কবিতা ভাবনা ৫ ।। অমিতাভ দাস |
সঙ্গে থাকবে তার নিজের স্বনির্বাচিত
একটি বা দু'টি কবিতা, যা প্রতিনিধিত্ব করবে
কবির কবিতা-দর্শনের।
সাইন্যাপস্ পত্রিকার জন্য এই কলামের
চতুর্থ কবিতা ভাবনা লিখলেন
হাবড়ার সুপরিচিত কবি অমিতাভ দাস।
সাইন্যাপস্ পত্রিকা কবিতা ভাবনা ৫
কবিতা ভাবনা
(ক) কবিতা
একটা পথ
আমি কবিতা কখনো জোর করে
লেখার চেষ্টা করিনি। কবিতা সর্বদাই ভেতর থেকে এসেছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কয়েকটা পংক্তি চলে
আসে — তারপর নির্মাণ। মানে একটু গুছিয়ে লেখা। কতটুকু লিখব, কতটুকু
বা বাদ দেব। কীভাবে সাজাব, কতটুকুই বা বলবো — এইসব আর কি!
জোর করে আমি লিখতে পারিনা, আমার আসে না। জীবন যা ধরা দেয়, জীবনকে যেভাবে স্পর্শ করেছি, অনুভব করেছি তারই কিছু
কিছু অংশ কবিতায় উঠে আসে। কবিতা আসলে কিছু মুহূর্তের আবেগ, অনুভব,
ভাবনাকে শব্দ দিয়ে সাজানো। নিজের সঙ্গে নিজের কথা মাত্র। যা একান্ত
সংগোপন।
কখনো কখনো মনে হয় হৃদয়ের গভীর থেকে কেউ যেন কথা বলছে অতি চাপা গলায়, চোখে তার জল। সে যেন কী
হারিয়ে ফেলেছে — সে যেন কিছু একটা খুঁজছে অথচ খুঁজে পাচ্ছে না। খুঁজেই চলেছে... এই
খোঁজার ছাপটা বা প্রক্রিয়াটাই হয়তো আমার কবিতা।
আমি কাকেই বা খুঁজছি,
আর কেনই বা খুঁজছি জানি না। জানা হয়ে গেলে কি
আর খুঁজতাম! এই খোঁজার মধ্যে আনন্দ আছে, বিষাদও আছে। আর
বিষাদ আছে বলে হয়তো এই খোঁজার মধ্যে একটা নেশা আছে, মধু আছে।
তখন খোঁজাটা হয়ে ওঠে মাধুর্যময়।
আমি কি কেবল
নিজেকেই খুঁজছি, নাকি আরো অন্য, আরো
ব্যাপক সেই খোঁজা! তার ব্যাপ্তি কোথায়?
কাঁদতে চেয়েছি
একটা ভাব, মহাভাব আসছে
রাধাভাব কি?
যা সারাদিন
আমায়
দৌড়ে নিয়ে চলেছে
চোখের জলের ভিতর
কোন
গভীরতম ছায়াপথ দেখি
নদী দেখি —
জল দেখি —
মাঝি নেই
পারাপার নেই — বস্তুত
কেউ নেই
আমি তার অশ্রু গভীরে
রাধাভাবে আকুল
এত কান্না পাচ্ছে কেন!
এতো বিশ্রী লাগছে কেন দিন!
আহত এক ‘আমি’ কে
খুঁজে চলেছি
যাকে আমি চিনি,
আবার চিনিও না
কেন খুঁজছি তাও তো জানিনা
খুঁজতে খুঁজতে
মায়া, বিচ্ছেদ-বিরহ-বিভ্রম
খুঁজতে খুঁজতে
পথ ও কখন যেন
কেঁদে উঠেছে আমার সঙ্গে..."
যাকে আমি খুঁজছি সে কি এসেছিল? এসে কী চলে গেছে? অথবা
আমি কি তার অপেক্ষায় ছিলাম কখনো? নাকি
সমগ্র জীবন ধরেই তার অপেক্ষা? এই অপেক্ষাই কি নিয়তি
নির্দিষ্ট? এই অপেক্ষাই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়—
তাকে চিনতে চাই
যাকে চিনি
তাকে চিনতে পারিনি এতটুকুও
যার চরণ ধ্বনি,
নুপুর-নিক্কন
চলে গেল রউদ্র-রাঙ্গা পথ ধরে
যার চলে যাওয়া
সহ্য হল না আমার
ঝরে গেল ফুল
দেখতে দেখতে
থেমে গেল কথা
যা শেষ হয়নি, বলা হয়নি
সবটুকু। অথচ
শূন্য নয়, শূন্য নয়
চলে গেল সে।
আমি তার ছায়া ধরে রাখতে গেলাম
আমি তার কথা ধরে রাখতে গেলাম
দরজা জানালায়
তার ছোঁয়া লেগে আছে
কতটা নিষ্ঠুর এই চলে যাওয়া
কতটা মধুর এই চুপ করে থাকা
তাকে তো চিনি না
চিনতে গিয়ে বেলা বয়ে গেল ।
তবু শূন্য নয়,
পূর্ণ করে দিয়ে গেল আমার বসত।”
আমার বাইরের আমিটাকে কিছুটা হলেও চেনা যায়, বোঝা যায়। আর ভেতরের আমিটাকে তো দেখা যায় না। বোঝা যায় শুধু। তাকে কি সঠিক ভাবে চেনা যায়? এক ধরণের বিপন্নতা বোধে সে যে আচ্ছন্ন...এক ধরণের অস্থিরতা...সে যে লেখে। সে যে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় তার বিপন্নতা, তার অস্থিত্ব, তার অনুভব। আমি তো লিপিকার মাত্র। সে যে কখন নির্দেশ দেবে, তা জানি না তো।
গিয়ে দাঁড়াই—
আলো থেকে আড়ালে চলে যাই
অপ্রস্তুত মনে হয়
নিজেকে গোছানো হয় না—
নিজেকে সাজানো হয় না—
ঠিকঠাক কথাটুকু
বলতে পারিনি আজো
কেবল আড়ালে থেকেছি..."
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
কে যে আমায় কাঁদায় আমি কি জানি তার নাম...তেমনি ভাবেই আমিও যে জনি
না কেন লিখি কবিতা? কেন, কীভাবে লিখি?
তখন সবে ক্লাস সিক্সে পড়ি। স্কুল পত্রিকা হাতে পেলাম। কত কবিতা। অথচ আমি যে
লিখতে পারি না। একদিন কী প্রবল ঝড়। জানালার কাছে বসে আছি। ঝড় দেখছি। লিখে ফেললাম
জীবনের প্রথম কবিতা—
এর পর থেকেই কবিতা সংক্রামিত হলো আমার ভিতর ঘরে।
যা লিখলাম তা কেন লিখির উত্তর নয়। কীভাবে এই রহস্য পথে এলাম তার কৈফিয়ৎ মাত্র। তাহলে কেন লিখি?
—
না লিখে পারি না তাই লিখি। এক কবি বন্ধু বলেছিল, যে ও কাঁদতে পারে না বলে কবিতা লেখে। আমি তো কাঁদতে পারি। অনেক কেঁদেছি। তাহলে?
আসলে আরো অনেক কথা আছে, ব্যথা আছে, না-বলা অভিমান আছে, অভিযোগ আছে, যা কবিতার ভিতর দিয়ে উঠে আসে। এসব যন্ত্রনাই কি কবিতা লেখায়? নিজের সাথে কথা চলে। নিজেকে বোঝাই। আত্মমোচন করি। নাকি নিজেকে খুঁজি — খুঁজতে
খুঁজতে বেলা যায়। এই প্রক্রিয়াটাই কি কবিতা লেখার উত্স! আসলে আমার যে যাপন তাই কি
কবিতা লেখা নয়। আমি তো সারাজীবন নিজেকেই রচনা করে গেছি। কেবল এই বেঁচে থাকা আর
ভুলজন্মের হিসাব খুঁজেছি। কেন অকারণ ভালো লাগে? কেন অকারণ
কান্না পায়? কেন এত এত এত ঝরে যায় পাতা?
আমি যতটা গভীর,
ঠিক ততটাই সহজ। আর এই যে গভীরতা বা সরলতা কোনোটাই আরোপিত নয়। যাঁরা
আমার সঙ্গে মিশেছেন, কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা জানেন যে আমার
ভিতর একটা ক্ষ্যাপাটে মানুষ বাস করে। তবে ক্ষ্যাপাটে হলেও সে বোহেমিয়ান নয়। স্বাধীন
ভাবে চলতে আর বলতে ভালোবাসি।
কখনো বানিয়ে বলার চেষ্টা করিনি। জোর করে লেখাটা আমার আসে না। যা আসে তা অন্তর
প্রদেশ থেকেই আসে। সহজ,
সরল লেখার চেষ্টা করে গেছি। পাঠকের কাছে পৌঁছতে চেয়েছি। আমি
পাঠকপ্রিয়তার কথা ভেবে লিখি না, লিখি মূলত নিজেকে প্রকাশের
জন্য। লিখি নিজের জন্য। যন্ত্রনাই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে। নিবিড় পাঠক মাত্রই
লক্ষ্য করেছেন যে, যন্ত্রনা আর তজ্জনিত বিষাদ আমার লেখার মূল
উপজীব্য।
অনেকেই বলেছেন যে,
আমি কেবল প্রেমের কবিতাই লিখেছি বা লিখে চলেছি। আসলে প্রেমট্রেম নয়,
কীভাবে বেঁচে আছি তা লিখেছি বা লিখে চলেছি। খুঁজে চলেছি অতীত
ঐতিহ্যকে। আমি তেমন কোনো বড়ো লিখিয়ে নই। তবে লিখতে খুব ভালোবাসি। আর সে কাজটাই করে
চলেছি গত ২৫ বছর যাবৎ। লেখাকে জড়িয়ে আমার বেঁচে থাকা,
আমার কথা সব।
(গ) অর্ধেক জীবন
লিখতে লিখতে ২৫ বছর। লিখতে লিখতে ১৬ টা কবিতার বই। লিখতে লিখতে ‘নির্বাচিত ১০০’ প্রকাশ পেয়ে গেল। অথচ আমি খুঁজে চলেছি। খুঁজে পেলাম কই। খ্যাপা তো আজো
পরশ-পাথর খোঁজে। কবি ইয়েটস তাঁর স্ত্রীকে মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, কবি যেদিন জেনে যাবেন কীভাবে কবিতা লিখতে হয়, তাঁর
বেঁচে থাকার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। আমি এখন জানি যে, কীভাবে
কবিতা লিখতে হয়।” এর সাতদিন পর তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি একজন
সাধক কবি ছিলেন। কবিতা লেখা তো সাধনাই। নিজেকে ভেঙে, ছিঁড়ে,
পুড়িয়ে, ক্ষয় করে চলা। ওই যে আগেই লিখেছি
আত্ম-অন্বেষণ। আমি যে লেখার চেষ্টা করেই চলেছি। তোমার কাছে যেতে চাইছি, নিজের কাছে যেতে চাইছি। তুমি কি আমার ঈশ্বর? আমার
পরম? এই প্রশ্নে ভিতরমহল উন্মুখ হয়েছে কতকাল।
কবির প্রতিনিধিত্বমূলক একটি কবিতা
আকন্দ-ভৈরব
সুন্দরী সকালবেলা আমাকে কবিতা শোনালো।
কবিতা থেকে উঁকি দিলো বৃষ্টিভেজা এক
শ্রাবণ-কিশোরী।
সে কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ও শঙ্খ ঘোষ ছিলেন...
সুন্দরী বললে , করোনা
কাল কেটে গেলে
আমাদের দেখা হবে।
শীতের শেষ বিকেলে সিমলাগড় রাজাবাড়ির
নাটমন্দিরে...
হয়তো একদিন ইতিহাস খুঁজে নেবে সুন্দরীর
শরীরের চন্দন-গন্ধ।
সে বললে, কাটোয়া
লাইনের মোহনভোগ খুব বিখ্যাত।
করোনা-কাল কাটলে কালনার মাখা সন্দেশ...আহা...
লালজী মহারাজের খুব প্রিয়।
বর্ধমান-রাজ স্বপ্নে দেখেছিলেন একদিন।
অগ্রদ্বীপের মেলা , দাঁইহাটের
নবীন ভাস্কর...
ইতিহাসের ভিতর থেকে রাত্রির মতো কবিতা নেমে
আসে।
'শ্রাবণ
ঘন গহন মোহে' বিদ্যুৎ চমকায়
আর দেবী সিদ্ধেশ্বরী মাঝে মাঝে চুল ছেড়ে
গিয়ে বসেন গঙ্গাতীরে।
নিঝুম নিশিথে গঙ্গাজলে পা ডুবিয়ে সামনে তাকিয়ে
থাকেন
কখন মহাকাল আসবেন,
কখন জেগে উঠবেন তাঁর আকন্দ-ভৈরব...
অমিতাভ দাস |
10 মন্তব্যসমূহ
বেশ ভাল লাগল অমিতাভ তোমার লেখাটি পড়ে
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ মানসীদি। ভালো থাকবেন।
মুছুনকেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম লেখাটা পড়তে পড়তে।নিজেও তো খুঁজছি কবিতাকে কতদিন।সে যে সোনার হরিণ।সে যে লুকিয়ে থাকে প্রেমেনবাবুর তেলেনাপোতায়,কখনও বা তৃষ্ণাদির কোটি যোগনীর গলির ভেতর।আজীবনের এই খোঁজেই কবির মরণ (মৃত্যু নয়,বেঁচে থাকা অর্থেই), এই খোঁজ শেষ হলেই কবির বেঁচে যাওয়া (অর্থাৎ ইয়েটসের ভাষায় 'মৃত্যু')।কিন্তু এই বেঁচে যেতে কি একজন কবি কখনই চাইতে পারেন!না,'মরণ রে, তুহুঁ মম শ্যাম সমান'।খুব ভাল লাগল আপনার সাধনা।চরৈবেতি ।
উত্তরমুছুনএকজন প্রকৃত কবিই তো এইভাবে অন্বেষণ করে। খোঁজ করে। এভাবে ভাবতে পারে। অর্কায়ন তোমার এই গভীর জীবন অনুধ্যান ভালো লাগল।
মুছুনভালো লাগলো আপনার কবিতা লেখার গল্প। মহহ্মদ আনসারুলের -- বিভূতি কবির নয়, কবিতার" এই উপলব্ধি ভাবালো। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় সমস্ত শিল্পই শিল্পীর বিভূতি। তাঁর পথের আনুষঙ্গিক প্রাপ্তি। তিনি পৌঁছুতে চাইছেন বিরাট এর কাছে। বিভূতিকে আশ্রয় করা সেখানে পৌঁছানো যায় না।
উত্তরমুছুনমত ও পথের ভিন্নতা স্বীকার করে নিলে আমার এই বক্তব্যের সাথে যে কেউই ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন। তবুও যুক্তি পারম্পর্য আমরা অস্বীকার করা চলে না। উপনিষদ সরলভাবেই সেই পারম্পর্য মেনে বলছে -- এবং ত্বয়ি নান্যথেতহস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নরে। আমি যদি কিছুকে ধরে থাকি তবে তার সাথে লিপ্ত হয়ে আছি, ছেড়ে দিলে নেই।
আপনার কবিতা যাপন, খোঁজ, এর কথা পড়ে মনে হল আপনাকে এসব বলা যায়। অপরিচিত হলেও সেই খোঁজার সুত্রে আমাদের কিছু একাত্মতা আছে।
আন্তরিক শ্রদ্ধা নেবেন।
আমার এই কবিতা যাপন আপনাকে এভাবে স্পর্শ করেছে, ভালো লেগেছে এবং অন্তরকে স্পর্শ করেছে দেখে আনন্দ হচ্ছে। নানা মত, নানা ভাবনা থাকবে-- আমাদের কেবল লিখে যেতে হবে। ভালো থাকুন। আপনার মরমী ও মেধাবী বক্তব্য আমাকে ভাবিয়েছে।
মুছুনআকন্দ ভৈরব -- খুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনআকন্দ-ভৈরব আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। সেই গভীরতা সেই মগ্নতাকেই বারবার ছুঁয়ে চলা-- জীবন তো তাই--আর কী , আর কিছু নয়। ভালো থাকুন🙏🙏
মুছুনকবির কথা পড়তে ভালো লাগলো। অভিনন্দন।
উত্তরমুছুন— রাজদীপ ভট্টাচার্য
ধন্যবাদ রাজদীপবাবু, আপনি পড়লেন, ভালো লাগল। ভালো থাকবেন।
উত্তরমুছুন