ছবি - আন্তর্জাল |
সেবিকারা তাদের কলমে তুলে এনেছেন
তারা যা দেখছেন।
করোনার অতিমারী পরিস্থিতিতে অক্টোবর
মাসে(২০২০) UPHC- Urban Public Health Center-এ কাজের সুযোগ পাই, সেখানে জয়েন করি। তখন পরিস্থিতি ছিল একটু জটিল, যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল কঠিন।
ট্রেন ছিল না, এমনকি স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যেও। যাতায়াত
করছিলাম বাস,অটোতে। খুবই অসুবিধার মধ্যে যাতায়াত করতাম। এই
মহামারি পরিস্থিতিতে পাচ্ছিলাম না কোনো থাকার ব্যবস্থা। তাই একটিই উপায় হাতে রইল,
বাড়ি থেকে যাতায়াত। জয়েন করার কিছু মাস আগেই আমাদের রাজ্যের নার্স
নিয়োগ প্রক্রিয়ার ইন্টারভিউ হয়েছিল। Health centre এ
ডিউটি করার সময়েই নভেম্বরে চালু হল ট্রেন তার কিছু মাস পরেই আমাদের রাজ্যে নার্স
নিয়োগ শুরু হল।
West Bengal Health
Recruitment Board এর লিস্ট অনুসারে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে
আমি মুর্শিদাবাদ জেলার একটি হসপিটালে একজন নার্স হিসাবে নিযুক্ত হই। এখানে আসার পর দেখতে পেলাম মানুষের মধ্যে
সচেতনতার হার অনেকটাই কম। করোনার এই অতিমারি পরিস্থিতিতে অনেকেই মাস্ক ব্যবহার
করছেন না। হসপিটালে ওয়ার্ডের মধ্যে সবসময় রোগীর আত্মীয়-পরিজনরা আছেন। মাস্ক
ছাড়াই তারা হসপিটালে ভর্তি শিশুদের কাছে আসছেন, কোলে নিচ্ছেন। মাস্ক পরার
কথা বললে পরনের কাপড় দিয়ে তারা মুখটা ঢেকে নিচ্ছেন।
এর
মধ্যে শুরু হয়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। বাজার-ঘাট নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা থাকার
নির্দেশ এল। বন্ধ হয়েগেছে
লোকাল ট্রেন। ছুটি
থাকলেও বাড়ি যাবার উপায় নেই। চিন্তা হচ্ছে
পরিবার পরিজনদের জন্য। হসপিটালে হসপিটালে বেডের হাহাকার, পর্যাপ্ত
অক্সিজেনের অভাব। আমাদের হসপিটালে চালু হোলো কোভিড ওয়ার্ড। কিছু ওয়ার্ড হসপিটালের
মধ্যেই অন্যত্র সরানো হোলো।
সহপাঠী
তথা কলিগদের থেকে তাদের কর্মক্ষেত্রের কষ্টকর পরিস্থিতির কথা শুনে নিজেরই বুক
কেঁপে উঠছে। PPE পরে কাজ করার যে কষ্ট তাদের মুখ থেকে শুনে সেটার ভয়াবহতা
আমিও অনুভব করতে পারছি।
'করোনা'-'বিশ্ব
কেলেঙ্কারি ' -এই জটিল পরিস্থিতিতে একদল সৈনিক নিজেদের
সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন জনসাধারণের সেবায়। না! এনারা কোনো উর্দি পরিহিত জওয়ান নন।
কামানের সাথে এনাদের কোন সাদৃশ্য মেলে না। ভীষন সাধারন নির্লিপ্ত সাদা পোশাকে
এনারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন সমাজের চোখে অছুঁত,মহামারীর
প্রকোপে কবলিত রোগীদের নিরাময়ের লক্ষ্যে-এনারা হলেন চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্য কর্মী।
খুব বেশী দিনের কথা নয়, এই তো গেল বছরের এমন সময় থেকেই লকডাউন চলছিল জোরকদমে। লাখো লাখো মানুষ বাড়ি ফিরলেও ফেরেননি এই লড়াকু যোদ্ধারা যাঁদের কথা খবরের কাগজে পাতার পর পাতা উল্টালে চোখের সামনে ফুটে উঠত। বহু আক্রান্ত করোনাযোদ্ধা নিজেরাই চোদ্দ দিন কোয়ারেন্টাইনে থেকেছেন আবার সুস্থ হয়েই কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিলেন লড়াইয়ের ফিরতি পথে। অনেকে হয়তো সেই চাপ নিতে না পারার জন্য আত্মঘাতীও হয়েছেন, কখনো হয়েছেন করোনা ছড়ানোর মতন ভ্রান্তধারনার অভিযোগে বিদ্রূপ ও রোষের শিকার যে সমস্ত খবর হামেশাই নজরে আসত আমাদের। দূর থেকে সর্ষে ফুল ঘনই লাগে তাই হয়তো বিষয়টা হালকা করেই নিয়েছিলেন অনেকে। তবুও আজকের পরিস্থিতির নিরিখে দাঁড়িয়ে তাদের প্রতি বিনম্রতা, কোমলতা দেখানো আমাদেরও আশু কর্তব্য।
বর্তমানে আমি নার্সিং এর প্রথম বর্ষের ছাত্রী। আজ করোনার দ্বিতীয় স্রোতে ভাসতে না ভাসতেই মানুষ ফের ঘরমুখো। আপাতত ভার্চুয়াল মাধ্যম ছাড়া পড়াশোনা চালানোর আর বোধ হয় অগত্যা কোনো বিকল্প নেই। তাই করোনা লড়াইয়ের সাক্ষী হওয়া আমাদের হয়নি শুধু নার্স দিদিদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা শোনা ছাড়া ,সত্যিই সেই রোমহর্ষক বর্ণণা, রোজনামচা শুনলে অবাক হতেই হয়, শিহরিত হয় সমস্ত শরীর। ভাবতেই হয় যে রক্ত মাংসের এই মানুষগুলো কিভাবে লড়ছে প্রতিদিন!!
গ্লাভস্, মাস্ক, পিপিই তে জর্জরিত কত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীদের দিনের পর দিন শারীরিক অবনতি ঘটেছে তার ইয়ত্তা নেই। প্রচন্ড গরম এ শরীরে হয়েছে ব্যাপক জলের ঘাটতি-'ডিহাইড্রেশন'। এদিকে জলপানেও যথেষ্ট কঠোরতা। মহিলা সংগঠকরাও 'ডিসমেনোরিয়া' চলাকালীন অসম্ভব মনোবল নিয়ে দৃঢ়তার সাথে কাজ চালিয়েছেন। অতিরিক্ত মাস্ক ব্যবহারের ফলে নাকের পরিধি বরাবর রক্ত জমাট এর দাগ লক্ষ্য করা যায় -'রেডনেস অ্যান্ড ইনফ্লেমেশন অব নোস '। অতিরিক্ত গ্লাভস্ এর কারনে হাতের তালুতে ত্বকের সমস্যা তো বাঁধাধরা-'স্কিন ইচিং'। এই তীব্র যন্ত্রনা একটুও টলাতে পারেনি তাঁদের।
মানসিক পরিস্থিতির কথা তো হিসেবের বাইরে। কখনো টানা তিনমাস, কখনো ছ মাস পর আপনজনদের সাথে একবার দেখা করবার সুযোগ মিললেও তা নির্দিষ্ট বিপদসীমার মধ্যে। বুকের মধ্যে কষ্টগুলো পাথর চাপা দিয়ে অন্যদের জন্য হাসতে হয়,অন্যদের জন্য বাঁচতে হয়। মানসিক সুস্থতা খুঁজতে শেষদিকে হাসপাতালে বিভিন্ন বিনোদনে নিজেদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা বেশ 'ভাইরাল' হয়। এই সামান্য উচ্ছাস সারাদিন এর নিরলস পরিশ্রম এর কাছে নগন্য মাত্র। পাছে যেন কাজে না ভাটা পড়ে সে কারণেই এমন উদ্যোগ। সংক্রমণ-এর ভয়কে উপেক্ষা করে কাজের সুবিধার্থে হাসপাতালের ওয়ার্ডে নিয়েছেন ঠাঁই। চোখের পাতা এক না করে কত স্বাস্থ্য কর্মী মাইলের পর মাইল অ্যাম্বুলেন্স চালিয়েছেন। কখনো সঠিকসময়ে রোগীকে সঠিক গন্তব্য স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন। কখনো মুমূর্ষু রোগীদের জন্য সরবরাহ করেছেন টনের পর টন অক্সিজেন সিলিন্ডার। ঘরবিমুখ করোনাজয়ী মানুষদের পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার মতন চরম প্রাপ্তি, চরম তৃপ্তি বোধ হয় ক্লান্তি দূর করার জন্য যথেষ্ট।
ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টারের একটি গ্রাফিত্তি |
প্রত্যেক কাজের বিশেষ দায়বদ্ধতা থাকে।
নীতিপালনের দায়। কাজে অংশগ্রহণের পূর্বে সেই নীতিপালনের দায়বদ্ধতার সঠিক রূপায়ণের
অঙ্গীকার করতে হয়, নাহলে যুক্ত হওয়া কাজের সঙ্গে মুক্ত মনের মিলন ঘটে
না । ফলে সেই নীতিপালনের দায়কে মনে হয় সীমাবদ্ধতা । যা তাকে কাজের প্রতি অনীহা
জন্মাতে,
অবহেলা করার দিকে নিয়ে যাবে।
আমরা যারা অসুস্থ মানুষের সেবা করার অঙ্গীকার করি তাদের কাছে কোনো বিশেষ
রোগ ফ্যাক্টর হয় কি? রুগীকে ভালোবেসে, মানবিকতার
সঙ্গে যখন যা প্রয়োজন বন্দোবস্ত করে দেওয়া এবং মানসিকভাবে সাহস যুগিয়ে পরিবারের
কাছে সুস্থ শরীরে ফিরিয়ে দেওয়াই আমাদের মতো সেবিকাদের প্রকৃত কাজ। আমরা প্রত্যেকেই
অবশ্যই এই ব্যপারে ওয়াকিবহাল।
গত পনেরো মাস ধরে চলে আসা অতিমারী পরিস্থিতিতে আমাদের এই নীতি অনুসারে
কর্মধারার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। এসেছে গতি। বেড়েছে কাজের প্রতি সচেতনতা ও
দায়িত্ববোধ।
এই পর্যন্ত ঠিকঠাক ছিল । সমস্যাটা দাঁড়িয়েছে কোভিড নিয়ে। আপাত নিরীহ অথচ
একটু অবহেলাতেই অবধারিত প্রাণঘাতি এই কোভিড ১৯ অত্যন্ত সংক্রামক। মানুষের মনে গেঁথে গেছে জীবন সংশয়ের ভাবনা। ইতিমধ্যে আমরা জেনে গেছি এর
ভয়ংকরতা ও নির্মমতা । সৌজন্যে, এই রোগে আক্রান্তের ও মৃত্যুর
পরিসংখ্যান।
করোনার যাত্রা পথের কঠিন পর্যায়গুলো আমরা পার
করতে করতে এখন গোষ্ঠী সংক্রমণের পর্যায়ে চলে এসেছি । হাসপাতালে ভিড় বেড়েছে।
হাসপাতাল ছাড়াও সেফ হোম বা কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের সংখ্যা বেড়েছে। আজ ঘরে ঘরে কোভিড রোগী। শ্মশানে বা কবরস্থানে মৃতদেহ
সৎকারে সামজিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। মৃত্যুভয় ঢুকেছে মানুষের মনে।
আর এখানেই কোভিড ফ্রন্টিয়ার কর্মীদের চাপ বেড়েছে। এতদিন আমরা নার্স, ডাক্তারবাবু সহ হাসপাতালের
সকল কর্মীদের কাজগুলো 'অ্যাজ ইট ইজ' ছিল।
কিন্ত বর্তমানে কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন করতে তারা বাধ্য হয়েছে। যোগ হয়েছে 'সেলফ প্রোটেকশন'। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিজের মা বাবা
ছেলেমেয়ে স্বামী সংসার আত্মীয় স্বজন ।
দরকার হয়েছে পিপিই কিটস, স্যানিটাইজার, মাস্ক গ্লাভস ইত্যাদির। কাজে যেতে গেলে ইউনিফর্মের ওপর টু-লেয়ার, থ্রি-লেয়ার
প্রোটেকশন নিয়েই বেরোতে হচ্ছে। আর পরে থাকতে হচ্ছে ততক্ষণ যতক্ষণ আমরা কাজের
ক্ষেত্রে রয়েছি। নিজকে বাঁচানোর জন্য শরীরে চরম অস্বস্তি হলেও, যথেষ্ট পরিমানে অক্সিজেন শরীরে প্রবেশ না করলেও পরে থাকতে হচ্ছে। আমরা নার্স বা স্বাস্থ কর্মীরা অঙ্গিকারবদ্ধ ।
যতই জীবনের ঝুঁকি থাকুক তারা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। জোর করেই জীবিকাগত
কারন কিন্তু এর প্রধান কারন নয়, মনের দিক থেকেই তারা বদ্ধপরিকর। কিন্তু ভয় আমাদেরও গ্রাস করে।
অনেক কর্মীরা কোভিড আক্রান্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে পারছে না। এই ক্ষেত্রে
আমরা বড়ো অসহায়। আমরা চাই রুগি ভালো হয়ে উঠুক।
এই যে কোভিড ভ্যাকসিন দেওয়া বা সোয়াব কালেকশনের সময় প্রচুর ভিড়। তা আমরা
কন্ট্রোল করতে পারছি না। বিভিন্ন কাজে আমাদের স্টাফরা করোনা পজিটিভদের কাছে কাছে
থাকছি। কিন্তু সেখান থেকে সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
প্রোটেকশন নিচ্ছি। অবশ্য সব সময় যে প্রয়োজন মত পি পি ই কিট আমাদের জোগান
দেওয়ায় হচ্ছে তাও না। তবু আয়োজন
মত মাস্ক বা কোভিড অ্যক্টিভদের কাছে গেলে পি পি কিটস্ পরলেও একটা ভয় কিন্ত থেকে
যাচ্ছে। অনেক রিস্ক ফ্যক্টর কাজ করছে। এমনকি বিপদের মুখে পড়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমারা বাধ্য। সে ক্ষেত্রে আমরা কিন্তু
অসহয়। তবু আমরা কিন্তু আমাদের মানসিক দৃঢ়তা দেখিয়ে কাজ করেই যাচ্ছি।
দীর্ঘ
ষোলো মাস ধরে আমাদের কোভিড নিয়ে সংসার। ভয়াবহ বলেই যে সরে আসলাম তা আর তো হয় না। আমরা মানসিকভাবে
প্রস্তুত এই করোনার মোকাবিলা করার জন্য।
তবে আফসোস থেকে যাচ্ছে এর মাঝেও কেউ কেউ
আমাদের দায় দায়িত্ব কাজ কর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। আমরা ইচ্ছাকৃত ভাবে ভ্যক্সিন দিচ্ছি না বা হাসপাতালে বেডের
ব্যবস্থা করছি না। কিংবা রুগীদের
ঠিকমত সেবা যত্ন করছি না। সোশাল
মিডিয়ায় বা লোক মুখে শোনা যাচ্ছে হাসপাতালে করোনা রূগিদের সব ক্ষেত্রে ভর্তি করা
হচ্ছে না। সেটাও ভ্রান্ত। মানুষের মুখে মুখে আমাদের পরিষেবা নিয়ে ভ্রান্তি
ছড়াচ্ছে। দু একটা এমন ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে গেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের
চেষ্টার কসুর থাকছে না।
স্বাস্থ্য
কর্মীদের স্পেশাল কোনো ব্যবস্থা নেই । স্বাস্থ্য কর্মীরা এই যে জীবনপণ করে হাই
রিস্ক নিয়ে কাজ করছে তার এগেন্সটে কোনো রকম বিমা বা প্রটেকশন নেই। রাজ্য বা কেন্দ্র সরকার অনেক
কথা, অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো কোনো বিমা বা স্বাস্থ্য পরিষেবা নেই। আমরা
শুধু শুনে গেলাম কেন্দ্র সরকার, রাজ্য সরকার মিলে কেউ পাঁচ লাখ
কিংবা দশ লাখ বিমার কথা বলা হয় সেটারও কোনো ব্যবস্থা নেই। এমন হচ্ছে আমরা যে এতো
কষ্ট করে দিন রাত পণ করে সেবা দিয়ে যাচ্ছি তার জন্য স্পেশাল কিচ্ছু নেই। এমন কি প্রাপ্য সম্মানটুকুও পাচ্ছি না। তারা
যদি কোনো কারণে পজিটিভ হয় তাদের কে বাঁচিয়ে রাখার কোনো স্পেশাল ব্যবস্থা নেই।
নার্সরা যদি বেঁচে থাকে আর অনেকের সেবা করে বাঁচিয়ে তুলবে সে দিকে খেয়াল নেই।
ডাক্তার বা যে কোনো স্বাস্থ্য কর্মীদের ক্ষেত্রেও সেই এক।
আবার ডিউটিতে কোনো রকম ফাঁকি থাকে না। ঘর দুয়ার ফেলে ছুটিছাটা না নিয়ে
ছুটতে হয় হাসপাতালে।
আমরা
ফিল্ড ওয়ার্কার অর্থাৎ কখনও ইনডোরে ডিউটির বদলে এই মুহূর্তে যাদের অন্য হাসপাতাল
বা সেফহোমে বা পুরো কোভিড হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হচ্ছে তাদের চরম অসুবিধার
মধ্যে পড়তে হচ্ছে। যেমন আশা কর্মীরা ফিল্ডে গিয়ে অর্থাৎ গ্রামে গ্রামে গিয়ে সোয়াব
টেস্ট করছেন। বা যারা সাবসেন্টারে রয়েছে্ন তাদের সমস্যা আরও গভীরে। কারণ তাদের কাজ
অধিকাংশ গ্রামের মানুষদের নিয়ে। এখনও অনেকেই তারা ঠিকঠাক জানে না। অবহেলা করলে করোনা কতটা ভয়ংকর হয় সে
অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতে হয়।
প্রত্যেক পাঁচ হাজার পপুলেশনের জন্য গড়ে একটি করে সাবসেন্টার থাকার কথা
বললেও এক হল নয় হাজার দশ হাজার করে হয়ে গেছে। সেখানে একজন ফার্স্ট এন এম সেকেন্ড
এন এম থাকেন। তার ওপরে থাকেন সুপার
ভাইজার , তার ওপরে পি এইচ এন । সবার ওপরে আছেন ডি পি এইচ এন
। আমরা প্রত্যেকেই এক সঙ্গে কাজ করে চলেছি।
আমাদের
শুধু একটাই বক্তব্য যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের সেবা করে তাদের আর কিছু না হোক
আর্থিক অনুদানের কথা বাদ দিয়েই বলছি তাদের জন্য আলাদা করে হসপিট্যাল খোলা হোক।
দেশের সেনা বাহিনীরা দেশ রক্ষা করে বাইরে থেকে, আর আমরা দেশকে রক্ষা করি
ভেতর থেকে। দেশবাসী যাতে সুস্থ থাকে ভালো থাকে তার জন্য। তাই সেনা বাহিনীদের যেমন আলাদা ট্রিটমেন্টের এর জন্য
স্পেশাল হাসপাতাল আছে তেমনি এই ফ্রন্টিয়ার কর্মীদের জন্যও স্পেশাল ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা
করা হোক।
রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক স্তরে সরাসরি কোনও
যোগাযোগ না থাকলেও ব্লক লেভেলের মিটিং বা থানা পর্যায়ের মিটিং বা কোনো সমস্যা হলে
তারা এগিয়ে আসছেন। আমাদের সাহায্য করছেন। তবে সেগুলো সব রুল অ্যান্ড রেগুলেশন মেনে। ইন্ডিভিজুয়ালি কেউ
অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জন্য বিশেষ কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
আমি নিজে একজন সিনিয়র নার্স। সদর থেকে আমাকে সরানো হয়েছে *** সেফ হোমে।
আমরা চেষ্টা করছি মাইল্ড কোভিড রোগীদের সঠিক সেবা দিয়ে সারিয়ে তুলতে।
আমরা প্রবলভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি আপানাদের সেবা করতে । সামনে থেকে এই
ভয়ঙ্কর করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করছি। আপনাদের কাছে শুধু প্রার্থনা আপনারা ভয়
পাবেন না। কারণ ভয় পেলে অক্সিজেনের লেভেল নেমে যাবে তাতে ইমিউনিটি আরো কমে যাবে।
ফলে কোভিদ খুব সহজেই
আমাদেরকে কাবু করে ফেলবে।
আর একটা অনুরোধ আমাদের প্রতি বিশ্বাস রাখুন। ধৈর্য্য ধরুন আর সমভাবে নিজেকে সেফ রেখে আমাদের সহযোগিতা করুন । 🚫
আমেরিকার নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে গ্রাফিত্তি |
বর্তমান এই অতিমহামারী সময়ে একজন প্রথম সারির
যোদ্ধা (পেশা- স্টাফ নার্স, গ্রেড টু,) হওয়ার
দরুন ভয়াবহ করোনার অভিশপ্ত দাপট-এর প্রতিনিয়ত সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী আমি। কোভিড
কোথাও না কোথাও মানুষের বেঁচে থাকার আকুতিকে উপেক্ষা করেই চলেছে। ভারতে গত বছরের প্রথম ঢেউ সরকার, ডাক্তার,
নার্স, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ও বিভিন্ন
সমাজসেবকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিয়ন্ত্রন করা গেলেও, এর
দ্বিতীয় ঢেউ একপ্রকার মরণলীলা হয়ে উঠছে যার প্রধান কারন হিসাবে সাধারন মানুষের
অবহেলা, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উৎসব কে আমি দায়ী বলে মনে
করি৷
প্রথমত, প্রথম ঢেউ সামান্য নিয়ন্ত্রন
হতেই জনসমাজ সগৌরবে অসচেতনতার দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়ে মাস্ক পরা, নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায়
রাখা, স্যানিটাইজ করা সমেত অন্যান্য কোভিড স্বাস্থ্যবিধি
শিকেয় তুলে রাখলো। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাস্কবিহীন উপস্থিতি থেকে
নিজেদের গাঁ বা পাড়া ভাসিয়ে দিল৷ সরকারের বহুরকম প্রচেষ্টা সত্বেও এক বিপুল
জনসংখ্যা বিভিন্ন গুজবে কান দিয়ে টীকাকরণ থেকে বিরত থাকল যার ফলে সরকারী হাসপাতালে
প্রচুর টিকা অব্যবহৃত থেকে গেল। গত দু'থেকে তিন মাস সময়ে করোনার দ্বিতীয়
ঢেউ আছড়ে পড়তেই দেখা গেল যে এই ঢেউ আগের চেয়ে অনেক বেশী ভয়ানক এবং প্রচুর অল্পবয়সী
কোনো রকম কোমর্বিডিটি (একজন ব্যক্তি যার একটি রোগ বা উপসর্গ আছে তার আরও এক বা
একাধিক অন্যান্য রোগ বা উপসর্গসমূহ থাকার বিষয়টিকে কোমর্বিডিটি বলে) ছাড়াই মৃত্যুর
কোলে ঢলে পড়ছে৷ দেখা যাচ্ছে এই করোনার প্রধান উপসর্গ হল জ্বর, শ্বাসকষ্ট, শরীর ব্যথা, কাশি,
নাকে গন্ধ না পাওয়া ইত্যাদি৷
অনেক মানুষ সাধারন জ্বর ভেবে বাড়িতে নিজে নিজেই
ওষুধ খেয়ে পাঁচ থেকে সাত দিন কাটিয়ে শেষদিকে মানে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা যখন কমে
শ্বাসকষ্ট শুরু হল তখন হাসপাতালে হন্য হয়ে ঘুরছে আর তখন সব হাতের বাইরে৷ বেশীরভাগ
ক্ষেত্রে যখন হাসপাতালে রোগী ভর্তি হচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে তার অক্সিজেন
স্যাচুরেশন এর মাত্রা চল্লিশ শতাংশের কম৷ পরিস্থিতি এতটাই ভয়ংকর যে দেখা যাচ্ছে,
ধরা যাক যেখানে বেড সংখ্যা ৭০ ও অক্সিজেন সংযুক্ত বেড সংখ্যা ৪০
সেখানে রোগীর ভর্তির চাহিদা ১৫০ থেকে ২০০ - মানে আগের থেকেই পূর্ণ। এই সংখ্যক রোগীর দেখাশোনার জন্য
পর্যায়ক্রমে দুই জন করে নার্স বরাদ্দ।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকেই(ব্যাঙ্গালোর থাকাকালীন) আমরা
একটা নতুন রোগ সম্পর্কে অনেক কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। এই যেমন চিন থেকে একটা নতুন রোগ
ছড়াচ্ছে, এই রোগ হলে হয়ত কেউ বাঁচবই না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমাদের সকলের স্মার্ট ফোনের সাহায্যেও আমরা এই
করোনা ভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন তথ্য জানতে পারছিলাম। মাস্ক, স্যানিটাইজার-এর
ব্যাবহার ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে বার বার বলা হচ্ছিল। অবশেষে ব্যাঙ্গালোরে একজন বৃদ্ধের মৃত্যু হল, আমাদের
কাছে এসে পড়ল করোনা। ততদিনে ২০২০। জানা গেল তিনি বিদেশ থেকে ফিরেছেন কিছু দিন আগে, তাই ধরে
নেওয়া হল তিনি বিদেশ থেকেই করোনা বহন করেছেন নিজের শরীরে। তখনও ভারতবর্ষে এই
রোগের প্রকোপ তেমন পড়েনি, তারপর ধীরে ধীরে এই রোগ থাবা
বসাতে শুরু করল, এখন তার পরাক্রমে থরহরি কম্প সবার।
২০২০
সালের মার্চ মাসে কলেজ ছুটি হয়ে গেল করোনা ভাইরাস এর কারণে। বলা হল কিছুদিন ছুটি
কাটাও বাড়িতে, করোনা ভাইরাস এর ভয়াবাহতা একটু কমলে আবার কলেজ শুরু করা হবে।
তড়িঘড়ি টিকিট কেটে বাড়ি চলে এলাম।
ততদিনে ইতালি-তে হু হু করে বাড়ছে করোনা
সংক্রমণ। ডাক্তার নার্সদের নাজেহাল অবস্থা। তারাও সংক্রামিত হয়ে পড়ছেন ধীরে ধীরে, প্রাণহানি
ঘটছে। এই খবর দেখে ভারতেও তখন মানুষের মনে আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। সবাই ভাবছে এই
ভাইরাসে সংক্রমিত হলে বোধহয় আর রক্ষে নেই। যদিও সোশাল মিডিয়াতে বিভিন্ন পোস্ট বা
ভিডিওর মাধ্যমে লোকজনকে বলা হচ্ছে যে এই রোগ নিশ্চিত মৃত্যু নিয়ে আসছে না। মাস্ক
ব্যবহার, স্যানিটাইজার ব্যবহার,আর
দূরত্ব বজায় রাখলেই সংক্রমণ এর ভয় থাকবে না। সংক্রামিত হলেও অনেকেই বেঁচে
যাচ্ছেন।
২০২০ সালের মার্চ মাসের প্রায় শেষ দিক থেকেই
পশ্চিমবঙ্গে লকডাউন শুরু হয়ে গেল।।দোকান পাট সব বন্ধ। বাজার, শপিংমল,
লোকাল ট্রেন, রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া সব বন্ধ।
শুধু মুদি, ওষুধ ও ডাক্তারখানা - এই ধরনের অতি প্রয়োজনীয়
কিছু দোকান খোলা থাকবে তাও মাত্র কিছু ঘণ্টার জন্য। পুলিশ গাড়ি নিয়ে টহল দিচ্ছে,
কোনো জমায়েত করা,বা আড্ডা দেওয়া যাবে না,
মাস্ক ছাড়া বাইরে যাওয়া যাবে না। লকডাউন এর প্রথম পনেরো দিন
একেবারে থমকে গেল গোটা রাজ্য। পনেরো দিন পর যে যেখানে ছিল সবাই তাড়াহুড়ো করে
বাড়ি ফিরে আসল। ততদিনে পশ্চিমবঙ্গে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে সংক্রমণ বেশি
সেইখানে রেড জোন করা হয়েছে। উত্তর চব্বিশ পরগনা আর কলকাতাতে সংক্রমণ সবথেকে বেশি।
ভয়ে সবাই জড়োসড়ো । এদিকে নতুন এক সমস্যা দেখা দিল। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষরা
বিপদে পড়লেন। তাদের আর দিন চলে না। সরকার থেকে স্কুলের প্রতিটি বাচ্চাকে কিছু
নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস, স্যানিটাইজার দেওয়া শুরু হল।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং তরুণ উদ্যোক্তারা শুরু করলেন নিজের এলাকার মানুষের সাহায্য
করা।
এইভাবে কাটল বেশ কিছু মাস। মাঝে আমারা সবাই অনেক প্রিয়জনকে
হারালাম। ধীরে ধীরে অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হল। দীর্ঘ নয় মাস ঘরে বসে অনলাইনে ক্লাস করে অবশেষে কলেজ খুলল।
ডিসেম্বর মাসে ফের চলে গেলাম ব্যাঙ্গালোরে। ওখানেও অবস্থা অনেক স্বাভাবিক। তবে
লোকজন তখনও মাস্ক ব্যবহার কিন্তু একটুও ছাড়েনি। কলেজ এ দেখলাম গেটের সামনে বসানো
হয়াছে টেম্পোরারি স্যানিটাইজার টানেল আর অটোমেটিক স্যানিটাইজার বক্স। কলেজ এ ঢোকার
সময় গায়ের তাপমাত্রা মেপে স্যানিটাইজার টানেল এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যাতে কিছুটা
হলেও সংক্রমণ এড়িয়ে থাকা যায়। শোনা গেল কিছু কলেজ নাকি সপ্তায় দুই বা তিন দিন
অফলাইন ক্লাস করছে আর বাকি দিন গুলো অনলাইনে ক্লাস হোস্টেল এর রুমে এ বসে।
প্রতিটি সুপারমার্কেটে মাস্ক ছাড়া প্রবেশ নিষিদ্ধ।
মল-গুলোতে ঢুকতে গেলে আগে টেম্পারেচর চেক ,তারপর স্যানিটাইজার। মানুষের
সচেতনতা সেখানে বেশ। নিজে থেকেই তারা সংক্রমণ এড়াতে চাইছে। পুলিশ ও টহল দিচ্ছে
অনবরত। কোনো অনুষ্ঠান করতে হলে রাত আটটার মধ্যেই শেষ করতে হবে। আর অনুষ্ঠান করার
জন্য অনুমতিও নিতে হবে সরকারের থেকে। এইরকম কড়াকড়ির মধ্যেই আমরা বড়দিন, সরস্বতী পূজা ও কলেজে ফ্রেশার পালন করলাম। বড়ো অডিটোরিয়াম গুলো তে বেশি
লোকের পারমিশন না থাকায় কলেজেই হল অনুষ্ঠানগুলো।
মাঝখানে এসে গেল ভ্যাকসিন। কলেজ এ ক্যাম্প করা হল। যারা
ইচ্ছুক তারা ভ্যাকসিন নিল। তখন
আর করোনার ভয় তেমন নেই মানুষের মধ্যে। কিন্তু সচেতন মানুষ তখন ভ্যাকসিন নিচ্ছে
নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে।
এর মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে পড়ল। করোনা
নিয়ে ভয়াবাহতা এবার আগের থেকে অনেক বেশি। এখন সে বেশি মানুষের প্রাণ নিচ্ছে।
আবারও ছুটি কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য। অগত্যা গত এপ্রিল মাসে আবার বাড়ি ফিরে
আসলাম।
এখানে এসে উপলব্ধি করলাম দীর্ঘ এক বছর করোনার
সঙ্গে লড়াই করে মানুষ বোধহয় ক্লান্ত। এখন আর আগের মতো ভয় পাচ্ছে না মানুষ।
মাস্কটাকেও অসহ্য লাগে বোধহয়, তাই রাস্তা ঘাটে বাজারে
ঘুরতে দেখা যায় মাস্ক ছাড়াই। হাতে গোনা মাত্র কিছু লোকের মুখে মাস্ক। কিছু
দোকানে অবশ্য দড়ি দিয়ে ব্যারিকেড করে লেখা আছে "মাস্ক ছাড়া মাল বিক্রি হবে
না।" তাই সেই সব দোকানে মাল কিনতে যাওয়ার আগে মাস্ক পড়ছেন খরিদ্দার বা
রুমাল, ওড়না দিয়েই কাজ চালাচ্ছেন। মোট কথা হল যেখানে
নিতান্তই মাস্ক না হলে চলছেই না সেখানেই একমাত্র মাস্ক পরছে লোকে।
সরকার থেকে আংশিক লকডাউন ঘোষণা করা হল, কিন্তু দেখা
গেল নির্দিষ্ট সময়ের বাইরেও অনেক দোকান পাট খোলা, চলছে বেচা
কেনা। অনেক বেশি বেপরোয়া হয়ে
গেছে মানুষ। করোনা ভাইরাস কে হালকা চোখে দেখছে।
এদিকে মৃত্যুর সংখ্যা আর
সংক্রমণ এর সংখ্যা বেড়েই চলছে হু হু করে। অক্সিজেন এর জন্য হাহাকার। হাসপাতালে
বেড পাওয়া যাচ্ছে না। সোশাল মিডিয়ার সাহায্যে স্বেচ্ছাসেবকরা চেষ্টা করছে
মানুষের সাহায্য করার।
1 মন্তব্যসমূহ
আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।
উত্তরমুছুন