গল্প।। অন্য খুনি ।। মৌসুমী ঘোষ
বাবার মৃত্যুর পর আমি সর্বপ্রথম খুন করেছিলাম মায়ের কান্নাটাকে। দুর্ভাগ্যের বিষয় সেটা ছিল আমার প্রথম কান্না খুনের চেষ্টা। তাই প্রথমবারে আমি সফল হতে পারিনি। আমি যে প্রথম বারেই সফল হতে পারিনি সেটা আমি অবশ্য প্রথমে বুঝতে পারিনি। কারণ সন্ধ্যেবেলা বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যাবার পর পরই মা যখন কাঁদতে কাঁদতে বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল তখন আমি ঠিক করলাম মায়ের কান্নাটাকে এখনই খুন করতে হবে। সবার অলক্ষ্যে ঘটনাটা ঘটাতে চেয়েছিলাম বলে, মাকে ডেকে নিয়ে গেলাম পাশের ঘরে। তারপর মা বুঝে ওঠার আগেই গলা টিপে খুন করলাম কান্নাটাকে।
বাবার আর মায়ের কান্নার
পারলৌকিক ক্রিয়া সমাধা করার পর একদিন রাতে মায়ের পাশে শুয়ে টের পেলাম মায়ের
দীর্ঘশ্বাস পড়ছে। এখনই মায়ের কান্নাটা ফিরে আসবে বুঝতে পেরে মায়ের মুখে হাত চাপা
দিলাম। টের পেলাম আমার হাতের তালুতে উঠে আসছে মায়ের গলায় জমে থাকা কান্নার কম্পন।
রাতের অন্ধকারে তৎক্ষণাৎ গলা টিপে ধরলাম মায়ের শ্রাদ্ধ হয়ে যাওয়া কান্নার।
সেদিন সারারাত আমি ঘুমাতে
পারলাম না। আধো ঘুমে সারারাত শুনলাম কান্নার ভৌতিক আর্তনাদ, “আমাকে মেরে ফেলোনা, আমাকে এখনি মেরে ফেলোনা।”
অলৌকিকতায় আমার তেমন বিশ্বাস নেই। তাই মায়ের কান্নার ভৌতিক আর্তনাদকে
আমি মোটেও আমল দিলাম না।
পরবর্তী সময়ে আমি আর মা
ব্যাঙ্কে, পোস্টঅফিসে, ইলেক্ট্রিক
অফিসে, মিউনিসিপ্যালিটিতে, গ্যাসের
ডিলারের দোকানে, টেলিফোন অফিসে বারে বারে গেছি, অপেক্ষা করেছি ঘন্টার পর ঘন্টা। মাকে দেখেছি ক্লান্ত হয়ে পড়তে। কিন্তু
কাঁদতে দেখিনি ক্লান্তির কষ্টে। এইসময়ে মাকে টিভিতে মীরাক্কেল দেখে, সিডিতে ভানুর কমিক শুনে, ফোনে নাতির দুষ্টুমির কথা
শুনে হাসতে দেখে নিজেকে সাকসেস্ফুল খুনি ভেবে গর্ব অনুভব করেছি মনে মনে।
আসল ঘটনাটা ঘটল বাবা মারা
যাবার মাত্র একবছরের মাথায়। দিদির ছেলের পৈতের অনুষ্ঠানে এক ঘর কুটুমের সামনে
দিদির স্পষ্টভাষী ননদ বলেই ফেলল, “আপনারা মা-মেয়ে কিন্তু খুব
শক্ত।” কথাটা শুনে মা প্রথমে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে
তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। আমিও তখন মায়ের দিকে বেশ নিশ্চিন্তেই চেয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।
কিন্তু মা আমার থেকে চোখ সরিয়ে দিদির চোখে চোখ রাখতেই কেঁদে ভাসিয়ে দিল পৈতে বাড়ির
আনন্দ। আমার তখন কি-ই বা করার থাকতে পারে। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি মায়ের বাবার জন্য, আমার জন্য কান্নাগুলোকে
দুবারের চেষ্টায় খুন করতে পারলেও আমি মায়ের অন্য আরো সব কান্নার কথা ভুলেই
গেছিলাম। তবু একজন সফল খুনি হবার কথা মাথায় রেখেই আমি কুটুমকূলের সামনেই গলা টিপে
খুন করলাম মায়ের অন্য কান্নাকেও। আমাকে সে সময় খুন করতে অবশ্য সহযোগিতা করল আমার
দিদি।
এরপর মা যখন অসুস্থ হয়ে
হাসপাতালে ভর্তি হল মায়ের সে কী কষ্ট সারা শরীরে। আমি হাসপাতালে রোজ গিয়ে মায়ের
কষ্ট দেখে বলতাম, “মা তোমার কান্না পাচ্ছে না!!” মা মুচকি হাসত।
আমি হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসে দিদিকে বলতাম, “দিদি, মায়ের এত কষ্ট হচ্ছে, কী
করে কমবে বলত?”
দিদি বলত, “যতক্ষণ না মা নিজের জন্য
কাঁদবে মায়ের এই কষ্ট থেকে মুক্তি নেই। তুই তো একবার মায়ের বাবার জন্য কান্না,
একবার আমাদের জন্য কান্না আর শেষবার নিজের জন্য কান্নাটাকে আলাদা
আলাদা করে খুন করেছিস। মায়ের নিজের জন্য জমানো কান্নটাকেও সেদিন সর্ব সমক্ষে খুন
করলি আমাদের বাড়িতে, মনে পড়ে তোর!”
আমি দিদির কথা শুনে বুঝতে পারলাম, তিন তিন বার
আমি মায়ের একটা ভেবে তিন তিনটে কান্নাকে খুন করেছি। মা কিছুটা ভালো হয়ে উঠল । মাকে
বাড়ি আনা হল। মা মায়ের বাড়িতে একদিন দেওয়ালে টাঙানো বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে মারা
গেল।
বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজন মায়ের জন্য কাঁদতে লাগল। আমি বুঝতে পারছিলাম
দিদি কান্না চাপছিল। কারণ ততদিনে অনেকেই কান্না চাপতে শিখে গেছে। ওকে ডেকে নিয়ে
গেলাম পাশের ঘরে। দিদি ডুগড়ে ওঠার আগেই আমি পেশাদার খুনির মতো গলা টিপে একবারের
চেষ্টাতেই মেরে ফেলতে গেলাম দিদির মায়ের জন্য কান্নাটাকে। দিদি বলল, “আগে তোর বুক চাপা কান্নাটাকে খুন কর।” আমি দিদিকে জড়িয়ে ধরে প্রথমে হাউ
হাউ করে মায়ের জন্য কাঁদলাম। তারপর নিজেই নিজের মায়ের জন্য কান্নাটাকে দম বন্ধ করে
খুন করলাম এবং প্রথম চেষ্টাতেই খুনটা করতে পারলাম বলে বেশ আনন্দ পেলাম। খুন করার
পরেও একটা আনন্দ হয় বইকি। সেটা চাপা কান্না খুনের আনন্দ।
মায়ের মৃত্যুর মাত্র নয়
বছরের মাথায়, জামাইবাবু মারা গেল গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে। সেদিন
দিদির স্পষ্টভাষী ননদ হাউ হাউ করে কাঁদলেও, দিদির সুন্দরী জা,
জামাইবাবুর ভাই চাপা কান্নায় কষ্ট পাচ্ছিল। থমথমে পরিবেশ দেখে বুঝতে
পারলাম, প্রিয় মানুষের জন্য মানুষের কান্নার ধরণ পাল্টেছে।
সবে যৌবনে পা দেওয়া বোনপোকে পাশের ঘরে ডেকে বললাম, “বাবু কষ্ট হচ্ছে?”
সে বলল, “হ্যাঁ।”
আমি বললাম, “কাঁদ, কষ্ট
কমবে।”
সে বিচক্ষণের মতো বলল, “আমি কারো
সামনে কাঁদতে পারি না।”
দিদি মুখ-চোখ ফুলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। অথচ চোখে জল নেই। খানিকবাদে দেখলাম বাড়ির কারো চোখেই আর জল নেই। আমি দিদির হাউ হাউ করে চোখ জলে ভেসে যাওয়া কান্নার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কারণ বাবার মৃত্যুর পর থেকে কান্না-খুন চেপে বসেছে আমার মাথায়। 🚫
9 মন্তব্যসমূহ
ভাল লাগল। রূপকাশ্রয়ী এই গল্প মানব মনের গভীর এক পরিবর্তনকে তুলে ধরেছে। পরিবর্তনটি ভাল নাকি খারাপ, সে-বিচার অবশ্যই আপেক্ষিক বলে আমি মনে করি। কিন্তু মানুষের আবেগের চরিত্র, ব্যথাবোধের চরিত্র ও সেসবের প্রকাশ যে বদলাচ্ছে, তা আমরা প্রতিদিন দেখছি। আমাদের রোজের দেখা অথচ নোটিশ না-করা খুব গুরুত্বপূর্ণ সেই দিকটিই মুনশিয়ানায় এই গল্পে ধরেছেন লেখক।
উত্তরমুছুনতোমার এই গল্পটা আগে শুনেছি। এবার পড়লাম। তোমার অন্যান্য গল্পের মত এ গল্পও বেশ অন্যরকম। তোমার লেখায় নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া যায়।
উত্তরমুছুনভাষাহীন বলব নাকি কান্নাহীন। হ্যাঁ এমন গল্প পড়লে কত দুঃখই তো উথলে ওঠে আর হাউ হাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কাঁদি না। কে জানে আশপাশে ঠিক কেউ না কেউ 'আর কাঁদিস না' বলে কান্না খুন করতে এগিয়ে আসে....
উত্তরমুছুনভাল থেকো... অনেক ভালবাসা রইলো ❤️
সত্যিই মন কেমন যেনো হয়ে গেলো। অসাধারণ লাগলো! আমি তো শত চেষ্টা করলেও কান্না থামাতে পারি না। গল্পটা পড়ে চোখে জল এসে গেল........
উত্তরমুছুনভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনভালো লাগল। সবথেকে ভালো লাগল লেখকের আপাত নিস্পৃহ কথনভঙ্গী।
উত্তরমুছুনপড়ার পর দীর্ঘশ্বাস পড়ল। গল্পকারের গল্প বলার নিজস্ব একটা ঢং আছে। এই গল্পে এই গল্প বলার ঢং বা প্রয়োগরীতিই প্রধান যে ক্ষমতার বলে পাঠককে গল্পের পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। যদিও এ পরিনতি অবসম্ভাবী ছিল।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো। রূপকের মাধ্যমে এক মায়াবিস্তারী রোদ শীত ভুলিয়ে দিল কিছুক্ষণ।
উত্তরমুছুনকান্না চাপতে চাপতেই আমরা কান্নার দিকে এগিয়ে চলি। এর নামই জীবন।
উত্তরমুছুন