সাইন্যাপস্‌ প্রবন্ধ ২ ।। বসন্ত নেই কো
কিন্নর রায়

    গরমে মর্নিং স্কুল সাড়ে ছ'টায়। শীতে আধঘন্টা এগিয়ে, ঠিক সাতটায়। বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয় সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র ইস্কুল, যার কোনো ঘেরাবন্দি নেই, বাউন্ডারি ওয়াল, উঁচু পাঁচিল, পোক্ত-দেখনদার লোহার গেট, গেটের দারোয়ান - দ্বাররক্ষক, কিছু নেই।

    আশুতোষ ভবন, বামাচরণ ভবন, বঙ্গশিশু ভবন (বেশ কয়েক বছর পরে যা তারাকুমার ভবন) প্রবোধ ভবন — সব মিলিয়ে আলাদা আলাদা চারটে বাড়ি। প্রবোধ ভবন তৈরি হল সবার শেষে, ষাটদশকের মাঝামাঝি সময়।
বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয় ।। তারাকুমার ভবন
ছবি - আন্তর্জাল
    কেন নেই বাউন্ডারি ওয়াল, বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়-এর? নিজেকে এই প্রশ্ন করেছি নানা সময়ে। যাঁরা জমি দান করলেন এই শিক্ষায়তনের জন্য, তাঁরা কি এক লপ্তে, এক সঙ্গে দিতে পারলেন না জমি, নাকি এই স্কুল যাঁরা তৈরি করলেন, শিক্ষাব্রতী মোহিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বনবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায় — তাঁরা সকলেই রবীন্দ্রনাথ ও শ্রী অরবিন্দের চিন্তা-চেতনার অনুসারী, তাহলে তাঁরাই কি বেড়া হীন, অর্গল শূন্য, শান্তিনিকেতনী ছায়াপাত নিয়ে এলেন এই বিদ্যালয় নির্মাণ চিন্তায়?

    আমার অবশ্য কেন জানিনা প্রথম কারণটিকেই  অর্থাৎ জমি যাঁরা দান করলেন স্কুলের জন্য তাঁদের জমি একলপ্তে না থাকার কারণকেই বাউন্ডারি ওয়াল না থাকার প্রকৃত কারণ মনে হয়।

    শীতের সকালে ষষ্ঠীদা, তিনি আমাদের স্কুল শিক্ষক, রোগা, প্রায় বারোমাসই মাথা, কান বন্দি করা মাফলার, নস্যি রঙের ফ্লানেল শার্ট, অবশ্যই শীতে, আর তার কাছাকাছি রঙের ফুলপ্যান্ট, পায়ে কালি-পালিশে  সে বুট পালিশ, 'বিল্লি', 'কোবরা' বা 'ফক্স' হতে পারে, আবার 'চেরি ব্লসম'ও হতে পারে, সেই চকচকানি শু, 'বাটা'-রই মনে হয়, সেই ফিতে বাঁধা জুতো পায়ে প্রায় দৌড়।

    ষষ্ঠীদা ছুটছেন, শীর্ণ তাই দীর্ঘকায় মনে হয় আরও বারোমাসই তাঁর ছোটা, 'ছুটে চলা'। সঙ্গে একটি ছ-সাত বছরের বালক, পুত্র সন্তান। সেও স্কুল যাচ্ছে, মাস্টারমশাই বাবার সঙ্গে, ছাত্র হিসাবে।

    কিন্তু এ সবের সঙ্গে বসন্তের কী সম্পর্ক? আছে, আছে। নিশ্চয়ই আছে। শীতের পরই তো কোকিল ঋতু। বসন্তের কোকিল, যাকে নিয়ে দারুণ লেখা বসন্তের কোকিল - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। 'বসন্তের কোকিল, তুমি শীত বর্ষার কেহ নয় . . .' মনে আছে অনেকেরই।

    বসন্ত মানেই দোল, হোলি, বসন্ত উৎসব। তখন মানে, ষাট-সত্তরের দশকে পলাশফুল,  অরগ্যানিক আবির, আবির-রঙ দিয়ে গালে খুব ছক বন্দি নকশা  টানটোন, এসব তখন তো ছিলই না।

    দোল মানে হুড়দ্দুম রঙবাজি, পিচকিরি। টিনের, প্লাস্টিকের, পেতলের। পেতলের পিচকিরি দারুণ বিক্রি হয় ইঞ্চির হিসাবে বড় বাজারে। একটা মাঝারি সাইজের পেতল-পিচকিরি বা পিচকারি প্রায় একশো টাকা। বড় পিচকিরির দাম অনেকটাই বেশি।

    পিতল বা পেতলের পিচকিরির ভেতর চামড়ার ওয়াশার। ফলে তা থেকে ছুঁড়ে দেওয়া রঙের ফোর্স অনেক বেশি। তার মুখের ঝাঁঝরি আর একনলা নজল বদলে দেওয়া যায় ইচ্ছেমতো।

    ১৯৬৫-১৯৬৬ সালে টিনের পিচকিরি দু'টাকা, তিন টাকা। তার ওয়াশার বানিয়ে নিতে হয় ন্যাকড়া পাকিয়ে। জলে ভিজিয়ে ফুলিয়ে নিতে হয় তাকে।

    শীত-গ্রীষ্ম বারোমাস রাস্তায় 'লেসন'  পড়া বলতে বলতে, বলাতে বলাতে ছোটেন ষষ্ঠীদা। তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করেন। স্কুলের ছাত্রদের জন্য অনবরত গ্লোবিউল টর্চার। হাঁ করতে হয় প্রায় সবাইকেই, ক্লাসের মধ্যে, সামান্য হাঁচি দিলেই বা একটু ঝিমিয়ে চুপচাপ বসে থাকলে।

    বঙ্গশিশু ভবনের পেছনে প্রায় রাস্তার ওপর ঝুঁকে নামা রাধাচূড়া। তার হলুদ ফুলে বসন্ত। সেই ফুল থেকে ফল নিচে পড়লেই তার খোসা সরিয়ে আমাদের কাটাকুটি-উৎসব। এই ফল দেখতে অনেকটা যেন বাদাম। তার ভেতর কাটাকুটির খেলার পরাগ।

    বসন্ত মানে পাড়ায় পাড়ায় টিকে দিদিমণি। তাঁরা সবাই বালি মিউনিসিপ্যালিটি থেকে স্কুলে স্কুলে। বাঁ হাতে খচখচ খচখচ। স্ক্রু স্ক্রু দেখতে যন্ত্র ঘোরান  খচখচ । ব্যথা। কখনও পেকে ওঠা। কখনও নয়। বাড়িতেও যান তাঁরা। বাতাসে ওড়ে লাল কাপড়ের ওপর সাদা হরফে  বসন্তের টীকা নিন।

    সেই চামড়া কাটার টীকা যন্তর ঘোরানোর আগে তুলো, স্পিরিট, ওষুধ। ঠান্ডা ঠান্ডা, স্পিরিটের গন্ধ। টীকা সধারণভাবে বাঁ হাতে। দিন দুই জ্বর জ্বর। টীকা দুইটি পাকিয়া পুঁজ বিশিষ্ট, টসটসে। লালচে ভাব তাদের ঘিরে। বগল পর্যন্ত টাড়স। জ্বর। জ্বর, জ্বর। বেশি ব্যথা হলে চন্দন পাটায় সাদা চন্দন কাঠ ঘষে ঘষে, বেটে বেটে সাদা চন্দন। থুপ থুপ করে পুঁজিয়ে, ফুটে- ফুলে ওঠা টীকা ঘা-তে শীতলতা, যন্ত্রণা-প্রলেপ। পাথরের চন্দন পিঁড়ি তখন হিন্দু বাঙালির ঘরে ঘরে। রাশান টীকা কখনও ডান হাতেও।
 ১৯৬৫ সালের একটি ভ্যাকসিনের লেবেল।
১৯৬৫ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের
উল্লেখ আছে। আছে নির্ভয়ে টীকা নেবার কথা।
ছবি - আন্তর্জাল
 
    
    তখনও স্মল পক্স, চিকেন পক্স  এই বসন্ত দিনেই। সঙ্গে পান বসন্ত, মুসুরি বসন্ত। পক্স-বসন্তকে 'মায়ের দয়া' বলার রেওয়াজ তখন।

    কুড়ির দশকে বসন্ত  স্মল পক্সের এক ভ্যারাইটি রক্ত চামদল। সে নাকি হয় চামড়ার নিচে। ভেতরে বসে যায় গুটি, বেরয় না। পরে সারা গা, চোখ ফেটেও নাকি বেরিয়ে আসে রক্ত। রক্ত।

    রক্ত চামদল হলে সাধারণভাবে মৃত্যু এসে যায়। এমনই শুনেছি। স্মল পক্সে জীবন যায়। স্মল পকসের লোকাল নাম, সাধারণ মানুষের মুখে মুখে মুসুরি বসন্ত। মুসুর ডাল যেমন  এমন তার দানা। তাই মুখে মুখে মুসুরি বসন্ত।
    স্মল পক্স খুব ছোঁয়াছে।
    
    ষাটের দশক শেষেই এল রুশ  রাশান টীকা। বাঁ হাতে দুটোর বদলে একটা। স্ক্রু কায়দার টিকে মেশিন ঘোরানোর বদলে একটা অতি সূক্ষ্ম ছুঁচাল মুখ ছুরি কাম ছুঁচ দিয়ে খচখচ খচখচ করে খানিকটা কেটে নিয়ে টীকা করণের ব্যবস্থা। তার আগে অবশ্য মেথিলেটেড স্পিরিট মাখা তুলোর শিহরন হাতের ওপর।

    রাশান বা সোভিয়েত টীকাতেও জ্বর, শাদাটে পুঁজ, পেকে ওঠা কখনও কখনও। তখন তো পঞ্চমে কু ডাক দেয় কোকিল। পুং কোকিলের গলাতেই বসন্ত রাগ।

    এই বসন্তেই তো 'বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ'  স্প্রিং থানডার। 'কমরেডো অর দোস্তোঁ ইয়ে রেডিও পিকিং হ্যায় . . .' ১৯৬৭ মার্চে প্রথম যুক্তফ্রন্ট। তার আগে ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলন - ফুড মুভমেন্ট।

    ১৯২০, ১৯৩০, ১৯৪০ এর কলকাতায় রক্তচামদল প্রবল। তখনও বসন্ত, 'মায়ের দয়ার' চিকিৎসা বলতে শীতলার বামুন বা শেতলার বামুন। তিনি অনেকটা যেন কবিরাজ। বটুয়ার ভেতর জড়িবুটি, প্রলেপ ইত্যাদি নিয়ে রোগীর বাড়ি বাড়ি যান তিনি। চিকিৎসা করেন। ছোঁয়াচে। তাই মায়ের দয়া হলে মশারি অবশ্যম্ভাবী, রোগীর জন্য। সেই সঙ্গে বাড়ি সুদ্ধু নিরামিষ। বাড়িতে ঝাঁট দেওয়া বারণ। কারণ শীতলা বা শেতলা বিগ্রহের হাতে ঝাঁটা এবং কুলো।

    ফাল্গুন-চৈত্রের শেতলা পুজোয় মুখ কাটা ডাব, সন্দেশ। পদ্মবাবুর রোডে শীতলা বা শেতলা পুজোয় পাঁঠাবলি। সম্ভবত কাঠের নাকি মাটির দেবী মূর্তিতে বাৎসরিক অঙ্গরাগ। সেই শেতলাতলার মাঠেই রাসযাত্রা  প্রাক গ্রীষ্ম দিনে। মালা ডাকা, ডাকের মালা ৬০-৭০-৭৫টাকা। রামের মালা, সীতের মালা - প্রাক গ্রীষ্ম দিনে। তখন ১৯৬৩-৬৪।

    বসন্তেই তো বেজে উঠল লালা তরাই। 'ঐতিহাসিক' না, না, বেশি বলা হল কি? নাকি কম? ইতিহাস উত্তর দেবে তার  ঐতিহাসিক, ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহ  নকশালবাড়ি, তেভাগা, তেলেঙ্গানা থেকে আলাদা।
নকশালবাড়ি।। ছবি - আন্তর্জাল। চিত্রগ্রাহকঃ সলিল বেরা

    কোনো মিলই নেই কাকদ্বীপ, বুঢ়াগঞ্জ, লয়ালগঞ্জ (যার নাম তখন লালগঞ্জ)  এই সব নামের সঙ্গে, নকশালবাড়ির তীর-টঙ্কার, ধনুকের ছিলা টানটান বিদ্রোহ  রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের আহ্বান। নাকি পুরোটাই এরকম  কাকদ্বীপ না হলে, তেলেঙ্গানা জেগে না উঠলে নকশালবাড়ি, খড়িবাড়ি, হাতিঘিষা, প্রসাদুজোত  এইসব নাম জাগে না?

    সে চেয়েছিল 'বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা' গাইতে। কিন্তু প্রাণে দখিন হাওয়া বইবে কী? গরম জলে গোলা খুন-খারাপি  লাল রঙ সে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিল সর্বত্র। কৃষ্ণ মার্কা রঙের কৌটো। টিনের কৌটোর ভেতর রঙা তার বাবা এনে দিয়েছিলেন বড় বাজার থেকে।

    তখন দোল মানেই গাড়ি আর মেশিনের কালি, বাঁদুরে রঙ, অ্যালুমিনিয়াম গুঁড়ো আর কী কী সব সোনালী-রূপালী মিলিয়ে আলাদা আলাদা রূপোলি কালার, সোনালি কালার! রঙ মাখলে গা, মুখ, কানের পাশ বহুদিন রঞ্জিত। খেললে  মানে রঙ খেললে সারা গা, হাত পায়ের পাতা, মুখ, গায়ের অল্প ছেঁড়া জামা প্যান্ট  সবই রঙ ঘোর।
দাদার কীর্তি (১৯৮০) চলচ্চিত্রে দোলের দৃশ্য


    রঙ খেলার জন্য মা কেচেকুচে তুলে রাখতেন তার জামা, শার্ট, গেঞ্জি  বাতিল, সামান্য ফুটাফাটা। তখন তো এমনই হত। আর ছিল ম্যাজিক রঙ  ভ্যানিশিং কালার। যেমন গোপন কথা লিখতে ভ্যানিশিং ইঙ্ক।

    সেই ভ্যানিশিং রঙ নিয়ে মজা হত, দোলের বিকেলে সুবেশ মহিলাদের শাড়ির আঁচলে, পুরুষের শাদা পাঞ্জাবির কোণে, হাতায়, ধুতির কোঁচায়। মিনিট পনের বড় জোর - এই, ওমা, কী করছেন  কতনা কথা-কাকলি, একসঙ্গে সব ভ্যানিশ। আর রঙ নেই।

    দোল মানেই বসন্ত।
    বসন্ত দিনে ফুটকড়াই, মঠ, চিনির তৈরি রঙিন বড় বাতাসা। মঠের ডিজাইনে রথ, ময়ূর, টিয়া, নারী, পাখি। রঙিন, সাদা  দু'রকমই হয়। সেইসঙ্গে চিনির মুড়কি। আবীর তো লালই ছিল। পরে এল সবুজ। সেটা সত্তর দশকের মাঝামাঝি।

  যে ছেলেরা, মেয়েরা নিজেদের রক্তকে রঙ করে দেওয়ালে দেওয়ালে লিখেছিল, 'নকশালবাড়ি লাল সেলাম', 'চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, চীনের পথ আমাদের পথ', তারা শহিদ বেদির নাম হয়ে গেল কত দ্রুত।

  ষাটের দশকে চার আনা ছ আনা আট আনার প্লাস্টিক পিচকিরি  শাঁখ, আনারস, কত না ডিজাইন তাদের। মোমের ছাঁচ তৈরি করে তার ভেতর রঙ পুরে সেই রঙ ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারা। সেই মোমের বাটির মুখ বন্ধ করে যেন ডিম চেহারা। আলু কেটে আধখানা করে তাতে উল্টো হরফে গাধা, ৪২০ লিখে রঙ মাখিয়ে পিঠে মারা। সেই সঙ্গে পচা ডিম, নষ্ট হয়ে যাওয়া টোম্যাটো। আহা, বসন্ত। পচা, দুর্গন্ধ ডিম, খারাপ হয়ে যাওয়া টোম্যাটো ছুটে আসে মিসাইল হয়ে। একবার গায়ে লাগাতে পারলেই - ব্যস। কী বদ গন্ধ রে বাবা।

  বসন্ত  বসন্তের দোল মানেই ভাঙের শরবত, কোথাও কোথাও সিদ্ধি। সেই সঙ্গে হু-হুইস্কি  পান  প্রাণ যাপন। তবে ষাট দশকে বাঙালি পরিবারে দোল উপলক্ষে হু-হুইস্কি - রা - রা - রাম ছিল না। সিদ্ধিতেই বুদ্ধি মাত।

  উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরে দেখেছি - বসন্ত দিনে মেয়েরা দোল খেলছেন নিজেদের মধ্যে, নিজেরা নিজেরা, আবির  ফাগ দিচ্ছেন, রঙ দিচ্ছেন, ফাগ ওড়াচ্ছেন। তখনও তো 'ফাগ' পাতান মেয়েরা নিজেদের মধ্যে। ফাগ, সই, সাগর, গঙ্গাজল  সব পাতান হয়, তার মধ্যে ভাব-ভালোবাসা, দেওয়া-থোওয়া  সব সব আছে।

    কেউ কেউ আবার পুরুষালি অহং নিয়ে বলেন, মেয়েরা ফাগ, সই, সাগর, গঙ্গাজল, কাচের গেলাস  সব পাতায়। এই কথা শোনার পর কারও কারও হো-হো হাস্যরব।
    
    বসন্তেই তো হোলি।
    হোলিকা দাহন।
    হোলিকা রাক্ষসীকে জ্বালান। 'বুড়ি'র ঘর পোড়ান। সেইসঙ্গে 'ন্যাড়া পোড়া' -
    'আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া
    কাল আমাদের দোল
    পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে
    বলো হরিবোল . . .'

    হারা ঘোষ, পগারে কেষ্ট ঘোষেদের খটখটি বাগানের থেকে শুকনো কলাপাতা, বাঁশপাতা, আধপাকা বাঁশে জড়িয়ে শুকনো কলাপাতা মুড়ে ন্যাড়া। তার মাথায় মাথায় হাঁড়ি। হাঁড়ির গায়ে চোখ, মুখ, চুন আর কালি দিয়ে  ন্যাড়ার মুন্ডু। তারপর বহ্নুৎসব। আকাশ লালে লাল আগুনে আগুনে।
    সেই ন্যাড়ার আগুনে কাঁচকলা, বেগুন, আলু  সবই পোড়া  অতি চমৎকার স্বাদ লাগে তখন  সামান্য নুন দিয়ে। কাঁচা মরিচ  কাঁচা লঙ্কা হলে তো হয়েই গেল।
    পিটুলির তৈরি মেড়া বা ভেড়া পৌরাণিক  সনাতনী পৌরাণিক মেঢ্রা সুরের প্রতীক হয়ে ঘরের ভেতর পুড়ে মরল বা হত্যা করা হল তাকে। অনেক হিন্দুবাঙালি বাড়িতেই তখন উঠোনে দোলভিটে বা দোলভিটি। ইটে গাঁথা থাক থাক বেদী যেন। ইটের পরে ইট। সারা বছর রোদে বৃষ্টিতে তার গায়ে ছ্যাতলা। দোলের আগের দিন চাঁচর  বুড়ির ঘর পোড়ান বা হোলিকা দাহন বা মেঢ্রাসুরকে পোড়ানোর পর সেই দোল ভিটে মেজে ঘষে ঝকঝকে, তার ওপর গৃহদেবতা। নারায়ণ, নারায়ণ শিলা হতে পারেন তিনি, অথবা পাথর নয়ত মাটির কৃষ্ণ অথবা রাই-শ্যাম-যুগল মূর্তি।
  দেবতার পায়ে, কপালে লাল আবির। আবির উড়তে থাকে দোলের আকাশে। বাইরে তখন রঙের উৎসব, প্রাণের উৎসব। সিন্থেটিক রঙই চরাচরে, প্রাকৃতিক রঙ কোথায়। তার গর্ভধারিণী গায়ত্রী রায় এই বসন্তে দোল খেলার সময় তাঁর বড়দা - বড় জ্যাঠামশাই শ্রীরাম রায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র দীনেশচন্দ্র রায় কী ভাবে কী ভাবে তৈরি করে দিতেন রঙ খেলার পিচকিরি, তলতা বাঁশের গাঁটঅলা মুখ ফুটো করে, আগুন ওলসান উনোনে লোহার ধারাল পেরেক ঠুসে ধরে, তাকে টকটকে লাল করে, তারপর সেই রঙিন তীক্ষ্ণতাকে বাঁশের গাঁটের গায়ে ঠেসে চেপে ধরে তৈরি করে নেয় পিচকিরির মুখ। সে আজ থেকে আশি একাশি বছর আগে হবে প্রায় ১৯৩৯-৪০। তারপর সেই পিচকিরির ভেতর শক্ত বাঁশের টুকরো দিয়ে হ্যান্ডেল, তার ওয়াশার নির্মাণ ন্যাকড়ায় পুরনো ধুতি-শাড়িতে। তারপর দে দোল দোল  দে দোল দোল, রঙের উৎসবে। সেই সব রঙ একেবারেই আর্থ কালার  প্রাকৃতিক রঙ। প্রকৃতি সঞ্জাত। পুঁই মেটুলি ভিজিয়ে লাল রঙ, নীল অপরাজিতায় নীল, তারপর নয়নতারার পাতা, বৃতি কৃষ্ণকলির সবুজ পাতা বেটে সবুজ রঙা সেই সঙ্গে সঙ্গে গায়ত্রী রায়দের দুধে-আলতা  দ্যাখো  অখন্ডবঙ্গের জেলা ফরিদপুর, আকসা, ভোজেশ্বর, মাদারিপুর সাব ডিভিসন, গ্রামটা তো আকসাই সেখানে পাওয়া যেতনা আর কিছুই। যেটুকু রঙ হল হল। বাকিটা জল। জল ঢালাঢালি, কাঁচা জল। দোলের সময় তবু বসন্ত নয়, পূর্ণ বসন্ত।

  এই বসন্তেই - চৈত্রদিনে, তাকে বালির বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় মিলিটারি। ততদিনে প্রবোধ ভবন বিল্ডিং হয়ে গেছে। সেই প্রবোধ ভবন-এ তারা ক্লাস করেছে নবম শ্রেণী  সি সেকসান  কর্মাস।
  এই মাঠেই সত্তরের শীত শীত বেলায় খর্বকায়, পৃথুল  মোটাসোটা যে মহিলা ঘরোয়া জলসায় গেয়েছিলেন 
" ও কাঠঠোকরা বউ মান কোরো না
   শোনো কথা . . ."
    
 এই গানটার বাকি লাইন তার মনে নেই। কে গেয়েছিলেন এই গান, আসলে কার রেকর্ড  "ও কাঠঠোকরা বউ মান কোরো না / শোনো আমার কথা . . ." নির্মলা মিশ্র।  আর সুমন কল্যাণপুর? যার গাওয়া গান সে ভালোবাসে আজও। সুমন কল্যাণপুরের গলায় -
"মনে কর আমি নেই
বসন্ত এসে গেছে
কৃষ্ণচূড়ার বন্যায়
চৈতালী ভেসে গেছে . . ."

১৯৬৬ সালের একটি মারাঠি গানের রেকর্ডে
সুমন কল্যাণপুরের ছবি

এইছবিটি ক্লিক করলে 
"মনে কর আমি নেই"
গানটি পাঠক শুনতে পাবেন


    দু'বার 'গেছে', 'গেছে' কিন্তু একবারের জন্যও কানে খট করে লাগেনা। এই গান গেয়েছিল সেই মেয়ে  কালো, মোটা, দাঁত সামান্য উঁচু, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। চোখে তার কাজল সব সময়। বালির অলোক দাস, যে কিনা শহিদ হয়েছিল  হাজারিবাগ জেলে গুলিতে  কারা রক্ষীর গুলিতে অথবা লাঠি পেটায়, সেটা ১৯৭০  'বসন্ত এসে গেছে'। হাজারিবাগ জেলে শহিদ অলোক দাস। অলোক দাস ভালোবাসত এই মেয়েকে, মেয়েও সেই নিশ্চয়ই . . .
  গোপনে রেজিস্ট্রি করেছিল তারা। ১৯৭০ সালেই। তারপর অলোকদার অ্যারেস্ট  গ্রেফতারি। কে কাকে মনে রাখে হিমালয়? কে কাকে মনে রাখে বেলেহাঁস? কাকে? কে?
    জনগণের জন্য যাঁরা প্রাণদান করেন, তাঁদের মৃত্যু থাই পাহাড়ের থেকে ভারি। আর ফ্যাসিস্তদের জন্য যারা প্রাণ দেয়, তাদের মৃত্যু বেলেহাঁসের পালকের চেয়ে হালকা। 'থাই পাহাড়' এর বদলে দেওয়াল লিখন, পোস্টারে কখনও কখনও লেখা হতো 'হিমালয়'।
    হিমালয় শুনতে পাচ্ছ?
    বেলেহাঁসেরা।
    অলোকদা ধুতি-বাংলা সূতির শার্ট বা ধুতি হ্যান্ডলুম পাঞ্জাবি। পায়ে চটি। হাতে ঘড়ি। ঘন ঘন সিগারেট। "ও কাঠঠোকরা বউ মান কোরো না / শোনো আমার কথা . . ."। এই বসন্তে অলোকদার 'সে' গেয়েছিল, প্রবোধ ভবনের মাঠে। তখন ফিকে শীত অথবা টাপটুপ বসন্ত। অলোকদা তার থেকে বছর পনেরর বড়। ১৯৭০-এ সে সতের। কলেজে ফার্স্ট ইয়ার। অলোকদার 'সে' কে তো 'দিদি' বলে ডাকে। নাম? থাক না এখন নামের ডাকদারি। অলোকদার শার্ট  পাঞ্জাবির হাতা গোটান। "মনে করো আমি নেই / বসন্ত এসে গেছে . . ."
    অলোকদার ডেডবডি পর্যন্ত দেওয়া হয় নি। বালিতে তখন পোস্টার, 'শহিদ অলোক দাস, তোমায় আমরা ভুলছি না, ভুলব না।'
    সত্যিই কি কেউ মনে রাখে। না হলে তারই বা মনে হবে কেন হঠাৎ হাজারিবাগ জেল ছিল তো নাকি বহরমপুরের জেল?
     
        "মনে করো আমি নেই / বসন্ত এসে গেছে . . ."

    বসন্ত নিয়ে, বসন্ত দিন নিয়ে কত কত গান, সুরবাহার আছে বাংলায়, হিন্দিতে। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন কতগান কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন। লিখলেন আরও কত গীতিকার, এছাড়াও আছেন প্রাচীন টপ্পা, ঠুংরি, বাংলা গানের মানুষরা। কিন্তু 'মনে করো আমি নেই . . .।'  খুন করে ফেলে তাকে। খুন  স্রেফ খুন, আজও।
    হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠবাহারে 'প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় . . .' শুনলে আজও সে দেখতে পায় শিরীষ মাথায় ফাগুনে ফুটে ওঠা ফুলদল  'ফাগুন মাসে কী উচ্ছ্বাসে ক্লান্তিবিহীন ফুল ফোটানর খেলা . . ."
    বঙ্গ শিশু ভবনের পিছনে সেই রাধাচূড়া, তার পড়ে যাওয়া ফুলেরা। মিলিটারি তাকে প্রবলভাবে আঘাত করতে করতে জানতে চায় বন্দুক কোথায়, বন্দুক, জোড়া বন্দুক? তার মুখ ফেটে যায়। কান দিয়ে রক্ত বেরয়। বসন্ত। বসন্ত। তবুও বসন্ত নয়। সত্তরের চৈত্র। বালিতে তার নামে পোস্টার - হাতে লেখা পোস্টার পড়ে  'শহিদ ঝুপু লাল সেলাম'।
    তার গর্ভধারিণী গায়ত্রী রায়ের স্মৃতিতে তাঁর পিতৃদেব হরিপদ রায়ের কাছে দোলের দিন আবির দিতে আসতেন তাঁর ছাত্ররা। সেটা ১৯৪৮-৪৯। লাল আবির শিক্ষক হরিপদ রায়ের পায়ে। অনেক, অনেকটা করে।
  মাস্টারমশাই হরিপদ রায় ভাড়া বাড়িতে থাকেন বাগবাজারের লক্ষ্মী দত্ত লেনে। দেশভাগের বেশ খানিকটা আগে ফেমিন  দুর্ভিক্ষের বছর তিনি দেশ ছাড়েন। তারপর আর দেশে ফিরে যান নি তিনি।
   হরিপদ রায়ের পায়ের পাতা ঝাড়া লাল আবির নিয়ে একটু একটু রঙ মাখামাখি করেন গায়ত্রী রায় আর তাঁর ছোটোবোন নমিতা। বড়দি বুলকি  ঊষারানি ভট্টাচার্যের বিবাহ হয়ে গেছে তার আগেই। এই পায়ের পাতা ঝাড়া আবিরে দোল খেলত কি অচিন্ত্য? ঊষারানি-গায়ত্রী-নমিতাদের একমাত্র জীবিত ভাই? বসন্ত জানে সে সব। বসন্ত জানে। জানে কি?
   সেই ছেলেটার পিতৃদেব অমরনাথ রায় কলকাতায় এক আনা ভরি ওজন হিসাবে রঙ বিক্রি হতে দেখেছেন, জাপানি রঙ। এই রঙ কেনার সাধ্য, সামর্থ্য  কোনোটাই তো তাঁর নেই। তবু অমরনাথ এক আনা  চারপয়সা ভরির গায় মাখার দোলের রঙ দেখে, দেখতে যাবে।
    আর ঝুপুনামে সেই ছেলেটা তার স্মৃতিতে লাল ও ম্যাজেন্টা রঙের আবির অনেক অনেক বছর পরে সবুজ। আবির তো লাল ই। টকটকে লাল। অমরনাথ জানতেন আবির - পুরনো আবির হাত- পা ঠান্ডা হতে থাকা রোগীর হাত-পায়ে মাখালে সেই শরীর কখনও কখনও  উত্তাপ ফিরে পায়। চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাট দশকে হিন্দু বাঙালি গেরস্থ ঘরে আবির রাখেন, পুরনো আবির। আবিরে অভ্রকুচি, অভ্র আবিরে সে এক অতি নিবিড় চুম্বন। তারপর  বহু বছর পর লাল আবিরে বডি পাউডার  সুগন্ধ। সুগন্ধ।
  দোলের দিন আবির মাখা 'কুমারী' কন্যারা মাথা ঘষত সিঁথির আবিরটুকু রেখে, পরদিন স্কুলে যাওয়ার সময়। সিঁথিটুকু লাল। দোল আবির সুযোগে প্রেমিকার স্তন বাহারে আবির লেপে দেওয়া পুরুষরা এখনও কেউ কেউ যথেষ্ট সতেজ, স্বরাট। স্মৃতিতে সেই ফাগ   ফাগুন তাদের কারও কারও মনকে উদ্বেলিত করে কি?
  ১৯৭৫ এর বসন্তে সে তো গ্রেফতার হয়েছিল গোপন শেল্টার থেকে। তখন দূরে হরিজন পল্লীতে স্যা - রা - রা - রা - স্যা - রা - রা -রা - হোলি হ্যায়। হোলি হ্যায়।
          
   ইলাহাবাদে সে দেখেছে তিন দিনের হোলি উৎসব। মেয়েরা, ইসলাম ধর্মের মানুষরা রাস্তায় বেরতে পারেন না এই তিন দিন হোলির রঙদারিতে। ইসলামে রঙ হারাম। আর রাস্তায় বেরলে রঙ দৌড়ে আসবেই।
   'বুরা না মানো  হোলি হ্যায়।' হোলিতে তিন দিন ঢালাও বিলাইতি, দিশি-ধররা দিশি মদ, নানারকম মিষ্টি, ভাঙের শরবত। ঘোড়ার পিঠে ইউনিফর্ম পরা ডি এস পি রঙ খেলে। তার ইউনিফর্মে রঙ। রঙ।
   দোলের আগের দিন বড় বড় শুকনো গাছ, গাছের গুঁড়ি দিয়ে আগুন। হোলকা বা হোলিকা দাহন। সারা রাত আগুন জ্বলে। হোলিকার চাঁদা তোলে লওন্ডারা - কমবয়সি ছেলেরা। চাঁদা না দিলে গেরস্থবাড়ির দরজায় খাটা পায়খানা থেকে গু এনে হাঁড়ি ভর্তি করে পটকে দেয়  ভাঙে ছেলে ছোকরারা। তারপর তো নরক। নরক।
       'বুরা না মানো, হোলি হ্যায় . . .'
   হোলির পর দিন প্রতিটি মহল্লা - এলাকায় এলাকায় নামকরণ মাইকে মাইকে চিৎকার করে করে 'টাইটেল' দান। সুরেশ ছিপকলি(টিকটিকি), তিরভুবন  ত্রিভুবন, মঘঘা (বোকা), রমেশ চিন্দিচোর, বেডূ সুম (কৃপণ), রমেশ ভাগোড়া। 
     হোলিতে পুরনো হিসেব চুকানো  খুন, খারাবা, বদলা, সবই ইলাহাবাদে, হোলি-দোল মিলে। বিহারে কাপড় ছিঁড়ে ল্যাংটো করে দেওয়ার রীতি আছে হোলি উপলক্ষে। তাকে বলে 'কাপড়া ফাড় হোলি . . .'। লালুপ্রসাদ যাদব বিহারে মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় নিজে খেলতেন কাপড়া ফাড় হোলি।
    সে ইলাহাবাদে দেখেছে 'কাপড়া ফাড় হোলি'। উসকো নাঙ্গা  নাংগা কর দো। নাংগা কর দো। এই চিৎকার তার কানে বাজে আজও। 
       সেই বসন্তে ইলাহাবাদের খসরু বাগে  শাহজাদা খসরুর মকবরা - সমাধিভূমির ওপর জেগে থাকা গোলাপ গাছে ফুটে থাকা কালো গোলাপ  ব্ল্যাক প্রিন্স।
১৭৯৬ সালে আঁকা টমাস ড্যানিয়েলের ছবি। খসরু বাগ। ছবি - আন্তর্জাল।

    খসরু  বাদশাহ জাহাঙ্গীরের পহেলা অওলাদ  বড়খোকা। বাগি খসরুকে বুরহানপুরের কারাগারে গলা টিপে হত্যা করেন জাহাঙ্গীর বাদশার তিসরা অওলাদ  খুররম। পরে যিনি শাহজান হলেন। তার আগেই 'বাগি' আব্ব্বাহুজুরের বিরুদ্ধে তলবার ওঠান খসরুর চোখে আকন্দের আঠা দিয়ে দেওয়া হল। আজ খসরু। দিওয়ানা খসরু। তাঁর সমাধিভূমিতে  ইলাহাবাদে তাঁর মকবরা  স্মৃতি সৌধ। সেই সঙ্গে তাঁর প্রিয় পানওয়ালির সমাধি। রয়েছে খসরুর হাতির সমাধি, ঘোড়ার সমাধি।
       বসন্ত দিনে ছাদের ওপর যদি উঠে আসা যায় খসরুর মকবরার তখন মনে হবে বাসন্তী চাঁদ ঝুলে আসছে, ঝুলে ঝুলে নামছে আপনার মাথার কাছে। পূর্ণ চাঁদের মায়ায় তখন ঘন ঘোর।
 মঙ্গলবার মঙ্গলবার পুরানা কাটরায় সব দোকানপাট, ব্যবসা বন্ধ। হোলি নয়, তার কাছাকাছি সময়ে তখন আকাশ জুড়ে লালচে চাঁদের মহোৎসব। এই চন্দ্রমায়াও মৃত্যুময়। বিষের রঙ নীল হয় তার জানা কিন্তু লাল রঙের বিষ!
   হে বিষ অবতীর্ণ হও।
       
  বালিতে হরিজন পল্লিতে একমাস মেয়ে সাজিয়ে লওনডা-ছেলে নাচান। পরবর্তী সময় জেনেছি মওগা বলে এদের।
        কী বসন্ত। কী বসন্ত। কী বসন্ত।
        স্যা - রা - রা -রা - রা - হোলি হ্যায়। হোলি হ্যায় . . .
   বসন্ত দিনে  দোলের পরদিন  'হিন্দুস্থানী দোলের' সন্ধ্যায় তার তো বহুবার অ্যারেস্টের আর একটি অ্যারেস্টের  গ্রেফতারের দিন। কীভাবে, কীভাবে যেন পুলিশ এসে গেল। এল। বাড়ি ঘিরে ফেলল। তারপর দরজায় খটখট। দরজা খটখটাখট।
         
        'প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
         তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ . . .'
        'চার অধ্যায়'। রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ।
       
     সেই গম রঙের ত্বক, সামান্য লালচে চুল, চোখের মণিতে সোডাবিহীন হুইস্কি, মানে 'ক্লাব সোডা' বিহীন হুইস্কির জঁর যেমন হয়, সেই মেয়ে, বালিতে শান্তিরাম রাস্তায়  সুরেন মাইতির দোতলায় ভাড়া আসা জলপাইগুড়ির চন্দনা গুহ সরকার ডাক নামে  বাবলি  আগুন রঙা লোকাট বুকে মোহময়ী। দোলের সন্ধ্যায় তাদের বাড়ি আবির দিতে যাওয়া  বাবলির মা, বাবাকে, বাবলিকেও।
   সে তখন উত্তরপাড়া রাজা প্যারিমোহন কলেজ-এ ফার্স্ট ইয়ার। বাবলি ক্লাস সেভেন। বালি বঙ্গ শিশু বিদ্যালয়-এর সপ্তম শ্রেণী। আজ নয় থাক, সেই বসন্তের গল্প। বসন্ত আসে নিকো। আসেনিকো . . . 🚫


    প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক কিন্নর রায়ের জন্ম ১৯৫৩ সালের ৬ নভেম্বর কলকাতার চেতলায়। বাবা অমরনাথ রায়, মা গায়ত্রী রায়। শৈশব, বালকবেলা, কৈশোর আর প্রথম যৌবন কেটেছে চেতলা, শিবপুর আর হাওড়া জেলার বালিতে। দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে স্কুলে পড়ার সময়েই সাতের দশকের উত্তাল আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মাশুল হিসেবে বার বার জেলে যেতে হয়েছে তাঁকে। ১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর পরই জেল থেকে বেরিয়ে জীবিকার সন্ধানে বহু ধরনের কাজ করেছেন। বিচিত্র সেই সব পেশা। তার মধ্যেই খবরের কাগজে যাওয়া-আসা শুরু। লেখালেখির শুরু সাতের দশকের শেষ দিকে। লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটোদের জন্য নানারকমের লেখা, খবরের কাগজের ফিচার ও উত্তর সম্পাদকীয়। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা আশিরও বেশি।
যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চোখরাঙানি, চাপ তাঁর না-পসন্দ।

উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা

১৯৯৩ চন্দননগর গল্পমেলা পুরস্কার
২০০৮ বঙ্কিম পুরস্কার (মৃত্যুকুসুম উপন্যাসের জন্য)
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার
সোপান পুরস্কার
নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন পুরস্কার
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার
অখিল ভারতীয় মারোয়াড়ি সম্মেলন প্রদত্ত ভরত ব্যাস পুরস্কার
আরো নানাবিধ পুরস্কার ও সম্মাননা।

ফেসবুকে কিন্নর রায় ফ্যান ক্লাব পেজের লিঙ্ক নিচে দেওয়া হল। কিন্নর রায়ের লেখা সংক্রান্ত নানা খবরাখবর পেতে নজর রাখুন এই পেজে। ছবিতে ক্লিক করতে হবে।