ছবি - সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা

কেন চেয়ে আছো গো মা

নবীন প্রজন্মের প্রতিক্রিয়া 

পায়েল লাহিড়ী


    ২৫শে জানুয়ারির সকাল, রোজকার অভ্যেস মতো খবরের কাগজে চোখ বোলাতে গিয়ে থমকে যেতে হল।  একবার, দু'বার, তিনবার, তবু যেন বিশ্বাস হয়না।  ঠিক পড়ছি তো? বোম্বে হাইকোর্টের নাগপুর বেঞ্চের একজন মহিলা বিচারপতি রায় দিয়েছেন পস্কো আইন অনুযায়ী 'Groping a minor's breast without ‘skin to skin contact’ is not sexual assault' অর্থাৎ জামার ওপর দিয়ে কোনো নাবালিকার স্তন  মর্দন যৌন নিপীড়ন নয়! 
    স্তম্ভিত হতে হল! একি ভয়ঙ্কর অন্ধকার সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা? যেখানে একজন মহিলা বিচারপ্রতি রায়দান করছেন একজন নাবালিকার ওপর শারীরিক নিপীড়ন নাকি নিপীড়ন নয় কারন তা জামার ওপর দিয়ে করা? তাঁর ত্বক স্পর্শ করেনি বলে সেটা নাবালক যৌন নিপীড়নবিরোধী আইনে অপরাধ নয়? এক্ষেত্রে মহামান্য বিচারপতির বক্তব্য যে উক্ত ঘটনাটিতে কোনো ডাইরেক্ট কন্ট্যাক্ট ঘটেনি! যদিও পস্কো আইনের ৭নং ধারায় কোথাও ডাইরেক্ট কথাটির উল্লেখ নেই তবু তিনি এবিষয়ে নীরবই থেকে গেছেন! তাই অপরাধী তিন বছর নয়, ভারতীয় দন্ডবিধির ৩৫৪ এবং ৩৪২ নং ধারা অনুযায়ী একবছরের সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করবেন! 

    অনেকের বক্ত্যবে অবশ্য অবাকই হতে হল যখন শুনলাম যে বিচারক তো শুধুমাত্র শ্লীলতাহানি বলে ছেড়ে দেননি বরং যৌন অপরাধ বলেই গণ্য করেছেন ঘটনাটিকে অতএব আইনত তিনি ভুল নন।  বেশ চমৎকার তো! আমার বিশ্বাস ছিল ২০১২ তে তৈরী পস্কো আইনের উদ্দেশ্যই ছিল নাবালক এবং শিশুদের যৌন নিগ্রহ থেকে সুরক্ষদান কিন্তু শুধুমাত্র আইনি শব্দের মারপ্যাচে তাঁর ভিন্ন ব্যাখ্যা আইনটির যৌক্তিকতাকেই পরিহাসে পরিণত করেছে! শিশুটির শরীর আর তারচেয়েও বড় কথা তার মন আজ নিগৃহীত? এঘটনা কি তার কাছে শুধুমাত্র আইনি পরিহাস? না! বিশ্বাস করুন কক্ষনো হতে পারে না! 

    ভীষণ ভয়ও পাওয়াচ্ছে ঘটনাটি! ওই বারো বছরের শিশুটিকে এবং তার সঙ্গে আমাদের মতো লক্ষ লক্ষ মহিলাদেরও! ভীষণ ভয়! এ কোন বিচার ব্যবস্থা? এই বিচার ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস করেই কি সত্যি সুরক্ষিত থাকতে পারব আমরা? সত্যি যদি কখনো আমার আপনার সাথে কোনো যৌন নিপীড়নের অপরাধ ঘটে আপনি কি চোখ বন্ধ করে সুবিচারের আশা করতে পারবেন? একবারের জন্যেও কি মনে হচ্ছে না যদি এই একই ঘটনা আপনার আমার সঙ্গেও ঘটে? এবং শুধুমাত্র আইনি শব্দের মারপ্যাচে ছাড়া পেয়ে যায় অপরাধী? 

    কী করব আমরা? আবার সেই একই নিপীড়নের শিকার হওয়ার  অপেক্ষা এবং সুবিচার পাওয়ার আশায় থুড়ি দুরাশায় ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকা? আর ছাড়া পেয়ে যাওয়া সেই অপরাধী? ছাড়া পেয়ে যাওয়ার আনন্দ কি তার লোভ বাড়িয়ে দেবে না? অপরাধের চেয়েও অপরাধ করে ছাড়া পেয়ে যাওয়ায় নেশা বেশি, তাতে অনেক বেশি এডভেঞ্চার! কী দারুন না! 

    একটা কথা ভাবুন তো এই সহজ সত্যিটা আমার মতো আইন সম্বন্ধে প্রায় অজ্ঞ একজনের মাথায় আসতে পারে আর একজন হাইকোর্টের বিচারপতির কি এটুকু দায়িত্ব থাকতে নেই যে শুধু শব্দের যৌক্তিকতা নয় আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বাস্তবতাকে অনেক বেশি প্রাধান্য দিতে হত? 

    একজন নারী হিসেবে বিশ্বাস করুন ভীষণ ঘেন্না হচ্ছে! আর মজার কথা হল খুব সহজেই যাদের পণ্য করে এই সমাজ, খুব অল্পতেই বৈষম্য টানা যায় যাদের ওপর, প্রশ্ন তোলা যায় যাদের অধিকার নিয়ে তাদের কথা ভেবে একজন বিচারপতি, অবাক হতে হলেও একজন মহিলা বিচারপতি আর একটু সহমর্মিতা দেখাবেন না এ কথা ভাবাই অবিশাস্য! 

    সত্যিই ভীষণ হাস্যকর কথা, 'মহিলাদের প্রতি সহমর্মিতা' কিন্তু একটু থেমে কথাগুলি আবার পড়ে দেখুন, মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের ঠান্ডা স্রোত নেমে আসবে।  কিন্তু এই এতকিছুর পরেও আমরা কী করব? 

    আমার বিশ্বাস কিছুদিন কথা হবে, ভীষণ বিতর্ক, অগ্নিগর্ভ আলোচনা এবং তারপর স্যোসাল মিডিয়ায় আবারও কোনো নোংরা মেসেজ পেয়ে আমরা গুটিয়ে যাবো। ট্রেনে বাসে অস্বস্তিকর স্পর্শে কুঁকড়ে যাব। পরিচিত কোনো মুখোশের নোংরা ইঙ্গিতে আবারও লজ্জা পাবো এবং সরিয়ে নেবো  নিজেদের । তারপর সবাই ফের আশা করব সুবিচারের যতদিন না আবার কোনো রায়দানে হয়ত কন্ডোম পড়ে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকে ঠিক পুরোটা ধর্ষণ বলা হবে না। ছিঃ! 🚫

আনন্দবাজার পত্রিকা/১৪.০২.২০২১/পৃষ্ঠা ৮