সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা ২৫ বছর ।। ফিরে দেখা

 

প্রবন্ধ

ভাষা অবদমনের মূল

শিবেন বন্দ্যোপাধ্যায়

 

Some of our libido must be surrendered to the system; we must pass from the private. If also delusive order of what calls the imaginary, to the social order of the symbolic. Our individuality is correspondingly reduced. – Jack Lacan

ভাষা – এমন নয় যে আমরা জন্মের সঙ্গে নিয়ে আসি, বরঞ্চ ভাষা ব্যাপারটাই আমাদের শৈশব থেকেই এক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ক্রমে প্রবর্তিত করা হয় যার ফলস্বরূপ আমরা সমস্ত সামাজিক ফান্ডামেন্টালগুলি বুঝতে শিখি। ভাষাকে বাদ দিয়ে এই বিশ্বের কোনো কিছুকেই আমরা চিন্তা-মনন দ্বারা স্পর্শ করতে পারি না। আমাদের চৈতন্যের অন্যতম প্রধান নির্মাতা শব্দের অবিচ্ছিন্ন প্রবাহ। ভাষা আমাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে প্রতিফলিত করে, তৎসহ আবার বিকৃতও করে। অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ভাষার কোনওরকম ব্যবহার অবশ্যম্ভাবি যা আমাদের সংলগ্ন করে আমাদের মানবিক ইউনিকনেসের সামান্যটুকু হলেও সমর্পণ করতে। 

ভাষা আজ এক নৈর্ব্যক্তিকতা যা ব্যক্তিসত্তা অতিক্রমে স্থাপিত। মর‍্যালিটির মতোই প্রচলিত অফিসিয়াল, গ্রাহ্য ভাষা আসলে একটি বিশেষ শ্রেণি সৃষ্ট কৃত্রিম ভাষা, যা সামাজিক শ্রমবিভাগের পরিপূরক। সামাজিক শ্রমবিভাগকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, এই ভাষা আবার বিভিন্ন উপভাষা সৃষ্টি করে, যা শুধু মালিকের ভাষা – শ্রমিকের ভাষা; এই পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়। এই উপভাষার প্রচলন এমন মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে যে, বুর্জোয়া সমাজ এমন কতকগুলি বৃত্তিরই জন্ম দিয়েছে, যেমন অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক, সাংবাদিক, উচ্চকোটির লেখক ইত্যাদি। যেগুলিতে পারদর্শী হওয়ার অর্থ হচ্ছে এক একটি উপভাষার পরিভাষাগুলিতে রপ্ত হওয়া।

উচ্চারণভঙ্গীর যে বিশিষ্টতা বাক্‌রীতিতে সুরের সৃষ্টি করে, কথা বলা ও শোনাকে সত্যিকারের মানসিক আদানপ্রদানের পর্যায়ে নিয়ে যায়, প্রচলিত অফিসিয়ালে, বিবর্ণ, ম্যাড়ম্যাড়ে ভাষা তা আত্মস্মাৎ করতে অক্ষম। কোনো ‘সবখোল চাবি’ গোছের প্রাতিষ্ঠানিক সরকারি ভাষা ও ভাষারীতিকে মেনে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে, এর রাজনৈতিক পার্ট অর্থাৎ অবদমন ও হ্রিংসতাকেও মেনে নেওয়া।

শ্রমবিভাগের উন্নততর পর্যায়ে ভাষার সরাসরি শব্দসৃজন ও গ্রহন (ওয়ার্ড কয়নেজ) করার ক্ষমতা চলে যায়, ফলে যেটা ঘটে, তা হচ্ছে – ভাষার ঐতিহ্যে সংরক্ষনের নামে সরকারি ভাড়াটে ভাষা বিশারদরা ভাষাকে সংস্কার ও নিয়ম-কানুনের কফিনে ঢুকিয়ে একটা দর্শনীয় মৃতদেহ করে রাখেন এবং অপর দিকে রাস্তাঘাটে, ট্রেনে-বাসে চলতে থাকে ভাষাগত অবক্ষয়, ভাষার ভালগারাইজেশন। বুর্জোয়াদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ – ভাষার শ্রেণিগত বৈষম্য বেড়ে চলে। আর এভাবেই বুর্জোয়াদের বেতনভুক এলিট ভাষাবিদরা ভাষাকে তার মূল ভূমিকা থেকে বিচ্যুত করে ঠিক বিপরীত কাজে লাগান।

“এসব থেকে সরে এসে বিচ্ছুরিত হও। ভাষাকে নতুন জয় দাও।”

ভাষার নূন্যতম দায়িত্ব হল ভাব আদান প্রদানের কাজকে সহজতর করে তোলা। বুর্জোয়াদের সৃষ্ট এই কৃত্রিম ভাষা, কোনো এক সময় তার বিপ্লবী ভূমিকা সত্ত্বেও, এখন মৌলিক চিন্তনকে কষ্টকর করে তোলে। আজ ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে এর আর দেওয়ার কিছুই নেই। 🚫


প্রকাশিত হয়েছিল সাইন্যাপস পত্রিকার মুদ্রিত সংখ্যায় ('সাইন্যাপস' - নামে প্রকাশিত হত) দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যায়, কলকাতা বইমেলা সংখ্যা ১৯৯৯; সংকলন - ৩ 

মূল সূচিতে ফিরে যেতে এখানে ক্লিক করতে হবে

---------------------------

লেখক পরিচিতি

শিবেন বন্দ্যোপাধ্যায়। অধুনা প্রয়াত। চুঁচুড়ার কবি, প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক। 'আধুনিক সময়' নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন। প্রকাশিত হয়েছিল বেশ কিছু সংখ্যা। পত্রিকাটি উল্লেখযোগ্য এক পত্রিকা। আধুনিক সময়ের পক্ষ থেকে সাহিত্যানুষ্ঠান আয়োজিত হত। ফরাসি ও জার্মান ভাষার চর্চা করেছিলেন। স্বভাবে উগ্র ছিলেন, যাকে যা বলার সরাসরি বলতেন রাখঢাক না করে। অনেকসময় অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে বক্তব্য পেশ করার জন্য বেশ একটা গন্ডগোলের সূচনাও হত। অপরিমিত মদ্যপানের জন্য পারিবারিক অবস্থার বিপর্যয় ঘটে এবং পরবর্তীকালে তার জীবনাবসান ঘটে।