সমীর মুখোপাধ্যায় হুগলির প্রখ্যাত গল্পকার। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলেই বোঝা যায় তিনি এক জীবন্ত মুভি ক্যামেরা বিশেষ। তার ক্যামেরায় হুগলি-চুঁচুড়া জনপদের ফেলে আসা সময় আর বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের ছবি ধরে রাখা আছে। তার আত্মজীবনীটি সাইন্যাপস্‌ পত্রিকায় ২০১৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা ওয়েবে প্রকাশিত হয়ে আরো অনেক বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে আমরা আশা রাখি, তাই আমরা আবার এই ধারাবাহিক স্মৃতিকথাটি প্রথম পর্ব থেকে বৃহত্তর পাঠকদের কাছে উপস্থাপিত করছি। এবারে রইল দ্বিতীয় পর্ব।

পর্ব ২

    মি কানুদার কথা দিয়ে লেখাটি আরম্ভ করেছিলাম। 'সত্তরের দশক মুক্তির দশক' ঘোষণার পর রণভূমি যখন বধ্যভূমিকে রূপান্তরিত হল, সেদিনের প্রগাঢ় অনুভূতি একটি গল্পের মধ্যভাগে এভাবে লেখা হয়, 

    "পর পর এই রকম চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে যাবার পর, এই সব বোমাবাজি, রক্তারক্তি অনেকটা নিস্পৃহ চোখে দেখতে লাগলাম। এই রকম মারামারি, রক্তারক্তি নতুন কিছু নয়, মূঢ় ইতিহাসের পর্বে পর্বে মানুষের আদিম রক্ত এক এক সময় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এক এক বার, এক এক নামে, এক এক পতাকার নীচে শুরু হয়েছে তান্ডব। গভীর নিশীথে বেজে উঠেছে কাড়া নাকাড়া, রক্ত মশালের ধক্‌ ধক্‌ আলোয়, অন্ধকার আরো করাল, আরো ভয়াল হয়ে উঠেছে, মানুষেরর কাটা মন্ডু জমিয়ে জমিয়ে মানুষ নিতান্ত ফাঁপা, অর্থহীন জয়স্তম্ভ তুলেছে। অশ্বক্ষুরের ধুলোয় ধুলোয়, বন্দুকের শব্দ, বারুদের ধোঁয়ায় সেদিন যে এসেছিল  আজ লাল তিলকে ললাট রাঙিয়ে সেই আবার এসেছে। এ নতুন কিছু নয়, চমকপ্রদও কিছু নয় —  সেদিন যদি মানুষ সব সহ্য করতে পারে, আজকেও মানুষ তা পারবে  এই সব ভেবে, সময়, জীবন আর ইতিহাসের এই ব্যাখ্যায় বেশ একটু আত্মপ্রসাদ-ও লাভ করলাম। . . .  মাস খানেক পর এই পথ দিয়েই ফিরছি, হঠাৎ এমনি চোখে পড়ে গেল। কী আশ্চর্য! একি ভোজবাজি নাকি! ম্যাজিক! জাদু! চোখে ঠিক দেখছি তো! রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে সেদিনের সেই মেয়েটির মতোই আরেকজন, সে জানলায় বসে আছে। আহা মুখখানি কী সুকুমার। চাঁদের মতো মসৃন কপাল। পিঠে একঢাল কুঞ্চিত চুলের রাশি। ঐ রকমই দীঘল চোখ  বড় বড় পালক দিয়ে ঘেরা। হাসিতে, লজ্জায় অপরূপ হয়ে কথা বলে যাচ্ছে। উড়ো পাখির ডাগর মতন ভুরু নেই কিন্তু চোখে মুখে অবিকল সেই একই মুগ্ধতা, যা চিনে নিতে ভুল হয়না। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত একটা কথা মনে হল . . . এ আর কী সামান্য দু'চারটে বোমা আর পাইপগান বা স্টেনগান, এ আর এমনকি সাংঘাতিক দুর্যোগের দিন! শত শত আগ্নেয়াস্ত্র বা ভূমিকম্প বা পরাক্রান্ত মহামারী বা বন্যার ওপরেও এ জানলা খোলা থাকবে। সেদিনও যুবক দাঁড়িয়ে থাকবে রাস্তায় আর জানলায় বসে নারী তার একমাত্র পুরুষের গায় তার হেমবর্ণ শরীরের আলো ফেলবে - আর তারা কথা বলে যাবে অনর্গল, যেমন করে ঝরে শিউলি, ঝরে বনভূমি আলো করে।" (চিরদিনের গান)

        বছর চারেক আগে টেকনো ইন্ডিয়ার উদ্যোগে কবি লেখক সম্বর্ধনা সভায় কবি মৃদুল দাশগুপ্তের কথায় জানা গিয়েছিল, 'চিরদিনের গান' গল্পটি আজো তাকে নাকি হন্ট করে। বাংলা সাহিত্যের দশ/বারো খানি গল্পের মধ্যে এ গল্পটিকে নাকি অনায়াসে রাখা যায়। এটা যেমন প্রশংসার দিক, তেমনি অখ্যাতি জুটেছিল। গল্পটি কী করে যেন কানু সান্যালের কাছে পৌঁছায়। উনি নাকি বলেছিলেন, 'ধনতন্ত্রের বন্দনামুখর পত্রিকায় কয়েকজন লেখক ভেরীবাদক আছেন, এই গল্পটির লেখক তাঁদেরই একজন। ইনি বিপ্লবী হিংসা আর প্রতিবিপ্লবী হিংসাকে একই চোখে দেখেন। ট্রটস্কিবাদ বা স্ট্যালিনবাদ এদের চোখ একই। মেনশেভিক ও বলশেভিক তাৎপর্য - এইসব বুর্জোয়া পত্রিকার দালালরা সব বুঝেও ইচ্ছে করে গুলিয়ে দেন।"
        
কবি মৃদুল দাশগুপ্ত।। ছবি - সাইন্যাপস্‌


    বলা বাহুল্য কানু সান্যালের সঙ্গে সরাসরি আমার কথা হয়নি। একজন বিশ্বাসভাজন 'বন্ধু' মারফৎ কানু সান্যালের প্রতিক্রিয়া আমি জেনেছিলাম এবং মনে মনে খুবই আহত হই।

    সত্তরের দশক অনেকদিনের বাসি চিন্তাভাবনাকে দূরে ফেলে দিয়ে নতুননতর উদ্দীপনায় আমাদের উদ্দীপ্ত করে। যদিও আমি ও আমার সেদিনের বন্ধুরা - যেমন কবি, লেখক, নাট্যকার শরিৎ শর্মা, কবি প্রণব মিত্র, অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন চক্রবর্তী এবং বেশ কিছু পরে কবি চিত্ত দাস - আমাদের উত্থান হয়েছিল তারো ঢের আগে। এরও পটভূমি ছিল দগ্ধ দেশ, রক্ত রঞ্জিত রাজপথ আর এক শ্লোগানমুখর ভয়ংকর যৌবন। কবি ও অধ্যাপক গিরীন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন 'শীর্ণ হাত করে দেয় টান, তখন কোথা যে কাঁপে পৃথিবীর কয়েকটি কোন।' শরিৎদা লেখেন, 'তাজা ঘোড়াগুলো লালের দৃঢ় শপথ, তোমাদের হাতে আশার লাল মশাল।' কবি চিত্ত দাস লেখেন, 'তোমাকে চিনিনা আমি, আমার স্বপ্নের তুমি, সোনার মানুষ' (বোধহয় সলিল চৌধুরীর উদ্দেশ্যে লেখা)। ওপার থেকে 'নতুন সাহিত্য' পত্রিকায় লিখছেন অধ্যাপক ও কবি সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইলামিত্র, কমিউনিস্ট নেত্রীর উদ্দেশ্যে 'তোমার ব্যাঙ্গমা/ শেষরাত চিরে ফেলে বলে রণরণি/ রাক্ষসের প্রাণ কোথা জমা, / কোথা সেই চাঁপার বরণ / কুমারী জিয়ন কন্যা নহলী যৌবন, / কারাকক্ষে মূর্ছা অচেতন . . .' উনি অন্য একট পত্রিকায় লিখেছেন, 'গোয়ালে শোভা নোয়ালে বাছুর / গগনে শোভা চাঁদে/ বুকের শোভা সোনার বাছা / ধুলোয় পড়ে কাঁদে' . . .  কী চেয়েছো সোনার হাতে কী চেয়েছো বাছা / শালিধানের মুড়ি মোয়া রাঙা পাখির নাচা'

    আমরা পঞ্চাশের প্রথম দিকের হতচ্ছাড়া, হাড় হাভাতের সময়ের সন্তান, যখন কলকাতার বিস্তীর্ণ রাজপথ আশিজন ভুখা নাঙ্গা কৃষকের রক্তে ভেসে যায়, যখন মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে জনৈক নিবারণ পন্ডিত স্বতস্ফূর্তভাবে বলে ওঠেন, 'নির্বিচার নরনারী, শিশুযুবক হত্যা / এই যদি হয় শিশুরাষ্ট্রের, আইন নিরাপত্তা / তবে আমি হাজারবার উচ্চকন্ঠে কহি, পাঁচশো হাজার অসংখ্যবার আমি রাজদ্রোহী"

    এসব রক্তের ছিটে গায়ে লাগতো বৈকি কেননা গন্ডারের চামড়া দিয়ে তো এ শরীর তৈরী নয়। তাছাড়া আমি যে ধাতু দিয়ে তৈরীই হই না কেন, আমার চারপাশের যুবকেরা হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে বিপুল অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়লে আমাদের মত অতিভীরু, পায়ে পায়ে নিষেধ মেনে চলা মানুষদেরও শেষাবধি কিছু করার থেকে যায়। তাছাড়া বয়স একটা বড় ফ্যাক্টর। এই অবস্থায় বিপ্লবী গল্পের মশলা সংগ্রহের জন্য কলেজ কামাই করে (যার জন্য ডিসকোয়ালিফাই হই) চটকল অঞ্চলের বস্তিতে বস্তিতে ঘুরি।

    এই সময় আমার একটি গল্প 'লাল চিঠি' কলকাতা অঞ্চলের কোনো একটি কাগজে প্রকাশিত হয়। তাতে, কীসের যোগাযোগে, যাঁকে কখনও চিনতাম না, যাঁর নামও কখনো শুনিনি সেই শরিৎ শর্মা একদিন আমাদের বর্মণ বাড়ির ভাড়াটে দরজায় এসে উপস্থিত। 'ভাই রে' এই ছিল তাঁর প্রথম সম্ভাষণ আর তারপর জড়িয়ে ধরা। আমি চিরকালই রোগা শোগা মানুষ, ঐরকম বক্সার বক্সার চেহারার জোয়ান, মাথায় একটু ছোট, আমার চেয়ে সাত আট বছরের বড়ই হবেন বোধহয়, মাংসল মুখে স্বাস্থ্যের দীপ্তি, তিনি আমায় জড়িয়ে ধরলেন। এইটি ছিল শরিৎদার আদত। উনি খুঁজতেন, খুঁজে খুঁজে বেড়াতেন, কারুর কলমে এতটুকু বিদ্যুতের উদ্ভাস দেখলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করতেন, আর প্রথম সম্ভাষণই ছিল ওই প্রকার, 'ভাই রে'।

    এর কিছুদিন পর উনি একজন প্রকান্ড লম্বা, একমাথা উস্কো খুস্কো চুল, শ্যামলা শ্যামলা গড়ন, গেরুয়া পাঞ্জাবী পরা একজনের কাছে নিয়ে গেলেন। আমাকে দেখিয়ে বললেন, 'এই ছেলেটি মাসের পর মাস শ্রমিক বস্তিতে পড়ে থাকে, ওখান থেকে উপাদান সংগ্রহ করে গল্প লেখেন।' ওকথা শুনে তালগাছ-ঢ্যাঙা মানুষটি মাথার চুলের বোঝাটি নেড়ে মৃদু হেসে বললেন, 'যে লিখতে জানে তাকে মাসের পর মাস চটকল এলাকায় পড়ে থাকতে হয় না। আপনি বছরের পর বছর কাটিয়ে দিলেন, কিছু পেলেন না, যিনি লিখতে জানেন তিনি একনজরেই যা দেখবার তা দেখে নেন।' তারপর গল্পটি পড়ে বললেন আমায়, 'তুমি দেখেছো অনেক, এটা ডকুমেন্টেশন হয়েছে, সাহিত্য হয়নি। সাহিত্য অন্য জিনিস। ওটা ভেতরের ব্যাপার। শিখে পড়ে কিছু হয় না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শুনেছ? উনি মাত্র সতেরো বছর বয়সে দিবারাত্রির কাব্য নামে অসাধারণ গল্প লিখেছেন। যদিও মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে লেখাটি পরিত্যাজ্য।'
সুভাষ মুখোপাধ্যায় ।। ছবি  সৌজন্য - আন্তর্জাল
    ফিরে আসতে আসতে ট্রেনে ফুল্লমনে সরিৎদাকে বললাম, কে মানুষটি? সরিৎদা বললেন, 'তুই জানিসনা? কখনও ওকে দেখিসনি? উনিই তো সুকান্ত ভট্টাচার্য্যকে সুকান্ত করেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়। পড়িসনি ওনার কবিতা? "জাপপুষ্পকে ঝরে ফুলঝুরি, জ্বলে হ্যাংকাও কমরেড আজ বজ্রে কঠিন বন্ধুতা চাও", পড়িসনি? উনি আবেগে আপ্লুত হয়ে বললেন, 'বুদ্ধদেব বসু, যিনি আদ্যন্ত মার্কসবাদবিরোধী মানুষ, সুভাষদার এই সম্পূর্ণ নতুন আবির্ভাবকে স্বাগত জানিয়েছেন।'

    এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, মার্কসবাদী বন্ধুদের ভালো লাগবে না, তবু বলি যদি প্রতিভার সন্ধান পান, তখন ঘোরতর অমার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীর কেউ কেউ তাকে স্বাগত জানাতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু মার্কসবাদী কবি, লেখক, বুদ্ধিজীবিরা প্রতিভাবান জেনেও - যেহেতু ব্যক্তিটি সম্পূর্ণ মার্কসবাদ বিরোধী, এমন কোনো ব্যক্তিকে কখনও স্বীকারই করেননি। উদাহরণ সেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ই স্বয়ং। তিনি জীবনানন্দ দাশ অসাধারন জেনেও সেই 'নষ্টশশা, চালকুমড়ার কবিকে - যেহেতু তিনি তাঁদের মতো চিন্তা করেন না, লেখেন না, তাঁকে প্রথমদিকে বহুদিন পর্যন্ত স্বীকার করেননি।
(ক্রমশ)