।। কথায় কথায় রাজীব।। 

আগাথা ও পোয়ারোর প্রথম উপন্যাস


আলোচিত অনুবাদ গ্রন্থ ।।।। 

দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস 
আগাথা ক্রিস্টি।। অনুবাদ - সায়ক দত্ত চৌধুরী
মন্তাজ (একটি কল্পবিশ্ব পাবলিকেশন ইমপ্রিন্ট)
 ISBN 978-81-945005-4-4
প্রথম প্রকাশ।। নভেম্বর 2020
পেপার ব্যাক।। পৃষ্ঠা সংখ্যা ২১৬ ।। মূল্য ২৫০ টাকা(প্রথম প্রকাশ) 
 

 “...মস্তিষ্কের ছোট্ট ধূসর কোষেরা..." 

 

দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস শুধু একটি তথাকথিত গোয়েন্দা বা রহস্য উপন্যাস নয়, বিশ্বপাঠকদের কাছে সাক্ষাৎ ইতিহাস। 


এগডার অ্যাল্যান পো-র আগুস্ত দ্যুঁপা-র থেকে শুরু হয়ে কোনান ডয়েলের হোমস-এর হাত ধরে এরকুল পোয়ারোর আবির্ভাব। যার প্রথম চেহারা বর্ণনাতেই আমরা কেন জানি না এক ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছিলাম। "He was hardly more than five feet four inches but carried himself with great dignity" এই 'ডিগনিটি' শব্দটি বড় গুরুত্বপূর্ণ। আর নির্ভুল তার পরিচয় চিহ্ন -- "প্রচুর পরিমাণে মোম মাখানো সযত্নে লালিত গুম্ফদ্বয়, যাশেষপ্রান্তে প্রদীপের শিখার মতো উঠে রয়েছে। "


পরবর্তীকালে আমরা দূরদর্শনে দেখেছি পোয়ারোর নামভূমিকায় ডেভিড স্যুশেট অভিনীত  সেই বিখ্যাত টিভি সিরিজটি। যার থিম মিউজিকটি ছিল অসাধারণ। সেই সময়ের তুলনায় যথেষ্ট অন্যরকম ছিল শুরুর ভিস্যুয়াল।

 

ডেভিড স্যুশেট অভিনীত সেই টিভি সিরিজ

ডেভিড স্যুশেট পোয়ারোর নাম ভূমিকায়

 

সেই সময়ের তুলনায় যথেষ্ট অন্যরকম ছিল শুরুর ভিসুয়াল

অনুদিত বইটি হাতে নিয়ে অনুবাদকের কথা পড়তে গিয়ে প্রথমেই ভালো লাগে তিনি এই জনপ্রিয় টিভি সিরিজটির উল্লেখ করেছেন বলে। এমনকি তিনি মন্তব্য করেছেন যে এই অনুবাদেও টিভি সিরিজটির প্রভাব পড়েছে। 

যা আমাদের প্রিয়, যা আমাদের কিশোরবেলার সঙ্গে জড়িয়ে নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন তার অনুবাদে একজন দক্ষ অনুবাদকের থেকেও দরকার হয় এমন অনুবাদকের যিনি এর একনিষ্ঠ মুগ্ধ পাঠক। দক্ষ অনুবাদকের চেয়েও বোধহয় পাঠকদের মরমী অনুবাদক দরকার। 

অনুবাদককে ধন্যবাদ তিনি সম্প্রতি প্রচলিত 'কোশ' বানানটি ব্যবহার না করে আমাদের সময়ের 'কোষ' ব্যবহার করেছেন। কোনো অজানা, অযৌক্তিক কারণে 'কোশ' বানানটি পছন্দ হয় না।

 

কিশোরবেলায় যখন অনুবাদ কাহিনিগুলি পড়েছি তখন আর অনুবাদকের নাম কে খেয়াল করে! বহুবার অনুবাদ হওয়া কাহিনি অনুবাদের পেছনে অনেকে যৌক্তিকতা খোঁজেন। এ ব্যাপারে আমার মতামত স্পষ্ট, অনুবাদ যত হয় তত ভালো। সময়ের ব্যবধানে বাংলা ভাষায় গল্প বলার রূপটিও বদলাচ্ছে ক্রমাগত। ফলে সাম্প্রতিক অনুবাদের একটা গুরুত্ব থাকে। সায়ক দত্ত চৌধুরী সঠিকভাবেই বলেছেন যে আগের অনেক অনুবাদই দায়সারাভাবে করা। তাছাড়া পাড়ার গ্রন্থাগারগুলি ক্রমাগত দেহ রাখার জন্য সেই অনুবাদগুলোও আজ পাওয়া মুশকিল। 

 

বর্তমান আলোচিত কাহিনিটির অনুবাদ স্বচ্ছন্দ, পাঠককে কোথাও হোঁচট খেতে হবে না। বইটি অনেক আগে সংগ্রহ করলেও পড়া হয়ে ওঠেনি। এর মধ্যেই সায়ক দত্ত চৌধুরী কৃত আরো দুটি পোয়ারোর কাহিনির অনুবাদ প্রকাশিত হয়ে গেছে। দ্য মার্ডার অন্য দ্য লিংকস এবং দ্য মার্ডার অফ রজার অ্যাকরয়েড। আশা রাখি একে একে তিনি পোয়ারোর সকল কাহিনি অনুবাদ করবেন। শুধু নস্টালজিয়া প্রজন্ম নয় বর্তমান প্রজন্মও উপকৃত হবে। তিনি দক্ষ অনুবাদক সর্বোপরি নিজের কোথায় একজন, 'ক্রিস্টিয়ান'।


 

আগেই বলেছি এই বই এক ইতিহাস সে শুধু পোয়ারোর প্রথম কাহিনি বলেই নয়, আগাথা ক্রিস্টির এটি প্রথম উপন্যাস। এই বিষয়ে বইয়ের শুরুতেই পরিমিত একটি চমৎকার মুখবন্ধ আছে বন্ধুবর গল্পকার বিশ্বদীপ দে-র। তাকে অবশ্যই বাহবা দেব। অল্প কথায় মূল বিষয়কে বলা একটি ঈর্ষণীয় দক্ষতা বিশেষ। একটি সঠিক ভূমিকা একটি বইকে অনেকটা এগিয়ে দেয় অবশ্যই। 

 


 গোয়েন্দা গল্পের যে ব্যাকরণ ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিল সেই সময়ে আগাথা ক্রিস্টি তার ধারাতেই গড়ে তুলেছিলেন চরিত্রদের। শার্লক হোমসের কাহিনির মূল চরিত্রগুলির সঙ্গে সমান্তরাল চরিত্রগুলি -- মূল গোয়েন্দা -- পোয়ারো; সহকারী -- হেস্টিংস (ওয়াটসনের মতোই এনার এক  সৈনিক অতীত আছে); ইন্সপেক্টর -- জ্যাপ। তবে আশ্চর্য লাগার বিষয় -- প্রথম কাহিনীতেই এত সুচারু উপস্থাপনা! পরে আগাথা ক্রিস্টি ক্রমাগত নিজের ছাপ বাড়িয়ে চলেছিলেন তার কাহিনিগুলিতে। বর্ননা, কথোপকথন রচনায় তিনি অনন্যা এবং অবশ্যই প্লট রচনাতেও। 

আমাদের মাথা যখন ঠাণ্ডা হবে আমরা তখন পরপর ঘটনাগুলোকে পরিচ্ছন্নভাবে সাজাব। একটার পর একটা। প্রত্যেকটা ঘটনাকে আমরা পরীক্ষা করব। যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোকে যত্নে রাখব, আর যার কোনও গুরুত্ব নেই, সেটাকে ফুসসস... একটু মজা করে সে যেন বলে উঠল "হাওয়ায় উড়িয়ে দেব।... একটা ঘটনা আরেকটা ঘটনার জন্ম দেয়। এভাবেই তৈরি হয় পারম্পর্য। 

পড়তে পড়তে ফিরে আসে সেই কবেকার ছুটির দুপুর আর মনের মধ্যে কল্পনায় গড়ে তোলা অবয়বটি। তখনও তো বাড়ি বাড়ি টিভি খুব বিরল, ফোন আরো বিরল, পাড়ার গ্রন্থাগার জমজমাট -- সেখানে গিয়ে খুঁজে চলা পোয়ারোর নতুন কাহিনি। আরো অভিনব কোনও প্লটের মুখোমুখি হয়ে মুগ্ধ হতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। বর্তমান কাহিনিতেও নতুন পাঠক ধাক্কা খাবেন সুনিশ্চিত। বিষ দিয়ে যে হত্যা করা যায় সেটা আগাথা ক্রিস্টির আগেও সব লেখক জানতেন, লিখতেন কিন্তু আগাথা বিষের মধ্যেও  যে গল্প আছে তা দিয়ে আমাদের হতবাক করে দিয়েছিলেন। 

প্রমিত নন্দীর প্রচ্ছদ যথাযথ।সামগ্রিকভাবে বইটি যত্ন নিয়ে প্রকাশিত। প্রকাশককে সাধুবাদ দিতেই হয়। 

 

পোয়ারোর সঙ্গে যারা নানা কারণে একদা পরিচিত  হতে পারেন নি তারা সায়ক দত্ত চৌধুরীর হাত ধরে পরিচিতিটা এবার করে ফেলতে পারেন। পৃথিবী বিখ্যাত এক গোয়েন্দার সঙ্গে আপনার দেখা হবে না? 

 

শেষে একটি ছোটো তথ্য দিই। অনেকে মনে করেন এই কাহিনির পেছনে আসলে ভারতে মুসৌরিতে ঘটা একটি ঘটনা।  ১৯১১ সালে এক ব্যক্তিকে হোটেলে মৃত পাওয়া যায়। বিষপ্রয়োগে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। অভিনবত্বের কারণে ঘটনাটি সেই সময়ে আন্তর্জাতিক স্তরে খবর হয়েছিল। রাসকিন বন্ড তার এক লেখায় বলেছিলেন আগাথা ক্রিস্টি এই অপরাধের ঘটনাটিকে ব্যবহার করেছিলেন। এর চেয়ে বিশদে ঘটনাটি বলতে গেলে স্পয়লার হয়ে যাবে। যারা আগ্রহী তারা সন্ধান করে দেখতে পারেন। আমার অন্তত রাসকিন বন্ডের দাবীটি ন্যায্য বলেই মনে হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে বলা চলে আগাথা ক্রিস্টির আবির্ভাব উপন্যাসের পেছনে ভারতে ঘটা একটি হত্যাকাণ্ড ছিল এবং সেটি একটি স্ফুলিঙ্গ হয়ে 'আগাথা' নামে এক অগ্নিশিখার জন্ম দিয়েছিল।

 

 

রাজীব কুমার ঘোষ

চুঁচুড়ার রাজীবমানেই সহদেববাবুর ঘোড়া’, ‘ভীষ্মদেবের মৃত্যুমুহূর্ত’, ‘অনেক জলের শব্দ’, ‘টাওয়ার অফ্ সাইলেন্স’, ‘হিবাকুশার ছেলেবা ঘোষ স্যারের গল্পগুলি বহুচর্চিত, ভিন্নমাত্রার কিছু গল্প। জন্ম ১৯৭৭; পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা চুঁচুড়া-হুগলি-চন্দননগর। ১৯৯৭ সাল থেকে লিটল ম্যাগাজিন কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত এবং নিয়মিত লেখালেখি। সম্পাদিত পত্রিকা সাইন্যাপস্। আছে বেশ কিছু কবিতার বই। প্রকাশিত গল্প সংকলন ঘর ও দরজার গল্প’, ‘অনেক জলের শব্দ’, 'আমাদের আশাতীত খেলাঘর'গল্পের জন্য বারাসাতের বহুস্বর পত্রিকার পক্ষ থেকে পেয়েছেন ২০১৯ সালের অনন্তকুমার সরকার স্মৃতি পুরস্কার। অণুগল্পের জন্য ২০১৮ সালে চুঁচুড়ার গল্প সল্পের আটচালার পক্ষ থেকে পেয়েছেন উৎপল স্মৃতি পুরস্কার। সম্প্রতি প্রকাশিত কবিতার সংকলন, "এই কবিতা শেষ হলেই"।

          পেশায় বিজ্ঞান শিক্ষক। নেশায় পাঠক। প্রিয় অবকাশ যাপন পাঁচশো বছরের পুরনো জনপদের অলিগলিতে সময়ের ভাঁজে ভাঁজে ঘুরে বেড়ানো।

মূল সূচিতে যেতে এখানে ক্লিক করতে হবে