সম্পাদকীয় 

কবরে কবরে বড় অন্ধকার এখন
আমরা সবাই আছি পরে মৃতের কাফন।

এতগুলো দিন . . .
এতগুলো মাস . . .
নিরপেক্ষ, নিরাপদ, নিশ্চিন্ত ভীষণ আঙুলগুলো শুধু
শিল্প-সাহিত্য টাইপ করে গেছে,
টাইপ করে চলেছে ভ্রমণ, খানাপিনা, বর্ষবরণ,
গল্প কবিতার প্রকরণ, ধন্য ধন্য যত ইমোজি এবং
রকমারি অনুরাগ ও উৎকন্ঠা।

শুধু টাইপ করলেনা তুমি 
এতগুলো দিন . . .
এতগুলো মাস . . .
এখনো তুমি বন্ধ্যা, নিরক্ষর?
আর কত দিন পেরোলে তুমি নিজেকে
আয়নায় পাবে দেখতে প্রসাধনহীন?

তোমার জন্য আর কোনো অক্ষরের দায় নেই।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

    লিটল ম্যাগাজিনের কোনো দায় নেই বাণিজ্যিক পত্রিকার মতন আসমুদ্র হিমাচলের লেখকবৃন্দের লেখা ছাপার। লিটল ম্যাগাজিনের প্রসারিত হবার কোনো দায় নেই। লিটল ম্যাগাজিনের কাজ এলাকা আঁকড়ে পরে থাকা বা চর্চার মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী তৈরি করা এবং অবশ্যই এই গোষ্ঠী খাতায় কলমে বা ফর্ম ফিল আপ করে বা বার্ষিক চাঁদার বিনিময়ে তৈরি গোষ্ঠী নয়। এই গোষ্ঠীর অর্থ কিছু কলমের একজায়গায় ধারাবাহিক প্রকাশ এবং এই প্রকাশ সাহিত্যের পরীক্ষা-নীরিক্ষার, তথাকথিত মূল ধারার গড্ডালিকা স্রোতের উপযোগী হয়ে ওঠা নয়। এই সংখ্যাতেই কবিতা ভাবনায় কবি রামকিশোর ভট্টাচার্য লিখেছেন, "কিন্তু অভ্যাসদায়ের বাইরে যদি না দাঁড়াতে পারা যায় তাহলে আর লিখতে এলাম কেন?" একই প্রশ্ন পত্রিকা সম্পাদক হিসাবে আমাদেরও, আপনি কেন লিখতে এসেছেন?  

    ঘটনাটা কী ঘটছে? লেখা শুরু হচ্ছে। ছাপা হচ্ছে বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত হচ্ছে। যত প্রকাশিত হয়ে চলেছে (পর্যালোচনা এবং সম্পাদনা বিহীন) তত নিজের প্রতি ভরসা বাড়ছে, যা স্বাভাবিক এবং অহং — সেও বাড়ছে। লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। এইবার কেউ যদি লেখা নিয়ে কিছু বলে তাহলে বিপদ। মুখে যতই বলা হয় আমি সমালোচনাকে স্বাগত জানাই, কেউ জানায় না। স্বাগত জানানোর অর্থ যদি ‘ভালো’ বল তাহলে স্বাগত। যদি ভালো না বল তাহলে ‘লেখাটা তুমি ধরতে পারোনি হে, ওটা তোমার মাথার উপর দিয়ে গেছে’। 

    রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় লেখক প্রশ্ন করতে ভুলে যান, কেন লিখতে এসেছি? প্রশ্ন করতে ভুলে যান কারণ তিনি অন্যান্য প্রশ্নগুলোও করতে ভুলে গেছেন ততদিনে। রোজ যে সব খবর তার কানে ভেসে আসে, চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় তিনি সেগুলোকে এড়িয়ে যাবার শিল্প আবিষ্কার করে নিয়েছেন নিজের মতন করে। তিনি ব্যাকুল হয়ে চারিদিক হাতড়ান দৈনন্দিন জীবনে নতুন নতুন উপকরণের খোঁজে। এগুলো লেখায় আনলেই, তিনি আধুনিক গল্প লিখছেন। আনন্দে উদ্বাহু হয়ে ঘোষণা করেন আমার লেখাতেই প্রথম উঠে এসেছে ট্যাটু বা অন-লাইন ক্লাস বা মাল্টিপ্লেক্স বা প্রি ওয়েডিং ফটো শ্যুট। 

    উড়ালপুল ভেঙে পড়ে, মাটি ধ্বসে যায়, জমি উচ্ছেদ হয়, কারখানা থেকে গ্যাস এসে ভেসে বেড়ায় মরা মরা খেলবে বলে, শ্রমিকেরা হেঁটে চলে মাইলের পর মাইল, কৃষকেরা ধর্নায় বসে, মহামারী বা ঝড়ে পাড়ার ছেলেগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে লঙ্গরখানা করে, ত্রাণে রওনা দেয় কোনো বিচ্ছিন্ন জনপদের দিকে ঠিক যখন আমরা আরো আরো স্যানিটাইজার মেখে নিচ্ছি হাতে  এবং আমাদের হাত থাকছে আরো পরিষ্কার। 

    প্রশ্ন আসে না , প্রশ্ন ওঠে না। প্রশ্নবিহীন সাহিত্যিক হবার দৌড়ের মাঠ লিটল ম্যাগাজিন নয়। দূরে থাকুন ভালো থাকুন। বিষয়হীন কবিতা লিখুন বাংলা অক্ষরে, যেমন বলেছিলেন প্রয়াত কবি অলোকরঞ্জন চক্রবর্তী।

    যারা লিটল ম্যাগাজিনের প্রসারের কথা বলেন তারা আসলে ঘাতকের কাজ করেন। লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণ গোষ্ঠীভিত্তিক যে সাহিত্যচর্চা, সমাজচর্চা তা পাকাপাকিভাবে বন্ধ করার কাজ করেন তারা। যুবকেরা ঢুকে যায় আরো আরো প্রসারিত হবার খেলায়। অবশেষে নিজেদের টুকরো জমিটাও হারিয়ে যায় বা বন্ধক পড়ে মহাজনের খাতায়। যখন হুঁশ ফেরে তখন সে পতিত, বন্ধ্যা। 

            তাহলে সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা ওয়েবে এল কেন? সে তো দুশো কপি ছেপেই এই কাজটা করতে পারত? ঠিক এই প্রশ্নটারই সবার আগে ফয়সালা করে ফেলা দরকার। না হলে অপরাপর ওয়েব পত্রিকার মতন একে ভেবে ফেললে শুধু বিব্রত হওয়া। আমরা সেইজন্য বার বার বলছি সাইন্যাপস্‌ লিটল ম্যাগাজিন, মাধ্যমটি শুধু ওয়েব। গোষ্ঠী চর্চার ক্ষেত্রটি প্রসারিত হবে অবশ্যই কিন্তু পত্রিকা ছড়িয়ে পড়ার উদ্দেশ্যে রকমারি লেখা ছাপার দায় আমাদের নেই। তাছাড়া, এই কথা এখন কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না অপরাপর মাধ্যমের মতন ডিজিটাল মাধ্যমেও একটা জবরদখলের লড়াই শুরু হয়েছে। এই লড়াইতে আপনি যার পক্ষেই দাঁড়ান আপনাকে এই মাধ্যমেও লড়াইটা লড়তে হবে। লেখার সামনে লেখা রাখতে হবে, যুক্তির সামনে যুক্তি, তথ্যের সামনে তথ্য - এরপর পাঠকের হাতে বা দর্শকের হাতে। 

            নিশ্চিন্ত নিরপেক্ষর খেলাও চলবে এরই সঙ্গে। যারা বলেন সাহিত্যে আছেন আর কিছুতে নেই, তারা ভুলে গেছেন সাহিত্যর অর্থ সহিতের ভাব, যোগ। এই যোগ যেমন লেখকের সঙ্গে পাঠকের ঠিক তেমনি লেখকের সঙ্গে জনগনের, মাটির, জলের, ঘামের, রক্তের। 

           সাইন্যাপস্‌ যেমন একটি স্নায়ুকোষের সঙ্গে আরেকটি স্নায়ুকোষের মাঝের সংযোগ , একটি মাধ্যম যার মাধ্যমে সংবেদন এক কোষ থেকে অন্য কোষে পরিবাহিত হয়ে চলে। ঠিক তেমনি 'সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা' ভাবনার সংবেদন পৌঁছে দিতে চায় একজন লেখকের কাছে থেকে পাঠকের কাছে বা পাঠকের কাছ থেকে লেখকের কাছেও। আর আমরা সেই লেখককেই চাই যিনি আজও প্রশ্ন করতে ভুলে যাননি। আমরা সেই পাঠককেই চাই যে পাঠকের মনে আজও প্রশ্ন ওঠে।

        আমরা যেন না ভুলে যাই জেগে থাকাটাও একটা ধর্ম।

        ভালো থাকুন বর্তমান পরিস্থিতিতে মুখ ঢেকে রাখুন। 

        ভালো থাকার জন্য মুখ ঢেকে রাখুন অথবা মুখ ঢাকার জন্য ভালো থাকুন। 

        ব্যাপারটা একই।🚫