এগিয়েছি
সব কেমন ঝাপসা হয়ে গেছে
হাঁটছি কিন্তু কোথায় পৌঁছাতে হবে
সেসব ভুলে গেছি
হাঁটছি, তবু হেঁটেই চলেছি ...


দর্পণে নিজের মুখ

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি

অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি
কিছুতেই বুঝিনা
আয়নার কাচ অস্বচ্ছ
না আমি নিজেই অস্বচ্ছ এখন?
আমি জানি কর্তব্যের অর্জিত পূণ্যে
অকর্তব্যের পাপ ক্ষয় হয় না।
সামনে দীর্ঘ সময়
তোমাদের সাথে দেখা হওয়াটা
আমার জীবনে এক মূল্যবান ঘটনা।
বোধহয় তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে বলেই
এই জনহীন প্রান্তরে অপেক্ষায় থেকেছি
কত বছর, কত কাল
তার হিসাব জানিনা
আমি ঘুরেছি অনেক তীর্থ
ঘুরেছি বহু দেশ
দেখেছি মন্দির, দেবতার মূর্তি
কোথাও খুঁজে পাইনি নিজেকে
এতদিন পর তোমাদের সাক্ষাতে
আমি দেখছি নিজেকে
আমি বুঝতে পারছি
তোমরা তো তোমরা নও
তোমরাই আমি
তোমরাই আমার দর্পণ
তোমরাই আমার ছায়া।
তোমার গায়ের চামড়া
কুঞ্চিত হয়ে পড়ছে
যেন রোদে ঝলসে গেছে
তোমার চোখ যেন গাছের কোটরে
লুকিয়ে থাকা প্যাঁচার মতো সংশয়ী
তোমার মুখ, কেন সুখহীন,
আনন্দহীন, যেন প্রেতের চোখ।
হাত পা যেন রক্তমাংসের নয়
ধাতুখন্ডের মতো কঠিন নির্মম।
আমি বুঝতে পারছি কোথাও
গোলমাল হয়ে গেছে বড়
আমি ক্লান্ত শরীরে অবসন্ন হয়ে
ঘুমিয়ে পড়েছি মৃতের সমাধির  পাশে
জানতে চাইনি কোথাও মৃত্যুর কারণ
আমি কি প্রতারণা করেছি নিজেকে?
ঘুম ভাঙলে দেখেছি
সারা আকাশ জুড়ে ছুটে চলেছে
কালো ষাঁড়ের মতো ক্ষ্যাপা মেঘ।
এক কোণে একটা টুকরো চাঁদ
বেরিয়ে রয়েছে সাদা কাপড়ে ঢাকা
শবদেহের পান্ডুর মুখের মতো
আমি ভয় পেলাম খুব
চিৎকার করে ডাকলাম
ভাই,বোন, পুত্র, বন্ধুদের
কেউ সাড়া দিল না
কেবল একটা গাছের
শুকনো পাতা বুনো ঘোড়ার মতো
কেশর দুলিয়ে ঠাট্টা করে গেল।
দৌড়ে পালাতে গিয়ে
ধাক্কা খেলাম গাছের শক্ত গুঁড়িতে।
চারপাশ ফাঁকা নিঃশব্দ
কোথাও কোনো শব্দ নেই
শুধু মাটির অন্ধকার থেকে
ভেসে আসছে পতঙ্গদের অস্পষ্ট ধ্বনি।
সেই অন্ধকারের বুক চিরে
বেরিয়ে এলো রুপালী চাঁদ
যেন এক অস্পষ্ট মুখ
আমি কিছুতেই স্পষ্ট ঠাওর
করতে পারলাম না।
সেই মুখ কেবল ঢেকে যাচ্ছিল
কালো চুলের মতো মেঘে
কিন্তু দুটো উজ্জ্বল চোখ
চেয়ে ছিল আমার দিকে অপলক।
ভোর হতেই আমি ছুটে গেছি
নদীর তীরে আমার অসহায়তা  নিয়ে
তখন নদীর প্রত্যেকটি ঢেউয়ে
ভেসে যাচ্ছিল সূর্যের ভাঙা টুকরো।
আমি জলে হাত দিতেই
নদীর জল হয়ে উঠলো রক্তরাঙা
সেই রক্ত ভেদ করে ফুটে উঠলো
ফুলের মতো মোহময়
আমার আজন্ম পরিচিত দুটি চোখ
যে চোখ দিয়ে ঠিকরে পড়লো
কোনো ঘৃণা নয়
ক্ষমার প্রশ্নহীন হাসি।
সেই থেকে আমি নিজের কাছে
নিজেই অস্বচ্ছ হয়ে গেলাম।
আমাকে কেউ তাড়া করেনি
কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই
রুপালী জলস্রোত
রক্তবিন্দুর মধ্যে কালো চোখ
আমি তাই চোখ বন্ধ করতে পারি না।
আমার জন্য ঘুমের আশির্বাদ
আর থাকবে কিনা জানা নেই।
তবে আমি ঘুমোতে চাই
আসলে ঘুম মানে ভুলে থাকা
যতক্ষণ ঘুমাবো ততক্ষণ শান্তি
ততক্ষণই সমস্যা থেকে দূরে থাকা।
কিন্তু ভুলে থাকবো কেন?
অন্যায় করেছি যদি
প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে।
তাই এই অনন্ত জাগরণ।

পক্ষ

শান্তি একটি ধারনা মাত্র

নিঃশর্ত শান্তি বলে কিছু নেই
শান্তির বাতাবরণে এক পক্ষকে
অবনত হতে হয় ।
যুদ্ধ চিরকালিন
যুদ্ধ প্রতিনিয়ত
কোথাও তা দখলের জন্য
কোথাও অধিকার রক্ষার
আমাদের পক্ষ না নিয়ে উপায় নেই
পক্ষ নেওয়া নিয়েও
নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ অবিরত।

তথাগত মৌলিক
লেখক, অনুবাদক, সম্পাদক, নাট্যকার,
তথ্যচিত্র নির্মাতা, শর্ট ফ্লিম নির্মাতা
তথাগত মৌলিক
**********************************
কর্মকান্ডের তথ্য দিয়ে তথাগত মৌলিককে চেনা যাবে না, জানা যাবে না। চুঁচুড়া - হুগলি - চন্দননগর তল্লাটে তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সামগ্রিক খতিয়ান দেওয়া প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব। আপাতত আমরা শুধু প্রাথমিকভাবে তুলে ধরলাম কিছু তথ্য, যারা তথাগত মৌলিক ওরফে সবার 'বাপতুদা'কে চেনেন না তাদের জন্য।
এক নজরে - তথাগত মৌলিক
জন্ম ১১ আগস্ট ১৯৫৩
**********************************
প্রকাশিত গ্রন্থ
বিবস্বান (যৌথ কাব্য সংকলন) প্রগতি মঞ্চ, ১৯৮৭
ডায়েরির ছেঁড়া পাতা (কবিতা) দিনান্তের অন্বেষণ, জুলাই ২০০০
সর্বনাশের স্মৃতিমালা (কবিতা) প্রথম আলো, বইমেলা ২০০০
পরাজয়ের অধিকার (কবিতা) আধুনিক সময়, অক্টোবর ২০০০
মৃচ্ছকটিকের ধূলো (কবিতা) দিনান্তের অন্বেষণ, এপ্রিল ২০০৬
ডাক বাংলো পেরিয়ে (কাব্য নাটক) দিনান্তের অন্বেষণ
অসংলগ্ন কথামালা (দীর্ঘ কবিতা) দিনান্তের অন্বেষণ
*****************************
অনুবাদ উপন্যাস
রাগো (তেলেগু)
অরণ্যকন্যা (তেলেগু)
কালো হীরের স্তরে স্তরে (তেলেগু : বারোয়ারি উপন্যাস)
সে (তেলেগু)
*****************************
উপন্যাস
খোঁজ - দিনান্তের অন্বেষণ
পতাকী - দিনান্তের অন্বেষণ
কলরব - দিনান্তের অন্বেষণ
*****************************
চিত্রনাট্য
স্বল্প দৈর্ঘের ২৫ টি
পূর্ণ দৈর্ঘের ৭ টি
*****************************
নাটক
একাংক ৩০ টি
পূর্ণাঙ্গ ১৫ টি (হিন্দি সহ)
অনুবাদ নাটক
চেকভ, বিজয় তেন্দুলকর, মোহন প্রকাশ, দিনেশ খান্না
*****************************
পত্রিকা সম্পাদনা - দিনান্তের অন্বেষণ
*****************************
পরিচালনা
নাটক -১৯৭২ থেকে আজও অব্যাহত
চলচিত্র - ১৯৮৯ থেকে আজও অব্যাহত।



আপনার মতামত নিচে 
'আপনার মন্তব্য লিখুন' শীর্ষক বক্সে লিখে 
আমাদের জানান। 
লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকে 
পাঠকদের মতামতে। 🙏