একুশে ফেব্রুয়ারির আগের রাত ।। শ্রীকান্ত অধিকারী |
এই সেদিন ফেব্রুয়ারি টোয়েন্টিথ, সারাদিন ঘোরাঘুরি করে বিভিন্ন সেমিনারে স্পিচ দিয়ে কোনোরকমে ডিনারটা নিয়ে বেডরুমে ঢুকে পড়েছিল লোকটা। না, লোকটা না হয়ে, আপনিও হতে পারেন কিংবা উনি বা তিনি। যে কেউ একজন হতে পারে। আচ্ছা ঠিক আছে গল্পের খাতিরে বা গল্পটাকে সযত্নে আপনাদের কাছে তুলে ধরার জন্য না হয় উত্তম পুরুষই আসুক।
ধরুন আমি একজন রীতিমত ভাষাবিশারদ। সাহিত্যিকও বলতে পারেন। আবার ক্ষুরধার বাগ্মীও। আমি অবশ্য নিজেকে সব কিছুর মধ্যে ‘আ কমপ্লিট লিটারেরি রিফর্মার’ মনে করি। আর তাতেই মঞ্চের পর মঞ্চ বাংলা ভাষার সংস্কার তথা বিশ্বের কাছে খুব গুছিয়ে, দরকারে চিকণতা এনে প্রেজেন্ট করি। কেননা আমি মনে করি বাংলা সাহিত্যে তেমন কোনও কাজ এখনও পর্যন্ত হয় নি। তা না হলে বেঙ্গলি লিটারেচর এমন পিছনের সারিতে এসে বসে। আমি ভাবি। আর ভাবলেই আমার গা গুলিয়ে ওঠে। এক সময় ঘুমিয়েও পড়ি।
হোমমেকারকে জানিয়ে দিয়েছি, আই’ম সো টায়ার্ড। সারাদিন ব্রেনে অনেক স্ট্রেস পড়েছে, এখন একটু রেষ্ট দরকার। আসলে আমি চাইছিলাম শুয়ে শুয়ে একান্তে রোমন্থন করতে। সারাদিন যেখানে যেখানে ‘বাংলা ভাষার হাল হকিকত এবং তার ভবিষ্যৎ’ নিয়ে যা যা বললাম সেটাকে নিয়ে কে কী বলল, কেমন রিঅ্যাক্ট করল তার একটা কপি মেমোরি কার্ডে ওপেন করতে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ লাঠি ঠোকার মত কিছু একটা বিশ্রী রকমের আওয়াজে আমার ঘুমটা গেল ভেঙে। চোখ কচলাতে কচলাতে দেখি সামনে বেঁটেখাটো লোক চোখ কটমট করে তাকিয়ে। পরনে সাদা থান কাপড়। হাঁটুর ওপর তোলা। গায়ে কোনো জামা বা আলখাল্লা নেই। ঊর্ধ্বাংশ ঢাকা আছে এক খন্ড সাদা কাপড়ে। সব থেকে অদ্ভুত লাগল ওর চুলের ছাট দেখে। কানের ওপর অনেকটা তোলা। ঠিক যেমন উড়িয়া’রা কাটে।
আমি হাঁ করে,
কিছুটা ভয়ার্ত বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছি দেখে হাতের লাঠিটা আরও একবার পাথরের মেঝেতে
জোরসে ঠুকে এক রকম ধমকে বলে, ‘বর্ণপরিচয়’টা
কখনও পড়েছিস?
‘আর সহজ পাঠ!’ এতক্ষণ খেয়াল করিনি, পাশে আরেকজন জোব্বা পরা অদ্ভুত দর্শণের ঢ্যাঙা, টিকালো নাকের লোক দাঁড়িয়ে আছে। এক মুখ অতিরিক্ত লম্বা দাড়ি। হাতে ছাতিমের ডাল।
শীতের গভীর রাত। রুমে এমনিতে কোনও আলো জ্বলছিলো না। তবে স্ট্রিট লাইটের কিঞ্চিৎ ছটা জানলার পর্দা ফাঁক করে ঢুকে পড়েছে। একে কাঁচা ঘুম ভাঙায় মেজাজ বিগড়ানো অবস্থা, তার ওপর কী অদ্ভুত সব প্রশ্ন! টিকি গরম হবার যোগাড়। তাও যদি কোনও পরিচিত জন হত, তা হলে না হয় আরেক কথা। তবু দুজনেই বয়স্ক, চেনা চেনা লাগল বলে নিজেকে ডিসেন্ট মুডে কনভার্ট করে নিয়ে জিজ্ঞেস করি, তোমরা কারা? অ্যাকচুয়ালি ডিটেক্ট করতে পারছি না তোমাদের।
ভয়ংকরভাবে দাবড়ে দিয়ে বলে, এতদিনে যখন চিনতে পারিস নি আর চিনে কাজ নেই। যেটা বলছি তার উত্তর দে, ‘‘বর্ণপরিচয়’ কিংবা ‘সহজ পাঠ ’ পুস্তকদুটির কোনওটার নাম কি শুনেছিস?’
আমি বেশ
বিরক্তের সুরে উত্তর দিলাম, ‘যে বইগুলোর কথা বলছ সেগুলো কবে
সেই গরুফেলা প্রাইমারিতে পড়েছিলাম। এখন তো ছেলে-মেয়েরা সে সবের নামই শোনেনি।’
‘হ্যাঁ। তা
না হলে তোর চোখের সামনে বাংলা ভাষার এমন শ্রাদ্ধ হয়!
‘মানে?’
জোব্বা পরা লোকটা সটান এসে আমার কান ধরে মুখটাকে এমন ঘোরাল, আমার ঘুমের লেশমাত্র থাকল না। বলল, ‘বিভিন্ন সভাতে তো চেয়ার দখল করে বক্তৃতা দিচ্ছিস, দেখ তোর বাগানের দিকে তাকিয়ে।’
দেখলাম সারা
বাগান জুড়ে মুনলাইটের ফোকাস এসে আছড়ে পড়েছে। তাতে আমার বাগানটাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে
রেখেছে। যেটা আমি এতদিন চেয়েছিলাম।
‘ইয়েস! হোয়াট এ লাভলি গার্ডেন! সো?’ চোখে আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।
‘ওরে গরু
তোর বাগানের মুখে কী লেখা আছে দেখ।’
‘হ্যাঁ প্ল্যাকার্ড! ওটা তো আমার বাগানের নাম –‘লকখি রানীর বাগান’। মাই প্যাশন!’
‘প্যাশনই
হোক আর ফ্যাশনই হোক নিজের ইমোশনকে অর্ধচন্দ্র দান করে এই বানান! ‘ক’ এর সঙ্গে ‘খ’ এর যোগ! তাতে হ্রস্ব ‘ই’ কার! লিখলি কী করে! আর রানিতে –‘ঈ’ কার!’
‘ইয়েস! সেই রামনারায়ণ আমলের যুক্ত বর্ণমালা, একজনের ওপর আরেকজনের কাঁধেচাপা শব্দের জটিলতা আজ উধাও। বদলে বাঙালি এখন যতটা সম্ভব ওপেন শব্দ আই মিন যুক্তব্যঞ্জন বাদ দিয়ে সেটাকে সরল করার চেষ্টা করছে। যেমন ‘উজ্জ্বল’ শব্দে পেছনে লাগা ব’ কবে আনইউজড অরগ্যানের মত লোপ পেয়ে গেছে। কিংবা ‘জিজ্ঞেস’ বানানে কেউ ‘জিগ্যেস’ লেখে অর্থাৎ ‘জ’ পর 'ঞ’ এর ব্যবহার না করে তো দোষের কী! বর্তমানে ও সব কেউ দেখে না। মোদ্দা কথা বুঝতে পারলেই হল। মনের ভাব মিষ্টি করে বোঝানোই তো ভাষা! যে শব্দ যত ভারহীন হবে তত মানুষের কাছে গ্রাহ্যতা বাড়বে। গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
তোর ঐ
সরলীকরণের কারণ বর্ণকে লোপ করে দেওয়া ! শব্দের
ভারহীন অর্থ কি শব্দের গাম্ভীর্য বা সৌন্দর্য নষ্ট
করা?
‘হ্যাঁ সময়ের সাথে সাথে তো বিলোপ - আগম – সংযোজন- বিয়োজন তো আছেই! ব্যাকরণবিদরা তো তাই বলেন। আরও কত আছে শুনবে? বড়ো বড়ো মনীষীও গরুতে ‘গ’ এ ‘ও’কার দিয়ে ছিলেন! উনি লিখলেন “সশঙ্কিত চিত্তে”। আবার কেউ লিখলেন, ‘তাই তো তোমায় শুধায় অশ্রুজলে’ এ রকম কত উদাহরণ দেব! অশ্রু আবার জল! তাদের বেলায় সেটা ভুল নয় আর্ষ প্রয়োগ! ঋষিদের প্রয়োগ!
‘তা বলে মুক্তবদ্ধ শ্বাসাঘাত যুক্ত ব্যঞ্জন মুক্ত ব্যঞ্জন হলন্ত স্বরান্ত ধ্বনি শব্দ এগুলো সব শবাধারে শায়িত করে দিয়ে নিজ মত পোষণ করা কি ঠিক? একটা ধ্বনি-সামঞ্জস্য তো থাকতে হবে। আর তা দিয়ে বাংলা ভাষাকে বিশ্ব প্রাঙ্গণে তুলে ধরলে ঔচিত্যবোধে ঘা লাগবে না!
‘সে তো প্রিন্টিং মিস্টেক বা ‘টাইপো’ মিস্টেক হয়! ‘ওগো বধূ সুন্দরী’ দেখনি? সেখানে অধ্যাপক ওরফে বাঙালীর আইকন উত্তমকুমার তো বলেই দিয়েছেন, ‘বলার সময় কারো খেয়াল থাকে না।’ তোমরা কি জানো বর্তমানে বাংলা একাদেমি বলে একটা প্রতিষ্ঠান আছে, তারা সব বিখ্যাত ভাষাবিদদের মিলিত চিন্তাভাবনার মূল্যবান ধীশক্তির প্রয়োগে বাংলা বানানবিধি নিয়ে একটি মহান পুস্তক রচনা করেছেন এবং এটাই এখন বাংলা ভাষার প্রবাহকে আই মিন ফ্লো’কে ত্বরান্তিত করে আধুনিক প্রজন্মের কাছে বিশ্বস্ত করে তুলছে। আর বাংলা ভাষাকে কীভাবে ব্যবহার করব, কিংবা বাংলা বানান কী হবে এই নিয়ে যে ব্যবহার বিধি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তাতে মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়! কে নেই সেখানে অশোক মুখোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস, পরেশচন্দ্র মজুমদার, পবিত্র সরকার থেকে শুরু করে রাজশেখর-রবীন্দ্রনাথ ঘুরে সুকুমার সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে হালের সুভাষ ভট্টাচার্য, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুন সেন, ক্ষু্দিরাম দাস। আর কার কার কথা বলব? এনারা বানানের জন্য আমাদের কাছে উপদেশের ঝুড়ি রেখে দিয়েছেন। নিতে পারলে হল!
সেখানে কি লেখা
আছে লক্ষ্মী বানান ক’ এর সঙ্গে খ’ মিশিয়ে ম’ কে বেত মেরে তাড়িয়ে দিতে! এইজন্য প্রথমেই জিজ্ঞেস করে ছিলাম ‘বর্ণপরিচয়’ কিংবা ‘সহজ
পাঠ’ পড়েছিস কিনা। পড়িস নি। আসলে তোদের প্রজন্ম সনাতন ঐতিহ্যকে
নির্লজ্জের মত অস্বীকার করে এই কারণে যে, তারা তাদের
পূর্ব পুরুষদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে পুরোপুরি অজ্ঞ। আর সেই অজ্ঞতাকে আবৃত করে রাখে বিদেশিভাষা
তথা সাহিত্য-সংস্কৃতির উচ্ছ্বিষ্ট দিয়ে, সম্পূর্ণটা দিয়ে নয়।
‘এ বিষয়ে তেনারাও তো কম যান নি। ‘বর্ণপরিচয়’ এর আগে ১৮১৬ সালে বারো পাতার একটা বাংলা বর্ণ শিক্ষার বই প্রকাশিত হয় ‘লিপিধারা’। সেটা তো মিশনারিরাই প্রকাশ করে। প্রথম প্রাইমার। তারপর স্টুয়ার্ট লিখলেন বাংলাভাষার দ্বিতীয় প্রাইমার –‘বর্ণমালা’। তারপর ঈশ্বরচন্দ্র বসুর ‘শব্দসার’। বঙ্গ বর্ণমালাও সেই বছর। শিশুসেবধি, জ্ঞানারুণোদয় ইত্যাদি আর কত বলব। এতেই থেমে থাকে না। মদনমোহন তর্কালংকারের ‘শিশুশিক্ষা’কে বাদ দিতে পারেন? তার পরে তো ‘বর্ণ পরিচয়’। সেই যুক্তাক্ষরের কচকচি ।
‘শোনো বাপু! এখন কেউ ‘কুজ্ঝ্বটীকা’ সিলেবেল নিয়ে টিকিতে দড়ি বেঁধে দুলে দুলে পড়া মুখস্ত করে না। আর দাঁড়ি কমা সেমিকোলন কোলনের বাংলা যতি চিহ্নের পেছনে কেউ ছোটে না। এখন মোদ্দা কথা মনের ভাবটা বোঝাতে পারলেই হল! ব্যস!
‘তা বলে এভাবে কি পড়া উচিৎ, গরু আমাদের প্রধান খাদ্য, গরু আমাদের প্রধান খাদ্য, …বহন করে। বহন করে। পড়ার রীতি হল, -গরু আমাদের প্রধান খাদ্য বহন করে।
‘এমনও তো লেখা যায় বা পড়া যায়, — লোকারণ্য কর্দমাক্ত ময়দান আকাশ মেঘাচ্ছন্ন পাহাড় ধুমায়িত চা পানে শরীরের শীতলতা দূর করার জন্য একটি হোটেলের করিডরে আপেক্ষারত আমরা কজন। — এতে কি বুঝতে কারো অসুবিধে হল? কি দরকার একটা সিম্পল বাক্যের পথ কণ্টকাকীর্ণ করে? কণ্টকাদীর্ণ হলে তো পথ চলার আনন্দই মাটি।
শিশুরা হস্ত পদ সঞ্চালনেই তো আনন্দ পায়। সেখানে কি সম্পূর্ণ মানুষের পরিমিত যাপন চিত্রের ব্যাকরণ বোধ থাকে? না। সেই আনন্দকেই আমরা আগামী পথের পাথেয় করে নিই। ভাষার ক্ষেত্রেও তো তাই। সম্পূর্ণ বাক্যবিন্যাস, রীতিনীতির লঘু অথচ দৃঢ় বন্ধনের স্বাভাবিক গমনের মধ্যেই ভাষার স্থায়িত্ব সূচিত হয়।
‘নিয়ম নীতির নিগড়ে ভাষার টুঁটি চেপে ধরলেও তো হবে না!’ আমি যুক্তির পর যুক্তি খাড়া করি। করেই যাই। ঠিক করেছি ঐ লোকদুটোর কাছে কিছুতেই হার মানব না।
‘তাই বলে যতি চিহ্ন বা শ্বাসাঘাতের দিকে দৃষ্টি দিবি না! ভাবকে মান্যতার মধ্যে আনতে হবে না?’
‘শ্বাসাঘাতের কষাঘাতে আর আমাকে জ্বালিও না বাপু! বাংলা ভাষা নিয়ে আনেক দিন ধরে অনেক বিজ্ঞজনে কপচিয়েছে। ভাষা শুধু ইমোশন-কে ধরলেই হবে না, মোশনকেও ধরতে হবে নইলে, — যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে/ সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে। এ আর নতুন করে বলব কী!
আমার কথা শেষ না হতেই ওদিকে লম্বা দাড়িবওলা লোকটা গোঁফের ফাঁকে একবার যেন খুক খুক করে হেসে উঠল। পাশে লোকটার কানে কানে বলল, ‘এরা সব জানে, সব বোঝে, তবু এরা ফুটো নৌকাতেই চড়ে। এ জাতি জীবনহারা!’
‘অসম্ভব!
এভাবে আমরা আমাদের উত্তরসূরীদের ত্যাগ করে যেতে পারি না। এরা বড্ড বেশি অবুঝ !
বড্ড বেশি জেদি। আর বড্ড বেশি লোভী!’
লাঠির আঘাত সমানে মেঝেতে পড়তে দেখে লম্বা লোকটা খানিক যেন ভীত কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে, বেশি কিছু চেল্লাচেল্লি কর না, এরা বাঁশের বাড়ি মেরে তোমার মাথা ফাটিয়ে দিতেও পিছপা হবে না।’
‘দিক!
অনেক বারই তো দিয়েছে। মেরে আমাদের সর্বাঙ্গ ভেঙে চুরমার করে দিলেও বলতে ছাড়ব না।
এখনও তো কিছু লোক আছে যারা বাংলা ভাষাকে মাতৃদুগ্ধের মত সেবন করে। মায়ের পরিচর্যা
করে! এক দুটো মানুষ নয় একটা গোটা দেশ এই ‘আ মরি বাংলা
ভাষা’র জন্য জীবনদান করতে পারে। আর এদের মত কিছু সবজান্তা
মানুষ পৃথিবীর একটি অমূল্য ভাষার
জীবদ্দশায় শ্রাদ্ধ করে দেবে, এ আমি মানতে পারছি না। তোমরা তো আমাদের উত্তরসূরী। কই
তোমরা তো এই ভাষাকে অবহেলা করতে পারনি।
তুমি তো ইচ্ছা করলে কত নতুন নতুন ধারা সংযোজন করতে পারতে। ইচ্ছে করলে এই বাংলা ভাষার গতির সঙ্গে দিকও
পরিবর্তন করতে পারতে।’
‘এরা সে
সব ঐতিহ্যের কথা ভুলে গেছে।’
আমি বললাম, ‘ঐতিহ্যকে ধরে রেখে তো সমাজ সাহিত্য এগিয়ে যেতে পারে না। সময়টাকে ধরতে হয়। এখন যেমন স্মার্ট ফোনের ডিজিট্যাল কি বোর্ডে লিখে, চ্যাট করে মেসেজ দিয়ে যে ভাবে কথোপকথন চলছে তাতে কি ছেলে মেয়েরা, আই মিন আধুনিক প্রজন্ম তাদের ভাব বোঝাতে পারছে না। বেশ তো দিব্যি গড় গড় করে কথা বলে চলেছে চুপি চুপি। কই তাদের তো কোথাও কোনও অসুবিধা হচ্ছে না!
আমরাও তো উচ্চকন্ঠে শোনাতে পারি, ‘হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন/তা সবে অবোধ আমি, না না আমরা অবহেলা করি পরধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমন...’ আই হ্যাভ টু কাম এগেইন মাই ডিয়ার! হাঃ হাঃ হাঃ’
হাসির দমকে আমার বেডরুম আর বেডরুম থাকে না। সচকিত হয়ে লক্ষ্য করি আমার সামনে হঠাৎ
আবির্ভূত হয় আরেক জন! দু’য়ে রক্ষে নেই আবার এক জন হ্যাট
কোট টাই বুট পরিহিত, এদের তুলনায় একেবারে আলাদা, অত্যন্ত স্মার্ট বলে মনে হল, চওড়া
মুখে মানানসই সজ্জিত দাড়ি, হঠাৎ ফার্স্ট অ্যাপিয়ারেন্সে সাহেব
বলে ভুল হবে। কিন্তু একেও আমি লাইব্রেরির পোর্ট্রেইটে দেখেছি কিনা অ্যাকচুয়ালি
বলতে পারব না। চুরুট মুখে আমার দিকে বিস্ফারিত চোখে এমন ভাবে তাকিয়ে, যেন বলতে চাইছে,
এ আবার কে! আমাদের রেখে যাওয়া ভবিষ্যৎ! না ভবিষ্যতের ভবিষ্যৎ! নাকি ভবিষ্যতের ভূত!
এতক্ষণ তবু ঠিক ছিল। কিন্তু এরপর যা ঘটল তা আমার ব্যক্ত করার ক্ষমতার বাইরে। সেই লোক তিনটে দু বাহু তুলে, কখনও লাঠি ঠুকে আর ছাতিম ডালের বাড়ি দিতে দিতে সারা রাত উচ্চ স্বরে আবৃত্তি–সঙ্গীতে-নৃত্যে উৎসব লাগিয়ে দিল।‘
আনায়
মাঝারে বাঘে পাইলে কি কভু/ছাড়ে রে কিরাত তারে? বধিব এখনি, অবোধ, তেমতি তোরে! জন্ম
রক্ষঃকুলে তোর, ক্ষত্রধর্ম্ম, পাপি, কি হেতু পালিব/তোর সঙ্গে?’ — তারপর হু হু করে হুগলি–পদ্মার স্রোতের
মত কারা যেন সব আসতে লাগল! নাচতে নাচতে গান গাইতে গাইতে। কেউ
বাঁশি বাজাল, কেউ সরোদ তো কেউ একতারা নিয়ে বাউল! কেউ গেয়ে উঠল – ‘বাংলা আমার সর্ষে ইলিশ চিংড়ি কচি লাউ...বাংলা
ভুলি কী করে।’ একদল আবার ঘরের এক
কোণে বসে হাত পা ছড়িয়ে গাইতে শুরু করে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি...’।
প্রথমে কাকুতি মিনতি করে বোঝালাম কালকে আমার অনেক কাজ আছে, চাপে থাকব। অন্তত গোটা কয়েক বক্তব্যের ব্লু প্রিন্ট করা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে স্পিচের ম্যাটারটা বড্ড দুর্বল ও অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে। দু একটা সংস্কৃত শ্লোক বা ইংরেজি ভাষায় কোটেশন দিতে না পারলে আই মিন জ্ঞানী গুনীজনের সিমপ্লি ভার্সন মঞ্চের ওপর থেকে ছুঁড়ে দিতে না পারলে কি আর সুবাগ্মী হওয়া যায়! কিছুতেই এমন বিছিকিচ্ছিরি পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারছিলাম না। ধীরে ধীরে রক্তের মধ্যে অধৈর্য্যের পারদ চড়তে শুরু করেছে অনেকক্ষণ। এবার আর আটকে রাখতে পারলাম না। দিলাম ঝেড়ে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আনন্দপাগল মানুষগুলোকে প্রথমে দাবড়িয়ে, পরে চিৎকার করে বললাম, ‘তোমরা আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও। আমি আর নিতে পারছিনা। জাস্ট লীভ মি অ্যালোন প্লিজ!’
ঘর থেকে বের হওয়ার আগে ওরা সকলে মিলে কেমন করুন সুরে আবৃত্তি করে, ‘নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছ আমার সত্তায়। ...তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো, বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।’
হঠাৎ কানের কাছে নাগাড়ে ঠক ঠক শব্দ হয়েই যাচ্ছে। চোখ মেলে দেখি বন্ধ কাচের জানলার ওপারে কতকগুলো দোয়েল পাখি জানলার গায়ে ঝরে পড়া শিশির রেখাতে চঞ্চু দিয়ে ভোরের শিশিরের স্বাদ নিচ্ছে। জানলার ফাঁকে ভোরের আলো। আমার সাড়া পেয়ে ওরা উড়ে গেল। জানলার শার্শি খুলতেই সাধের বাগান চোখে ধরা দিল। অবাক হয়ে দেখি কালকে রাত পর্যন্ত যে লিখনটা ছিল, ‘লকখি রানীর বাগানবাড়ি’ সেটা আর নেই। তার বদলে লেখা রয়েছে – আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। শুদ্ধ ভাষা দিবস।
অদূরে কোত্থেকে ভেসে আসে একটা মন কেমন করা গান, ‘আমি বাংলায় গান গাই। আমি বাংলার গান গাই।/আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই।’
আহা কী মিষ্টি গান! কী অসাধারণ সুর! কী অসাধারণ কথা। গুন গুন করে আমার হৃদয় গেয়ে ওঠে, ‘আমি বাংলায় গান গাই। আমি বাংলার গান গাই ...’ 🚫
মূল সূচিতে ফিরে যেতে এখানে ক্লিক করতে হবে
শ্রীকান্ত অধিকারী। সিউড়ি বীরভূম। পেশায় শিক্ষক। মাষ্টার্স — বাংলা ভাষা এবং শিক্ষা। নেশা গল্প, প্রবন্ধ ও ভ্রমন কাহিনী লেখা। প্রিয় শিশুতোষ চরিত্র সৃষ্টি — রাঙাপিসি। জ্বলদর্চি পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে রাঙাপিসির গল্প নামে শিশুতোষ গল্পের সিরিজ প্রকাশ পাচ্ছে।
আদ্যন্ত গ্রামের মানুষ। তাই গল্পে বারবার গ্রামজীবনের সমস্যা তথা নানান কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। দেশ, আনন্দবাজার, সানন্দা, বর্তমান, তথ্যকেন্দ্র সহ নানা পত্র পত্রিকায় গল্প প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া দি ওয়াল, ইরাবতী, পারক, জ্বলদর্চি ইত্যাদি নানান ওয়েব ম্যাগাজিনেও লিখে চলেছেন। প্রথম গল্পগ্রন্থ — হাঁসের পালক। প্রকাশক — সৃষ্টিসুখ পাবলিশার্স(২০২০)।
0 মন্তব্যসমূহ