।।  অনুবাদ ।। 

ম্যাগো মাসির ঝুলন্ত শব / মদন মোহন শর্মা 

Ik Lamakadi Loth  (A Hanging Corpse)

বঙ্গানুবাদ - বিপ্লব বিশ্বাস


গল্পকার পরিচিতি

মদন মোহন শর্মা (১৯৩৪- ১৭ জুন ২০১১) 
    খ্যাতকীর্তি ডোগরি লেখক। তাঁর কয়েকটি গল্প সংকলন, দুটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক, তিনটি রেডিয়ো একাঙ্ক নাটকের সংকলন, একটি উপন্যাস, Dharan Te Dhuran (Hils and Mists)  ও অনুবাদগ্রন্থ আছে।  তিনি ১৯৭৪ সালে তাঁর ১২টি গল্পেরর সংকলন 'দুধ লহু তে জহর' (১৯৭১ সালে প্রকাশিত)-এর জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান। এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত উল্লেখযোগ্য গল্পের মধ্যে কয়েকটি হল,  'Patthari', 'Meri Gali Da Paap', এবং Ik Lamakadi Loth' 
    তিনি ১৯৭৬ সালে জম্মু কাশ্মীর সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান।জম্মু কাশ্মীর রেডিওর জন্য বহু নাটক লিখেছেন তিনি। তার নাটক 'বাঞ্জর' জাতীয় স্তরে পুরস্কৃত হয়। দুটি উল্লেখযোগ্য রেডিও নাটক হল, Ik Janam Hor (Another Birth 1971) এবং Yatru (The Traveller, 1974)। এ ছাড়া জে কে আকাডেমির শিল্প, সংস্কৃতি ও ভাষা পুরস্কারও পেয়েছেন।২০১১ সালে তাঁর প্রয়াণের পর তৎকালীন ডোগরি সংস্থার সভাপতি মদন মোহন বলেছিলেন,  “His subtle and sublime expressions bestowed depth and breadth to the flowing stream of Dogri short story and he would always live as long as Dogri literature exists”  তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য ছিল গভীর মানবতাবাদ, সমকালীন সমাজের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, মনঃসমীক্ষণ  এবং ভাষার জোরালো ব্যবহার। 
    বর্তমান অনুবাদক মদন মোহন শর্মার এই গল্পটি অনুবাদের জন্য বেছে নেবার কারণ হিসাবে জানিয়েছেন "এই ফল্গু - উচ্চকিত গল্পটি আবহমান শিশ্নসর্বস্ব পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে এক অগ্ন্যাক্ষর প্রতিবাদ। সে কারণেই গল্পটি তরজমা করতে প্রাণিত হয়েছি।"


     দিদিমার বাড়ির পেছনে সেই পাতাভরা বৈঁচি গাছটা যার ফলগুলি মধুর অধিক মিষ্টি, গ্রামের বাড়িসব ছাড়িয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে, আমার চোখের সামনে নাচছে যেন আর আমি দেখছি সেই গাছ থেকে একটা মড়া ঝুলছে - এক যুবতী, পরনে সবুজ কুর্তা, আঁটোসাটো সালোয়ার আর একটি তারা- ভরা সিল্কের দোপাট্টা - মানানসই। 

    আমি এখন যুবতী আর এই মড়াটি আমার মাসির বারো বছর আগে যে এভাবে ঝুলে নিজেকে শেষ করেছিল। জানি না, তা দেখে যখন মুহূর্তের জন্য চোখ বুজলাম তখন আমার কী হল! সেই বিশেষ গাছটা আমার মনে ঝাঁপিয়ে নামল আর দড়ি থেকে ঝুলন্ত মড়াটা বাঁইবাঁই ঘুরতে লাগল। হঠাৎ মড়ার চোখদুটো খুলে গেল আর ম্যাগো মাসির মুখটি সেই পরিচিত হাসিতে ঝলকে উঠল। মাসি গলা থেকে ফাঁসের দড়িটা খুলে ফেলল, সবুজ পরীর ঢঙে হালকা পায়ে মাটিতে নেমে আমাকে বলল, ' কুন্ত, আয়। এবার ঝুল খাওয়ার পালা তোর। '  তারপর আদেশ পালনের ঢঙে আমি গলা বেড়ে দড়িটা পরে নিলাম আর মাসি দড়ির অন্য প্রান্ত ধরে টানতে লাগল। আমার শরীরটা সেই টানে মাটি ছেড়ে ওপরে উঠতে লাগল যতক্ষণ না গলার শিরাগুলি ফুলে ওঠে, শ্বাসকষ্ট হয়ে গলা বুজে আসে, মুখ গলে গ্যাঁজলা বেরোয় আর চোখদুটো ফট - শব্দে ফুঁড়ে বাইরে আসে - এবং শেষত ওই বৈঁচি গাছে ম্যাগো মাসিকে সরিয়ে আমার মড়াটা ঝুলতে থাকে। 
    
    এখন আমি আঠারো। কিন্তু ম্যাগো মাসি যখন এই গাছ থেকে ঝুলে পড়েছিল তখন আমি বড়জোর ছ বছরের বালিকা। তারপর এক যুগ পেরিয়ে গেছে কিন্তু ওই দৃশ্য শুধুই স্মৃতিবস্তু নয়, তা এক অভিজ্ঞতা, একটা ঘটনা যা আমার চোখের সামনে ঘটেছিল। গত বছর বারকয়েক এমনটা ঘটেছে যে আমি যখন গভীর ঘুমে, আমার মাথাজুড়ে কালো ছায়াসব চলাফেরা করেছে, তারপর ওই সব ছায়া প্রবল শক্তিতে একে অপরের সঙ্গে মিশে গিয়ে এক ঘন পাতাভরা বৈঁচি গাছের রূপ নিয়েছে। তারপর কোথা থেকে এক ধুলোঝড় এসে গাছটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে আর বড় বড় পাকা বৈঁচিফল মাটিতে আছড়ে পড়েছে। আমি ফলগুলি কুড়োতে লাগলাম আর তখন ওপরপানে তাকাতেই গলা ফুঁড়ে চিৎকার বেরিয়ে এল। ওইতো ম্যাগো মাসির মড়া, মোটা দড়িতে ঝুলছে, বাতাসের আঘাতে দুলছে, চোখদুটো ফট করে বেরিয়ে এসেছে, দাঁতপাটি মাড়ি ছেড়ে বাইরে আর মুখ থেকে গ্যাঁজলা ঝরছে। এই ধরনের ঘটনা যে শুধু আমার ঘুমের মধ্যেই ঘটেছে তা নয়, জেগে থাকা অবস্থাতেও তা ঘটেছে, দিনের আলোয়। আমার শরীর - স্বাস্থ্য ভালোই, একদম স্বাভাবিক, সব সময় কোনও না কোনও স্কুলপাঠ্য বই পড়ি বা ছবির বইয়ের পাতা উলটে যাই। সেখানে একটা ছবিতে আমার চোখ আটকে যায় যা একটা গাছের এবং তাতে একজন চড়ছে। পুরো বৃত্তটি শুরু করতে এটাই যথেষ্ট। দিদিমার গ্রামের বাড়ির ওই গাছটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। সেই গাছ থেকে ঝুলন্ত ম্যাগো মাসির মড়াটা আমার চোখের সামনে দুলতে থাকল আর আমার সর্বাঙ্গ ঠান্ডা মেরে গেল, ঘামে ভিজে চপচপে হল গায়ের জামাকাপড়। দাঁতকপাটি লেগে অজ্ঞান হয়ে ঘন্টাকয় পড়ে থাকলাম। 
    
    আমার ওই অবস্থা দেখে বাবা আমাকে শহরের নামী ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল আর সেখানে আমার ভালোমতো চিকিৎসা হল। মা আমাকে বেশ কিছু সন্ত মানুষের কাছে নিয়ে গেল, তারা সব সাধু, পীরবাবা যারা আমাকে পবিত্র ছাইভস্ম মাখতে দিলেন। মা পারিবারিক দেবদেবীসহ অন্যান্য দেবতার কাছে মানত করল। বাড়িতে শোধনের পুজোআচ্চা  চলল। খাবারদাবার, জামাকাপড়, অন্যান্য দানধ্যান ম্যাগো মাসির নামে গরিবদের মধ্যে বারকয়েক বিলোন হল। আমাকেও কয়েকবার দিদিমার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল, বৈঁচি গাছটার গা বেড়ে লম্বা লম্বা সুতো জড়ানো হল আর গাছটাকে কাপড়চোপড় উৎসর্গ করা হল। এত কিছু করেও গাছটা বা ম্যাগো মাসির ঝুলন্ত মড়া আমার সামনে থেকে দূর হল না। 
হঠাৎ আপনা থেকেই তা থেমে গেল। আমি তখন সবে ক্লাস এইটে। এরপর থেকে এমন দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠেনি কিংবা আগের মতো আমি অজ্ঞানও হয়ে যাইনি। 
    
    আর এখন যখন আমার আঠারো, কলেজের এক বুদ্ধিমতী, সবকিছু বুঝতে সক্ষম তখন অবাক হয়ে ভাবি কেন আমারই মতো সুন্দরী যুবতী, সকলের ভালোবাসার পাত্রী ম্যাগো তার জীবন যৌবনকে এক রাতের মধ্যে ব্যর্থ, অযথা ভেবে বসল যে প্রত্যেকে যখন ঘুমে অচেতন সে গোলাবাড়িতে গিয়ে, একটা মোটা দড়ি চালের আড়ায় ঝুলিয়ে, নিজের গলায় ফাঁস করে পরে শান্তভাবে পেছনের দিকে পিছলে বৈঁচি গাছটার কাছে গেল আর দড়ির অন্য প্রান্ত পোক্তভাবে একটা ডালে বেঁধে মরণ - খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ল! 

    গ্রামবাসীরা ভেবেছিল যে বাল- বিধবা হিসাবে এ জগতে তার এমন কেউ ছিল না যার কাছে সে অবাধে যেতে পারে। আর হয়তো আমার দাদু - দিদিমা দিনরাত তাকে খাটিয়ে মারত, প্রায়ই বকাঝকা মারধোর করত আর তাই সে সব অত্যাচার আর একাকিত্ব সহ্য করতে না পেরে সে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আজ যখন দুয়ে দুয়ে চার মেলাচ্ছি, বুঝতে পারছি যে এইসব গুজব একদমই ভিত্তিহীন। প্রকৃত কারণটা আলাদা এবং কেউই তা সহজে খুঁজে বের করতে পারবে না। 
    আজ বারো বছর পর আমার দৃষ্টিপথে যখন ম্যাগো মাসিকে স্পষ্ট করতে চেষ্টা করছি, আমার সামনে একটি মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি - দারুণ সুন্দরী, মনোরম, আমুদে, সব সময় হাসমুখ, ভক্তিমূলক গান গাইতে ভালোবাসে, স্বভাবে নিয়মনিষ্ঠ ও পরিচ্ছন্ন আর সমস্ত কাজে ক্লান্তিহীন শক্তি তার। যে বয়সে মেয়েরা পুতুলখেলায় মেতে থাকে সেই বয়সে তার মা তার বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের বছর চার পাঁচ পর শ্বশুরঘরে যাবার জন্য তার খানিক বয়স বাড়লে সে শুনল স্বামীর মৃত্যুসংবাদ। বিধবার পরিধেয় শাদা থান পরে শ্বশুরবাড়ি গেল আর মোটামুটি সপ্তাহখানেকের মধ্যে মায়ের ঘরে ফিরে এল সে। অশুভ বলে দেগে দিয়ে শ্বশুরভিটে তাকে ঠাঁই দিল না। আবার মায়ের কাছেও সে নিয়ত আপদের উৎস হয়ে ধরা দিল। 

    একদিন তার মা মারা গেল। মুমূর্ষু সময়ে বুড়ি মা গ্রামের পুরোহিতের কাছ থেকে কথা আদায় করেছিল যে তিনি মাসিকে আমার দিদিমার বাড়ি রেখে আসার ব্যবস্থা করবেন। 

    দিদিমার পরিবারের সঙ্গে ম্যাগো মাসির মায়ের কোনও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল না। দিদিমা একবার পুরীতে তীর্থ করতে গিয়ে ম্যাগো মাসির মায়ের সঙ্গে আলাপ ও বন্ধুতা হয়। হয়তো মৃত্যুশয্যায় মাসির মায়ের মনে পড়েছে আমার দিদিমার কথা। সেই সূত্রেই মায়ের মৃত্যুর পর ম্যাগো আমার দিদিমার আশ্রয়ে থাকতে চলে এল। 
          
    এই বেচারা মেয়েটিকে দিদিমা খুবই স্নেহ করত। নিজের মেয়ের মতো দেখভাল করত। দিদিমার কাছ থেকে অফুরান ভালোবাসা পেয়ে ম্যাগো তার দুঃখ - কষ্ট ভুলে গিয়েছিল, পরিণত হয়েছিল সতেরো বর্ষীয়া এক গ্রাম্য সুন্দরীতে ঠিক তার বয়সী যুবতীদের মতো যারা কিনা আপন বাপ- মায়ের ঘরে রাজকুমারী হয়ে থাকে। 

    ম্যাগো মাসি আমাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। মনে পড়ে যখনই মায়ের সঙ্গে ওই গ্রামে যেতাম সে আমাকে দেখে সহজ আনন্দে মেতে উঠত। তখন আমি ছয়, নিজের পায়েই দিব্যি হাঁটতে পারি। তবু্ও ম্যাগো মাসি আমাকে মাটিতে নামতে দিত না। পিঠে করে গ্রামের এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরত। কেউ আমার সম্পর্কে জানতে চাইলে সে বলত, ' ও আমার বোনঝি... শহরে থাকে... আমার ভগ্নীপতির মেয়ে, ওর বাবা নায়েব - তহশিলদার। ' 

    'বেটি, তোমার নাম কী ', কেউ হয়তো জিজ্ঞেস করত। আমি উত্তর দেবার আগেই ম্যাগো মাসি বলে উঠত, ' এই মিষ্টি পুতুলটির নাম কান্তা। কিন্তু আমি ওকে কুন্ত বলে ডাকি। তাই না, আমার আদরের বোনঝিটি? ' এ কথা বলে সে আমার গাল চুমুতে ভরিয়ে দিত।
 
    তারপর আবার আমাকে পিঠে বয়ে আমবাগানে, সবুজ মাঠের পথে যেত, জমি থেকে আঁখ ভেঙে দাঁতে ছিলে আমাকে দিত চিবিয়ে রস খেতে। আমার জেদাজেদিতে মাঠে উড়ন্ত রঙিন সব পাখি ধরতে চেষ্টা করত। সে আমাকে তুলে ধরত যাতে করে আমি গাছে পাখির বাসা আর ডিম দেখতে পাই। পলাশের পাতা জোগাড় করে এক জায়গায় জড়ো করত আর তারপর আনন্দে ধেই ধেই নাচত। গরমকালে সে সকাল - সন্ধ্যায় গ্রামের কুয়োতে নিয়ে গিয়ে আমাকে স্নান করাত, জামাটামা পরিয়ে গ্রামের মন্দিরে নিয়ে যেত যেখানে মন্দিরের ঝুলন্ত ঘন্টা বাজিয়ে আর ভক্তিগীতি গেয়ে আমাকে আনন্দ দিতে চেষ্টা করত। যতদিন আমি দিদিমার বাড়ি থাকতাম সে আমাকে খাওয়াত, তার বিছানায় ঘুম পাড়াত আর চাঁদের চরকা - বুড়ির গল্প বলত। মোদ্দা কথা, গ্রামে থাকার সময়কালে আমাকে নিয়ে মায়ের কোনও ভাবনাই থাকত না। আমার পুরো দেখভালই করত ম্যাগো মাসি। 

    সেই শেষবার আমরা গ্রামে গেছিলাম ম্যাগো মাসিকে আনতে। মা কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিল। বাবাকে কাজের জন্য দিনের পর দিন বাইরে ঘুরতে হত। বাড়িতে আমাকে দেখাশোনার কেউ ছিল না। চাকরবাকর রাখার চাইতে মাসিকে এনে রাখা ঠিক হল। তাই বাবা আর আমি গ্রামে গেলাম। 

    আমাদের উদ্দেশ্য জানতে পেরে ম্যাগো মাসি আনন্দে লাফিয়ে উঠল। ' শহরের বাড়িঘর কেমন? সেখানকার রাস্তাগুলি কেমন চওড়া? সেখানে কেমন লোকজন বাস করে? ' মাসি এইসব প্রশ্ন করতে লাগল, আরও কত কী আর মৃদু হেসে তার প্রতিটি প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিলাম। 

    ' কিন্তু মাসি, তোমরা গ্রামের লোকেরা যেমন একফেরতা কাপড় পরো শহরে সেভাবে কেউ পরে না। এমনকি কেই এমন নোংরা পোশাকও পরে না। শহরে যদি তোমাকে যেতেই হয় তাহলে অন্তত এক প্রস্ত সুন্দর পোশাক সেলাই ফোড়াই করে রাখতে হবে। '

    ' কেন? নতুন পোশাক বানাতে হবে কেন? আমার তো বেশ ক'জোড়া ভালো পোশাক আছে। সিল্কের কুর্তা, আঁটো সালোয়ার আর সুন্দর সূচ- কাজ করা দোপাট্টা আছে। কিন্তু আমি সে সব এই গাঁ- ঘরে পরি না। একবার শহরে যেতে দে তারপর দেখবি  আমি কেমন সুন্দর পোশাক - আশাক পরি। '

    ' তুমি মিথ্যে বলছ? কই সে সব সুন্দর জামাকাপড়, দেখাও তো? ' আমি জানতে চাইলাম। 
    ' আমার বাক্সে আছে। '
    'তোমার বাক্স কোথায়? '
    ' ওই গোলাবাড়িতে রাখা আছে। তোকে  কাল দেখাব। '

    পরদিন দুপুর - খাবারের পর ম্যাগো মাসির সঙ্গে গোলাবাড়িতে গেলাম। সেখানে নিজের মতো করে বানিয়ে নেওয়া মেজ্যানিন তলে রাখা হাবিজাবি বস্তুর মাঝ থেকে একটা বাক্স টেনে বের করল মাসি। বাক্সটি খোলার সময় মাসির চোখ বেয়ে জল ঝরছিল। বাক্সের মধ্যে তার বিয়ের সিল্কের পোশাক সব ছিল আর ছিল সেই সব জামাকাপড় যা মাসির দ্বিতীয়বার শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় আমার মা বানিয়ে দিয়েছিল - যে সব আর কোনওদিনই মাসি পরতে পারেনি।
 
    ও সবের মাঝে একটি সবুজ পোশাক ছিল। মাসিকে তা পরার জন্য জেদ করতেই মাসি পরে নিল। সেই সবুজ পোশাকে আর দারুণ সূঁচকাজের দোপাট্টা মাথায় তাকে এতটাই সুন্দর দেখাচ্ছিল যে আমার মনে হল, মা যেমন লোক- কাহিনি থেকে আমাকে সবুজ পরীর গল্প শোনাত, সে-ই যেন জ্যান্ত সামনে দাঁড়িয়ে। 

    বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ভেতরে গোলাবাড়িতে দরজা বন্ধ অবস্থায় ম্যাগো মাসি যেন আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইছে, ' কী, শহরে এই পোশাক চলবে তো? ' 

    এরপর আমাকে কোলে তুলে নিয়ে খড়ের গাদায় বসিয়ে শহরের হাবভাব সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে লাগল। বারবারই বলতে লাগল, আমার মায়ের চাইতে অনেক ভালোভাবে সে আমার দেখভাল করবে। 

    ঘুমে চোখ জড়িয়ে না আসা অব্দি অনেকটা সময় আমরা এ ভাবেই কথা চালিয়ে গেলাম। তারপর এই খড়গাদায় বসেই আমরা দুজনে ঢুলতে লাগলাম। 

    জানি না, কতক্ষণ সে ভাবে ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু জেগে উঠে দেখলাম, গোলাবাড়ির এক কোণে মাসি দাঁড়িয়ে কাঁদছে, পাশেই আমার বাবা, নতচোখে। 

    আমি খড়গাদার ওপর উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে জাগতে দেখে বাবা কাছে এল। 

    ' ম্যাগো মাসি কাঁদছে কেন? ', বাবার কাছে জানতে চাইলাম। আমার চোখও ভিজে উঠেছে। 

    বাবা আমাকে খড়গাদা থেকে তুলে, কান্নারত ম্যাগো মাসির দিকে এক পলক তাকিয়ে আমার চোখ মুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এল। 
সেই রাতে বাবার পাশে ঘুমিয়েছিলাম। মাসি গোলাবাড়িতেই রয়ে গেল, হয়তো রাতভর, একা। 

   পরদিন সকালবেলায় গ্রামের লোকেরা জানল, ম্যাগো মাসি আত্মহত্যা করেছে আর আমাদের বাড়ির পেছনে বৈঁচিগাছ থেকে তার মড়া ঝুলছে। আমিও নিজের চোখে মাসিকে ঝুলতে দেখলাম। তার পরনে সেই একই সিল্কের পোশাকটি কিন্তু চোখদুটি বেরিয়ে এসেছে, ঘাড়ে টান ধরেছে, দাঁতপাটি মাড়ি ফুঁড়ে বাইরে আর তার মুখভর্তি গ্যাঁজলা। 

    সেই ঘটনার পর বারো বছর কেটে গেছে। ম্যাগো মাসিকে আমার ভুলে যাওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু আমি তা পারিনি। এই এক যুগ ধরে আমি বারবার ভেবেছি, কী এমন ঘটেছিল যাতে মাসি নিজের জীবনটাই শেষ করে দিল!
 
    সেই বয়সে এ সব বুঝতাম না। এখন বুঝি। আর যেদিন থেকে ম্যাগো মাসির আত্মহত্যার কারণ আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে, সে দিন থেকে বাবার ঘরে যাই না। আমাকে যখন সে কাছে ডাকে গোটা শরীর কাঁপতে থাকে। পরনের পোশাক সব ঘামে ভিজে ওঠে আর মনে হয় অজ্ঞান হয়ে যাব। 

         ইচ্ছে হয়, ম্যাগো মাসিকে ভুলে যাই ; বাবাকে ক্ষমা করে দিই। কিন্তু ইচ্ছে হলেও তা পারি না। যখনই মাসির কথা মনে হয়, বাবার শরীরটা চোখের সামনে ভাসতে থাকে ; ভাসতে ভাসতে গ্রামের দিদিমার বাড়ির পেছনের বৈঁচিগাছ হয়ে যায় আর তারপর প্রচণ্ড হাওয়ার দোলায় সেই গাছ থেকে ঝুলতে থাকে এক সতেরো বর্ষীয়া যুবতীর মড়া। আর সেই মড়ার মুখটা কখনও  ম্যাগো মাসির মতো মনে হয়, কখনও আমার নিজের মতো, আবার কখনও বা অন্য কোনও মেয়ের মতো আর মুহূর্তের মধ্যে আমার দেহটা ঠান্ডায় নিথর মেরে যায়। 🚫

অলংকরণ - সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা, উপাদান সৌজন্য Free vectors 



অনুবাদক পরিচিতি

    জন্ম ১৭ জানুয়ারি ১৯৫৪; গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র তথা সহশিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক হিসাবে দীর্ঘ কর্মজীবন কাটিয়ে বর্তমানে অবসৃত। নির্জন সৃজনে বিশ্বাসী এই কলমচির ১৯৭৬-এ লেখা প্রথম গল্পই 'সমতট' আয়োজিত সারা বাংলা প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। কেন্দ্রীয় সাহিত্য অকাদেমির নথিভুক্ত অনুবাদক। মৌলিক এবং ভাষান্তরিত গল্পের রচনাকার হিসাবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতাপুষ্ট এই লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হল : এবং গণ্ডারের শোক (গল্প সংকলন, পাণ্ডুলিপি) ক্ষোভ বিক্ষোভের গল্প (খোলা বারান্দ) সামরিক সারমেয় কথা (অনূদিত উপন্যাস, মূল : মারিয়ো ভার্গাস ইয়োসা, সন্দেশ, ঢাকা) দক্ষিণ ভারতীয় ছোটগল্প (অনূদিত গল্পমালা, ভাষাবন্ধন) ইচ্ছেখাম (গল্প সংকলন, দোসর) পড়শি ভাষার গল্প (অনুবাদ, দ্য সী বুক এজেন্সি)