সাইন্যাপস্ কথামুখমেদিনীপুর শহরের অনন্য এক বইয়ের দোকান ভূর্জপত্র। গৌতমদার এই পুস্তক বিপণীটি অনন্য এই জন্য যে, এই শহরে একমাত্র গৌতমদাই সচেতন ভাবে এবং নিজের উদ্যোগে লিটল ম্যাগাজিনগুলি রাখেন। একদিন ঘাঁটতে ঘাঁটতে হাতে আসল আট পাতার ছোট্ট আকারের একটি পুস্তিকা, 'জল পড়ে পাতা নড়ে'। মাঝের পাতা খুলতেই ধাক্কা দিল শব্দরা, "পাথর ভাঙার দেশে অন্ধ ছেলেকে তুমি / নিয়ে এসেছো।/ মা, আমাকে ঘিরে রাখো,"১৬ টি ছোট ছোট কবিতার সংকলন। শুধু জানা গেল লেখকের নাম সুকান্ত সিংহ, প্রকাশস্থান নেকটার, শয়লা, সোনাখালি, পশ্চিম মেদিনীপুর আর মুদ্রক শাসমল কম্পিউটার সেন্টার। আর কিছু তথ্য নেই। না আছে উৎসর্গ জাতীয় কিছু বা কবি পরিচিতি বা যোগাযোগের নম্বর। বোঝাই যাচ্ছে কবি নিজেই প্রকাশ করেছেন। প্রচ্ছদটিও তার করা। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২ সালে। অর্থাৎ নয় বছর আগে, প্রায় এক দশক আগে। কোনোভাবে এই একটি পুস্তিকা থেকে গেছে ভূর্জপত্রে আমাদের হাতে উঠে আসবে বলে।কবিতাগুলি পাঠ করে হতচকিত অবস্থা। এইরকম একজন কবির সঙ্গে আলাপ নেই!তারপর কীকরে তার ফোন নম্বর জোগাড় হল সে কাহিনী উহ্য থাক। ফোন করে আলাপ হল এক বেবাক উদাসীন কবির সঙ্গে। পরে ফেসবুক ঘেঁটে দেখলাম কবির শেষ কবিতার বই বেরিয়ে ছিল পাঁচ বছর আগে। আমরা জানালাম এই পুস্তিকাটির সমস্ত কবিতা আমরা প্রকাশ করতে চাই বৃহত্তর পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য। তিনি সম্মতি দেওয়ায় সাইন্যাপস্ পত্রিকা পাঠকদের বৃত্তে হাজির করল 'জল পড়ে পাতা নড়ে'' কবিতার বইয়ের সবকটি কবিতা।আমরা এই ডিজিটাল যুগে নিজেদের প্রচার নিজেরাই করি এবং সেটি বিশেষ গর্হিত কাজও নয়। ফেসবুক বা অনান্য মাধ্যমগুলি তো যোগাযোগ এবং খবরাখবর দেবারই মাধ্যম। ব্যাপারটি আজ স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু আমরা বোধহয় মনে রাখছিনা সবাই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নেই বা থাকলেও অনেকসময় নিজের মুদ্রাদোষে সরব নন। আমাদের মনে রাখতে হবে পাঠকদেরও একটা দায় থাকে ভালো লেখা খুঁজে বার করার, সম্পাদকদেরও দায় থাকে ভালো লেখককের ওপর যথাসাধ্য আলো ফেলার।সাইন্যাপস্ পত্রিকার প্রথম ওয়েব সংখ্যায় এইরকম একজন কবির কবিতা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সম্ভাব্য অগণিত পাঠকদের সামনে উপস্থিত করতে পেরে আমরা আনন্দিত। আশা রাখি পাঠ শেষে আপনারা মন্তব্য রেখে যাবেন কবি সুকান্ত সিংহের কবিতা নিয়ে। আসুন খুব নিরুচ্চার এক কবির কবিতায় আমরা প্রবেশ করি।
কবি সুকান্ত সিংহ
জন্ম ১৯৭৪
জন্ম ও বসবাস পশ্চিম মেদিনীপুরে।
প্রকাশিত কবিতার বই
তৃণার জন্য রোদ্দুর
কবিতা পুস্তিকা
একলা সাঁকো
তোমার কাছে
জল পড়ে পাতা নড়ে
যোগিয়া
ছড়ার বই
ও পাখি আমার পাখি
গদ্যের বই
অনুপম শোনো
বিবেকানন্দ - শিমলা থেকে শিখরে
১
মাথার পিছনে কোনো অলৌকিক আলো নেই
যা আছে তা আহত হবার এক দীর্ঘস্থায়ী
অহংকার বোধ।
আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে জল নয়, গলে যায়
দুপুরের শ্বাস, মাঝরাতের নির্জনতা।
সমস্ত জীবন জুড়ে আলিঙ্গন করে আছে
ভয় নয়, - সহ্য।
যা কেউ এসে ভেঙে দেবে
২
আগুনের কাছে এসে নত হই,
সচেতন ভেতরে ভেতরে!
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
৩
চালধোয়া জল দিয়ে
হর-গৌরী বাঁচিয়ে তুলেছো,
এখনো জোড়াশালিক দেখতে না পেলে
সারাদিন ভয়ে ভয়ে থাকো,
সম্পর্কে বুঝি আজো
বাসাবদলের শব্দ ভেসে আসে
৪
শ্রাবণের দিন জুড়ে বসে আছে
মন খারাপ, চৈত্র দুপুর
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
৫
সমস্ত দুপুর জুড়ে নির্জনতা
বসে থাকে আমার কাছেতে,
ছায়ার বিস্তার জানি
সন্ধ্যার গল্পে শেষ হয়,
আমাকে দেখতে দাও অন্ধকারটুকু
দেখতে দাও দিনের প্রণাম
৬
সারা রাত জেগে, ঘরে ঘরে,
পাখিদের বাসা বোনে সেলাই মেশিন
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
৭
ঘুমের ভেতর থেকে সাড়া দিই।
ঘুমের ভেতর থেকে সাড়া দিই
অবিরত বয়ে চলা বাতাসের ডাকে।
যে শরীর ঢেকে রাখি এক বিঘৎ
প্রশ্বাসের মাপে, সে শরীর ভিন্ন হয়ে
সরে যায় দূরের পাহাড়ে।
যূথছুট হস্তিনীর মতো পরিত্যাগের
গন্ধে জড়সড় শরীরের দ্বিধা
মুছে দিতে সাড়া দিই
৮
আত্মজীবনীর থেকে নেমে যাওয়া
ঝুরি ধরে দোল খায় বিকেলের মরারোদ,
ছেঁড়া ঘুড়ি, পুণ্যিপুকুর
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
৯
পাথর ভাঙার দেশে অন্ধ ছেলেকে তুমি
নিয়ে এসেছো।
মা, আমাকে ঘিরে রাখো,
ঘিরে ঘিরে রাখো,
তোমার আঁচল জুড়ে একটু ঘুমোবো
ঘিরে রাখো,
যে রকম গান থাকে স্বরলিপি জুড়ে
১০
একা একা দাঁড়িয়ে আছো
কিশোর দেবতা,
দেখছো,
তালা ও চাবির দেশে
কড়ানাড়া দূরে সরে আছে!
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
১১
মৌনতা তুলে দিই
কিছু বলবার অজুহাতে
১২
ঘরের ফাটলে রাখি ঈর্ষা-ক্রোধ-ঘৃণা
মাঝে মাঝে নিঃসঙ্গ হলে
তারা সব বেরিয়ে এসে আমাকে দংশন করে
আবার ফাটলে ফিরে যায়
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
১৩
অসুখের অজুহাতে আসি।
ওষুধের গন্ধভেজা হাত দিয়ে
স্পর্শ করো।
বেশ। কিছুই হয়নি যদি,
আশার ইচ্ছেটুকু সারিয়ে দাও দেখি
১৪
কপালের কাটা দাগ দেখে চিনে গেছি
গত জন্মে তুমি ছিলে
গুণিনের ক্ষয়াটে স্যাঙ্গাৎ
ফিরে এসো, দ্যাখো তোমার গল্প শুনতে
এক পোতে বসে পড়ছে
রোদ জল ধুলো ঝড় কাদা
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
১৫
গান ফেরাচ্ছ তুমি।
মনসা মঙ্গল।
সাপে কাটা সন্তানের মুখ
ভেসে আসছে।
আসর জানে না।
১৬
চলো খুঁজে আনি কবেকার
ভাসানো কাগজের নৌকো,
কখন জমেছে মধু নিজের কোরকে
চলো দেখে আসি,
এই জল কাদা ঘুম দেশে চলো
মাদলের শব্দ হয়ে ঘুরে ঘুরে নাচি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ছবি - ফেসবুক থেকে
4 মন্তব্যসমূহ
উজ্জ্বল উদ্ধার। আপনাদের ধন্যবাদ প্রিয় কবির এই কবিতাগুলো পাঠ করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
উত্তরমুছুনআহা! এমন কবিতার কাছে হাত পেতে গ্রহণ করি জীবন।
উত্তরমুছুনআহা! এমন কবিতার কাছে হাত পেতে গ্রহণ করি জীবন।
উত্তরমুছুনআহা! কত স্নিগ্ধ, কত সুন্দর!
উত্তরমুছুন