সম্পাদকীয় ।। ওয়েব সংখ্যা ৫

সম্পাদকীয়

বাঁক বদল

 

কোভিড এবং লক ডাউন পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা এবং তার প্রকাশে কি কোনো উল্লেখযোগ্য বাঁক বদল হয়েছে? অথবা যাকে অনেকেই বাঁক বদল মনে করছেন আসলে তা অনিবার্য ছিল, কোভিড পরিস্থিতি তাকে ত্বরান্বিত করেছে মাত্র?

    মোটামুটি ২০০০ সালের আগে সাহিত্য প্রকাশ ও প্রচারের প্রধান মাধ্যম ছিল বিভিন্ন মুদ্রিত পত্র পত্রিকা যার মধ্যে প্রচারে এবং প্রসারে অবশ্যই এগিয়ে ছিল বাণিজ্যিক পত্রিকা এবং সংবাদপত্র। অধিকাংশ ব্যক্তিই আঞ্চলিকভাবে বিভিন্ন ছোটো পত্রিকাগুলি সম্পর্কে অবহিত থাকলেও ‘লিটল ম্যাগাজিন’ এই ধারণা এবং তার গুরুত্ব সম্পর্কে সেইভাবে অবহিত ছিলেন না। এখনো যে খুব একটা অবহিত তাও অবশ্য নয়। সমাজের বৃহৎ অংশের কাছে সাহিত্য এখনো খুব একটা আবশ্যিক এবং দৈনন্দিন বিষয় নয়। তবে তুলনামূলকভাবে এখন কলেজ পড়ুয়ারা অনেক বেশি অবহিত লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে। এই পরিবর্তনের পিছনে স্থানীয় লিটল ম্যাগাজিন কর্মীদের অবদান অনস্বীকার্য। এখন তো বিভিন্ন জনপদে নির্দিষ্ট সময়ে লিটল ম্যাগাজিন মেলারও আয়োজন হয়ে চলেছে। আমাদের মনে পড়তে পারে পুরুলিয়া জেলা স্কুলের ইংরাজি প্রশ্নপত্রে শ্রী সন্দীপ দত্ত প্রতিষ্ঠিত কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি নিয়ে থাকা একটি প্রশ্ন। লিটল ম্যাগাজিনের মূল সমস্যা প্রচার ও বিপণনের। আগে কলকাতা বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলয়ন এই কাজের প্রধান ভরসাস্থল ছিল। এমন নয় যে, যারা স্টল পেতেন তাদের পত্রিকাই শুধু থাকত। মোটামুটি উল্লেখযোগ্য সব লিটল ম্যাগাজিনগুলিই পাওয়া যেত বিভিন্ন স্টলে। এখনো যায়। বর্তমানে সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত বা বিভিন্ন স্থানীয় লিটল ম্যাগাজিন আয়োজিত মেলাগুলো এই সমস্যার অনেকটা সুরহা করেছে। নতুন প্রজন্মের যারা লিটল ম্যাগাজিন করছেন তারা কিন্তু প্রচারে জোর দিচ্ছেন, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা অনুসারে দক্ষভাবে অর্থের সংস্থানও করছেন। আবেগের পাশাপাশি প্রফেশনাল ঢং-এ ম্যানেজমেন্টেও তারা জোর দিচ্ছেন। এর ফলে সহজে কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনগুলির মৃত্যু ঘটছে না। তারা পাশাপাশি ওয়েব এমনকি তাদের পত্রিকার অ্যাপও বানিয়ে ফেলছেন। 

    দৈনিক সংবাদপত্রের রোববারের সাহিত্য বিভাগ এবং তাদের সংস্থার প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকাগুলিতে যারা নিয়মিত লিখতেন বা লেখেন এবং পাঠক মন জয় করতেন বা করেন নিজ লেখনী গুণেই, তারাই জনমানসে সাহিত্যিক হিসাবে অবস্থান করেন। স্বাভাবিকভাবেই বড় প্রকাশনাগুলি থেকে তাদের বই-পত্তর প্রকাশিত হয়। এর পিছনে যেমন তাদের লেখার সাহিত্যমূল্যকে অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই ঠিক তেমনই তাদের জনপ্রিয়তা বই বিক্রিয় নিশ্চয়তাও দিত প্রকাশকদের কাছে। আগে আক্ষরিক অর্থেই হাজার হাজার বই ছাপা হত। বিভূতি রচনাবলীর প্রথম সংস্করণের (১৩৮৪) মুদ্রণ সংখ্যা ছিল ৮৫০০; এখন ঠিক সেই অবস্থা আর নেই। মাঝে মাঝে আমরা বিপুল বিক্রির নানা প্রচার দেখি বটে কিন্তু তা কতটা ভরসাযোগ্য তথ্য তাতে সন্দেহ থেকেই যায়।

মোটামুটি এই রকম পরিস্থিতে চারটি বিষয় পটভূমিকা পরিবর্তনের অনুঘটক হিসাবে দেখা দিয়েছিল বিগত দুই দশকে।

(এক) স্মার্ট ফোনের আবির্ভাব, সেই সঙ্গে নানা কারণে সাধারণ মানুষের সেই ফোন ব্যবহার করতে বাধ্য হওয়া। এর ফলে কিন্তু প্রত্যেকের হাতে বা নজরে যে কোনো লেখা পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হল। যে ব্যক্তি হয়ত আগে সংবাদপত্রটিও নিয়মিত পড়তেন না ফেসবুকের সৌজন্যে তারও চোখে পড়তে থাকছে নানা সাহিত্য বিষয়ক পোস্ট। তিনি পড়েও ফেলছেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠছেন।

 

(দুই) ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইউ টিউব এবং আরো নানাবিধ সোসাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিল ছোটো পুঁজির প্রকাশকরা এবং প্রচারের ব্যয়ভার বহনে অক্ষম বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিন। ফেসবুক অত্যন্ত কার্যকরী হয়ে উঠল এই ব্যাপারে। নামী প্রকাশনা বা সংবাদপত্র ফেসবুকে আসতে কিন্তু দেরী করে ফেলল। ফলে মুদ্রিত দুনিয়ায় যে সমীহের জায়গা তার তৈরি করতে পেরেছিল, পুঁজির জোরে প্রচারের এই প্ল্যাটফর্মে তারা বিশেষ কোনো জায়গা তৈরি করতে পারলো না। ততক্ষণে বহু পত্রিকার ওয়েবে কাজ কর্ম শুরু হয়ে গেছে। শুরু হয়ে গেছে ফেসবুক গ্রুপে সাহিত্য চর্চা। খুব সম্প্রতি লিটল প্রচার লিটল প্রসারের করা ১৯১টি লিটল ম্যাগাজিন ওয়েব পত্রিকার হাইপারলিঙ্কের তালিকা চোখে পড়েছে অনেকেরই।

 

(তিন) নবীন বেশ কিছু প্রকাশনার আবির্ভাব বই পাড়ায়, যারা প্রকাশনা ব্যবসায় থাকতেই এসেছে এবং ‘টাকা পাইলেই ছাপিব’ এই সহজ পথ ছেড়ে দীর্ঘ যাত্রার কষ্টকর প্রস্তুতি এর মধ্যেই সাঙ্গ করে ফেলেছে। বলাই বাহুল্য এদের প্রচারের একটি বড় ভরসার জায়গা ডিজিটাল মিডিয়া। এইসব প্রকাশনের সাহয্যে যোগ্য অনেক লেখকেরা উঠে আসছেন পাদপ্রদীপের আলোয় তথাকথিত নামী প্রকশনা থেকে বই প্রকাশ না পেয়েই। খ্যাতিমান হবার পথটি কিন্তু এখন শুধু বড় প্রকাশক বা বড় পত্রিকার দালানবাড়ি দিয়েই শুধু যায় না, অনেক উঠোন দিয়েই যাচ্ছে। আগেও যেত, কিন্তু উঠোনের সংখ্যা বড়ই কম ছিল।

 

(চার) টাকা দিয়ে বই করা ব্যাপারটি এখন আর লুকোনো বা লজ্জার জায়গায় নেই। নিজের বই নিয়ে প্রচার আর বিপননের ব্যাপারটিও বুক ঠুকেই করছেন সবাই। যার নিজের লেখার প্রতি আস্থা আছে নানা প্রকাশনাকে দিয়ে বই করাচ্ছেন, যার প্রোডাকশন দেখলে অনেক সময়েই গুলিয়ে যাবে নামী প্রকাশনীর বইয়ের সঙ্গে। অনেকে নিজেও প্রকাশ করছেন। সেই সব বই পাঠকপ্রিয়তাও লাভ করছে। বিগত দুই দশক ধরে অনেকেই ডিটিপি আর অফসেট প্রিন্টিং-এর ব্যাপারগুলি বুঝে ফেলেছেন ভালোভাবেই। লেখকদের ঠকানো এখন আর ততটা সহজ নয়। স্বাভাবিকভাবেই এই লেখকদের প্রাথমিকভাবে নিজেদের একটি পাঠক বৃত্ত থাকে, সেটা একশো হতে পারে, দু’শো হতে পারে, পাঁচশো হতে পারে। এখন আর কেউ ছাপার সংখ্যা নিয়ে মাথা ঘামায় না, বিশেষত ‘প্রিন্ট অন ডিম্যান্ড’ ব্যবস্থা চলে আসার পর। দরকার হলে প্রথমে দশটি বই, পরে আরো কুড়িটি বা যত চাই। হাজার সংখ্যায় বা তার ওপরে যাদের বই মুদ্রিত হয় তারা এই সংখ্যা নিয়ে উপহাস করতে পারেন কিন্তু তারা ভারতের বিমান পরিষেবা ক্ষেত্রে এয়ার ডেকানের ব্যাপারটা খেয়াল রাখবেন। সত্যি কথাটা হল এই পিওডি পদ্ধটি লিটল ম্যাগাজিন আর ছোটো প্রকাশকদের অসীম ক্ষমতা দিয়েছে নিজেদের যত খুশি ব্যপ্ত করার। এক্ষেত্রে দীর্ঘদীন ধরে পুঁজি আটকে থাকার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য হয়ে যাচ্ছে। এই লকডাউন পরিস্থিতিতে যখন বড় বড় প্রকাশকরা ভয়াবহ সমস্যায় পড়েছেন প্রধানত তাদের বড় ইনফ্রাস্ট্রাকচার আর বিপুল সংখ্যক মুদ্রিত বই নিয়ে, সেখানে ছোটো প্রকাশকেরা সমস্যায় পড়লেও বিপুল পরিমানে জমে থাকা বইয়ের বোঝা বা বড় পরিকাঠামোর পেছনের খরচ তাকে বহন করতে হচ্ছে না।

    প্রধানত ওপরের এই চারটি বিষয়কে ঘিরে ধীরে ধীরে একটা বাঁক আসছিল প্রকাশনা এবং লিটল ম্যাগাজিন জগতে। এমন সময় এসে পড়ল কোভিড পরিস্থিতি। এবার দেখা যাক এই পরিস্থিতি কীভাবে প্রভাব ফেলেছে।

    স্মার্ট ফোনের দৌলতে যেহেতু বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহারের অভ্যাস তৈরি হয়েছিল তাই বিভিন্ন সাহিত্যগোষ্ঠী আয়োজিত অনলাইন সাহিত্য অধিবেশনে জুম বা গুগুল মিট ব্যবহার করে যোগ দিতে সেইভাবে খুব বড় অসুবিধা হয় নি কারো। বরং দূরের সদস্য যারা নিয়মিত হাজির থাকতে পারছিলেন না তারাও অনলাইনের সৌজন্যে নিয়মিত হাজির থাকতে পারছেন। এখন তো সারা দুনিয়া থেকেই অংশগ্রহনকারীরা উপস্থিত থাকছেন। এখানে যখন অনুষ্ঠান হচ্ছে তখন হয়ত আমেরিকায় রাত, তবুও রাত জেগেই তারা উপস্থিত থাকছেন।

কলকাতা কেন্দ্রীক বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেভাবে কলকাতাবাসীদের প্রায় কুক্ষিগত হয়ে গিয়েছিল, সেই  অবস্থান জনিত সুবিধায় জল ঢেলেছে অন লাইন অধিবেশন। বিভিন্ন গুণীজনদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানগুলিও হয়ে উঠছে অত্যন্ত মনোগ্রাহী। আগে যিনি দশজনের মধ্যে অনায়াসে রাজা সাজতেন এখন তাকে একশোজনের মধ্যে রাজার পদ ধরে রাখতে সচেষ্ট হতে হচ্ছে। লাভবান হচ্ছেন উপস্থাপক, শ্রোতা সবাই। অঞ্চলভিত্তিক গন্ডী থেকে স্থানীয় লেখকরাও বেরিয়ে আসতে পারছেন বৃহত্তর জগতে। এর একটা বড় প্রভাব কিন্তু পড়ছে সামগ্রিকভাবে এমনকি তা বিপননের ক্ষেত্রকেও প্রভাবিত করছে। আগে যাদের নাগাল পাওয়া সহজ ছিল না তাদের ফোন নম্বর যেমন বিভিন্ন হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে সহজলভ্য হয়ে যাচ্ছে, সেই লেখকও আরো বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারছেন। একইভাবে আগে যাদের নাম কেউ শোনেনি, অনলাইন অনুষ্ঠানে তাদের আবিষ্কারও করছেন আগ্রহী পাঠকবৃন্দ। পরিচিতির যে জায়গায় যেতে হয়ত তার আরো সময় লাগত সেই জায়গায় লকডাউন সৌজন্যে একটু দ্রুতই পৌঁছে যাচ্ছেন সেই লেখক।

অনেক মুদ্রিত পত্রিকা এর মধ্যেই বন্ধ বা অনিয়মিত হয়ে গেছে। এ কথা আমরা সবাই মনে মনে জানি যে মুদ্রণের দিন যেতে বসেছে, হয়ত মেরেকেটে আরো দুই দশক। তার পর বই মুদ্রিত হলেও ডিজিটাল মাধ্যমের পাঠকরাই হবে সংখ্যাগুরু। ঠিক যেভাবে আজ টাইপের ব্যবহার খুব কম। আদালতের বিশেষ কিছু কাজ না থাকলে টাইপের ব্যবহার সেভাবে হয়ত থাকতোই না। এখনই বর্তমান প্রজন্ম পি ডি এফ বা ই-বুকে অভ্যস্থ হয়ে গেছে। যারা পুরনো প্রজন্মের প্রতিনিধি এই লকডাউনের সৌজন্যে তারাও অভ্যস্থ হয়ে উঠছেন ক্রমশ। এর একটা প্রভাব দেখা যাচ্ছে কিন্তু ই-বুক ক্রেতার সংখ্যায়। ই-বুক ক্রেতার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন ই-বুক কিনতে এবং পড়তে।

লকডাউনে যারা নিয়মিত পাঠক তারা তো বটেই লিটল ম্যাগাজিনের পাঠকরাও কিন্তু বাড়ি থেকে অর্ডার দিয়ে পোস্টের মাধ্যমে বা ক্যুরিয়ারের মাধ্যমে বই আর পত্রিকা আনাতে অভ্যস্থ হয়ে গেছেন। ধীরে ধীরে অধিকাংশ পাঠকই অভ্যস্থ হয়ে গেছেন পোস্টাল বা ক্যুরিয়ার চার্জ দিতে। এটা কিন্তু মাঝারি, ক্ষুদ্র প্রকাশক আর লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে একটা আশার দিক। আশি টাকার পত্রিকা পেতে কুড়ি টাকা ডাক খরচা দিতে কেউ আপত্তি করছেন না। আর প্রকাশনা থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যক বই নিলে তো ডাক খরচা অনেক সময় উসুল হয়ে যায়। লকডাউন পরিস্থিতিতেই অনেকের বই বা পত্রিকা কিন্তু ডাকযোগেই বিক্রি হয়েছে।

উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে ইউ টিউব। অনেকে গল্প-পাঠের চ্যানেল খুলে ফেলেছেন। অডিও বুক আর তার অ্যাপ আগে থাকলেও একটু পুরনো প্রজন্ম তা ব্যবহার করতেন না। ইউ টিউবে চেনা-পরিচিতিদের গল্পপাঠ হয়ত দায়ে পড়েই শুনতে শুনতে আজকের দিনে কিন্তু পাঠকের একটি বৃহৎ অংশ এই অডিও গল্পে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছেন। কপিরাইট ইত্যাদি চক্করে কিন্তু বর্তমান প্রতিথযশা লেখকেরা এর সুবিধা প্রথমেই নিতে পারেন নি। সেক্ষেত্রেও জায়গা আগেই দখল হয়ে গেছে প্রধানত লিটল ম্যাগাজিনের লেখকদের হাতে। প্রতিথশারা যতক্ষণে নেমেছেন ততক্ষণে কিন্তু জনমানসে বড় হাউসের লেখকেরা বা বাণিজ্যিক পত্রিকার লেখকেরাই একমাত্র ভালো লেখেন এই ধারণা পাল্টে গেছে।

এবার একটা প্রশ্ন উঠবে, যা আলোচনা হল তা ডিজিটাল মিডিয়া ভিত্তিক। সব পাঠক তো আর ডিজিটাল মিডিয়ায় নেই, সব ক্রেতাও নেই। তাহলে? সেক্ষেত্রেও এখন অঞ্চলভিত্তিক বিপননে বিভিন্ন স্থানীয় প্রকাশকেরা এবং বলাই বাহুল্য লিটল ম্যাগাজিনরা সামান্য হলেও খানিকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। এমনকি যে বইগুলো বেশ ভালো বই সেগুলো অনেকবার পুনঃমুদ্রিত হচ্ছে। মনে রাখতে হবে স্থানীয় দোকানের শোকেসে একটি স্থানীয় বই রাখা মানে সেটি কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে জনপ্রিয় একটি বইকে সেখান থেকে হটিয়ে দিচ্ছে।

ফেসবুকে লিখে লেখক হয় কি হয় না সেই বিতর্কে আমরা যাব না। যার লেখক হবার সে ফেসবুকে লিখলেও হবে না লিখলেও হবে। কিন্তু ফেসবুক লিখতে আসা নবীনদের নানা দাদাদের দ্বারস্থ হওয়া থেকে অনেকটাই মুক্তি দিয়েছে একই সঙ্গে সুযোগ করে দিয়েছে তার লেখা অনেকের নজরে আনার। ফুল ফুটলে তার সৌরভ এখন শুধু বাতাসের মাধ্যমেই যায় না, ফেসবুকের মাধ্যমেও অপেক্ষারত নাকে যায়। আমরা যারা এই সাহিত্য জগতে আছি তারা কিন্তু বেশকিছু নাম জানি যাদের ফেসবুক লেখাতে আকর্ষিত হয়ে প্রকাশক এমনকি সংবাদপত্রও যোগাযোগ করেছে। তারা অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত লেখক।

লকডাউন পরিস্থিতির জন্য বিখ্যাত লেখকেরা কিন্তু অনেক বেশি করে অনলাইন সাক্ষাৎকারে আসছেন। এর ফলে পাঠকেরা, ভবিষ্যতের লেখকেরা উপকৃতই হচ্ছেন। তারা সরাসরি লেখকের অভিজ্ঞতা শুনতে পারছে, এমনকি কখনো কখনো প্রশ্নও রাখতে পারছে। লকডাউনে হাতে সময় থাকার জন্য পাঠকরাও এগুলো শুনছেন। একইভাবে অ-বিখ্যাত লেখকেরাও অনলাইনে আসছেন। তাদের সম্পর্কেও পাঠক জানতে পারছেন। অনেকসময়ে আগ্রহও তৈরি হচ্ছে।

এই সব কিছুর উল্লেখযোগ্য ফলাফল পেতে হয়ত আরো কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু আমরা বলতেই পারি একটা বাঁক শুরু হয়েছে। এই বাঁকে কোনো পাড় ভাঙবে আবার কোনো পাড় গড়ে উঠবে। ভাঙা গড়ার যে খেলা চিরন্তন সেই খেলাটি লকডাউন ত্বরান্বিত করেছে এবং হয়ত অভাবনীয় কোনো নতুন খাতেও এই প্রবাহ বেঁকে গিয়ে বইতে পারে। যারা এখনো ভাবছেন কোভিড পরিস্থিতির পরিবর্তন হলেই সব আবার ঠিক আগের মতো হয়ে যাবে, তারা সম্পূর্ণ ঠিক ভাবছেন না। ঠিক আগের মতো কিন্তু পরিস্থিতিটা থাকবে না। 

আমাদের শুধু একটাই প্রার্থনা প্রবাহটি যেন ঘোলা না হয়ে যায়, কলুষিত না হয়ে যায়, একেবারে ক্ষীণ না হয়ে যায়। ‘বিখ্যাত-অখ্যাত’, ‘বাণিজ্যিক-লিটল ম্যাগাজিন’, ‘পুঁজি–পাল্টা পুঁজি’ আমরা সবাই কিন্তু আসলে একটা নৌকাতেই বসে আছি। আর সেই নৌকাটি এমন কিছু কিন্তু বড় নয়। ভয় একটাই নৌকাটা আমরা একেবারে না ডুবিয়ে ফেলি আর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের দিকেই আঙুল তুলে বলবে, এরাই ছিল বাংলা সাহিত্যের ঘাতক, বাংলা ভাষাচর্চার ঘাতক। 🚫


আবার সূচিতে যাবার জন্য ক্লিক করুন 📃


আপনার মতামত নিচে 
'আপনার মন্তব্য লিখুন' শীর্ষক বক্সে লিখে 
আমাদের জানান। 
লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকে 
পাঠকদের মতামতে। 🙏