ছবি - সাইন্যাপস্

সহজপাঠ / তৃপ্তি সান্ত্রা

১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০২১
স্বাতী ভট্টাচার্যের বাজেট-বিস্ময়পোস্ট দেখতে দেখতে সকাল শুরু আজ। কাগজ তখনও আসেনি।

    ২০১২ সালে শিশুদের যৌন নির্যাতনের মোকাবিলায় সরকার একটি আইন আনেন — ‘দ্য প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেনসেস’ — সংক্ষেপে ‘POCSO’ 

    তো সেই পকসোনিয়ে আবার নতুন কথা কী?

    কথা একখান নয়। অনেক কথা। কাকে বলে ধর্ষণ? কাপড়-জামার উপর দিয়ে ঘষাঘষি? হাত মারা? ওসব ধর্ষণ নয়। খোলাখুলি শারীরিক টাচ প্রমাণ না হলে . . . ইয়ে! স্যার-ম্যাডাম। ধর্ষণ হল না। এসব কে বলছেন? ষাট বছর আগে আমাদের কোনও মাসিপিসি? না। না। উনারা তো বলতেন লক্ কইর‍্যা থাক। বুক টিপেছে তো তা নিয়ে অত চ্যাঁচান কী? 

     না না মাসিপিসি নয়। বলেছেন কোর্টের বিচারপতি। মহিলা বিচারপতি।

    সে কী! ভাবা যায়! মহিলা বিচারপতি এই রকম রায় দেন!

   আরে পাওয়ারের কোনও মহিলা-পুরুষ ভাগ হয় না। সবটাই ক্ষমতা-শোষণ-পিতৃতন্ত্র-গণতন্ত্রের মুখোশে সর্বভূক  স্বৈরতন্ত্র . . . 

   মুষ্টিমেয়র সুখ সম্পদ বৈভব লালসার জন্য জনগণের কৃচ্ছতা। বলিদান। শোষণ পীড়ন ধর্ষণ। প্রতিবাদ করলে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করতেও রয়েছে বিভিন্ন ধারা। আইনের গেরো। 

    তো সকালের বাজেট-বিস্ময়টা বলি। সবার সাথে সবার বিকাশের চালচিত্রটা দেখা যাক্।


💥মহিলা ও শিশু কল্যাণে বরাদ্দ কমেছে। 
💥জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনে বরাদ্দ দু’বছর আগের কাছাকাছি।
💥কৃষি ও কৃষক কল্যাণে বরাদ্দ কমল।
💥মাটির স্বাস্থ্য ও উর্বরতা রক্ষার জাতীয় প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়েনি। 
২০২০-২১ সময়কালে দেশে কিশোরী কন্যাদের প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ২৫০ কোটি। খরচ হয়েছে ৫০ কোটি।
💥পিএম-কিসান প্রকল্পের যত টাকা খরচ হয়নি গত বছর — ১০ হাজার কোটি।

    বাজেট-বিস্ময়দেখে জনগণের মঙ্গলের জন্য, আরো নির্দিষ্ট করে বললে মাটি সংলগ্ন খেটে খাওয়া দলিত মানুষের জন্য সরকারের মনোভাব অতি পরিষ্কার বোঝা যায়। দেশের মানুষের জন্য কোনও দায় নেই সরকারের। কর্পোরেট শক্তির হাত শক্ত করতে গুটিকয় বানিয়া পরিবারের কাছে তার দায়বদ্ধতা। শাসন, আইন, বিচার, নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতার দাপে, সব বিভাগেই তারা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে, সংবিধানকে পাল্টে দেওয়ার স্বৈরাচারীতায় বলীয়ান। NRC, CAA, কৃষি বিলের সাথে আর এক নব সংযোজন ধর্ষণ আইন।

 ভিড় বাসে, রাস্তায়-পুরুষের লোভী হাতের কথা, হাইটেক শহরে ফ্ল্যাট, গ্যারেজ, নির্জন রাস্তায় শহুরে ধর্ষণের কথা আমরা জানি। তা বহুল প্রচলিত। এর বাইরে মফসসলে, গ্রামে গঞ্জে, মাঠে . . . আক্ষরিক অর্থে শ্রমজীবী মেয়েরা অনেক রকম স্তরে ধর্ষণের পাঠ জানে। পকসো আইন এই সব বুক আর পাছা মর্দনকারীদের উৎসাহিত করল মাত্র। এই সব অবাঞ্ছিত স্পর্শ কি কিশোরী, বালিকা মেয়েটিকে সাইকো, ডিপ্রেসড করে তুলছে? বাবু সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি পুষ্ট, প্রভাবিত মেয়েদের নিষ্কলুষ, পবিত্র থাকার পাঠ নিতে হয়। মেয়েদের থাকতে হয় অনাঘ্রাতা। অন্য কেউ শুধু ছুঁলে নয়, অন্য পুরুষের কথা ভাবলেও তাদের পাপবোধ, বিবেক দংশন হওয়া উচিত। গরিবগুর্বো মেয়েদেরও তাই হয়! ভোরে দুপুরে সন্ধ্যায় মাঠে মালিকের খেতিতে কাজ করা মেয়েদের কথা তাদের ভাষায়, তাদের মতো করে আর কবে জানলাম আমরা। তাদেরও নিজস্ব চেতাবনি থাকে।

   মহড়ায়, মেক্-আপ রুমে, খেলার মাঠে . . . সিনিয়র দিদিদের সতর্কবাণী ছিল একা ওই মেক-আপ ম্যানের কাছে সাজতে বসবে না, অমুক ডাক্তারদাদুর কাছেও একা যাবে না। আর ঐ শুওরটার মুখের দিকেও তাকাবে না দৃষ্টিপাতে গর্ভবতী করে দিতে পারে। 

    ছত্রিশ বছর চাকরি করেছি মফস্‌সলে। প্রথম জীবনে কুড়ি-তিরিশটি ছাত্রী নিয়ে ফাঁকা ক্লাসরুম। ক্লাসরুম ভরে গেছে একুশ শতক থেকেই বসতে জায়গা দিতে পারি না। সংখ্যা লঘু, আদিবাসী, রাজবংশী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মেয়েরা। পায়ে হেঁটে তারা নালা, নদী, মাঠ ডিঙিয়ে এসেছে। এখনও সাইকেলে কখনও একা কখনও দলবেঁধে তারা শীতের ঝপ্ করে সন্ধে হয়ে আসা নির্জন পথে আসছে। মেয়েরা বিয়ের বয়স তেরো থেকে আঠারোয় পিছিয়ে দিতে পারছে হয়তো একুশেও পারবে। ধর্ষণ আইন ১৪, ২০১৬ কেসের আসামী সতীশ রেগড়েকে প্রাপ্য শাস্তি দিলে, অবাঞ্ছিত ছোঁয়াও যে শাস্তিযোগ্য সেই সমন জারি হলে, অন্যদের সাথে, এই সব মাঠঘাটের মেয়েরাও একটু জোর পেতো।  

  আইন, সমাজ পাশে না থাকলে নিজেদের বিচার, নিজেদের মোকাবিলা নিজেদের মতো করেই তৈরি ভালো। এই সব অবাঞ্ছিত স্পর্শগুলো কুকুর, শেয়ালের আঁচড় বলে উপেক্ষা করতে শিখুক তারা। শুচিতার গ্লানি যেন তাদের কুরে কুরে না খায়।

 পৃথিবী জুড়ে আকাল। মাটিতে মাটি নেই। জলে নেই জল। জঙ্গলও ডানা লাগিয়ে ওড়ে। মাটি জল জঙ্গল সংলগ্ন মানুষের জীবিকা, জীবন তছনছ। স্থায়ী ঘর নেই। অনুমোদিত যৌন সঙ্গী নেই। স্থিতি নেই। কিছুই দিতে পারছে না সরকার তাই কী নিছক গা ঘেঁষাঘেঁষি বা টেপাটেপির জন্য পকসো আইনের ৭এর প্রয়োগ, ৮এর অভিযোগ থেকে অব্যাহতি!

  অর্থ হয় এসবই একটি রামরাজত্বের আসল পাঠ। অত নারীবাদী চেতনার, স্বাধীনতার চিৎকার কী! ঘরে ঢোকো সব্বাই। অন্তঃপুরবাসিনী হও। সতীলক্ষ্মী হও। ধর্ষণ আবার কী! রাস্তায় বেড়ালে অবাধ টেপাটেপি লিঙ্গ, পায়ুদ্বার, স্তন   ঘষটানি খাও। পোষাক সরিয়ে বা পোষাকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তো করেনি তবে? রাস্তায় বেরিয়ে স্বাধীকার, স্বাধীনতা চাইলে এসব খেতে হবে, সোনা। স্থায়ী সঙ্গী আর কোথায় পাবে, এ সবেই চালিয়ে নিতে হবে। যৌন ক্রিয়ায় না বলেছিলে বুঝি!

 আহা, লজ্জাশীলা মেয়েরা আবার ক্ষিধের কথায় কবে হ্যাঁ বলতে পারে! তাদের সব না, হ্যাঁ।

 স্বচ্ছ বার্তা এই বাইরে বেরোলে এসব হয়। হবে। ঘরে থাকো। গৃহলক্ষ্মী হয়ে। চাকরির বাজার ফাঁকা হবে। আত্মনির্ভরভারত তৈরির সূক্ষ্ম নির্মাণপর্ব এইসব। ফ্যাসিজিমের সহজপাঠ। 🚫



তৃপ্তি সান্ত্রা। তৃপ্তি সান্ত্রার জন্ম ২ জানুয়ারি, ১৯৫৬ সালে মালদা জেলাশহরের সদর হসপিটালে। বাবা সুরেশচন্দ্র সান্ত্রা, মা বেলা সান্ত্রা।  পড়াশোনা সেখানেই। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে এম এ। মালদহের একটি স্কুলে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছেন। লিটল ম্যাগাজিন ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। গদ্য এবং কবিতা উভয়েই স্বচ্ছন্দ তিনি। লিখেছেন বহু বিষয়ে প্রবন্ধ। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার (২০০৬) পেয়েছেন। কবিতার জন্য পেয়েছেন কবিতা পাক্ষিক পত্রিকার মঞ্জুষ দাশগুপ্ত নামাঙ্কিত পুরস্কার। পেয়েছেন সান্নিধ্য স্মারক সম্মাননা (২০১৬), গল্পমেলা পুরস্কার (২০১৭), হিতেন নাগ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৭), কবি দিলীপ তলোয়ার স্মৃতি সম্মাননা (২০১৯) এবং ঐহিক সম্মাননা (২০১৯), কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের ছোটো গল্প পুরস্কার (২০২০) । 

প্রকাশিত গ্রন্থ

গল্পের বই  
অষ্টমীটোলা (২০০৬, অমৃতলোক)
পরশপাথর প্রকাশনের দশটি গল্প গ্রন্থমালা সিরিজে, দশটি গল্প (২০০৭)
অষ্টমীটোলা ও ৫০ টি গল্প / পুনশ্চ প্রকাশনী (২০১৯)
রাত রোয়াকে বুদবুদ যাপনের ২৫ আখ্যান(২০১৪, গাঙচিল)
তৃপ্তি সান্ত্রার গল্পবই (২০২০, শুধু বিঘে দুই, আলপথ সিরিজ) 

উপন্যাস লিখেছেন দুটি
চিরকুট(২০০৭, অমৃতলোক) 
চুড়েইল (২০১৭, ঐহিক) 

প্রবন্ধ/কলাম-এর বই দুটি 
ছোপছোপ কাটাকুটি(২০১৮, পুনশ্চ) 
মেয়েদের চোরাগোপ্তা স্ল্যাং, শরীর এবং অন্যান্য  আলাপ(২০১৯, কারিগর) 

দুটি অনুবাদের মধ্যে আছে
এক যে ছিল রাজকইন্যা (আ প্রিন্সেস রিমেমবারস) (২০১০, সবাই জয়সিঙ্ঘ বেনিভোলেন্ট ট্রাস্ট, জয়পুর)  
উত্তরবঙ্গের রাজবংশী (চারুচন্দ্র সান্যালের দ্য রাজবংশীজ অব নর্থবেঙ্গল) (২০১৮, আনন্দ পাবলিশার্স) 

কবিতার বই বেরিয়েছে চারটি 
কত দীর্ঘ হলে মূল (প্রথম কবিতার বই, ১৯৮৭/ জোয়ার) 
নিষাদ কলম (২০০৫, কাগজ প্রকাশন, কলকাতা) 
তৃষার শব্দকোষ(২০০৭, অমৃতলোক) 
ছোপছোপ কাটাকুটি(২০১১,অমৃত লোক)