সাইন্যাপস্ অণুগল্প ৬।। আবেশ কুমার দাস |
দরজা
আবেশ কুমার দাস
বস ডেকেছিল চেম্বারে।
শতানীককে টপকে
প্রোমোশনটা হয়েই যাচ্ছে আমার।
হওয়ারই ছিল।
লোকটা পছন্দই করে আমাকে। হাবেভাবেই শুধু নয়, কথাবার্তাতেও বেশ বোঝা যায়। কিন্তু যা
বলল আজ লোকটা...
ধাঁধায় পড়ে
গেলাম। বুঝতে পারছি না বাবা বেঁচে থাকলে খুশি হত নাকি।
সবকিছুর মূলে
আসলে আমাদের বাড়ির সদর দরজাটা।
বাবা লোকটা
ছিল মাথায় খাটো। সাড়ে পাঁচ ফিটের একটা দরজা পেলেই গলে যেত আরামসে। বাবার দিকের
বাকিরাও ওই পদেরই। জ্যাঠা। কাকারা। ঠাকুরদাকে যদিও চোখে দেখিনি আমি। কিন্তু অদ্ভুত
ভাবে মামার বাড়ির তরফে আবার সক্কলেই তালঢ্যাঙা। মা-ও বাবার চাইতে মাথায় অল্প উঁচুই
ছিল। ঢুকতে বেরোতে দরজা ঠেকেও যেত মাথায়। কিন্তু এই নিয়ে মায়ের তরফে কোনওদিন কোনও
অনুযোগ কানে আসেনি আমার। দাদুর মতের বিরুদ্ধে গিয়েই বাবার হাত ধরে বেরিয়ে আসা
মায়ের। পরে যদিও মিটমাট হয়ে গিয়েছিল সব।
মনে আছে যেদিন
বড়মামা প্রথম এল আমাদের নতুন বাড়িতে...
উফ, কোথায়
বাড়ি করলে গো সুকুমার! গাড়িটা ঢুকলই না এত ফ্র্যাকশনাল অ্যাড্রেসের চক্করে। আর এত
কষ্ট করে নিজে দাঁড়িয়ে বাড়ি তুললে। খুঁতটা রেখে দিলে দোরগোড়াতেই!
কী বলুন তো
দাদা...
আর কী। তোমার
বাড়ি ঢুকতে যে প্রায় এক হাত মাথা ঝোঁকাতে হবে এখন থেকে...
ওটা তো খুঁত
নয় দাদা...
বাবার মুখের
দিকে চোখ পড়তেই আচমকা টের পেয়েছিলাম সেদিন। হাসি চওড়া হওয়া কথাটার অর্থ। বাবা
বলছিল, ওটা ইচ্ছাকৃতই। আমরা খাটো মানুষ। ওতেই চলে যায়। আর নিজের লোক হলে মাথা
ঝুঁকিয়ে ছুটে আসতেও কিন্তু আটকাবে না দাদা...
বড়মামা
মানুষটাকে ছোটবেলায় বেশ পছন্দই হত আমার। দামি চকোলেটের লোভে। কিন্তু সেদিনের পর
থেকে আর ক’বার আমাদের বাড়ি এসেছিল মানুষটা, বোধহয় হাতে গুনেই বলা যায়।
আমিও বড়
হচ্ছিলাম।
আর বাড়ছিলাম
মাথায়। সবাই বলত, মামার বাড়ির ধাত পেয়েছি আমি। ক্লাস নাইনে উঠতে না উঠতেই টের পেলাম
এখন থেকে আমাকেও মাথা নীচু করেই ঢুকতে হবে বাড়িতে। তা তিনশো পঁয়ষট্টি দিনের
রুটিনের যা পরিণাম হয়। একটা সময়ের পর থেকে ওটাই অভ্যাস হয়ে গেল আমার।
আজ বস ডেকেছিল
চেম্বারে। সুখবরটা দিয়ে বলল, মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না ভৌমিক। তোমার হাইট পাঁচ
দশ হতে পারে। তবে আমাদের দরজাগুলোও তো ছ’ ফিটের কম নয়। উঁচু দরজা দিয়ে ঢুকতেও
যাদের মাথা ঝুঁকে যায় তাদেরই পছন্দ আমার...
সেই থেকেই
ভাবছি।
বাবা বেঁচে
থাকলে কি খুশি হত আজ! 🚫
আবেশ কুমার দাস |
জন্ম ৩০ মার্চ, ১৯৮৩ নৈহাটিতে। প্রযুক্তিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। যদিও অনুরাগ সাহিত্যে। গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। এখনও অবধি প্রকাশিত গ্রন্থ পাঁচটি। তিনটি ছোটগল্প সংকলন --
বনলতার বিজন (২০০৯),
পুরনো দিনের ছবি (২০১২)
মর্ফিয়ুস (২০১৫)
যথাক্রমে সিনেমা ও ক্রিকেট বিষয়ক দু'টি প্রবন্ধের বই --
তপন সিংহঃ সার্বিক চলচ্চিত্র বীক্ষা (২০১৬)
বাইশ গজের কিসসা (২০১৯)
সাইন্যাপস্ পত্রিকা ওয়েবে প্রকাশিত
5 মন্তব্যসমূহ
বাহ্ খুব ভাল
উত্তরমুছুনচমৎকার লেখা। সার্থক অণুগল্প।
উত্তরমুছুনবেশ লাগল। 🙂
উত্তরমুছুনএই মধ্যবিত্ত ভালোমানুষদের মাঝে সাধারণ জীবনে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের গল্প কোনো না কোনো ভাবে আপনার গল্পে আসে। প্রত্যাশাও থাকে।
এই দরজায় মাথা নীচু করে ঢোকার দ্যোতনা। খাটো মানুষ।
গড় সাড়ে পাঁচ উচ্চতার দেশে পাঁচফুট দশকেও কেউ বলছে 'আমাদের দরজাগুলোও ছ ফুটের কম নয়!'
পড়লে ফুরিয়ে যায় দু মিনিটে... ভাবা ফুরোয় না। 🙂
খুব ভালো লাগল। দরজা নিয়ে যে এমন করে গল্পের দিক নির্ণয় করা যায়, আমরা ভাবতে পারি না।
উত্তরমুছুনদারুণ । অনেক দিন পর একটা সত্যিকারের গল্প পড়লাম। অণু কথাটা ইচ্ছা করেই বাদ রাখলাম।
উত্তরমুছুন