২০১২ সালে শিশুদের যৌন নির্যাতনের মোকাবিলায় সরকার একটি আইন আনেন — ‘দ্য প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেনসেস’ — সংক্ষেপে ‘POCSO’।
তো সেই ‘পকসো’ নিয়ে আবার নতুন কথা কী?
কথা একখান নয়। অনেক কথা।
কাকে বলে ধর্ষণ? কাপড়-জামার উপর দিয়ে ঘষাঘষি? হাত মারা? ওসব ধর্ষণ নয়। খোলাখুলি শারীরিক টাচ প্রমাণ না হলে . . . ইয়ে!
স্যার-ম্যাডাম। ধর্ষণ হল না। এসব কে বলছেন? ষাট বছর আগে
আমাদের কোনও মাসিপিসি? না। না। উনারা তো বলতেন — লক্ কইর্যা থাক। বুক টিপেছে তো তা নিয়ে অত চ্যাঁচান কী?
না — না — মাসিপিসি নয়। বলেছেন কোর্টের বিচারপতি। মহিলা বিচারপতি।
সে কী! ভাবা যায়! মহিলা বিচারপতি এই রকম রায় দেন!
আরে পাওয়ারের — কোনও মহিলা-পুরুষ ভাগ হয় না। সবটাই ক্ষমতা-শোষণ-পিতৃতন্ত্র-গণতন্ত্রের মুখোশে সর্বভূক স্বৈরতন্ত্র . . .
মুষ্টিমেয়র সুখ সম্পদ বৈভব লালসার জন্য জনগণের কৃচ্ছতা। বলিদান। শোষণ পীড়ন
ধর্ষণ। প্রতিবাদ করলে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করতেও রয়েছে বিভিন্ন ধারা।
আইনের গেরো।
তো সকালের ‘বাজেট-বিস্ময়’টা বলি। সবার সাথে সবার বিকাশের চালচিত্রটা দেখা যাক্।
ভিড় বাসে, রাস্তায়-পুরুষের লোভী হাতের কথা, হাইটেক শহরে ফ্ল্যাট, গ্যারেজ, নির্জন রাস্তায় শহুরে ধর্ষণের কথা আমরা জানি। তা বহুল প্রচলিত। এর বাইরে মফসসলে, গ্রামে গঞ্জে, মাঠে . . . আক্ষরিক অর্থে শ্রমজীবী মেয়েরা অনেক রকম স্তরে ধর্ষণের পাঠ জানে। পকসো আইন এই সব বুক আর পাছা মর্দনকারীদের উৎসাহিত করল মাত্র। এই সব অবাঞ্ছিত স্পর্শ কি কিশোরী, বালিকা মেয়েটিকে সাইকো, ডিপ্রেসড করে তুলছে? বাবু সমাজে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি পুষ্ট, প্রভাবিত মেয়েদের নিষ্কলুষ, পবিত্র থাকার পাঠ নিতে হয়। মেয়েদের থাকতে হয় অনাঘ্রাতা। অন্য কেউ শুধু ছুঁলে নয়, অন্য পুরুষের কথা ভাবলেও তাদের পাপবোধ, বিবেক দংশন হওয়া উচিত। গরিবগুর্বো মেয়েদেরও তাই হয়! ভোরে দুপুরে সন্ধ্যায় মাঠে মালিকের খেতিতে কাজ করা মেয়েদের কথা — তাদের ভাষায়, তাদের মতো করে আর কবে জানলাম আমরা। তাদেরও নিজস্ব চেতাবনি থাকে।
মহড়ায়, মেক্-আপ রুমে, খেলার মাঠে . . . সিনিয়র দিদিদের সতর্কবাণী ছিল — একা ওই মেক-আপ ম্যানের কাছে সাজতে বসবে না, অমুক ডাক্তারদাদুর কাছেও একা যাবে না। আর ঐ শুওরটার মুখের দিকেও তাকাবে না — দৃষ্টিপাতে গর্ভবতী করে দিতে পারে।
ছত্রিশ বছর চাকরি করেছি মফস্সলে। প্রথম জীবনে কুড়ি-তিরিশটি ছাত্রী নিয়ে ফাঁকা ক্লাসরুম। ক্লাসরুম ভরে গেছে একুশ শতক থেকেই — বসতে জায়গা দিতে পারি না। সংখ্যা লঘু, আদিবাসী, রাজবংশী — বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মেয়েরা। পায়ে হেঁটে তারা নালা, নদী, মাঠ ডিঙিয়ে এসেছে। এখনও সাইকেলে কখনও একা কখনও দলবেঁধে তারা শীতের ঝপ্ করে সন্ধে হয়ে আসা নির্জন পথে আসছে। মেয়েরা বিয়ের বয়স তেরো থেকে আঠারোয় পিছিয়ে দিতে পারছে — হয়তো একুশেও পারবে। ধর্ষণ আইন ১৪, ২০১৬ কেসের আসামী সতীশ রেগড়েকে প্রাপ্য শাস্তি দিলে, অবাঞ্ছিত ছোঁয়াও যে শাস্তিযোগ্য — সেই সমন জারি হলে, অন্যদের সাথে, এই সব মাঠঘাটের মেয়েরাও একটু জোর পেতো।
আইন, সমাজ পাশে না থাকলে নিজেদের বিচার, নিজেদের মোকাবিলা নিজেদের মতো করেই তৈরি ভালো। এই সব অবাঞ্ছিত স্পর্শগুলো কুকুর, শেয়ালের আঁচড় বলে উপেক্ষা করতে শিখুক তারা। শুচিতার গ্লানি যেন তাদের কুরে কুরে না খায়।
পৃথিবী জুড়ে আকাল। মাটিতে মাটি নেই। জলে নেই জল। জঙ্গলও ডানা লাগিয়ে ওড়ে। মাটি জল জঙ্গল সংলগ্ন মানুষের জীবিকা, জীবন তছনছ। স্থায়ী ঘর নেই। অনুমোদিত যৌন সঙ্গী নেই। স্থিতি নেই। কিছুই দিতে পারছে না সরকার তাই কী নিছক গা ঘেঁষাঘেঁষি বা টেপাটেপির জন্য পকসো আইনের ৭এর প্রয়োগ, ৮এর অভিযোগ থেকে অব্যাহতি!
অর্থ হয় এসবই একটি রামরাজত্বের আসল পাঠ। অত নারীবাদী চেতনার, স্বাধীনতার চিৎকার কী! ঘরে ঢোকো সব্বাই। অন্তঃপুরবাসিনী হও। সতীলক্ষ্মী হও। ধর্ষণ আবার কী! রাস্তায় বেড়ালে অবাধ টেপাটেপি — লিঙ্গ, পায়ুদ্বার, স্তন — ঘষটানি খাও। পোষাক সরিয়ে বা পোষাকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তো করেনি — তবে? রাস্তায় বেরিয়ে স্বাধীকার, স্বাধীনতা চাইলে এসব খেতে হবে, সোনা। স্থায়ী সঙ্গী আর কোথায় পাবে, এ সবেই চালিয়ে নিতে হবে। যৌন ক্রিয়ায় না বলেছিলে বুঝি!
আহা, লজ্জাশীলা মেয়েরা আবার ক্ষিধের কথায় কবে হ্যাঁ বলতে পারে! তাদের সব না—ই, হ্যাঁ।
স্বচ্ছ বার্তা এই — বাইরে বেরোলে এসব হয়। হবে। ঘরে থাকো। গৃহলক্ষ্মী হয়ে। চাকরির বাজার ফাঁকা হবে। ‘আত্মনির্ভর’ ভারত তৈরির সূক্ষ্ম নির্মাণপর্ব এইসব। ফ্যাসিজিমের সহজপাঠ। 🚫
3 মন্তব্যসমূহ
Typical Tripti Santra Class 🙏❤️
উত্তরমুছুনএকদম ঠিক লজ্জাশীলারা ঘরে বসে না থাকলে আত্মনির্ভর ভারত তৈরী হওয়া বড়ই মুশকিল। এত জোরে এগোচ্ছি আমরা এগোচ্ছি না পিছিয়ে যাচ্ছি বুঝতেই পারি না।
উত্তরমুছুনবড়ো কঠিন বাস্তব। নারীদের অবমাননার ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। কবে যে অবস্থা পাল্টাবে ,আমরা মেয়েদের মানুষ বলে ভাবতে শিখবো কে জানে ?
উত্তরমুছুন