ছবিস্বত্ব।।সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা

সমীর মুখোপাধ্যায় হুগলির প্রখ্যাত গল্পকার। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলেই বোঝা যায় তিনি এক জীবন্ত মুভি ক্যামেরা বিশেষ। তার ক্যামেরায় হুগলি-চুঁচুড়া জনপদের ফেলে আসা সময় আর বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের ছবি ধরে রাখা আছে। তার আত্মজীবনীটি সাইন্যাপস্‌ পত্রিকায় ২০১৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা ওয়েবে প্রকাশিত হয়ে আরো অনেক বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে আমরা আশা রাখি, তাই আমরা আবার এই ধারাবাহিক স্মৃতিকথাটি প্রথম পর্ব থেকে বৃহত্তর পাঠকদের কাছে উপস্থাপিত করলাম।

পর্ব ১

   কানু সান্যাল চলে গেলেন। বর্তমান সময় থেকে বেশ কয়েক দশকের দূরত্ব থেকে আজও দেখতে পাচ্ছি — শহীদ মিনারের সভামঞ্চ, সেখানে উদ্দাম ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে উড়ন্ত ইঁটবৃষ্টি — তার মধ্যেই স্থির, অবিচলিত, খাঁকি জামা ও হাফপ্যান্ট পরিহিত একটি প্রস্তরমূর্তি। তিনি আন্দোলিত করছেন রেডবুক — তখনকার যুবক যুবতীদের হৃৎস্পন্দন, আর কী বলার চেষ্টা করছেন! শুনবো কী উরে! ততক্ষণে অতিভীরু আমি সাংবাদিকের পল্কা টেবিলের নীচে আরও কয়েকজনে সঙ্গে ঢুকে গেছি . . .

কানু সান্যাল, শ্রদ্ধেয় কানু সান্যাল — তুমি হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ যুবক যুবতীদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলে, শিখিয়েছিলে কী করে আজীবন সৎ থাকতে হয়, কী করে ভাববো সেই তুমি আর নেই! (এই ধারাবাহিক যখন শুরু হয় তার কিছু বছর আগেই কানু সান্যাল আত্মহত্যা করেছিলেন — সম্পাদক) কানুদা, রাজনীতির অন্দরমহলে অবাধ সঞ্চরণের ফলে ‘রাজনীতি’ বস্তুটির প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা জন্মে গেছে! ভারতবর্ষে ছোটো বড় মিলিয়ে৩৫/৩৬টি মার্কসবাদী দল আছে। তাদের মধ্যে প্রধান ৪/৫টি দল। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যাঁরা সমর্থন করেন এমন ২৫/২৬ টি দল — সবার প্রতি আমার সমান বিতৃষ্ণা। তথাপি এই একান্ত ‘গর্হিত’ রাজনীতির গর্ভ থেকেই উত্থিত এমন দু’চারজন মানুষকে দেখেছি যে রাজনীতির প্রতি একান্ত অনীহা সত্ত্বেও তাঁদের শ্রদ্ধা না করে পারিনি। কানু সান্যাল তুমি আর নেই, আমি নতমস্তকে তোমায় বন্দনা করি, যেখানেই তুমি থাকো, তুমি এইটুকু জেনো — আরও লক্ষ লক্ষ যুবকের মত আমারো ইচ্ছে ছিল কিন্তু সাহস ছিল না, আমাদের ক্ষমা করো তুমি। ভীরুতার মুখে পদাঘাত করে তুমি নিজেই হয়ে গেছ শহীদ মিনার। তোমার অন্য মর্যাদার দরকার নেই।

    তোমার চলে যাবার পর আমার এই অতি পরিচিত শহরের কোনো দেয়ালে তোমার নামে কোনো পোস্টার দেখলাম না। মনে খুব আঘাত লেগেছিল। পরে ভেবে দেখলাম, এ ভালোই হয়েছে। শহরের দেয়ালগুলি নোংরা নেতাদের অশ্লীল নামে ভরে গেছে, এখানে, ওদের ভীড়ে যে তোমার নাম জুড়ে যায়নি, এজন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। পুরাকালের এক অতি প্রসিদ্ধ কবির কথায় বলি, ‘প্রসাদ বলে হৃৎকমলে, বেঁধেছি তোমারে। তুমি ছাড়াও দেখি কেমন পারো রামপ্রসাদের গিরে।’

বন্ধুরা, আমি জানি ‘সাইন্যাপস্’ একটি নির্ভেজাল সাহিত্য পত্রিকা। হঠাৎ আল্পটকা জননেতা কানু সান্যালের মৃত্যু নিয়ে ব্যক্তিগত এলেজি রচনা কেন? এটা আপনারা বলতেই পারেন! কারণ একাধিক। যদিও স্বীকার করতে বাধ্য, কারণগুলি জুৎসই নয়। প্রথম কারণ —  কানুদার মৃত্যু আমার মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। আমি চাইছিলাম কোথাও না কোথাও একটু যদি সুযোগ পাই তাহলে ওঁর সম্বন্ধে শ্রদ্ধা নিবেদন করব। দ্বিতীয় কারণও ব্যক্তিগত যদিও ক্ষীণভাবে সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত! আমার সত্যকার লেখা — প্রায় সমস্তই অরাজনৈতিক। ভালো হোক বা মন্দ হোক — সাহিত্য বলতে আমি সেগুলোকেই স্বীকার করি! আমার কিছু রাজনৈতিক লেখাও ছিল — কিছু উপন্যাস, কিছু ছোটোগল্প, কিছু রিপোর্টাজধর্মী রচনা। সেগুলোর সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। নকশাল আন্দোলনের পটভূমিকায় ‘এসো ছিন্ন কর’, ‘এ তো রক্ত নদী’(উপন্যাস), ‘অন্য গ্রাম অন্য তরঙ্গ’ (রিপোর্টাজ) — সেই সময়কার দলিল একপ্রকার।

    
    এ ছাড়া কিছু ছোটোগল্প — যেগুলোর জন্য বহু ভীতিপ্রদ রজনী আমাকে কাটাতে হয়েছে। গভীর রাত্রে পুলিশের বুটের সশব্দ পদচারণা আমার বিজন মুহুর্তগুলোকে ভরিয়ে রাখত। এসবের জন্য হাতে হাতে কিছু পুরস্কারও জুটেছে আমার। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় মাঝে মাঝে আশ্রয় নিতে হয়েছে — হ্যাঁ গল্প লেখার জন্যই। ‘তারা’ আমায় খুঁজতো; এমন কেউ নেই, লেখা যাদের বিরুদ্ধে গেছে। নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য ‘তাদের’ হাতে পায়ে ধরতেও হয়েছে। এই ছিল সেদিনের তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক’ পরিবেশ।
    তারপর একযুগ কেটে গেলে — ঘটনাগুলো বাসি হয়ে গেলে, যেমন পড়ন্ত বাড়ির দেওয়াল থেকে চুনবালি খসে পড়ে, তেমনিভাবে আমার গল্পগুলিও একদিন লোকেদের মন থেকে খসে খসে গেল। আমিও বেঁচে গেলাম। ওগুলো ঝেঁটিয়ে বিদায় করলাম। এখনও কেউ কেউ ওগুলোর কথা উল্লেখ করেন। বলেন, থাকতোই না হয়, এমন তো কত ভাঙাচোরা জিনিস পড়ে থাকে, আপনি বিদায় করলেন কেন? আমি তাঁদের সবিনয়ে বলেছি, তেলে ভাজা বাসি হয়ে গেলে ওগুলো ফেলে দিতে হয়। তাছাড়া আমি এমন কিছু দরের লেখক নই যে আমার লেখার ধারাবাহিকতার ইতিহাস রাখতেই হবে। বস্তুত আমাকে লেখকই বলা যায় না।

আমি লেখকই নই তবু রাজীব, সাইন্যাপস্-এর সুযোগ্য সম্পাদক বলেছেন, তিনি এবং আরও কেউ কেউ আমার আনন্দমেলায় লেখাগুলি পড়ে একদা উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন — হায়, সে সব যেন জন্মান্তরের কাহিনী। এই সেদিন হঠাৎ কী খেয়ালে লেখাগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম। বোধহয় রাজীব বলেছেন বলে। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বুক থেকে নির্গত হলো। এসব সত্যি সত্যি আমি লিখেছি না অন্য কেউ?

        বিমলদা, প্রখ্যাত লেখক বিমল করও একদিন আমার সামনে তাঁর কোনো কোনো লেখার উল্লেখে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলেন। সভা করতে গিয়ে সল্টলেকে প্ল্যাটফর্ম থেকে নামার সময় হঠাৎ পড়ে গিয়ে পা দুটো মচ্‌কে যায়। বাড়িতেই শুয়ে আছেন। অফিস অর্থাৎ 'দেশ' পত্রিকায় যেতে পারবেন না। আমাকে, অন্যরা চলে গেলে বললেন, 'হ্যাঁ হে, আমার কটা উপন্যাস তুমি জানো?' 

    আমি বললাম, 'চারশোর ওপর।' 

    উনি রীতিমতো বিস্মিত হলেন। বললেন, 'এতো!' তারপর অসম্ভব চুপ করে রইলেন মিনিট তিনেক। ভাবলাম কিছু কী অন্যায় বলেছি! পরক্ষণেই বললেন আমাকে রীতিমতো বিস্মিত করে, 'আসলে আমি লিখেছি একখানি মাত্র বই — পূর্ণ ও অপূর্ণ। ওই যে লেফট্‌ তাকে আছে। ওটা নিয়ে এসো দেখি।' 

    বিমলদা শুয়ে ছিলেন ট্রাকসান্‌ লাগিয়ে। আমি উঠে তাক থেকে নিয়ে এসে ওঁকে দিলাম। উনি বইখানায় লিখে দিলেন, 'সমীরকে  বিমলদা। 

    বাংলা সাহিত্যে কিছু অসাধারণ উপন্যাস আছে, ইংরেজি সাহিত্যের ভিতর দিয়ে বিশ্বসাহিত্যের যেটুকু পরিচয় পেয়েছি তাতে নিঃসন্দেহে এই সিদ্ধান্তে আসা যায়, শরৎচন্দ্রের 'গৃহদাহ', তারশঙ্করের 'কবি',বিভূতিভূষণের 'অপরাজিত' ও 'আরণ্যক', বনফুলের 'জঙ্গম' (১ খন্ড), 'স্থাবর' এবং মাণিকের 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'পদ্মানদীর মাঝি', 'চতুষ্কোণ', 'জননী' ইত্যাদি (যেগুলো সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ An Acre of Green Grass এ বলেছেন, Manik was both logical and magical. He had both virtuality and vision. Perhaps there was none among us none) সমরেশ বসুর 'শাম্ব' আর বিমল করের 'পূর্ণ অপূর্ণ'। Life is meaningless এরই কাব্যময় সাহিত্যিক রূপান্তর গ্রন্থটি। এটি পাঠ করলে চিত্তশুদ্ধি হয়। বইটি হাতে পেয়ে সেদিনের রোমাঞ্চ আমি আজও অনুভব করি।  (ক্রমশ)



সমীর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার বাড়িতে
সম্পাদক রাজীব কুমার ঘোষ
ছবিঃ সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা