ক্রোড়পত্র।। প্রথম সাইন্যাপস্‌ স্মারক বক্তৃতা। 
বক্তা সিদ্ধার্থ সেন ।। বিষয় - অলোকরঞ্জন চক্রবর্তীর কবিতা

স্মারক

চুঁচুড়া কিশোর প্রগতি গ্রন্থাগারের সভাকক্ষে ২০১৯ সালের ৬ জুন সাইন্যাপস্ পত্রিকা স্মারক সম্মাননা তুলে দেওয়া হয় চুঁচুড়ার (অধুনা প্রয়াত) কবি অলোকরঞ্জন চক্রবর্তীর হাতে। এই দিনই আয়োজন করা হয়েছিল প্রথম সাইন্যাপস্ পত্রিকা স্মারক বক্তৃতাবক্তা ছিলেন চুঁচুড়া অধ্যাপক ও কবি সিদ্ধার্থ সেনবিষয় ছিল অলোকরঞ্জন চক্রবর্তীর কবিতাসেদিন মূল মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন স্মারক সম্মাননা প্রাপক কবি অলোকরঞ্জন চক্রবর্তী। তাঁর হাতে এই সম্মাননা তুলে দেবার জন্য উপস্থিত ছিলেন শ্রীরামপুরের কবি রামকিশোর ভট্টাচার্য। উপস্থিত ছিলেন স্মারক বক্তৃতার বক্তা অধ্যাপক সিদ্ধার্থ সেন।

অলোকরঞ্জন চক্রবর্তীর কবিতাজগৎ নিয়ে অধ্যাপক সিদ্ধার্থ সেনের বক্তব্য শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনেন। বক্তৃতা শেষ হলে উচ্চ করতালির শব্দে সভাকক্ষটি মুখরিত হয়ে ওঠে। পত্রিকার পক্ষ থেকে সেদিন স্মারকটি সিদ্ধার্থ সেনের হাতে তুলে দেন মৌসুমী ঘোষ এবং কবি শুভেন্দু বিকাশ অধিকারী। কবি শুভেন্দু বিকাশ অধিকারীকেও আমরা হারিয়েছি সদ্য।

স্মারক বক্তৃতাটি নিয়ম মতোই আমরা প্রকাশ করছি কিন্তু অলোকরঞ্জন চক্রবর্তী ও শুভেন্দু বিকাশ অধিকারীকে হারিয়ে আমাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত। তাদের এইভাবে সহসা হারাতে হবে তা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। এর আগে অলোকরঞ্জন চক্রবর্তীর কবিতা, কবিতার বিষয়বস্তু আর গঠন নিয়ে কোনো বিস্তৃত আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে বলে আমরা জানি না। আজ তাই এই স্মারক বক্তৃতাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, যারা প্রয়াত কবির পাঠক তাদের কাছে তো বটেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছেও।

সাইন্যাপস্ পত্রিকা স্মারক বক্তৃতা ২০১৯
বক্তা চূঁচুড়ার অধ্যাপক ও কবি সিদ্ধার্থ সেন




সিদ্ধার্থ সেনের হাতে সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার পক্ষ থেকে
স্মারকটি তুলে দিচ্ছেন অধুনা প্রয়াত
অধ্যাপক কবি ও অনুবাদক শুভেন্দু বিকাশ অধিকারী




সময়ের কন্ঠস্বর ও অলোকরঞ্জনের কবিতা

     ময়ের দাগ সবকিছুতেই পড়ে। আমাদের এই ছোট্ট প্রিয় শহরে দীর্ঘদিন যারা একটু-আধটু লেখালেখির চর্চা করে চলেছেন তাঁদের শরীর লেখালেখি — সবকিছুতেই সময় তার থাবা বসিয়েছে। একদিনের সেই গতিশীল মধ্যবয়স্ক যুবাদলের কেউ কেউ চাক্ষুষ সীমানার বাইরে, কেউ কেউ দিকশূন্যপুরের পথিক, আর যাঁরা আছেন তাঁরাও সময়ের নিয়মে বাইরের দিক থেকে শ্লথ হয়ে পড়েছেন, কিন্তু ভিতরের দিক থেকে আজও সম্পূর্ণ সজীব। তেমনই একজন কবি অলোকরঞ্জন চক্রবর্তী। চোখ বুজলে এখনো দেখতে পাই অলোকদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এই শহরের পথে চলমান, কিংবা হাতে পোর্টফোলিও ব্যাগ, ফেরিঘাট পেরিয়ে নিত্য লঞ্চ পাড়ি দিয়ে অপর পারে নৈহাটিতে যাতায়াত। সেখানে মহেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে অলোকদা দীর্ঘদিন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষকতা করেছেন। আজ শারীরিক অসুবিধার কারণে, ব্যক্তিগত নানা লড়াইয়ে বিপর্যস্ত (বাইরে যদিও তার কোনো প্রকাশ নেই) অলোকদা প্রায় গৃহবন্দি হলেও মহাভারতের সঞ্জয়ের মতো চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে বসে দূরদর্শী মন নিয়ে খবরা খবর রাখেন এই শহরের লেখালেখি তথা বাংলা সাহিত্যের হালহকিকতের। অলোকদা এক দীক্ষিত পাঠক, মেধা ও মননের নিরন্তর চর্চায় সংবেদী এক মানুষ, স্পষ্টভাষী যে কারণে হয়তো বা অনেকের থেকেই খানিক স্থানিক দূরত্বে থাকলেও তাঁর বাড়ির সাহিত্যের আড্ডায় অনেকেই উপস্থিত হন। এই শহরের বুকে মূলত তাঁরই প্রণোদনায় ‘দিনান্তের অন্বেষণ’ নামের পত্রিকার প্রায় নিয়মিত প্রকাশের আয়োজন, তাঁরই অভিভাবকত্বে তথাগত মৌলিকসহ অন্যান্যদের বিভিন্ন সময়ে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড এই শহরের কৃষ্টির পরিবেশক সমৃদ্ধ করেছে। (তথাগত বর্তমানে সুদূর মুম্বইপ্রবাসী হলেও তাঁর অফুরন্ত প্রাণশক্তি অব্যাহত অলোকদার অনিঃশেষ প্রেরণায়) অলোকদা মনে এক দায়বদ্ধতা অনুভব করেন, সমকালীন এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই দায়িত্বপালন যথেষ্ট প্রতিকূল হলেও তা এখনও তিনি পালন করার চেষ্টা করে চলেছেন এটা অবশ্যই ধন্যবাদার্হ।


অলোকরঞ্জন গত শতকের সত্তরের দশক থেকে কবিতা লিখে চলেছেন। সেইদিক থেকে ভাবলে তাঁর কবিতাযাপনও প্রায় অর্ধশতক ছুঁতে চলেছে। তখন এমন এক সময় যখন ওই ভাবনালয় অলোকরঞ্জনকেও স্পর্শ করেছিল, তাঁর মনকে দোলা দিয়েছিল ‘সামাজিক আর কাব্যিক উভটান’-এর দ্বিমুখী স্রোত। তাঁর মনের খাতায় আঁকা হতে থাকে প্রতিবাদের এক নন্দন জ্যামিতি যা পড়ে তোলে তাঁর কবিতার প্রকরণশিল্প। নিছক কবিতাচর্চার ভাবনা থেকে যে পথের চলন একটু আলাদা। বাংলা-ইংরাজি-সংস্কৃত-এই তিনটি ভাষার সাহিত্যের পাঠক হিসেবে তাঁর সাবলীল পারঙ্গমতা, সুনিবিড় পাঠ তাঁকে বিশিষ্ট করে তুলেছে সময়ান্তরে।

    সাহিত্যের প্রতি তাঁর দীর্ঘকালীন ভালোবাসা, সাহিত্য নিয়ে আলোচনার সূত্রে মনে পড়ে যেতে পারে তেমন কোনো সান্ধ্যকালীন সাহিত্যের আড্ডা যেখানে জ্বলছে মোমবাতির মৃদু আলো আর সেই আধো আলো-অন্ধকারময় পরিবেশে অলোকদা অসাধারণ আলচনা করছেন সাহিত্যের, জ্বালিয়ে দিচ্ছেন ওই মোমের শিখাটির মতো মনের আলোটিকে। যে কোনো লেখাকে আলোচনার এক সহজাত দক্ষতা আছে অলোকদার। তাই তাঁর লেখালেখি নিয়ে কিছু বলা খুব বিপদের। স্নেহের অনুজ ‘সাইন্যাপস্’ পত্রিকার সম্পাদক রাজীব ভালোবেসে সেই বিপদের মুখোমুখি আমায় দাঁড় করিয়েছে। বুক দুরদুর করলেও, পা কাঁপলেও কোনোমতে দাঁড়িয়েছি; আমার মতো করে অলোকদার কবিতা নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছি।

গত শতকের সাতের দশকের কিছু সময় জুড়ে গোটা বাংলাতেই সংগঠিত হয়েছিলো এক বিপ্লব। সেই বিপ্লবের ফলে সমকালীন সময় হয়েছিলো রক্তাক্ত, সময়ান্তরে যা ইতিহাসের গায়ে রেখে গেছে এক গাঢ় কালচে দাগ। অলোকরঞ্জনের এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বই ‘তিমিরহননেরর গান’-এ সত্তর দশক নামের একটি কবিতা আছে। মিশ্রকলাবৃত্তের বন্ধনে বাঁধা এই কবিতা শুরু হয়েছে এইভাবে :
“তখন সমস্ত বাতাস স্তব্ধ, তারাহীন মৌন আকাশ, পাখীর কাকলিহীন মাইল মাইল ছড়ানো নিথরতা, এমনকি, পাতা পড়ারও শব্দ নেই চরাচরে, শব্দ নেই
মানুষের ঘরে, আশ্চর্য কারণে, শিশুরাও খেলা ভুলে
চঞ্চলতা ভুলে শান্ত, নির্বাক।”
সময়ের অন্ধকার, স্তব্ধতা, নিথর পারিপার্শ্বিকতা কবিতাটিকে ছুঁয়ে আছে। চারপাশের দমবন্ধ করা পরিবেশ, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, আত্মগোপনে বাধ্য যুবসমাজ-সবকিছু কবিতায় উঠে আসে ব্যথিত কলমে :
“মাঝে মাঝে কড়া নড়ে ওঠে, বস্তির অন্ধকার-নিচু চালার সামনে এসে থেমে যায় ভারী বুটের শব্দ, রাতের বুক চিরে গর্জে ওঠে সার্ভিস রিভলবার, রাতজাগা পাখির আর্তকন্ঠ দোল খেতে-খেতে চলে যায় বহুদূর, . . .
উৎকন্ঠায় বিছানায় পাশে শুয়ে থাকা শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে মা, নিদ্রাহীন অপলক চেয়ে থাকে ভোরের অপেক্ষায়।”
বাংলা কবিতার পাঠকদের কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ছেলে গেছে বনে’, কৃষ্ণ ধরের ‘একদিন সত্তর দশকে’, মণিভূষণ ভট্টাচার্যের ‘গান্ধীনগরে এক রাত্রি’-র মতো কবিতাগুলি মনে পড়তে পারে। কবির উপমায় ‘তখন তৃণভূমিতে লেগেছিল আগুন’ আর সেই আগুনের আঁচ কবিতার শব্দগুলিকে আষ্টেপৃষ্টে ধরেছে। এই প্রলম্বিত অন্ধকার এই বইয়ের একাধিক কবিতার আনাচেকানাচে স্থির হয়ে আছে। দুটি কবিতার খন্ডাংশের দিকে চোখ ফেরানো যাক :
১. পেতে রাখো কান বাতাসে,
কাঁটাওলা বুট ধাতবশব্দে বাজলেই
শাঁখে শাঁখে দিও ইশারা।
আর খেলা নয়, সন্ধ্যা নামছে,
ছেলেগুলো সব ডেকে নাও,
কচিমাথাগুলো জাগিয়েছে লোভ
ছেলেধরা সব ঘুরছে। (রাত নামছে)
২. এখন তৃতীয় প্রহর,
ভোর হতে আরো কিছু দেরী।
এ প্রহরে তস্কর জেগে থাকে।
গৃহস্থের অসাবধানতায় সিঁধ কাটে
গভীরে গোপনে।
ভোর হবার আগে এই রাতটুকু
বড় দুঃসময়; পেঁচা আর বাদুড়ের
তীক্ষ্ণ ঠোঁটে ঘটে যায় উজ্জ্বল
শস্যের অপচয়। (তৃতীয় প্রহর)

‘সত্তর দশক-ফিরে দেখা’ নামেও একটি কবিতা আছে। বহুদিন পরে সেই সময়কে ফিরে দেখতে গিয়ে কবির স্মৃতিতে সেই দিনগুলি এইভাবে ফিরে আসে :

“আকাশ ভরা ছিল উজ্জ্বল নক্ষত্রমালায়,
দিগন্ত থেকে শোনা যাচ্ছিল বোধনের তুমুল বাজনা,
কালপুরুষের খড়গ থেকে ঠিকরে পড়া আলোয়
ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছিল একটা যুগ,
একটা খরশান সময়।”
সেদিন লেখা হয়েছিল নব-মহাকব্যের একটি পৃষ্ঠা : ‘সেদিন বারণাবত থেকে পান্ডবেরা যাত্রা করেছিল / দাহময় কুরুক্ষেত্রের পথে’।
অলোকরঞ্জন নিছক কবিতাচর্চা করায় বিশ্বাসী নন, তাঁর একটি স্থির দর্শন আছে; রচিত কবিতাগুলিতে সেই দর্শনকে তিনি প্রচ্ছন্নও রাখতে চাননা। ‘হে বিশুদ্ধ কবি’ নামে একটি কবিতা আছে এই কাব্যগ্রন্থে :

“বানেতে কার ঘর ভেসেছে, কে মরেছে অনাহারে
কার গতরের নোনাজলের ফসল গেল কার গোলাতে
কোন্ কিশোরী পায়ের নূপুর ছিন্ন পড়ে ঝোপেরর ধারে;
এসব নিয়ে যারা ভাবে, কিংবা শব্দে ধরে রাখে,
তারা সবাই ব্যর্থ কবি, ভবিষ্যতের আবর্জনা।”

আর বিশুদ্ধ কবিরা ‘সান্ধ্যভাষায় কাব্য করে’, ‘মধ্যরাতে নীলঘরেতে’ ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলার নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে রাত কাটিয়ে দিলেও ‘দিনের বেলায় ভব্যিযুক্ত’ শ্বাসগ্রহণ, আহারগ্রহণ, লজ্জানিবারণ তাদের সবকিছুই স্বাভাবিক। কর্মস্থলে গিয়ে ‘গ্রামাফোনের সারমেয়টি’-র মতো ঘাড় নুইয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষে সেলাম ঠোকা – তাঁদের হারিয়ে ফেলা মেরুদন্ডটিকে পোশাক-আশাকের আড়ালে যেমন লুকিয়ে রাখতে পারেনা তেমনি আপাতশান্ত কবিব্যক্তিত্বের আড়ালে কবিমানুষটির শিরদাঁড়াটি টানটান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কবিতাটির শেষ স্তবকে কবির কলম এমন লেখে :

“কবি কোন দায় মানে না, ভেতরে তার মুক্তবাউল,
তাই বিশুদ্ধতার গোলাপবনে, এড়িয়ে কাঁটা শব্দ বুনে,
নারীর শরীর টুকরো করে, টুকরো নিয়ে প্রতীক গড়ে
বামাচারী কাপালিকের বিকৃতকাম চিত্রকল্পে ফুটিয়ে তোল।”
এই সৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে-রাখা মনটির প্রতি কবির ছোট্ট একটি খোঁচা ‘পেট ও পকেট ভরা থাকলে রবীন্দ্রনাথকে থোড়াই কর।’
সাম্যবাদী দর্শনের প্রতি কবি অলোকরঞ্জনের আস্থার কথা তাঁর কবিতা পড়লে অনুভব করা যায়। মাও সে তুং-কে নিয়ে দুটি কবিতা আছে এই বইতে। একটির নাম ‘বীরের মৃত্যু নাই’, অন্যটির ‘দুটি কবিতা মাও সে তুং’। বিপ্লবীর মৃত্যু হলেও বিপ্লবের হয় না, বাহ্যত প্রশমিত হয় মাত্র। প্রথম কবিতাটিতে দেখি এমন বিশ্বাসের প্রতিফলন :

“কারণ আমরা জানি বনস্পতির মৃত্যু নেই,
বীজ থেকে বীজ, বীজান্তরে তার সহজ বিস্তার
আর তাই ইয়েনান থেকে উঠে আসা এক উর্বর বাতাস
ছড়িয়ে দিচ্ছে সেই বীজ অভিজ্ঞ কৃষকের হাতে হাতে
পৃথিবীর নরম মাটিতে,
বনস্পতির মৃত্যু হয় না কখনো।”

আদর্শের বিনাশ ঘটে না, দেশ-কাল-সময় পেরিয়ে তা বেঁচে থাকে। প্রিয় কমরেড মাওয়ের সঙ্গে কথাবার্তা আছে অন্য কবিতাটিতে, আছে আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে মতানৈক্যের বেদনার কথা। ‘লিউপান পাহাড়ে’ কবিতাটিও উৎসর্গিত মাওয়ের প্রতি। প্রত্যাশা ছিলো দিনবদলের, কিন্তু বাস্তবে তা সুদূরপরাহত। মানুষের প্রতি সমানুভূতিতে, ভালোবাসায় কবি বেদনার্ত হয়ে লক্ষ্য করেন যে, দীর্ঘদিন দেশ স্বাধীন হলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের বিপন্নতা। স্বপ্নপূরণের সেই প্রত্যাশিত মুহূর্তে ভবিষ্যতের আকাঙ্কা হয়েই থেকে যায় :

এসব স্বপ্নের বীজ, আজো ওড়ে নিরন্ন এদেশে,
এসব স্বপ্নের বীজ, ঝোপে-ঝাড়ে জোনাকীর মত
জ্বলে আর নেভে।
. . .
এখনো সন্ধ্যার ছেঁড়াখোঁড়া অন্ধকারে,
নির্জন পুকুরের পারে, অন্তহীন মাঠের কিনারে
দাঁতালো শেয়াল অক্লেশে ছুটে যায়
জীবন্ত হাঁসের গলা চেপে ধরে।” (কথা ছিল)

ওই শেয়াল আর হাঁসের প্রতীকে সমস্তটাই পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। এমন ছবি বা চিত্রকল্প অলোকরঞ্জনের কবিতাকে কালের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়। মনে পড়ে যেতে পারে এজরা পাউন্ডের কথা ‘An image . . . presents an intellectual and emotional complex in an instant of time’। তাঁর কবিতায় ইত্যবসরে কিছু শব্দনির্মিত ছবি বা বাক্-প্রতিমা ব্যবহারের দিকে তাকানো যেতে পারে :

১. শকুনের মত পাক খায় কপ্টারের ছায়া

২. ছিল টলটলে পুকুরের মত ভালবাসা
৩. কারা যেন বাদুড়ের মত
            উড়ে আসে গ্রামে।

৪. রিরংসার হ্রিংস করাত।

৫. পাক খেয়ে দুলে যায় দুরন্ত শিশুর মতো হাওয়া।

অষ্টাশি পাতায় সাজানো একাত্তরটি কবিতা বন্দী হয়ে আছে অলোকদার ‘তিমিরহননের গান’ বইটির দুটি মলাটের মধ্যে। উল্লিখিত এমন অনেক বাক্ প্রতিমার আবিষ্কার করবেন পাঠক যেগুলির কোনোটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঘ্রাণ-দৃষ্টি-শ্রুতি-স্পর্শসহ পঞ্চেন্দ্রিয়ের অনুভূতি। প্রকৃতি থেকে অনেক ছবি তিনি সংগ্রহ করেন। জীবনানন্দের অনুষঙ্গ শুধু গ্রন্থনামেই নয়, উপমা-প্রতিমাসহ অনেক কাব্যিক উপাদানেই তাঁর অনুসৃতি যা স্বাভাবিক কিন্তু অগৌরবের নয়, আসলে জীবনানন্দ এমন একজন কবি ‘নিরবিচ্ছিন্ন কালজ্ঞান’ সম্পন্ন কবিতাচর্চায় তিনি অপরিহার্য বা অনতিক্রম্য হয়ে ওঠেন। এই কাব্যগ্রন্থের নামকরণেও আছে জীবনানন্দের অনুষঙ্গ, বেশির ভাগ কবিতাতেই আছে সময়ের শরীরে ব্যাপ্ত এক অন্ধকারের কথা। তাই বোধহয় কবিতার প্রচ্ছদটিতে গাঢ় কালো রঙের বিস্তৃতি আর সেই অন্ধকারের বুক চিরে এক রক্তিম সূর্য যা তীব্র আশাবাদের দ্যোতক। তাঁর কবিতার অন্ধকার ও ক্লান্তির উত্তরাধিকার তিনি জীবনানন্দের থেকেই পেয়েছেন মনে হয়। মানুষ, জীবন ও সমাজের ভাবনা তাঁকে আলোড়িত করে। সময়ের সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সংযোগের সূত্রটি অনুভব করা যায়। একটি কবিতার দিকে চোখ ফেরানো যেতে পারে :

“আমরা মাটি চিনেছিলাম, কিন্তু মানুষ চিনি নি।
আমরা বীজের আঁতের কথা জানি, কিন্তু
মানুষের মন পড়তে পারি নি . . .
তাই আজ দেখছি, পুড়ে যাওয়া ভিতের ওপর বসে :
দ্রুত মুছে যাচ্ছে দিন আর রাত্রের পার্থক্য।
চেনা যাচ্ছে না কে শত্রু আর কেই বা মিত্র।
কে দেখাচ্ছে ভয়, আর কার হাতেই বা বরাভয়।
বুঝতে পারছি না, কার রাজ্য পড়তে
আমরা আজ দাবার বোড়ে হয়েছি,
আমাদের রক্তে-রাঙা নিশান উড়িয়ে
কারা চলেছে গলায় মালা পরবে বলে” (গ্রামের চিঠি)
কবি ত্রিকালদ্রষ্টা, তাই সময়প্রবাহের সঙ্গে তাঁর কন্ঠস্বর যুক্ত হয়ে যায়, সমকাল বিদ্যুতের মতো চকিতে ঝলসে ওঠে। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, সময়ের দীর্ঘশ্বাস, মানুষের প্রকৃত শিরদাঁড়া হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা কবির কলমে জেগে ওঠে :

“মাটিতে মানুষের পায়ের ছাপ নেই
কেন্নো হেঁটে যায় চিহ্নহীন;
গ্রন্থাগারে কীট পান্ডুলিপি কাটে,
বাতাসে উড়ে যায় মনীষা-ছাই।
. . . বন্যা আসে ভোট আসে,
বাৎসরিক ঋতুরঙ্গে মেতে ওঠে
ননীচোরা গোপালের দল;”

কিন্তু হতাশা এই কবির শেষ অবলম্বন নয়, কেননা তিনি জানেন ‘ইতিহাস অপেক্ষা করে থাকে’। কবিতার উচ্চারণে, ভাষা প্রকরণে তিনি নিজেকে উন্মোচিত করতে চান; নিছক শব্দ নিয়ে খেলা, কল্পনার আনন্দে ভেসে যাওয়া তাঁর তেমন পছন্দ নয়। তাই কবির প্রতি তাঁর আহ্বান :

“কবিতা এখনো জীবনের কাছে ঋণী,
যেমন জীবন কবিতার পথ চেয়ে।
কবি কেন শুধু পরিভাষা চোখে নিয়ে
আত্মরতিতে শব্দ-কুহকে মাতবে।
ফিরে এস কবি তোমার কবিতা নিয়ে
কবিতাকে করো উজ্জ্বল টেরাকোটা।
ফিরে এস কবি মাতাল তরণী ছেড়ে।”

সময়চেতনার এই উত্তরাধীকার অলোকরঞ্জন লাভ করেছেন মঙ্গলাচরণ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, দিনেশ দাস, রাম বসু, সুকান্ত ভট্টাচার্য, অমিয় চট্টোপাধ্যায়, দ্রোণাচার্য ঘোষ, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখের কবিতাপাঠের অভিজ্ঞতায়। আসলে প্রত্যেক লেখকের কাছেই আছে যুধিষ্ঠিরের ওই আয়নার মতো এক আয়না। সমালোচ্য কাব্যগ্রন্থটির শেষ পাতায় মুদ্রিত কবিতাটির নাম ‘আয়না অথবা কবির গল্প’। সেই কবিতায় দেখি :

“একদিন আয়নায় মুখ রেখে মানুষটা সারাদিন বসে থাকে নিজের ঘরে। বারবার দেখে আয়নায় প্রতিফলিত মুখটাকে আর মাঝে মাঝে একটা খাতায় কী যেন লেখে।”

একসময় সেই কবি-মানুষটি তাঁর লেখাকে মনে করেছিলেন মিথ্যার বেসাতি ‘এতদিনকার লেখালেখিকে সে ঘৃণা করে, মনে করে ঝুড়ি-ঝুড়ি বাতিল কাগজ, মিথ্যাচার।’ এই অতৃপ্তি, প্রকৃত শিল্পসৃষ্টির ব্যর্থতা একজন লেখককে যন্ত্রণাবিদ্ধ করে। নতুন করে এক আয়ুধের মতো লেখককে কলম হাতে তুলে নিতে উৎসাহিত করে। জন্ম নেয় আরো নতুন, নবীনতর কবিতা। কবি তো এক চিরপথিক যাঁর ‘পথচলাতেই আনন্দ’ আর সেই অভিযাত্রার প্রবাহে তাঁর চারপাশে খেলা করে যায় ‘রৌদ্র ছায়া বর্ষা-বসন্ত’। কবির চলা অনিঃশেষ :
“কবি হেঁটে যান শব্দ পাড়ায়
কবি হেঁটে যান শব্দ ছড়ায়
কবি হেঁটে যান শব্দ পাথর মাড়িয়ে
কবি চলে যান স্বদেশ সময় পেরিয়ে”

মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দের প্রতি অলোকরঞ্জনের বিশেষ পক্ষপাত, বক্তব্যপ্রধান কবিতার শরীরে সেই ছন্দের অলংকারটিই যেন অপেক্ষাকৃত বেশি মানায়। তিনি মনে করেন না যে, ছন্দে লেখাটা কবিতার পক্ষে অনিবার্য। তাই ছন্দ নিয়ে কবিতায় নিরন্তর পরীক্ষানীরিক্ষায় তিনি মেতে ওঠেন না, কিন্তু মাঝে মাঝে অন্য ছন্দেরও ক্বচিৎ দেখা মেলে। যেমন,

ক। চারমাত্রার কলাবৃত্ত ছন্দ :

রাত্রি যখন/শরীর খুলে/মেখে নিল         ৪+৪+৪
পঞ্চদশীর /আলো,/নলখাগড়ার/বনে         ৪+২+৪+২
তখন কেন/ভাঙ্গল সেতু/হঠাৎ বন্যা/এসে ৪+৪+৪+২

খ। ছয়মাত্রার কলাবৃত্ত ছন্দ :

আতসবাজীর/আলোকমালায় ৬+৬
ধামসা মাদল/পুতুল খেলায় ৬+৬
কিংবা
ফসকে না যায়/ এই ভয় পাই ৬+৬
দখলদারি / রাজ্যপাটের। ৬+৬
চোরাস্রোতে এসে/সুড়সুড়ি দেয় ৬+৬
রাতের ঘুমের/ বারোটা বাজিয়ে ৬+৬ (স্বাগত সংলাপে)

প্রাচীন আলংকারিকেরা বলেছিলেন ‘রসাত্মক বাক্য কাব্য’, কাব্যের রসলোকে যে যে উপকরণ পাঠককে পৌঁছে দেয় তার মধ্যে একটি হলো অলংকার। শব্দের বর্ণময় দেহরূপে আড়ালে আছে তার অর্থময় ‘চিদ্ রূপ’। পাঠকের কাছে প্রথমটির আবেদন ইন্দ্রিয়ের কাছে আর দ্বিতীয়টির বোধের কাছে। অলোকরঞ্জনের কবিতার চেহারায় কিছু আলংকারিক প্রয়োগকে আমরা দেখতে পারি। যেমন,

১। সকালের আলো স্মান ছায়া মেখে সন্ধ্যায়
চুপ বসে আছে ভাঙ্গা চালাটির নীচে। (সমাসোক্তি)

২। জল নয়কো সর্বনাশা স্রোত
কুটোর মতো ভাসিয়ে নিল। (নিশ্চয়)

৩। কারা যেন বাদুড়ের মতো উড়ে আসে গ্রামে (পূর্ণোপমা)
৪। ভাসিয়ে দিতে চাইলেও ভাসিয়ে দেওয়া চলে না (বিরোধভাস)

সাতের দশকের শুরুতে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার স্বপ্ন দেখেছিলো একদল যুবক। তাঁদের সামনে ছিলো পঞ্চাশের কবিদের সাফল্য, ষাটের কবিদের আন্দোলনের ব্যক্তিগত দ্রোহ, সে সমস্ত সত্তরে এসে হয়ে উঠলো গোষ্ঠীর বিক্ষোভ। তার আগে আমরা দেখেছি চল্লিশের সমাজমনস্ক রাজনৈতিক মেধাসম্পন্ন কবিতা। অলোকরঞ্জনের অজানা নয় বাংলা কবিতার ইতিহাসের এই চিহ্নগুলি। কবিতাপাঠ ও কবিতাচর্চা – এই দুইয়ের অনুশীলনে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকার ফলে তিনি জানেন কবিকে এক স্বতন্ত্র কাব্যভাষা আয়ত্ত করতে হয়। সেই অনুশীলনের দাগ তাঁর রচনায় মোছে না। একটি কবিতার খন্ডাংশের দিকে তাকানো যেতে পারে :

“না, না, ওদিকে নয়, তাড়াহুড়োয় আপনার মারাত্মক ভুল হতে পারে,
সতর্কতার সঙ্গে এই মশালের আলোয় ভালোভাবে লক্ষ্য করুন, চামড়ার
ভাঁজ সরিয়ে দৃষ্টি মেলে দিন, দেখুন কেমন আলোর পরিধি জুড়ে
বিছিয়ে আছে শুধু থকথকে কাদা; এলোমেলো হাঁটবেন না –
আপনার পা চটচট করবে, কারণ ওটা রক্ত – এবং মানুষেরই রক্ত।
জানবেন, ওই সব দুর্বিনীত রক্ত একবার হাতে কিংবা পায়ে লাগলে
সহজে উঠতে চায় না।” কিংবা,

“তোমরা দেরিদার কথা বলো, বিনির্মাণে
খুঁজে পাও চৈতন্যের তীব্র আরক।
তোমাদের চোখে ভাসে পশ্চিমের নব-রূপকথা,
আপ্লুত তোমাদের দেখি ক্রমশই ভেসে যেতে
চাঁদহীন বৈতরণী ধরে।”

কবিতাপাঠক হিসেবে আমাদের সাধারণ ধারণা ও প্রত্যাশা থাকে যে, কবি তাঁর লেখা কবিতায় যে শব্দ ও শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন তা পাঠকের নন্দনবোধকে তৃপ্ত করবে। কিন্তু কোন্ শব্দটি কাব্যিক আর কোন্ শব্দটি অকাব্যিক তার নির্ধারণ করা সহজ নয়। প্রতীক-চিত্রকল্প-পুরাণ-ইতিহাসসহ আরও অনেককিছু যেমন কবিতাকে শক্তি যোগায় তেমনি শব্দার্থের যথার্থ ব্যবহারে কবিতা অভিষিক্ত হয় পাঠকের দরবারে। অলোকদার কবিতার নিবিড় পাঠে পাঠকেরা এই সত্যগুলি উপলব্ধি করতে পারবেন। উপস্থাপনে একটু প্রাচীন রীতি বা ভঙ্গির প্রতি অনুরক্তি, তৎসম বা সাধু শব্দের ব্যবহার, কোনো কোনো কবিতায় কিঞ্চিৎ সম্পাদনার প্রয়োজনীয়তার নিষ্পত্তি ঘটলে তা ত্রুটিমুক্ত হতে পারত একথা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা চলে না।
    সময়ের আত্মঘাতী চিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাঁর কবিতায়। তাই তাঁকে প্রণোদিত করে কবিতা লেখানোয়। কবির উচ্চারণে পাই : ‘সময় পাল্টায়, / শপথের কঠিন উচ্চারণে ছুটে যায় ধারালো বাতাস,/ভেতরে ভেতরে নামে উৎসাহের প্রবল জোয়ার,/ক্রমশ তীক্ষ্ণতর সময়ের চোখ’। আর আছে মানুষের দুর্দশা, দেউলিয়া রাজনীতির যন্ত্রণাময় ছবি, গণতন্ত্রে নিছক বোড়ে হিসেবে ধুরন্ধর আদর্শহীন রাজনীতিকদের দ্বারা স্বদেশ ও তার সাধারণ নাগরিকদের ব্যবহার, কবির ভিতরে রক্তক্ষরণ ঘটায়। কখনো স্বগতোক্তি, কখনো সংলাপে, কখনো বিবৃতিমূলক মন্তব্যে, কখনো ব্যঙ্গোক্তিতে গড়ে উঠতে থাকে তাঁর কবিতার শরীর। তাঁর অনেক কবিতাতেই ইমেজারিতে ‘গন্ধ’ শব্দটি আসে জীবনানন্দের কবিতার মতো, আসে শেয়াল-শকুন, নেকড়ে, পেঁচা আর বাদুড়ের ছবি, মৃত্যু, ফণীমনসার ঝোপ ইত্যাদি। স্বকৃত পাপের বোঝায় মানুষ ক্রমশ ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে, রাজনীতির ঘৃণ্য খেলায় মানবিকতা প্রায় নিশ্চিহ্নের মুখে। তাঁর অনেক কবিতাতেই আছে এক বেদনার্ত কন্ঠস্বর :
১। এখন আলোহীন রাস্তায় হাঁটতে ভয় হয়,
বাতাসের শব্দেও ছলাৎ বাজে বুকে;
অচেনা মানুষ দেখলেও ভয় হয়,
দেবদূতের মুখে যদি বাঘের
হিংস্রতা ফুটে ওঠে। (স্বাধীন পঞ্চাশ)

২। বান নয়, বন্যা নয়, মারী ও মড়কের রক্তমুখ সন্ত্রাস নয়,
শুধু একদল মানুষের ক্ষমতায় শানানো আকাঙ্খার ফলা
ভেঙে-চুরে তছনছ করে দিচ্ছে শিকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলছে,
আর একদল মানুষের . . . (রঘুপতি, তোমার অসুখ)

ভাঙাচোরা এই দেশে ‘ইতিহাস আলো জ্বেলে দেয়’। চারপাশেই ঘুণে ধরা সমাজে সবকিছু পোকায় কাটা আর তা বোকাবাক্সের মোহিনী মায়ার ফাঁদে ধরা পড়েছে, বাকতাল্লার ঝড়ে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। তাই কবির কলমে বর্ষিত হয় তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ :

১। “বোকা-বাক্সের দুনিয়ায় গুঁজে মুখ
আমরা রয়েছি পড়ে,
ওদিকে তোমরা কথার মুজরো গেয়ে
ফসল তুলছ ঘরে।” (ফসল তুলছ ঘরে)

২। “পঞ্চাশ বছর ধরে খুব বাড় বেড়েছে মানুষ
পঞ্চাশ বছর ঘরে আমরা উড়িয়েছি শুধুই ফানুস
পঞ্চাশ বছর ধরে তলে তলে কাটা হল খাল
এই তো কুমীর এল, যেন গত কাল।” (মহানিশা)

শুধু দেশীয় রাজনীতির ঘোলাজল নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির নগ্ন ক্ষমতালোভী স্বৈরাচারী শক্তির প্রতিও বর্ষিত হয় তাঁর ক্ষোভ :

‘সার্বভৌমত্ব’ এখন একটা বাতিল কথামাত্র।
‘মানবিক অধিকার’ বড়ই সেকেলে হয়ে গেছে।
রাষ্ট্রসংঘ নামক একটি পোড়ো বাড়িতে বসে
দিন গুনছেন কোফি আন্নান-ভালোয় ভালোয়
মেয়াদটা শেষ করতে পারলে তিনি বাঁচেন –
আর কত নতজানু হতে পারে মানুষ,
আর কত অনুগত হতে পারে?
ইতিমধ্যে নীল দিগন্তে, কখনো রাতের আকাশ ঘিরে
ভয়ংকর দূষণ আর আতঙ্ক ছড়িয়ে তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র।
ভারি ট্যাঙ্কের ধাতব শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে
নির্জন মরুভুমি, মগ্ন পাহাড়, আর
অরণ্যময় উপত্যকায়।”
(সময়ের সিঁড়ি ভাঙছে নয়া হিটলার)

শুধু ‘সময়ের জলছবি’ আঁকাতেই কবি অলোকরঞ্জন তাঁর দায়িত্বভার শেষ করেননি, সময়ের এক বিস্তৃত দোলাচল তাঁর কবিতার শরীরকে মন্থিত করে, তিনি হয়ে ওঠেন চলমান ইতিহাসের অন্তহীন সময়প্রবাহের একটি নির্দিষ্ট অংশের চারণকবি। সময়ের দেহের আঘাতচিহ্নগুলিকে দেখে একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে তিনি সচেতন করতে চান সমকাল ও ভবিষ্যতের মানুষগুলিকে। হেরে যাওয়া নয়, এক তীব্র আশাবাদ যার গ্রন্থি অপরাজেয় এক মনোভাবের সঙ্গে বাঁধা হয়ে থাকে – এমন মনোভাব তাঁর কবিতাকে সমকালের অনেক কন্ঠস্বরের থেকে বিপরীত ও বিশিষ্ট করে তোলে। তেমনই একটি কবিতার খানিক উচ্চারণে এই রচনার উপসঙ্ঘারে পৌঁছানো যেতে পারে :

“কিন্তু, আমি তো হারাতে চাই
মানুষের ভীড়ে, একাকীত্বে, আমার ভীষণ ভয়,
শুনতে চাই বুকে কান পেতে,
উষ্ণ রক্তের তা তা থৈ থৈ গান।
নির্জন মাঠ নয়,
মানুষের কন্ঠস্বরে মুখরিত
জীবনের টাটকা স্বপ্নে
আমি যে আজো জেগে আছি,
জেগে থাকি।”

কবির সজাগ মনটি আরও বহুকাল জেগে থাকুক, সে জাগরণ চিরন্তন জেগে থাকা সৃষ্টির মাঝখানে আজকের, কালকের, অনাগত পরশুর পাঠকদের জন্য।
সিদ্ধার্থ সেন