কথায় কথায় রাজীব ।। পল্লব ভট্টাচার্যের 'পাখিপুরাণ'
এ কা র আ কা শে এ কা র উ ড়া ন
(এক)
খাঁচার মায়া বক্ষ জড়ায় – ভাইঙ্গতে পারি না।’’
পুরাণ
কী ? প্রাচীন আখ্যায়িকা ? ইতিহাস ? পুরাভবম্ ইতি পুরাণম্। বৈদিক সাহিত্যে ইতিহাস
ও পুরাণ সমার্থক। পল্লব ভট্টাচার্যের ছয়টি গল্পের গল্প সংকলন এই ‘পাখিপুরাণ’ তাহলে
কী ?
“ – হারানদা, তোমার এই বাংলা লোকগানে এত পাখি কেন বলো তো ?
হারান
সরকার একটুক্ষণ ওর দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ‘ড. বোস, আপনি কি
বাঙালি ?’
সিদ্ধার্থ
অবাক হয়ে বলে – হ্যাঁ।
– বাঙালি
কিন্তু পাখির জাত।
- পাখির
জাত ?
- কেন পড়েন
নি, ঐতরেয় আরণ্যকের বয়াংসিদের কথা ? যাযাবর, পক্ষী প্রজাতি। অস্ট্রিকদের বং
উপজাতিদের টোটেম হয়তো ছিল পাখি। দেখেন
নি, বাংলায় পাওয়া সেইসব পক্ষীমানব মানবীর খোদাই মূর্তি ?” (পাখিপুরান)
পল্লব ভট্টাচার্য এই পাখির জাতের বিশেষ কিছু পাখির ইতিহাস-আখ্যান লিপিবদ্ধ করেছেন তার পুরাণে। এই পাখিরা একলা পাখি। উড়তে চাওয়া অথচ উড়তে না পারা একলা পাখি, দলছুট পাখি। কখনো আবার কোনো পাখি বুঝে যায় ‘সে নিজেই একটা লোহার খাঁচা, জং ধরা’।
পল্লব
ভট্টাচার্যের পুরাণপাঠ মোটেই অনায়াস, সহজ পাঠ নয়। এই পুরাণকার পাঠকের প্রতি
উদাসীন। তিনি জানেন, খাঁচার থেকে বেরুতে চেয়ে, আঁচড়ে, কামড়ে, ব্যর্থ হয়ে, নিজের
পালকে মুখ গুঁজে নেওয়া যে পক্ষী মানবদের আখ্যান তিনি রচনা করতে বসেছেন তার জন্য
প্রয়োজন বিশেষ নির্মিতির আর সেই নির্মিতি প্রথাগত গল্পের পাঠককে ধাক্কা দেবেই দেবে
এবং তাতে পাঠক মাঝপথে পাঠ ত্যাগ করতেও পারেন। কিন্তু তিনি গল্পকার নন পুরাণকার -
পুরাণমানব। যুগলক্ষণ বিচার এবং যুগসন্ধিক্ষণের বিষে নীল এই পক্ষী মানবদের কথা লিপিবদ্ধ
করা তার কর্তব্য। সেই কর্তব্যে তিনি অটল। আর সেখানেই ‘পাখিপুরাণ’ বাংলা সাহিত্যের
ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য অবশ্যপাঠ্য পুরাণ হয়ে উঠেছে।
“. . . . জানি না
হারানদা, জীবনের কোনও মানে আছে কিনা। আর না থাকলে এই জীবন কীভাবে কাটাতে হয় তাও
জানি না বলেই . . . .
. . . .
সিদ্ধার্থ বসু, সমাজবিদ্যার অধ্যাপক, বুঝতে পারে না, কোন্টা আকাশ আর কোন্টা
খাঁচা।
. . . .
উড়তে চায় যে মানুষ, সে-ই আবার শক্ত করে খাঁচা বানায়।” (পাখিপুরান)
পল্লব ভট্টাচার্যের গল্পগুলিতে প্রবেশের আগে তার গল্পের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতেই হয়।
বৈশিষ্ট্য ১ - গল্পগুলি যেন চিত্রকরের আঁকা ছবি। এবং অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করা যায় – ‘হলুদ পাখির ঠিকানা’ আর ‘রাতপাখি’ এই দুটি গল্পে রঙেরা সরাসরি তাদের অন্তর্নিহিত সংকেত নিয়ে হাজির। আমরা জানি প্রতিটি রঙ একটি প্রতীক বা মানসিক স্তর বা বিশেষ সংকেতবাহী হয়ে উঠতে পারে দক্ষ লেখকের কলমে। তারই এক নিপুন প্রয়োগ দেখা যায় এই দুটি গল্পে। বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার জন্য নীচের ছক দু’টির দিকে আমরা লক্ষ্য রাখব। (ছক - ১/হলুদ পাখির ঠিকানা আর ছক - ২/রাতপাখি)
ছক – ১/ হলুদ পাখির ঠিকানা
গল্পের নাম |
কি কি রঙের উল্লেখ কত বার আছে |
রঙের স্থূল বিভাগ ও তাৎপর্য অনুসারে কত বার আছে |
সংকেত অনুসারে |
হলুদ পাখির
ঠিকানা |
হলুদ
(৬), হলুদ আভা (৪) |
মোট হলুদ গোত্রের রঙ = ১০
বার আশা, বিশ্বাস – জীবনের
ধনাত্মক দিক। পরম পাওয়া। |
ধনাত্মক দিক মোট = ১৯ |
সবুজ(৩),
জলপাই সবুজ (২), কচি
কলাপাতা(১), হলদেটে সবুজ(১), কাঁচা আপেলের সবুজ (১) |
মোট সবুজ = ৮ জীবনের ধনাত্মক দিক। পরম
পাওয়ার পথের দিশা। |
||
সাদা(১) |
সাদা
(১) ধনাত্মক ইশারা। |
||
নীল(২),
নীলচে (১) |
মোট
নীল = ৩ জীবনের ঋণাত্মক দিক। সম্পদ জনিত আবিলতার প্রতীক। |
ঋণাত্মক
দিক মোট
= ১২ |
|
লাল(৩) |
লাল
(৩) জীবনের প্রধান সমস্যা। |
||
কালো (৬) |
কালো (৬) জীবনের ঋণাত্মক দিক। |
||
সোনালি
(২) |
সোনালি
(২) |
ধনাত্মক
আর ঋণাত্মকের মধ্যবর্তী রঙেরা মোট
= ৫ |
|
সিলভার
(১) |
সিলভার
(১) |
||
বেগুনি
(১) |
বেগুনি
(১) |
||
কমলা(১) |
কমলা
(১) |
ছক -২/রাতপাখি
গল্পের নাম |
কি কি রঙের উল্লেখ কত বার আছে |
তাৎপর্য |
সংকেত অনুসারে |
রাতপাখি |
সাদা (৯) |
ধনাত্মক
ইশারা। |
মোট
= ৯ ধনাত্মক
দিক |
লাল(২) |
এক্ষেত্রে
অতীত যা চলে গেছে। চলে যাওয়াটা ঋণাত্মক। (ব্যবহার - লাল হয়ে যাওয়া শুকনো পাতা) |
ঋণাত্মক
দিক মোট
= ১১ |
|
আগুন বা আগুনরঙা (২) |
জীবনের
প্রধান সমস্যা। সংকট। |
||
নীলাভ (৪) |
জীবনের
ঋণাত্মক দিক। সম্পদ জনিত আবিলতার প্রতীক। |
||
কালো(৩) |
জীবনের ঋণাত্মক দিক। |
||
উল্লেখযোগ্য যে এই গল্পে কোনো মধ্যবর্তী রঙ নেই অর্থাৎ
দুটি দিক প্রবলভাবে পৃথক |
এই
ছক দুটি অনুধাবন করলে আমরা গল্পের উপাদানের ভাগ আর গল্পের সাম্য সুস্থির না অস্থির
তা বুঝতে পারি। এখানে মূল বক্তব্য হল - নির্মিতিতে রঙের ব্যবহার গল্পকে অন্য
মাত্রা দিয়েছে এবং তা লেখকের সচেতন কৃৎকৌশল বা তার চিত্রকর সত্তার প্রকাশ।
বৈশিষ্ট্য ২ – প্রতিটি গল্পের মূল চরিত্র পুরুষ। মূল কথক পুরুষ। প্রতিটি গল্প গড়ে উঠেছে এই কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্রকে ঘিরে। গল্পের মূল উপজীব্যই এই পুরুষদের মানসিক জটিলতা, অসহায়তা এবং সর্বোপরি বিচ্ছিন্নতা। যে বিযুক্তি শুধু সংসারের মানুষটির কাছ থেকে নয়, এই সমাজ সংসার থেকেও।
“একাকিত্ব মানে তো
বিযুক্তি। এলিয়েনেশন। মার্কস্ এই এলিয়েনেশনকে বুঝতে চেয়েছিলেন, উৎপাদন সম্পর্কের
মধ্যে দিয়ে। কিন্তু আজকের গ্লোবাল দুনিয়ায়, এলিয়েনেশন আরও মারাত্মক, আরও ব্যাপক। .
. . .
বৈশিষ্ট্য ৩ – প্রতিটি মূল পুরুষ চরিত্রই ক্ষয়িষ্ণু, শীতল, বিনষ্ট সম্পর্কের ভার নিয়ে ভয়ঙ্করভাবে একা। এরা যেন সেই সব পাখি যারা ধীরে ধীরে আবিষ্কার করে তাদের চারপাশের সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রটিকে এবং খাঁচাটিকেও। কখনো খাঁচার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য চেষ্টা, সংঘাত আবার কখনো পাখিই তৈরি করে তার নিজস্ব খাঁচা।
বৈশিষ্ট্য ৪ – আপাতদৃষ্টিতে মূল পুরুষ চরিত্রগুলির সংকটের কারণটি সম্পর্ক-তন্তু থেকে উদ্ভূত বলে প্রতীয়মান হলেও বস্তুত এই সম্পর্ক তন্তুর টানাপোড়েনটিও বিশ্বায়ন-উত্তর সমাজের সংকোচন-প্রসারণের ফল। যা কখনোই খুব প্রকটভাবে উপস্থিত হয়নি। এই প্রসঙ্গে আমরা ছক -৩ দেখে নিতে পারি।
ছক-৩
গল্পের নাম |
বিশ্বায়ন-উত্তর সমাজ |
হলুদ পাখির ঠিকানা |
গাড়ির কালো কাঁচ আর ড্রাইভার/মেশিনে প্রপার কমান্ড দেওয়া
হয় নি, তার মানে ঘন্টায় প্রোডাকশন রেট কমে যাচ্ছে/ফ্যাক্টরি/ফোরম্যান/ফ্ল্যাটটা
কোম্পানি থেকে ওকে দেওয়া হয়েছে। প্রোডাকশন ইমপ্রুভ করার পুরষ্কার।/মাথার ভেতর আর
বাইরে শুধু স্প্রিং-এর মতো লাফানো সময়।/সে এখানে কিভাবে এল, এই হাইরাইজ
বিল্ডিং-এর পাড়ায়।/ |
রাতপাখি |
রাবার বাগান। কোনোও দলিল নেই।/ইলেকশন ইয়ার/-সময়টা বোঝার
চেষ্টা কর। বারো লাখে ছেড়ে দে। |
অন্ন-পুরুষ |
অফিস/ তিন হাজার টেলিফোন বিল/ফর্মের খোপ/মধ্যবিত্ত জীবন |
আকার আকৃতি |
আজ আর অনলাইন থাকবে না। লগ আউট করে বেরিয়ে গেল।/দিন
হাজিরার নার্স।/ফেসবুক একাউন্ট খুলে যায়। মাঝরাত অব্দি . . . কথা চালাচালি |
পাখিপুরাণ |
ইনবক্স/ ২০০০ পাউন্ড পুরস্কারের ফালতু মেসেজ/মউ সিগারেট
টানছে/কর্ণফ্লেক্স/রিসার্চ প্রোজেক্ট/ পার্টি /লিভ ইন |
কর্তার গ্রামের আখ্যান |
বহু আওয়াজ, আগুনের, টিনের চালা-খড় ফেটে যাওয়ার, ত্রাহি
ত্রাহি ছুটে যাওয়া, জলের ঝাপটা আর বাতাসের শাঁই শাঁই মিশে / শালা মালাউনের
বাচ্চা/কাল সকালে এখানেই দেখা যাবে গলার নলি কাটা এক কালো লাশ/ লড়কে লেঙ্গে . .
. (বিশ্বায়ন উত্তর বিশ্বেও আদিম সমাজের অবস্থান) |
বৈশিষ্ট্য ৫ – প্রতি গল্পেই পাখি ব্যবহৃত হয়েছে
প্রতীক হিসাবে।
বৈশিষ্ট্য ৬ – যৌনতা, সমকামীতা, নপুংসকতা গল্পের উপাদান হলেও তা নিয়ে বেসাতি করেন নি লেখক। শরীর নয়, মনের গভীরে নেমেছেন তিনি। যে গভীরে হয়ত মরমীয়া লেখকই নামার সাহস করতে পারেন। উড়িয়ে দিতে পারেন একলা পাখিগুলিকে তার গল্পের আকাশে।
(দুই)
এবার
এক এক করে ছুঁয়ে যাওয়া যাক গল্পগুলিকে।
“আমি মিশ্রীঘর একবার যেতে চাই . . . ”
‘হলুদ পাখির ঠিকানা’ গল্পে মূল চরিত্র অনুভব। ঘামলেই সে টের
পায় তার শরীর থেকে এক অদ্ভূত গন্ধ বেরোয় – পুরনো কবর খোঁড়া ঝুরঝুরে মাটির গন্ধ।
অনুভব বিছানায় এসে শোওয়া মাত্র স্ত্রী শ্রেয়ার ছটফটানি শুরু হয় – বমি হয়। আর তারপর
সে ডলপুতুল হয়ে যায়। এমনি সময়েও শ্রেয়ার শাড়ির আঁচলে আগুন লেগে গেলেও সে
নির্বিকারভাবে চায়ের কাপে চামচ নেড়ে যায়। বউ কথা কয় না। অনুভবের এই জীবন একদিন মুখোমুখি হয় মিশ্রীঘরের মহেশ বদ্যির। যে
মিশ্রীঘর মহেশ বদ্যির কথা অনুসারে একধরণের পাখির জন্য বিখ্যাত। সেখানে নাকি
একসঙ্গে দেখা যায় অজস্র হলুদ পাখি – বউ কথা কও। মহেশ বদ্যিরও গায়ে ছিল হলুদ শার্ট
– সে হলুদ ঝলক রেখে ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়েছিল। অনুভবের কখন যেন মনে হতে থাকে, এই
হলুদ আভা কি তবে হারিয়ে যাবার ? কখনো তার মনে হয় মহেশ বদ্যি এক অন্যরকম ডাক্তার,
যে বোধহয় তার গা থেকে কবরের গন্ধওয়ালা অসুখটা ভালো করে দিতে পারে। এমন কি শ্রেয়ার
ডলপুতুল হয়ে যাবার রোগটাও ভাল করে দিতে পারে।
এই গল্পে রঙের ব্যবহার নিয়ে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়াও
বহু সংকেত মুন্সিয়ানার সাথে ব্যবহার হয়েছে গল্পটিতে। চরিত্রগুলির নাম থেকে শুরু
করে বিভিন্ন বর্ণনায় সংকেত ব্যবহার করেছেন লেখক। গল্পটি হয়ে উঠেছে একটি সফল
সাংকেতিক গল্প। পাঠক নিজেও কখন উঠে বসে সেই হলুদ বাসটিতে – যা চলে যাবে মিশ্রীঘরের
পাশ দিয়ে।
(তিন)
লাল হয়ে যাওয়া পাতাগুলো ঝরে পড়লেই, সমস্ত শূণ্যতা দিয়ে কেঁদে উঠবে।”
রাতপাখি গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র অশীন এমন জমিতে সাত বছর
ধরে গড়ে তুলেছে তার রাবার বাগান যে জমির দলিল নেই।
“টাকার গাছ লাগাতে
লাগাতে সে ভুলে গিয়েছিল, এ গাছে ঘুণ ধরে না ঠিক, কিন্তু কোনও পাখিও বাসা বাঁধে
না।”
এই বাগানে অশীনও একটা গাছ। নেই- নেইয়ের সংসারে এক গলগ্রহ,
অক্ষম, অপদার্থ পুরুষ। যে পুরুষ কিছু ধরে রাখতে পারে না। আশিক স্বাতীকে ছেড়ে যাবার
পর স্বাতী অশীনকে বিয়ে করেছিল। দশ বছরের নেহা আজ জানে অশীন ওর বাবা নয় মায়ের
হাজব্যান্ড। সেই স্বাতী তাকে বলে ওঠে, ‘কবি! কথার কারবারী। কথা বানায়।’
“অশীন জানে, সে কবি
নয় আর। একজন কবি ছিল, তার ভেতরেও।”
এখন রাবার বাগান আছে, লেটেক্সের বাজার আছে – কিন্তু তাও
মন্ত্রীবাহাদুরের বাইক নিয়ে ঘোরা নাতির গ্রাসে চলে যেতে বসেছে আর কোনো গাছে একটা
কাঠঠোকরা ‘কিনে নেব, কিনে নেব’ শব্দে ঠুক ঠুক করে ঠুকছে। মন্ত্রীবাহাদুর বাঁশের
হুঁকোয় তামাক খায়। পাতায় বাঁধা ভাতের মোচা, শূয়োর মাখা ভর্তা আর বোতল নিয়ে বসে।
অনীশকে বলে খাও। হঠাৎ জিগ্যেস করে, ‘মাস্টর,
তুমি বলে কবি-ব্যবসা কর ? ঠিক নি ?’
আর আসে
আনন্দ। সে বলে ‘পুরুষ নও, তুমি
কবি।’ যে আনন্দ তার শরীরে, মনে মিশে যেতে চায়।
হায়দ্রাবাদে ট্রান্সফার নেওয়া স্বাতী চিৎকার করে ওঠে, “কবি ? কবিতা ? যা খুশি করার
একটা পাসপোর্ট চাই শুধু, না ! লম্পট, ইতর! স্বাতী হিসহিসিয়ে ওঠে।”
সে বিড়বিড় করে বলে,
‘আর তো আমার কবিতা আসে না।’
- আসবে, আসবে। সমস্ত
রাত কবিতার পাখিরা আসবে। তোমায় ছুঁয়ে আদর করবে। আর ক’টা দিন অপেক্ষা কর।’ স্বাতী
তীক্ষ্ণ ফ্যাঁসফ্যাসে গলায় চিৎকার করে ওঠে।”
গল্পের পাঠ
সাঙ্গ হলে আমরাও দেখতে পাই নিশ্চল কালো কালো গাছগুলোর মধ্য দিয়ে নীল আগুনের শিখার
মতো কেউ হেঁটে যাচ্ছে। সে কি কবিতা ? সে কি রাতপাখি আনন্দ ? যে আনন্দ ঘুমের
ওষুধগুলো খাবার আগে পড়ে নিয়েছিল স্বাতীর প্রত্যাখ্যাত সেই আগুন রঙা শাড়ি। অশীনকে
দেওয়া র্যাঁবোর কবিতার বইয়ের প্রথম ‘সাদা’ পাতায় লেখাটিও আমরা দেখতে পাই, “তুমিও পুরুষ হয়ে গেলে।”
লেখক - পল্লব ভট্টাচার্য প্রকাশ - ফেব্রুয়ারি ২০১৪ প্রচ্ছদ - লেখক প্রকাশক - সুমিতা পাল ধর, ত্রিপুরা যোগাযোগ - ৯৪৩৬১৬৭২৩১ |
“অন্নাৎ পুরুষঃ। অন্নাৎ পুরুষঃ।”
বলতে দ্বিধা নেই, বাংলা সাহিত্যে অন্ন-পুরুষ একদম ভিন্ন
নির্মিতির একটি গল্প। গল্পের মূল ঘটনা বা প্লট যদি সংক্ষেপে বলা যায় তাহলে এমন
প্লট নিয়ে বহু গল্প রচিত হয়েছে এবং রচিত হবে। কিন্তু অন্ন-পুরুষ এক অন্যতর গল্প।
পরমার্থ
– নন্দিনী আর ভুবনেশ্বর দত্ত। হঠাৎ বাবা মারা যাওয়ায় মায়ের অসুস্থতায় আর
ভুবনেশ্বরের মধ্যস্থতায়, পরমার্থের সাথে নন্দিনীর বিয়েটা হয়েছে।
“এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। উচিতও নয়।”
“নন্দিনীর সামনে নিজেকে একটা কুঁচকে
যাওয়া চিরকূটের চেয়েও তুচ্ছ মনে হয়। কথা বলতে গিয়েও থমকে যায়। নন্দিনীর ভাষায়, কথা
বলার ধরনে, একটা অন্য জগতের ছাপ আছে, যে জগত পরমার্থের অচেনা। এতখানি অচেনার মধ্যে
থাকতে থাকতে, সে বুঝতে পারে পরস্পরকে বলার ভাষা তাদের নেই।”
নন্দিনীর
রাঁধা তিতিরের মাংস খেয়ে উঠে যান ভুবনেশ্বর। যে মাংস জোগাড় করে দিয়েছে পরমার্থের
অফিসের পিয়ন মনমোহন।
“মনমোহনদা, তুমি নাকি শিকারী মানুষ . .
. কী শিকার করো তুমি ?
পাখি। গ্রামের ঝোপে-ঝাড়ে, নদীর পাড়ে
তিতির পাখিরা গরম খায়। ডিম পাড়ে। উম দেওয়ার জন্য আসে। আমি ফাঁদ পেতে ওগুলো ধরি। তিতিরের মাংস খুব নরম আর
সুস্বাদু। একদিন নিয়া আসুম আপনার জন্য।”
যে তিতির
পাখি আত্মজ্ঞান খুঁটে খুঁটে খেয়েছে – যা ধরা আছে তৈত্তরীয় উপনিষদে, সেই তিতির
পাখির মাংস খান ভুবনেশ্বর দত্ত। নন্দিনীর রাঁধা। নন্দিনীর নোটবুকে তিনি ‘বনশ্রী’।
“নন্দিনী নন্দিনী,
তিতিরের মাংসের এত ভালো স্যুপ কীভাবে বানাতে পারো তুমি !”
নন্দিনী যাবার আগে বলে যায়, ‘নিজেকে একবার আমার জায়গায় রেখে
দেখো।’
পুরো
গল্পজুড়েই সেই জায়গায় পরমার্থ চলে আসে – নন্দিনীতেই রূপান্তরিত হয় সে।
এই
গল্পের নির্মিতি মুগ্ধ করার মতো। লেখক এক স্তর থেকে অন্য স্তরে অবাধে যাতায়াত
করেছেন পাঠকের জন্য কোনো প্রয়োজনীয় ব্যবধান না রেখেই। যাতায়াত করেছেন বর্তমান থেকে
অতীতে – অতীত থেকে বর্তমানে।
(পাঁচ)
“আমি দৃশ্য আঁকিনি। দৃশ্যই আঁকছে আমার শরীর ও পটভূমি।“
‘কর্তার গ্রামের আখ্যান’ গল্পের কথক গগন হাড়ি কর্তার কথা
বলে যায় এক প্রগাঢ় ভাব-বিহ্বল শ্রদ্ধায়।
“‘বৌ পোলাপান লয়্যা
একবারে একবস্ত্রে পলায়্যা আইছি। তখন জঙ্গল আর জঙ্গল। আর সেই সেই জঙ্গলের ভিতরে
একখান ইটের দালান।’ সবার জানা। তবুও, এই দালান যে কর্তার, একথা গগন হাড়ির মুখ
থেকেই শুনতে চায়।”
“উয়ার ভিতরে, দেব কি দানো, কী আছে বুঝি
না। তবে, এ কথা ঠিক, উয়া ঠিক ঠিক মানুষও না।’
এই ভাবেই আঁকা হতে থাকে কর্তার শরীর যার উপস্থিতি ‘আমি’
হিসাবে। সেই ‘আমি’ জানায় – “এ ভাবেই গভীর নিবিষ্টতায় আঁকা হতে থাকে আমার
শরীর, অথচ আদৌ যা আমার নয়।”
“ইয়া কি মজ্জিদ, না
মন্দির, জানি না।’ গগন দু’হাত কপালে ঠেকায়। আবেশে তার চোখ বোজা। ‘উয়ার জাতও জানি
না। শুধু জানি, এই গেরাম,
কর্তার গেরাম।’’
এর সমান্তরালে উঠে আসে আরেক কিস্সা –
“আমার বন্ধু বেরাদর
কেন তাহারে পায় ? কেন আমি কিসমত বলিয়াই গুনাগার হইলাম ? আমার দেল কান্দিত।
ভাবিতাম, আখেরি রাত্রে উহারে দোজখের আগুন দেখাইব। কিন্তু আজ যে নেকি তাহার চক্ষে
দেখিলাম। তাহাতে বুঝিলাম, সোয়ামি বলিয়া যাহারে লইয়াছে, সে তাহার সবকিছু। উহার দিলে
আমার জন্য কোন আন্দাজ নাই। সোয়ামির জিন্দেগির বদলে সে জাহেল হইতেও রাজি। উহার
চক্ষে আমার জন্য যে গিবত, তাহাতে বুঝিলাম, উহার দেল আমি পাইব না আর।”
গল্পের শেষে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ে অন্ধকার, তার ভেতরে,
একটা শরীরের রক্ত ও আলো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে যায়।
(ছয়)
“আর তখনই, ছোট্ট, কালো পাথরের শিবলিঙ্গটি কেঁপে উঠল।”
‘আকার ও আকৃতি’ গল্পের প্রধান চরিত্র দীপ্ত। তার মা শয্যাশায়ী – অশক্ত। দেখাশোনার লোক হল অনিতা যাকে মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে পুরো সংসারটাই টানতে হয়। ইদানিং শুধু-শুধুই অনিতার মুখ দীপ্তের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভেসে ওঠে চোখদুটির অদ্ভুত অসহায়তা।
আছে
মাঝরাতে ফেসবুক একাউন্টে অভীকের সাথে দীপ্তর কথা চালাচালি –
“- একটু ছুঁয়ে থাকো।
- আছি তো। তোমার বুকেই মাথা রেখেছি। . .
.
. . . আরও গভীরভাবে আমায় জড়িয়ে রাখো
- এই তো ঠোঁটে ঠোঁট রাখলাম”
আছে অমরকন্টকের পাথুরে মন্দির চাতালে দেখা পাওয়া অনিরুদ্ধ
মহারাজ – অনিরুদ্ধ। যে বলে, “সব বস্তুই আসলে ভাবের আকার। আমি বস্তুর ভেতর দিয়ে তার
ভাবটি খুঁজে পেতে চাই।”
যে মহারাজের ছবি ফেসবুকে দেখে ইনবক্সে অভীক প্রশ্ন করে –
“হু হি ইজ ?”
কী
উত্তর দেবে দীপ্ত ! লগ আউট করে বেরিয়ে যায় সে।
“রঙের পর রঙে, কখনও
পাখি, কখনও বাঘ ও হরিণ, গাছ নদী আকাশ হয়ে উঠেছে শরীরের এক-একটা কোণ। সে নিঃসাড়,
অথবা হয়ে উঠছে এই সবই। এই সমস্ত কিছুর উপরে, অনিরুদ্ধের আগ্রাসী তুলি আছড়ে পড়ছে।
পাল্টে যাচ্ছে রঙ, আকার, আকৃতি।”
ভেতরে ফুঁসে
ওঠা এক অসহায় অভিমান ছুঁড়ে দেয় অনিরুদ্ধকে, “পেয়েছ, আমার ভাব,
তোমার ভাব ?”
“ ভেবেছিল, গোঁফ-দাড়ি জটার
আড়ালে মুখটা যন্ত্রণায় বেঁকে উঠবে এই প্রশ্নে। কিন্তু অনিরুদ্ধ, যার শরীরে এখন
সুতোটি নেই, উঠে দাঁড়াল একটা অন্ধকার স্তম্ভের মতো। ভাবলেশহীন পা ফেলে ঘরে ঢুকে
গেল। . . . হাতদুটো টেনে নিয়ে, অনিরুদ্ধ বলে, ‘নে –’
দু’হাতের
মুঠোয় শক্ত অথচ ঠান্ডা এক পাথর।”
আমাদের মনে
পড়ে যায় বেড়াতে যাবার দলের পুলকদাকে দীপ্ত প্রশ্ন করেছিল,“আমরা কি খুঁজতে এসেছি পুলকদা?
কি পাচ্ছি ?”
গল্পের শেষে আমরাও সেই একলা বারান্দায়, ভয়াবহ শূন্যতায় সম্মুখিন
হই দীপ্তের আরেক প্রশ্নের, “অনিরুদ্ধ, আমার কেন
এমন হয় ?” আর অনিরুদ্ধর জবাব, “আমিটা কি ? শরীরটা ?”
স্থির
টেবিল, চেয়ার, বিছানা সবই স্থির অথচ ছোট্ট, কালো পাথরের শিবলিঙ্গটি কেঁপে ওঠে।
দীপ্ত ভাবতে থাকে এ-ও কি বিভ্রম !
(সাত)
মনের কামড়টা মরে গেলে, তোমার এই সমাজ, সঙ্গী, সাথী কিচ্ছু লাগে না।
তখন তুমি একা। একার আকাশে একা উড়ছো”
‘পাখিপুরাণ’ গল্পের মূল চরিত্র সিদ্ধার্থ, ছাত্র রাজনীতি
করা সিদ্ধার্থ, এখন সমাজবিদ্যার অধ্যাপক। একদা ছাত্রী মৌকে তিনিদিন বেহুঁশ জ্বরের
পর উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “মে উই লিভ টুগেদার ?”
“চায়নি, একটা খাঁচা
তৈরি করতে। অথচ মনে হয়েছিল, মউয়ের সঙ্গে থাকা যায়। তাই, রেজিস্ট্রিই করে ফেলেছিল,
ক’দিন বাদে। অথচ . . .”
“হঠাৎ-ই ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে সেই গাছ।
তারপর, ডালপালা মেলে জড়িয়ে ধরে সিদ্ধার্থকে। নখের আঁচড় আর কামড়ের খয়েরি দাগগুলো
কাঁটা দিয়ে বিঁধছে আর বলছে, এ-ই, এ-ই। এই তো সুচিস্মিতা সেন, রাকা বোস, ধরণীধরণ,
শম্পা দাশ। মউ কই – মউ ?
“কিসের বিট্রে ? হ্যাঁ, কিসের বিট্রে ? ইজ
দেয়ার এনি এগ্রিমেন্ট ?
অনীশ, আমার ছাত্র। কী করে রুচিতে দিল ?
রুচি ? আমার নেই। তোমার আছে ? আয়নায়
নিজের মুখটা আগে দেখো।”
‘অনীশ’ যে অনীশকে রিসার্চ প্রোজেক্ট গুটিয়ে, ইউনিভার্সিটি
ছেড়ে যেতে বাধ্য করে সিদ্ধার্থের চ্যালারা। আর সেটা সেলিব্রেট করা হয় সন্ধ্যের
পার্টিতে – থ্রোন বাই সিদ্ধার্থ বোস টু হিজ কর্পোরালস।
নেশায় চুর সিদ্ধার্থ খোঁজে মার্কসকে।
“হোয়ের হি ইজ ?
মার্কস ? চারপাশে তাকায়। ঘোলাটে সেই চোখদুটো দেখে, ভিকি বুঝতে পারে, নেশা হয়ে
গেছে। আজও পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। শালা অনীশটা দাগা দিয়ে গেছে স্যারকে। আর মেয়েছেলে
পায় নি, একেবারে সিদ্ধার্থ বোসের ঘরে !”
“লুক বয়েজ। সিদ্ধার্থ
বসু উঠে দাঁড়ায়। ‘হিউম্যান বিয়িংস আর নাথিং বাট আ টুলস্ ইন দ্য সোসাইটি।’ জড়ানো
স্বরে বলতে বলতে সিদ্ধার্থ হঠাৎ চুপ করে যায়। অনেক্ষণ চুপ দাঁড়িয়ে, বিড়বিড় করতে
থাকে, ‘দ্যান হাউ ওয়ান ক্যান ফিল ? হোয়াই দ্য ফিলিংস –’ বলতে বলতে হাউহাউ করে
কেঁদে উঠল সিদ্ধার্থ।”
কাজ করতে গিয়ে একদা হারান সরকারের সাথে পরিচয় ড. সিদ্ধার্থ
বসুর। ফোকলোর ডিপার্টমেন্টের হেড ঠিকানাটা দিয়ে বলেছিলেন, ‘মিট
উইথ হারানদা। লিভিং এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইয়োর বাংলা ফোকসঙ।’ যার প্রথম প্রশ্নই ছিল, ‘গানের মধ্যে সমাজ, না সমাজের মধ্যে গান ?’ সেই জলু ফকিরের মাটির দেওয়ালে
হেলান দিয়ে হারান সরকারের গান আর তার পরিবার- সুজাতা। যে বলেছিল, ‘কী পন্ডিত,
গানের পাঠই চলবে সারারাত ! মনের পাঠ কখন শুরু হবে ?’ ফসলের সম্ভাবনা জাগবে ভেবে,
বহু-বহুদিন বাদে যে সুজাতার শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজে গিয়েছিল,সেই ঠোঁট দুটোও এখন
অচেনা লাগে সিদ্ধার্থের। তাছাড়া নীল ইনল্যান্ড লেটারের অক্ষরগুলো তাকে তাড়া করে, “অনেকদিনের মধ্যে
তোমাদের কোনও সংবাদ পাই না। . . . আশীর্বাদিকা মা।” ছুটতে ছুটতে আজ ড. বসু এক অদ্ভুত মোড়ে দাঁড়িয়ে
হাঁপাচ্ছে। কোথায় যাবে সে !
সিদ্ধার্থর ইচ্ছে হয় প্রশ্ন করতে – “তোমার
কাঁচা বাঁশের খাঁচা যে আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে, তুমি বুঝতে পারোনি হারানদা ?” সেই হারানদা জলু ফকিরের আখড়ায়,
একদিন ফোনে জানায় – “এখানে কত রঙ-বেরঙের পাখি।
ঘুরছে, ফিরছে, উড়ে যাচ্ছে। একলা একলা। আশ্চর্য কী জানো, কেউ জোড় বাঁধছে না।”
“. . . . সিদ্ধার্থ বসু, সমাজবিদ্যার
অধ্যাপক, বুঝতে পারে না, কোন্টা আকাশ আর কোন্টা খাঁচা।” একা থাকলেই তার পাখি হতে ইচ্ছে করে। দু’হাত ছড়াতেই, পালক গজিয়ে ওঠে। আস্তে
আস্তে উড়তে থাকে। আর তখন সেই ভয়ঙ্কর খাঁচাটা দেখতে পায়।
(আট)
পল্লব
ভট্টাচার্যের গদ্য জড়াতে থাকে পাঠককে, গ্রাস করে। এক আশ্চর্য গদ্য যা প্রায়শই
কবিতার পাশাপাশি হেঁটে যায়। গল্পকারের কলম বলিষ্ঠ কলম। প্রত্যয় প্রশ্নাতীত। তার
নিজের আঁকা প্রচ্ছদটিও পাঠ শেষে হয়ে ওঠে সপ্তম গল্প। কালো পটভূমিকায় সাদা পাখি, সাদা
লাইন দিয়ে গড়ে তোলা মস্তিষ্ক প্রতিম একটি বৃক্ষ। আর লেখকের নাম – হ্যাঁ, হলুদ রঙেই ছাপা।
ত্রিপুরার সাহিত্য আকাশ থেকে উড়াল দেওয়া এই পাখি এসে বসুক বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি
পাঠকের আঙিনায়।
বইটি ছাপা হয়েছে কুমারঘাট সাব-ডিভিসনের হালাইমুড়ার ‘গ্রাফিপ্রিন্ট’ নামক
প্রেসে। ২০১৪ সালে বইটি প্রকাশ করেছেন ত্রিপুরার স্রোত প্রকাশনা। সুন্দর প্রকাশনা।
এই বই ছাপার ঠিক দশ বছর আগে কুমারঘাটে এক বিকেলে আমি আর আমার স্ত্রী খুঁজে
বেড়িয়েছি একটি ডিটিপি সেন্টার আর অফসেট প্রেস। সেখান থেকেই আমাদের পত্রিকা ছাপাব
বলে। যা চেয়েছিলাম সেই রকম প্রেস তখন পাইনি আমরা। বছর দুই পত্রিকা বেরোয়নি। আজ সেই কুমারঘাটের কাছেই হালাইমুড়া থেকে ছাপা ঝকঝকে এই বই পেয়ে
নস্টালজিক না হয়ে উপায় নেই। ভাবি সেদিন যদি কুমারঘাট থেকে ব্রিজটা পার হয়ে
হালাইমুড়ার দিকে হেঁটে যেতাম তাহলে স্রোতের বন্ধুদের সাথে দেখা হত কি !
বহুদিন পর কুমারঘাট আবার এসে আমার হাত ধরল। কোনো দ্বিধা, জড়তা নেই সেই হাতের বন্ধনে। এ এক নতুন নবীন ত্রিপুরা।
‘চুঁচুড়ার রাজীব’ মানেই ‘সহদেববাবুর ঘোড়া’, ‘ভীষ্মদেবের মৃত্যুমুহূর্ত’, ‘অনেক জলের শব্দ’, ‘টাওয়ার অফ্ সাইলেন্স’, ‘হিবাকুশার ছেলে’ বা ঘোষ স্যারের গল্পগুলি — বহুচর্চিত, ভিন্নমাত্রার কিছু গল্প। জন্ম ১৯৭৭; পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা চুঁচুড়া-হুগলি-চন্দননগর। ১৯৯৭ সাল থেকে লিটল ম্যাগাজিন কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত এবং নিয়মিত লেখালেখি। সম্পাদিত পত্রিকা ‘সাইন্যাপস্’। আছে বেশ কিছু কবিতার বই। প্রকাশিত গল্প সংকলন ‘ঘর ও দরজার গল্প’, ‘অনেক জলের শব্দ’, 'আমাদের আশাতীত খেলাঘর'। গল্পের জন্য বারাসাতের বহুস্বর পত্রিকার পক্ষ থেকে পেয়েছেন ২০১৯ সালের ‘অনন্তকুমার সরকার স্মৃতি পুরস্কার’। অণুগল্পের জন্য ২০১৮ সালে চুঁচুড়ার গল্প সল্পের আটচালার পক্ষ থেকে পেয়েছেন ‘উৎপল স্মৃতি পুরস্কার’।
0 মন্তব্যসমূহ