সাইন্যাপস্ পত্রিকার গল্প ৫ বিমল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প স্বজন |
কল্যাণ সঙ্গে আসতে চেয়েছিল। রাজীব রাজি হয়নি।
বলেছে, প্রাইমারী ইনফরমেশন, আমি একাই সামলাতে পারব। তুই বরং
ফোন কল অ্যাটেন কর। একটা কলও যেন মিস না হয়।
মুখে মাস্ক লাগিয়ে রাজীব, চামড়ার ব্যাগটিতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলি গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। অল্প পথ। পায়ে হেঁটে যাবে। ঠিক জায়গায় পৌঁছে রাজীব বাড়িটি আন্দাজ করতে পারল। পুকুরের পশ্চিমপাড়ের তিনটি বাড়ির মধ্যে, মাঝের বাড়িটিতে তাকে আসতে বলা হয়েছে। রাজীব নিশ্চিত তার ধারণায় কোন ভুল হচ্ছে না। তিনটিই নতুন বাড়ি। প্রত্যেকটি বাড়ি-ই দোতলা। এমনকি আকার আয়তনেও প্রায় কাছাকাছি। রাজীবের কাছে একটা ফোন নম্বর রয়েছে। কিন্তু ফোন করে কনফার্মড্, হতে হবে, এমনটা মনেই হল না তার। সে স্থির বিশ্বাসী পায়ে মাঝের বাড়িটির দিকে এগিয়ে গেল। দেওয়ালে ঝোলানো নেমপ্লেটে বাড়ির নম্বর এবং মালিকের নাম দেখে, নিজের ওপর আস্থা বেড়ে গেল। তার ধারণা নির্ভুল। সে ঠিক জায়গায় এসেছে।
লোহার গেট খুলে ঘাসে ঢাকা এক ফালি উঠোন পেরিয়ে বন্ধ দরজার সামনে হাজির হল রাজীব। দরজার ডানদিকের ফ্রেমে লাগানো কলিংবেলটিকে দেখতে একটু অন্যরকম লাগলেও নির্দ্বিধায় সেটিতে চাপ দিল। সুরেলা নয়, বরং একটু বেশী রকম কর্কশ শব্দে রাজীব অবাক হলেও, চমকে উঠল না।
কলিং বেলের শব্দ থামার পরে, বাড়ির মধ্যে থেকে বয়স্ক মহিলার ক্ষীণ গলা শোনা গেল, কে? কে বেল বাজাল?
আমি । বলে রাজীব একটু থামল, নাম বললে
চিনতে পারবেন না।
এবার কম বয়সী একটি মেয়ের গলা ভেসে এল, দাঁড়ান।
আসছি।
দরজা খুলল একটি কিশোরী মেয়ে। রাজীবের মুখের
দিকে চেয়ে বলল, আপনি ?
হেলথ
সেন্টার থেকে আসছি। রাজীব বলল, সুশান্তবাবু ফোন করে আমাকে
আসতে বলেছেন।
মেয়েটি অস্ফুটে ওঃ! বলে দরজার পাশে সরে দাঁড়াল।
আসুন। তার আগে লোহার গেটটা একটু বন্ধ করে দিয়ে আসুন।
রাজীব পিছন ফিরে তাকাল। অন্যমনস্কতায় সে লোহার
গেটটিকে হাট করে খুলে রেখে এসেছে। উঠোন পেরিয়ে রাজীব লোহার গেটটি বন্ধ করে দিয়ে
এল।
জুতো জোড়া কি দরজার বাইরেই খুলে রাখব ? রাজীব কিশোরীকে জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ, তাই রাখুন। মোজা খোলার দরকার
নেই।
কিশোরী ছিটকিনি তুলে দরজা বন্ধ করল।
পেসেন্ট কোথায় আছে ? রাজীব জিজ্ঞেস করল কিশোরীকে।
মানে ?
মানে, রোগী কোথায় আছে ?
আপনি দিদার কথা জিজ্ঞেস করছেন ?
দিদা, ঠাকুমা
জানি না। রাজীব বিরক্ত বোধ করল, একজন বয়স্ক মহিলা, যিনি অসুস্থ হয়েছেন। বোঝা গেল ?
আমি
তো তাই বলছি, কিশোরীর গলার স্বরে অল্প ঝাঁঝ, দিদা
ওপরের ঘরে আছে। আপনাকে দোতলায় যেতে হবে। আপনি কি ডাক্তারবাবু ? দিদাকে দেখতে এসেছেন ? আপনাকে কে কল দিল ?
রাজীবের রেগে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে রাগল না। সে বুঝতে পারল, কিশোরীর প্রশ্ন করার মধ্যে নির্ভেজাল সরলতা রয়েছে।
বললাম না, সুশান্তবাবু ফোন করে ডেকেছেন।
বলে রাজীব কিশোরীর মুখের দিকে চেয়ে হেসে বলল, ডাক্তারবাবুর
মতো দেখতে না হলেও, অন্য কোনওরকম, মানে
চোর ডাকাত বলে মনে হচ্ছে না তো ?
কিশোরী লজ্জা পেল, ধ্যাৎ! আমি
কি তাই বলেছি ?
কথা শেষ করেই দ্রুতপায়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি টপকে
উঠে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাত বাড়িয়ে রাজীবকে ডাকল, কী হল ? আসুন।
দোতলার সিঁড়ি শেষ হয়েছে যেখানে সেখানে একটি
গ্রীলঘেরা বারান্দা। বারান্দার কোল ঘেঁসে পাশাপাশি দুটি ঘর। একটি ঘরের দরজা বন্ধ।
অন্যটির খোলা। রাজীব খোলা দরজাটির দিকে ঘাড় ঝুঁকিয়ে তাকাতেই, কিশোরী বলে
উঠল, দিদা পাশের ঘরে আছে।
সে বন্ধ দরজাটি খুলতে যাচ্ছিল, রাজীব হাতের
ইশারায় তাকে থামতে বলল। জিজ্ঞাসু চোখে এদিক ওদিক চেয়ে বলল, আগে ঐ ভদ্রলোক, মানে সুশান্তবাবুকে ডাকো,
যিনি ফোন করে আমাকে এখানে আসতে বলেছেন।
কার কথা বলছেন ? মামা ?
মামা তো বাড়ি নেই। এক হপ্তা হলো এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। মামা মামী আর
ওদের ছেলে, উত্তরপাড়ায় মামীর বাবার বাড়িতে চলে গেছে।
কিন্তু উনি যে বললেন ওনার
মা এ বাড়িতে ...
হ্যাঁ ঠিকই বলেছে। রাজীবকে থামিয়ে দিল কিশোরী, এখন দিদা আর আমি এ বাড়িতে আছি।
তুমি একা! সাতদিন! রাজীব অপলক কয়েক মুহূর্ত
কিশোরীর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, কে হও তুমি এদের ?
কিশোরী মাথা নাড়িয়ে বলল, কেউ না। আমি
এ বাড়িতে কাজ করি। থাকা খাওয়ার কাজ। সাত আট বছর হয়ে গেল।
তোমার দেশের বাড়ি কোথায় ?
সুন্দরবন, ঝড়খালি। গ্রামের নাম হাট
গোবিন্দপুর।
কে আছে সে বাড়িতে ?
বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই আছে। বুড়ি ঠাকুমা
আছে। সে অবশ্য বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। এ বাড়ির দিদার মতো।
তুমি দেশের বাড়ি যাও না ?
হ্যাঁ। বছরে একবার-দুবার যাই। গত মঙ্গলবারে
বাবা আমাকে ফোন করেছিল, নিতে আসবে বলে। চারদিকে যে অসুখটা হচ্ছে,
বাবা বলছিল এখন শহরে থাকার চেয়ে গ্রামে থাকাটাই ভাল। একটু চুপ করে
থেকে কিশোরী বলল, আমি
বাবাকে বারণ করে দিলাম। এখন আসতে হবে না।
রাজীব বলল, কেন ?
বারে! দিদাকে একা ফেলে রেখে চলে যাব ? যে
মানুষটা দিনরাত বিছানায় শুয়ে আছে, নিজে থেকে পাশ ফিরতে পারে
না। চোখে সব ঝাপসা দেখে...
রাজীব লক্ষ্য করল কিশোরীর দুচোখে জলের আবছা ছাপ, মাথা নামিয়ে
ধরা গলায় বলল, আমার ঠাকুমার অবস্থাও দিদার মতোই। কিন্তু
সেখানে তো আমার বাবা আছে, মা আছে, আর
এখানে ... !
রাজীব কিশোরীর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল, দিদাকে নিয়ে
একা থাকতে তোমার ভয় করছে না ?
না। আমি মামা মামীর মতো ভীতু নই। জানেন তো, ওরা দুজনে
শুধু ভীতুই নয়, কেমন যেন! দিদার কী কষ্ট হচ্ছে শুনে এ ওর
মুখের দিকে এমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। দুজনের চোখমুখের চেহারা যদি তখন দেখতেন, ভয়ে সাদা
কাগজের মতো হয়ে গেছে।
রাজীব কিশোরীকে বলল, দিদার ঘরে
ঢাকার আগে রুমাল বা ঐ জাতীয় কিছু দিয়ে নাক মুখ ঢেকে নেবে।
আমি তেমনটাই করি।
হুটপাট ঘরের মধ্যে ঢুকবে না।
কিশোরী মাথা দুলিয়ে জানাল, না।
তোমার দিদা কি এখন ঘুমোচ্ছেন ?
মনে হয় না।
আমারও তেমনটাই মনে হচ্ছে, রাজীব বলল,
বেল বাজানো মাত্রই উনিই প্রথম সাড়া দিয়েছিলেন 'কে' বলে। তাই না ?
এই ক'দিনে দিদা যে কতবার 'কে' বলে সাড়া দিয়েছে, কিশোরীর
গলায় ভেজা ভেজা ভাব, কতবার যে আমায় বলেছে, দোতলার বারান্দা থেকে গলা বাড়িয়ে দেখনা, তোর মামার
গাড়িটা গলিতে ঢুকল কিনা!
উনি জানেন, ছেলে-বউ-নাতি সবাই বাড়ি ছেড়ে
চলে গেছে ? রাজীব জিজ্ঞেস করল।
কিশোরী অস্ফুট জবাব দিল, হুঁ।
তাহলে ?
রোজ প্রতি মুহূর্তে ভাবে, মামা বুঝি ফিরে এল। আমার কী মনে হয় জানেন! কিশোরী রাজীবের মুখের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।
রাজীব উদগ্রীবগলায় বলল, কী ?
কী মনে হয় তোমার ?
মামা
যদি ফিরে এসে একবার 'মা' বলে ডাকে, দিদার অর্ধেক রোগ ভাল হয়ে যাবে। চোখে তো দেখতে পায় না। মামার গলাটা শুনলে
দিদা চাঙ্গা হয়ে যাবে। আমি বলছি বিশ্বাস করুন, ঠিক এমনটাই
হবে।
রাজীব কিশোরীর কথায় কোন জবাব দিল না। প্যান্টের
পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালটা মুছল। আঙ্গুলের আলতো টোকা দিয়ে চশমাটাকে সামান্য
এদিক ওদিক করল। হাত ঘড়িতে সময় দেখল।
তারপর বলল, ঘরের দরজাটা খোল। ভেতরে যাব।
কিশোরী ঘরের দরজাটা খুলল। রাজীব তখনও চৌকাঠ
পেরিয়ে ঘরের মধ্যে পা রাখেনি। বৃদ্ধা ডাকলেন, কে ? কে
এলে ?
আমি। কিশোরী সাড়া দিল।
মনে হচ্ছে যেন তোর সঙ্গে
আরও একজন কেউ আছে।
আছে তো। বলে কিশোরী খিলখিল
করে হেসে উঠল।
হাসছিস কেন ?
বলো ? আন্দাজ
করো, কে হতে পারে !
তবে কি সন্তু এলি ? বলনা কৃষ্ণা,
আমি কি ঠিক বলছি, সন্তু এসেছে? বল না?
কিশোরী কৃষ্ণাকে মনে হল, মুহূর্তে যেন কেমন বেসামাল হয়ে পড়েছে। শূন্য চোখে রাজীবের মুখের দিকে চেয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিল। রাজীব নিজের ঠোঁটের ওপর আঙ্গুল রেখে ইশারায় কৃষ্ণাকে চুপ করে থাকতে বলল। তারপর ধীর পায়ে বৃদ্ধার বিছানার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে চাপা গলায় অস্ফুটে বলল, কেমন আছ, মা ?
বৃদ্ধার শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। দুচোখের কোণ বেয়ে জলের ধারা নেমে এল। কান্না জড়ানো গলায় বলল, ভাল আছি। তুই কেমন আছিস সন্তু ? বৌমা ? দাদুভাই ?
রাজীব সহজ গলায় উত্তর দিল, ভাল।
কৃষ্ণা বৃদ্ধার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, আর কোন
চিন্তা নেই তো ?
বৃদ্ধা লম্বা করে শ্বাস ফেলে বলল, না।
কৃষ্ণা রাজীবকে এগিয়ে দিতে ঘাসে ঢাকা উঠোন পেরিয়ে লোহার গেট অব্দি এল।
রাজীব বলল, আপাতত ভয় পাওয়ার মতো কিছু মনে
হলো না। তবে আরও কয়েকটা দিন দেখতে হবে।
আপনি আবার আসবেন তো ? কৃষ্ণা
জিজ্ঞেস করল।
নিশ্চয়ই। দু-তিন দিনের মধ্যেই আসব। এখন সন্তুর
আসাটা খুবই জরুরী, তাই না ? বলে রাজীব
হাসল।
ঠিক বলেছেন। কৃষ্ণার গলায় খুশি ঝড়ে পড়ল।
কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে রাজীব দাঁড়িয়ে পড়ে পিছন
ফিরে তাকাল। কৃষ্ণা তখনও লোহার গেটটি ধরে দাঁড়িয়ে।
রাজীব ঘার কাত করে হাসল। তারপর বিদায় নেওয়ার
ভঙ্গিতে হাত নাড়ল।
কৃষ্ণার মন বলছে দু-তিনদিন নয়। এই নতুন মামা কালকেই আসবে। তারপরের দিন, তারপরের দিনও আসবে। ঠিক, ঠিক আসবেই। 🚫
বিমল গঙ্গোপাধ্যায়।। ছবি - সাইন্যাপস্ পত্রিকা |
1 মন্তব্যসমূহ
পড়ে ফেললাম বিমলদার গল্প। তাঁর গল্পের এই আন্তরিকতা ও মানবিক মুখ আমরা পূর্বেও দেখেছি অনেক গল্পে। এই গল্পটিও তেমন নরম একটি লেখা। আমার খুব ভালো লেগেছে। তবে শেষটা যেন একটু দ্রুত শেষ হয়ে গেল। আরেকটু চাইছিলাম এবং সে অবকাশ ছিল।
উত্তরমুছুন