ছবি - সাইন্যাপস্‌।। উপাদান - গেটি ইমেজেস্‌

 রাজেশ কুমারের কলমে।। জলের মতন জলের খোঁজে ভেসে

পর্ব ৩ ।। বাংলার মুখ ও কবি রতন দাস

দরজাটা আর একটু
আস্তে বন্ধ করো
কানের চেয়ে বুকে
বড় লাগে
    বলেছিল রতন দাস। তার লেখা এক কবিতায়। জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা ছাইপাঁশ যে এত কিছু লিখি এসব কী আদৌ কোন কবিতা! আমি সামান্য এক সাহিত্যপ্রেমী। কবিতার হয়ে ওঠা না ওঠার আমি কি জানি! এক সংশয়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম রতন দাসের দিকে। দ্যোদুল্যমান অভিব্যক্তি। হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। কিম্বা পারা না পারার মধ্যবর্তী কোন এক অবস্থান। বয়ে চলা নদীর বুকে জেগে ওঠা এক টুকরো চড়া। কেউ কী বলতে পারে তা নদীখাতের একান্ত নিজস্ব নাকি পৃথিবীর তিনভাগ স্থলের! রতন দাস বলেছিল, আসলে কবিতাচর্চাও মনে হয় আপনার ওই দৃষ্টির মতো। আগাগোড়া কেবল এক সংশয়ে ভর করে এগিয়ে চলা। পায়ে পায়ে দ্বিধাদন্দ্ব। অপ্রস্তুত আমি বলেছিলাম, তা কেন! রহস্যময়তাও তো একটা ব্যাপার। আপনার লেখায় তা আছে। রতন দাস হেসেছিল, উদাসী এক হাসি। সে হাসিতে জড়িয়েছিল এক কবি মনের গোপন ব্যথা, বঞ্চনার দীর্ঘ অভিমান আরও কত কিছু। যত দিন গেছে ধীরে ধীরে আমার উপলব্ধির মধ্যে মিশে গেছে তা। রতন দাসের হাসি কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে আমার অন্তরে।

    তখন বরেন্দ্রভূমির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটছিল। বালুরঘাটের কবি লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। অমল বসু, মৃণাল চক্রবর্তী, নির্মলেন্দু তালুকদার আরও অনেকে। সোমবার করে বসত
‘সবুজের আড্ডা’সেই আড্ডাতেই রতন দাসের আসা যাওয়া। রোগা লম্বা শুকনো কাঠের মতো চেহারা। নিস্পৃহ চোখ। কিন্তু লেখে,
 
"তোমাকে কি কখনও ছেড়ে যেতে পারি
নিষ্পাপ হৃদয়ে এখনও জেগে আছে
জল নুড়ি পাথরের কলতানে
স্বর্গীয় সিমফনি।" 

অথবা

"বাঁধানো চাতাল জুড়ে হাড়িয়ার গন্ধ
মচ্ছব হবে
দাবার কোটে ঝুঁকে দু’বুড়ো খোয়াচ্ছে
জীবন যাপন।"
    সেই রতন দাসের সঙ্গেই একদিন ঘোরভাঙা সকালে দেখা হয়ে গেছিল কুশমান্ডির মাঠে। কৃষিমেলার এক প্রান্তরে। তখন শীতকাল। খেজুরের গাছে গাছে হাঁড়িতে জমা রসের সময়। গ্রামের মেঠো রাস্তায় ছেঁড়া চাদর জড়ানো জবুথবু বুড়োর খালি পায়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কিম্বা রাস্তার মোড়ে একমাত্র চায়ের দোকানির উনুনে আগুন দেওয়ার সময়। মেলা শুরু হয়নি তখনও। ব্লকের চাষিভাইরা তখনও হাজির হয়নি বড় বড় লাউ, কুমড়ো, ওলকচু, মান, ফুলকপি, বাঁধাকপি নিয়ে। ক্ষেতের টাটকা গন্ধ উড়ে এসে বসেনি মেলা প্রাঙ্গণে।
কবি রতন দাস ।। ১৯৫২ - ২০১৫
ছবি - সবুজের আড্ডার সৌজন্যে

    আমি আর রতন দাস চলে এসেছিলাম আল বরাবর, গ্রামের শেষ সীমায়। আবাদি জমির মাঝে। নির্জন এক পুকুরপাড়ে, নারকেল গাছের গোড়ায়। পুকুরের জলে তখনও ভেসেছিল আবছায়া কুয়াশারা। শীতের কড়া-মিঠে রোদ হামাগুড়ি দিচ্ছিল সতেজ সবুজ আলুর ক্ষেতের ওপর। কিছুটা দূরে বাঁশের ঘন জঙ্গল। সবুজ অন্ধকার সেজে তৈরি করেছে যেন কোন রহস্যময়তা। হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাদের। আমি আর রতন দাস বসেছিলাম সেদিকে তাকিয়ে। কি যেন এক অপার শান্তি পড়ে রয়েছে চরাচর জুড়ে। 

    কথা বলছিলাম আমরা দুটি মানুষে। রতন দাস বলছিল চাষবাসের কথা। নদীর ওপর নির্ভরশীলতার কথা। কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে বোরোধানের চারা পোঁতা। তখন জল লাগবে অনেক। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তুলাইপাঞ্জির কথা। দিনাজপুর শুনলেই ভরা কলকাতার বুকে বসেও একটা সুঘ্রাণ ভেসে চলে আসে বাতাসে ঠিক। রতন দাস শ্বাস ছেড়েছিল বড় করে। ক্ষেতের ভঙ্গুর মাটি কিছুটা হাতে তুলে নিয়ে মুঠোয় ভরে  বলেছিল, ভালো প্রজাতির তুলাই জেলা ভাগের পর সব চলে গেল উত্তর দিনাজপুর। এখন ওদেরই সব রমরমা, বিদেশযাত্রা। আমাদের এখানে পড়ে রইল সামান্য কিছু। এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তবে সুগন্ধি চালের কথা যদি বলেন, আমাদের আছে কাটারিভোগ, চিনি আতপ। সব খিয়ারমাটির ফলন। আপনারা যেটাকে এঁটেলমাটি বলেন। আত্রেয়ীর পশ্চিমপাড় বরাবর হেঁটে গেলেই পাবেন। বালুরঘাট, তপন . . . ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই গন্ধ আসবে নাকে। ধান পাকলে তো আর কথাই নেই। বলতে বলতে মুঠো আলগা করে দিয়েছিল রতন দাস। খোলা মাঠের এলোমেলো শীতল হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে গেছিল তার হাতে ধরা মাটির কণা। অদ্ভুত এক গন্ধ পেয়েছিলাম। দিনাজপুরের মাটির গন্ধ, বরেন্দ্রভূমিরও বলা যায়। বিষ্ময়াভিভূত আমি বলেছিলাম, আমরা কলকাতার দিকের লোক। তুলাই ছাড়া সেভাবে আর কিছুই চিনি না। রতন দাস বিড়ি ধরিয়েছিল একটা। ধোঁয়া ছেড়ে বলেছিল, শহুরে মানুষ এমনই হয়। বিজ্ঞাপন, চমক এসবের বাইরে কিছু চেনে না। কথাটা বলার সময় আবার হেসেছিল সে।  তার হাসিতে আমি আবারও লক্ষ্য করেছিলাম সেই গোপন ব্যথা, জমে থাকা অভিমান।  বিড়ি শেষ করে কথা শুরু করেছিল আবার, কৃষি প্রযুক্তি সহায়কের কাজ করি। জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটে গেল এই মাঠে মাঠে, কৃষকদের মাঝে। এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে ঘুরে ঘুরে। এই মাটিতেই খাদ্য আন্দোলন, তেভাগা। এরও একটা চরিত্র আছে। তা বুঝতে হয়। না হলে মাটির কথা, তার সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষের কথা কী আর লেখা যায়!  তাদের দুঃখ, কষ্ট, যুগে যুগে প্রাপ্য অধিকারের জন্য আন্দোলন। আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম রতন দাসের কথা।  গ্রাম মানেই সবুজের সমারোহ নয়, প্রকৃতির কোলে স্নিগ্ধ সময় কাটানো নয়। তারও মাঝে আছে আগুনের হলকা। তাদের ঝুপ করে জ্বলে ওঠার অপেক্ষা। রতন দাসের চোখে আমি সেই আগুন দেখিনি। কিন্তু তার লেখা বারবার আমায় উপলব্ধি করিয়েছে বেঁচে থাকা গ্রাম গঞ্জ-এর কথা। মুঠোর ভেতর নড়াচড়া করা বিশুদ্ধ বিপ্লবের কথা।

    রতন দাসের বাড়িতেও গেছি একবার। সাহিত্যের আড্ডায়। দেখেছি কি ভীষণ রকমের কাব্যহীন জীবন। ম্যাড়মেড়ে পোশাক। রঙ উঠে যাওয়া দেওয়াল।  আলো হাওয়া খেলা না করা ঘর। দম বন্ধ হয়ে এসেছে আমার। ছুটে বেড়িয়ে আসতে চেয়েছি কি যেন এক অজানা কষ্টে।   
কবি রতন দাসের কবিতার বই
ছন্দোবদ্ধ যন্ত্রণা

    রতন দাসের সঙ্গে এরপর দেখা  আমার অফিসে। পেনশন চালু করার লাইনে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছি, কি ব্যাপার রতনদা আপনি এখানে! কি কাজ আছে আমায় বললেই তো পারতেন। রতন দাস সেদিনও হেসেছিল। তার সেই গোপন ব্যথা জড়ানো অভিমানী হাসি। বলেছিল, সামান্য কাজ। মিটে যাবে ঠিক।  এর জন্য আপনাকে আর কষ্ট দেবো না।

    সেই শেষ। আর দেখা হয়নি কোনদিন।  কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায় সে। রাতের অন্ধকারে রেললাইন পার হতে গিয়ে, হোঁচট খেয়ে পড়ে। সেও ছিল এক শীতের রাত। রহস্যময় কুয়াশায় ভরা। একা অন্ধকারে নিঃশব্দে পড়ে থাকে।  সকলের অলক্ষ্যে। জানা হয় না রতন দাসের, শেষ ট্রেন চলে গেলে স্টেশান মাস্টারের  ভারি টর্চের আলো গিয়ে পড়ে তার ওপর।  রতন দাসের সে মৃতদেহ আমি দেখিনি। কিন্তু জানি তখনও তার ঠোঁটে লেগেছিল সেই ব্যথাতুর অভিমানী হাসি।  


    আজও কোন জনশূন্য স্টেশানের প্রান্ত বুকে লাগে বড়।  মনে পড়ে যায় কুশমান্ডির সেই সকালের কথা। পুকুরের ওপর জমে থাকা আবছায়া কুয়াশার কথা। গুমড়ে ওঠে বুকের ভেতর। আঙুল তুলে বলতে ইচ্ছা করে, দরজাটা বড্ড জোরে বন্ধ করলে হে, আর একটু আস্তে করলেও পারতে।
………………..
সবকটি চরিত্রের নামই অপরিবর্তিত
সম্পাদক রাজীব কুমার ঘোষ, রাজেশ কুমারের সঙ্গে
ছবি - সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা

জন্ম : ১৯৮০ মূলত গল্পকার। লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান, দৈনিক স্টেটসম্যান, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, তথ্যকেন্দ্র, কৃত্তিবাস, সংবাদ ৩৬৫ প্রভৃতি পত্র পত্রিকায়। এছাড়াও বাংলা লাইভ ডট কম, দ্যা ওয়াল, ইরাবতী, গল্পপাঠ-এর মতো ওয়েব ম্যাগাজিনেও। 
পেশায় - আধিকারিক, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। নেশা - লেখালেখি ও লং ড্রাইভিং।  
প্রকাশিত বই - বাউন্ডারি লাইন পেরিয়ে, সোপান পাবলিকেশান।