সাইন্যাপস্ পত্রিকার অণুগল্প ৪
সাইন্যাপস্ অণুগল্প ৪ |
কুঠারটা তোলার পর কত দিন বা কত বছর বা কত যুগ বা কত সহস্রাব্দ বা কত হাজার বছর কেটে গেছে শম্ভুলাল রেগার আর মনে করতে পারে না। মাথার ওপর কুঠারটা এখনো ধরা আছে। যে সময়কালের নির্ণয় শম্ভুলাল করতে পারেনা, সেই সময়কালে কুঠারটা কি নেমেছে কিছুটা? শম্ভুলালের মনে হয় নেমেছে চুল পরিমাণ।
শম্ভুলাল তো ওপরে তাকিয়ে দেখতে পারে না। কুঠারটা তোলার সময় সে তাকিয়ে ছিল নীচে পড়ে থাকা লোকটার বুকের দিকে। ওখানেই কুঠারটা গেঁথে দেবার প্রবল ইচ্ছা ছিল তার। ছিল — এখন আর নেই। এখন শম্ভুলালের ঠিক মনে পড়ে না সেই প্রবল ইচ্ছেটার কী কারণ ছিল। এমনকি সে ঠিক চিনতেও পারে না পায়ের তলায় পড়ে থাকা লোকটাকে। লোকটার দুটো হাত উঠে আছে কুঠারটাকে আটকানোর চেষ্টায়। আতঙ্কিত মুখ। ঠোঁটের কোণে ফেনা।
এই সবই শম্ভুলাল দেখতে পায় চোখের মণি না ঘুরিয়ে। সে চোখের মণিও সরাতে পারে না। হাত পা দেহ নাড়ানো তো অনেক দূরের কথা। এই অনির্ধারিত সময়কালে শম্ভুলালের চোখের পলক একবারও নেমে আসেনি। কিন্তু সে কুঠারের এই চুল পরিমাণ নেমে আসাকে টের পায়। পড়ে থাকা লোকটার বুকের ওপর মাথার ওপরের কোনো গাছের পাতার ছায়ার চুল পরিমাণ সরে যাওয়া তার স্থির মণিতে সে ধরতে পেরেছে।
এই অনির্ধারিত সময়কালে টিভিতে আটকে যাওয়া ছবির মতো আটকে স্থির হয়ে আছে শম্ভুলাল, তার পায়ের তলায় পড়ে থাকা লোকটা, গাছপালা, একফালি রাস্তা এমনকি উড়তে থাকা কিছু ধুলোও স্থির হয়ে আছে, স্থির হয়ে আছে সূর্যের আলো। বহু অসহায় ঘুম আর জাগরণের পর শম্ভুলাল বুঝেছে কোনো কারণে এই জগৎটা স্থির হয়ে গেছে। ঠিক স্থির নয়, অত্যন্ত ধীর। কেন তা সে জানে না।
সে এটা জানে এই পড়ে থাকা লোকটাকে সে প্রাণে মারতে চেয়েছিল। এই অসহায় অনন্ত স্থির জগতে সে চাওয়া এখন অর্থহীন হয়ে গেছে বরং শম্ভুলাল এখন চায় কুঠারটা তার নিজের বুকে বসিয়ে দিতে। কিন্তু তার আগের ইচ্ছার জন্য শম্ভুলাল বুঝতে পারে কুঠারটা চুল পরিমাণ হলেও নামছে।
শম্ভুলাল প্রাণপণে তার হাতের স্নায়ু পেশীতন্তুকে খবর পাঠায় কুঠারটাকে নিজের বুকেই বসিয়ে দেবার জন্য। শম্ভুলাল ভয় পায় যদি এই থমকে যাওয়া কোনোদিন হঠাৎ শেষ হয়ে যায় তাহলে সেই আগের ইচ্ছা আর গতির জন্য কুঠারটা লোকটার বুকেই যদি নেমে আসে। তাই প্রাণপণে শম্ভুলাল খবর পাঠায় কুঠার ধরা দৃঢ় হাতদুটোকে। এই পরিমাপহীন সময়ে বেঁচে থাকা থেকে সে মুক্তি চায়। এই নেমে আসা কুঠারকে সে এখন ভয় পায়।
প্রথম প্রথম আফরাজুল কিছু ভাবতেই পারতো না। চোখের সামনে লাল জামা, সাদা প্যান্ট পরা লোকটার হিংস্র মুখ, দু’হাতে ধরা কুঠার। নিজের চোখের সামনে নিজের অসহায় হাত দুটোকে দেখতে পায় আফরাজুল। উঁচিয়ে আছে কুঠারের আঘাত আটকানোর জন্য।
একসময় সে বাঁচতে চাইত এই কুঠার থেকে। আনন্দ পেয়েছিল ওয়াক্ত রুখে যাবার জন্য। অগণিত ঘুম আর জাগরণের মাঝে তার মনে ভেসে উঠত কালিয়াচক, সৈয়দপুর, শেখপাড়া। ভেসে উঠত গুলবাহার বিবির মুখ, জোসনারা, রেজিনা আর হাবিবার মুখ। এখন সে আর কোনো নাম মনে করতে পারে না। কোনো জায়গার নামও তার মনে নেই। কিছু মুখ এখনও শুধু ছিন্ন বিচ্ছিন্ন সুতোর মত ভেসে ওঠে। সেই সব সুতোগুলোকে আফরাজুল আর জোড়া দিতে পারে না।
আফরাজুল উঁচিয়ে থাকা কুঠারে ঝলকে ওঠা রোদের টুকরোটার চুল পরিমাণ সরে যাওয়াটা ধরতে পেরেছে। কুঠারটা নামছে। কিন্তু আফরাজুল জানে তার বুকে নেমে আসতে আসতে এখনো তাকে অসংখ্য ঘুম আর জেগে থাকা পেরোতে হবে। আফরাজুল তার হাত দুটোকে সরিয়ে নিতে চায়। প্রাণপণে চেষ্টা করে হাত দুটোকে সরিয়ে দিতে। এখন তার সেটাই কাজ। নেমে আসা কুঠারকে সে আর একটুও বাধা দিতে চায় না। এই অনন্ত অপেক্ষা তার আর সহ্য হয় না। আফরাজুল খোয়াব দেখে কুঠারটা দ্রুত নেমে আসছে — খুব দ্রুত। খোয়াব ভেঙে গেলে আবার সেই হিংস্র মুখ, কুঠার।
এখন আর আফরাজুল হিংস্র মুখের
চোখে চোখ রাখতে ভয় পায় না। সে জানে একদিন তার বুকে কুঠারটা নেমে আসবে, সেদিন তার এই অনন্ত অপেক্ষা শেষ হবে। কিন্তু ওই লোকটা তাকে আরো, আরো কত অনন্ত এই বেঁচে থাকা নিয়ে বাঁচতে হবে তা আফরাজুল কল্পনাও করতে পারে
না।
অসীম করুণা নিয়ে আফরাজুল চেয়ে থাকে শম্ভুলালের দিকে। 🚫
সাইন্যাপস্ পত্রিকা ওয়েবে প্রকাশিত
5 মন্তব্যসমূহ
আফরাজুল এর চরিত্রটি বেশ আবেগঘন।
উত্তরমুছুনদারুণ গল্প। একদম অন্যরকম।
উত্তরমুছুনএ গল্প সময়কে থামিয়ে দেয়। পাঠকও স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে গল্পের দুই চরিত্রের দিকে। এক অসহিষ্ণু সময় গুটিসুটি দিয়ে শুয়ে থাকে যেন লেখকের কলমের ডগায়।
উত্তরমুছুনDARUN
উত্তরমুছুনশেষটা অপূর্ব...
উত্তরমুছুন