সঙ্গে থাকবে তার নিজের স্বনির্বাচিত
একটি বা দু'টি কবিতা, যা প্রতিনিধিত্ব করবে
কবির কবিতা-দর্শনের।
সাইন্যাপস্ পত্রিকার জন্য এই কলামের
চতুর্থ কবিতা ভাবনা লিখলেন
চুঁচুড়ার প্রখ্যাত কবি দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য।
সাইন্যাপস্ পত্রিকা কবিতা ভাবনা ৪
কলমদানির গপ্পো
'কবিতাভাবনা'
বললেই ভয় হয়। যেন এক বিপজ্জনক কবিত্ব নিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে লিখতে
বসেছি। তা তো নয়! তবু একদিন কবুল
করতে হয়, রেসের মাঠ বা শেয়ার বাজারের লাভজনক জুয়া ছেড়ে অন্য
সকলের কাছে যা এক অচল আধুলি, হঠাৎ সেই কবিতার দিকে তুমি কেন
বাঁক নিলে। সে তো জুয়ার রানি জুয়া! কে সেই রাজ্ঞী, যে তাঁর
খুশিমতো তোমায় পুতুলভাবে সুতোয় টান দেয়?
কবিতা হল শব্দের,
ভাবের এক উচ্ছৃঙ্খল পারম্পর্য। বাঁধন নেই, তবু
তারা ভাবের পরম্পরায় বন্ধু যেন... কবিতা বোধহয় ভিতরে ভিতরে এক বদলে যাবার খেলাও --
পালতোলা সেই 'ভিতর'কে সর্বক্ষণ বহন
করার খেলা। বাজার
মাত করার কোনো ইন্ধন নেই তাতে। তুমি মাইকেল জ্যাকসন বা শাহরুখ খান নও যে অ্যালবাম
বা বই বেরোনোর আগে তাকে বাজারে তথা ফেসবুকে ঠুকে ঠুকে কালো করে দেবে। মঞ্চে আগুন
ধরিয়ে দেবে। বাজার জানে বিরিয়ানি, উলটো দিকে কবিতা হল
কুমড়ো ফুলের বেসনে-ডোবানো বড়া। তবু কেউ যদি তোমার লেখাকে ভালো বলে, কেউ যদি সাড়া দেয়, একঝলক ভালোবাসা উপুড় করে দেয় -
ভালো কি লাগে না তখন! কিন্তু সে আর কতটুকু সময়। পরক্ষণেই কেউ যেন ভিতর থেকে তোমাকে শাসায়,
সব ঝুটা হ্যায়।
শুধু মনন নয়, দেহ অবশ্যই আসবে কবিতায়। শরীরই, শারদীয়। এই শরীর
নিয়েই মেতে থাকা সুখে-দুঃখে। হাওয়ার চলনে বাঁশি হয়ে বাজা। তবে শরীরের কথা বলতে
গেলেই সে এমন বাঁধভাঙা কেশ ছড়িয়ে পথে এসে দাঁড়ায়, আর কোনো
আলোই পথ পেরতে পারে না। তাই একটু ছদ্মবেশে ছবিগুলো চালান করা যাক না হয়, যাতে সে মাঝপথে বামাল
সমেত ধরা না পড়ে।
গুণেগেঁথে কবিতা লিখতে
গেলে একদিন মনে হবে পণ্ডশ্রম করছ। যেন তুমি মাইক্রো আভেনে সুক্তো রান্না করতে
লেগেছ। তাপ বাড়বে না, উপচিয়ে যাবে না -- তা আবার
হয় না কি! আগুন যে পুড়িয়ে রাখ করতে পারে, তা কি জান না তুমি?
তাই বলে কি মা-ঠাম্মার উনোন ছাড়বে! বলো তো দেখি, তাতে কবিতার নামে এক বোবা ঈশ্বর গড়ে তুলবে না?
কবিতা যে লেখে, সে যেন এক ছবি আর ভাব ধরে রাখার আজব কল। সময় তার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাবার সময়
আঁকাবাঁকা কিছু আকারপ্রকার রেখে যায়। আভাস রেখে যায়। কিছু ব্যথা ও বিষাদ রেখে যায়।
কুলহারা গোপনতা ও প্লাবন রেখে যায়। কাশ্মীরের মন্দিরে ধর্ষিতা কিশোরীর কষ্ট,
বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের জালে ঝুলে-থাকা গুলিবিদ্ধ মেয়েটির মরণজ্বালা, সিরিয়ার শিশুদের কান্না, তাপসী মালিকের পুড়ন্ত
শরীরের দগদগে ঘা, অ্যামাজনের পশুদের তীব্র আর্তনাদ - সমস্ত বিষাদ সেই বিষাদকলসে
এসে জমা হয়। এত যে ছড়ি-ছোরার অশ্লীল
দাপট, এত যে অনর্থক যুদ্ধবাজি, সেসব
কি তোমার কবিতা নেবে না একেবারে? নিতে তাকে হবেই গো! ওই যে দেখো শুকনো রক্তের দাগ, ওই কলসের গায়ে। ভয় হয়, এত এত তথ্যে যদি কবিতা চাপা
পড়ে যায় শেষে! তাই জমা হোক নির্যাসটুকু। ওহ্ ভুলেই গিয়েছিলাম, শোনো, তুমি বিনয় মজুমদার নও, তাই কবিতায় 'যেহেতু' 'সুতরাং' উপপাদ্য লেখা
তুমি সামলাতে পারবে না। তুমি তোমার মতো হও। নামগুলো দেশগুলো মুছে যাক শুধু,
নিউজপ্রিন্টের সঙ্গে কবিতার খাতার এই তফাতটুকু থাক বরং। একদিন
সেগুলো তালগোল পাকিয়ে যদি বাইরে ছুটে আসে, এসে হতচকিত হয়ে
হঠাৎ মুখ ডোবায় সেই খাতার পাতায় -- তখনই কবিতা! নইলে সবই তো রচনা।
দেখো, বাড়ি
করতে গেলে যেমন কর্ণিক বাগানো শিখতে হয়, ওলন ঝোলানো শিখতে হয়,
মশলার ভাগ জানতে হয়, সেটুকু মিস্তিরিগিরি শিখে
নিলে মন্দ নয়। বেশি জানলে সে আবার তোমায় আঙুল হাঁকিয়ে কড়া নির্দেশ জারি করবে। তখন তোমার লেখাপত্রে গজগজ করবে ওলনের
অঙ্ক আর মশলার ভাগ। লেখার পিঠে পাটা ঠোকা বাপু সইবে না তোমার। ওটা হল সংসার
বাবুদের কাজ। সংসার বাবুদের দিয়ে কবিতা কি হয়, তুমি বলো?
সুখী
মানুষেরা কবিতা লেখে না। তারা
বেড়াতে গিয়ে ফাইভ পয়েন্ট সেভেন পয়েন্টে ঘুরে বেড়ায় আর হাতের কাগজে টিক মারে। সাড়ে
পাঁচটায় অফিস কাটিয়ে অন্যায়ভাবে বাড়ি ফিরে এসে মশারির ভেতর থেকে পুট পুট করে রিমোট
ঘুরিয়ে টিভি দেখে। এরিয়ার আর পে কমিশনের প্রেমে এমন আত্মহারা পাগলপারা হয়, যেন সে না-দেখা মিস ইউনিভার্স। উলটো দিকে, এক 'নেই' থেকেই তো মেঘ জমে, জল ঝরে!
কবিতার নারী কখনো সত্যি
হতে পারে, তুমি বলো! তারা তো আঁচলের ডানাওড়ানো দুঃখব্যথার পরি। তাকে কি পাওয়া যায়? যায় না বলেই তো উঠোন থই থই করে, কাঠচাঁপা ভেসে যায়
তাতে -- তোমার সেই কবিতার উঠানে।
কবিতার কোনো দাবি নেই, পক্ষ-বিপক্ষ নেই, জ্ঞানের বড়াই নেই। কী নিয়ে লিখবে
তা তোমার নিজের ব্যাপার। রোজকার ছোটো ঘটনাই সই, কিংবা কোনো
সার্বজনীন ব্যাপার-স্যাপার -- কবিতা যে বীজ নিয়েই লেখা হোক না কেন, এক
আদিগন্ত ক্যানভাস চাই তার,এক বিশাল প্রান্তর চাই। বিরাটের
সঙ্গে তার দেখা হতে হবে। তা
না হলে সেই খাঁ খাঁ প্রান্তে মানুষ গাছপালা ও পশুপাখিরা কার কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে
দাঁড়াবে! কোথায় সেই নিথর নৈঃশব্দ্য, এক কবিতা ছাড়া!
কী অপূর্ব গাছপালা, আর তার পাশেই কী অপূর্ণ আমাদের জীবন! সব কিছুই শেষ হয়ে যাবে একদিন। এই জগৎ
থেকে যাবে, তোমার লীলা শেষ হয়ে যাবে। তোমার প্রেমিকার শরীর
তোমার চোখের সামনে বিদায় নেবে। কেউ কি থাকতে আসে! মহাকালের পাশে এই যে তোমার
একরত্তি সময়ের খেলাঘর, তাও কি তোমাকে লেখার টেবিলে নিয়ে যায়
না -- বুকে হাত রেখে বলো তো! তোমাকেও সেই ছায়াঘুম প্রান্তরে একদিন হারিয়ে যেতে
হবে। চলো, হাত ধরো আমার -- তোমায় আমি কলমদানি দেব...
🚫
প্রতিনিধিত্বমূলক দু'টি কবিতা
স্বপ্ন
বলেছিলে
রাণুমাসি
প্রহর ছিঁড়ে হু হু করে জল। শ্রাবণদ্বীপের
বন্ধ দেরাজগুলো আজও অগোছালো। গুমখুনে ভরা এই মাঝরাত। হাতি বশ করত একটা মানুষ আমি
মনে মনে তাকে সদর দুয়ারে টেনে আনি। স্বপ্নের অবিকল রং পাতাপত্রে লেগে আছে এই
বাবুইকলস পৃথিবীর। রাণুমাসি গান শোনাবে একদিন - সেই দিন কাছাকাছি আসে
![]() |
দীপকরঞ্জন ।। মূল ছবি - ফেসবুক থেকে |
কবি পরিচিতি
দীপকরঞ্জন পেশায় একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট যদিও কবিতাই তার পাখির চোখ। এছাড়া শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, মণীন্দ্র গুপ্ত, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সহ বিশিষ্ট কবিদের গহন সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতাবই সাতটি, অনুবাদগ্রন্থ দুটি। চেতন-অবচেতনের শান্ত এবং স্রোতময় দরজাগুলোতেই তার নিঃশব্দ মাধুকরী।
মেষপালকের চিঠি নেই : কুবোপাখি প্রকাশন
আমার একটা ঈগল আছে : কুবোপাখি প্রকাশন
(ডায়ানাস ট্রি : আলেহান্দ্রা পিসারনিক)
বন্ধ্যাভূমি ও চতুরঙ্গ (সটীক। ভূমিকা শ্রী শঙ্খ ঘোষ) : ঋত প্রকাশন
4 মন্তব্যসমূহ
ভালো লাগল। গভীর ও মগ্ন যাপন না থাকলে এই দর্শনে যাওয়া যায় না। দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্যের প্রথম পাঁচটি কবিতার বই আমি পড়েছি , এমনকী আলোচনাও লিখেছি। কিছুদিন আগে 'রুপোলি মাছ' নামক অনুবাদ বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়াও লিখেছি। তো, আমার পছন্দের এই মগ্নচারী কবির কবিতা ভাবনা পড়ে আমি আনন্দিত। আমার বিশেষ ভালো লেগেছে।
উত্তরমুছুনআসলে কলম তো দুটো। একটা জীবিকার, অন্যটা জীবনের। যদি দুটো দোয়াতকে আলাদা রাখা যায়...
উত্তরমুছুনশরীরী কবিতামুখী মানুষের এই সংগ্রাম। সংবাদের আর দুঃখ পোষা কবিতাপংক্তির দোয়াত-কলম একাকার হলেই বিপত্তির ঘণ্টি বাজান এই কথক। গোপনে বাতলে দেন খবরের কোন নির্যাসটুকু বীজ বপন করে লেখনীতে।
কবিতাকে কতটা বুকে ধরলে এমন কথক হওয়া যায়!
ধন্যবাদ অমিতাভ। 'আশ্চর্য লন্ঠন' অবগুণ্ঠন-এ ছেপেছিলে তুমি।
মুছুনধন্যবাদ অসীম!
মুছুন