তৃতীয় ওয়েব সংখ্যার কবিতাগুচ্ছ


বাঁশবেড়িয়ার অহংকার কবি তারাপ্রসাদ সাঁতরা। মৃদুভাষি, আত্মমগ্ন, প্রচারে মতিবিহীন এই কবির কবিতাও সেই অর্থে খুব সোচ্চার বা উচ্চকিত নয়। কিন্তু তার কবিতারা চুপ এসে বসে পাঠকের পাশে। পংক্তি থেকে পংক্তিতে চলার পথে পাঠক অজান্তে কখন ধরে ফেলেন পাশে চুপ বসা কবিতার হাতটি। ধরে ফেলেন কবি তারাপ্রসাদ সাঁতরার হাত। পাঠ সাঙ্গ হয়, আবেশ থেকে যায়। পাঠক অপেক্ষায় থাকেন পরের কবিতাটির জন্য।

।। তারাপ্রসাদ সাঁতরার কবিতাগুচ্ছ ।।

মনোহর মাঝি

নৌকাটি তীরে বেঁধে
গাছের নীচে বিশ্রাম নিচ্ছে মনোহর
ঢেউগুলি তীরে এসে ধাক্কা দেয়
তীর ভেঙে ভেঙে পড়ে . . .
মনোহর দ্যাখে নদীর ক্ষুধা।

চন্দনা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময়
বলেছিল -  বয়স হয়েছে পরিশ্রম কম করতে।
চন্দনাও কি দেখেছে তার পরিবেষ্টিত
সীমানায় ভাঙনের আতঙ্ক?

এক ঝাঁক পাখি ওপার থেকে 
এপারের এই গাছে এসে বসলো।
গাছও জানে বর্ষায় তার শরীর 
ছুঁয়ে যায় নদীর জল 
তখন পাখিরা নীরব।
তারাও কি দ্যাখে জীবনের পারে
স্তব্ধতার চোরা শিকার ?

মনোহর নৌকার দিকে তাকিয়ে থাকে . . .
নৌকা নাচে অবিরাম ঢেউয়ের ইঙ্গিতে 
তার চোখের সামনে একে একে ভেসে ওঠে
জীবনের খসে পড়া বিবর্ণ সব দিন . . .


দেয়ালে ঝুলন্ত চিত্রপট

দেয়ালে ঝুলন্ত চিত্রপট
তিনটি হাঁস। সাদা ।
সবুজ গাছপালার ভিতর একটি দৃশ্যমান চাকা
প্রচ্ছদ জুড়ে উদভাসিত আলো ।

বছর কুড়ি আগে কিনেছিলাম
মেলা থেকে 
সুন্দর সকালের এই ছবি

বর্তমানে অনেকটা মলিন
তবুও প্রতিদিন পরিচ্ছন্নতার হাত রাখি
যদি স্বপ্নের এই সকাল ফিরে আসে একদিন।

এখন ভাবনার গতি অনেকটা  শ্লথ
যে ছবি প্রতিদিন ফুটে ওঠে  রাতে  দিনে 
দেশে  দেশান্তরে . . .
মনে হয় এই দিন ফিরতে পৃথিবীতে 
আরও অনেক  শতাব্দী বাকি ।


ধর্ম শব্দটির পাশ থেকে

ধর্ম শব্দটির পাশ থেকে 
তুলে নাও রঙ-বেরঙের পালক।

কোন্ রঙ  কোন্ কথা বলে
বুঝতে পারে না কেউ।

তাই রঙিন পালকে মরণের পদধ্বনি . . .

কেবল সাদা পায়রাটি থাক।
শুভ্রতা উড়ুক আকাশে বাতাসে . . .
পরমেশ্বরই আমাদের পিতা 
সন্তানদের কোন রঙ হয় না  আলাদা।


ভালোবাসার বাড়ি

দুঃখের পাশে বাড়ি বানিয়েছি ভালোবাসার ।
বিষন্ন দুঃখগুলি ভেঙে ভেঙে পড়ে 
ভালোবাসার ঘায়ে।

সহসা দুঃখ আসে না, তাই
কষ্টগুলিও ততটা শেকড় ছড়ায় না
গভীরে ।
ভালোবাসার উষ্ণতায় দুঃখের মূর্তি 
ক্রমশ বিলীন হয় . . .

আজও ভালোবাসার বাড়িটি যত্নে সাজাই
প্রতিদিন রোপন করি গোলাপের চারা
ফুল ফোটাই 
দিই সাত সমুদ্রের জল, তারার আলো . . .

একদিন ভালোবাসা চলে গেল বলে 
রাঙাদিদি হারালো নিজেকে
তার বাড়িটা বড় শূণ্য, খাঁ খাঁ  করে 
ওদিকে গেলে তবু ভালোবাসাকেই মনে পড়ে।

ভালোবাসাকে আগলে রাখতে হয় বুঝেছি।
নয়তো সে-ও ফাঁকি দিতে জানে ।


গাছকে নিয়ে দুজন

গাছকে নিয়ে দুজন । একজন 
পথিক।

গাছের মায়া চিরকালীন।
স্বাগত জানালো। সাদরে 
ফল দিল
দিল শীতল বাতাস, দহনে।

গাছটির শরীরে কুঠারের দাগ।
মানুষের ।
কে বলে মানুষ শ্রেষ্ঠ ?
উপকারীর উপকার অস্বীকার করে।

পথিক নিশ্চিন্ত নিরাপদ।
মগ্ন তপস্বী -  সত্যকে জেনেছে, 
তাই সবুজ পাতার ভিতর ফুটে ওঠে বুদ্ধের চেতনা।

নীল আকাশের নীচে
একমাত্র পবিত্র জীবন এই গাছ, চির- প্রেমিক  
আমাদের প্রথম পূর্বপুরুষ ।

জানালা খুলে রাখি

পাখি ডাকছে . . . ভোরের প্রত্যাশা বুকে
রাত্রির ঘর থেকে উঠোনে এসে দাঁড়াই ।
না, এখনো সেই গাঢ়তর অন্ধকার,
এখনো রাতের পরিসীমা অন্তহীন।

পাখি নয়, রাত্রি-হরবোলা ডেকে ওঠে মাঝে মাঝে . . .
উপহাস, ছলনা . . . এক নিরবিচ্ছিন্ন সাজসজ্জা তার . . .

ঘরে গিয়ে বসি আবারও
আবারও কান পেতে থাকা
একটি প্রকৃত সংলাপের, আগামী প্রভাতের রোদ্দুর বুকে।

এদিকে দিন ফুরিয়ে যায় আমারও
যত ছবি    মৃত মানুষের    দেওয়ালে টাঙানো
ধুলো জমা    অদ্ভুত হাসে- কাঁদে . . .

তবুও জানালাটা খুলে রাখি
একটু আলো, সামান্য।
যদি ফিরে যায় টোকা দিয়ে দরজায়
যখন আমি অসতর্ক, নিদ্রামগ্ন জগতের
বাসিন্দা।

আপনার মতামত নিচে 
'আপনার মন্তব্য লিখুন' শীর্ষক বক্সে লিখে 
আমাদের জানান। 
লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকে 
পাঠকদের মতামতে। 🙏

    বাঁশবেড়িয়ার কবি তারাপ্রসাদ সাঁতরার জন্ম ১৯৬৫ সালের পয়লা অক্টোবর। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর । বাঁকুড়ার জল মাটি হাওয়ায় বেড়ে ওঠা এই কবির কবিতার সঙ্গে সহবাস ছোটবেলা থেকেই। 

তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্হগুলি হল  
খুঁজবো কোথায় তোকে         (২০০৩ ) ইসক্রা।   
হলুদ পাতার ঘর                (২০০৫) ইসক্রা।    
যদি বন্ধু  হতে পারো            (২০০৭) পত্রলেখা। 
এসো বৃষ্টিমেঘ এসো রোদ্দুর    (২০১০) পত্রলেখা। 
ছুঁয়ে আছি অপরূপ তোমাকে    ( ২০১৫) পত্রলেখা। 

    সামাজিক দায়বদ্ধতার সঙ্গে রহস্যময়তা তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
    এছাড়াও লিখেছেন দর্শন বিষয়ক দুটি গ্রন্হ  
আত্মবোধ                (২০১৫) পত্রলেখা, এবং  
মহাজীবনের সন্ধানে    (২০১৯) পত্রলেখা।  

কবিতার জন্য পেয়েছেন  দীনবন্ধু ঘোষ স্মৃতি পুরস্কার ২০০৬, 
এখন উচ্চারণ পত্রিকা থেকে সেরা কবি সম্মাননা ২০০৬ ,  
হুগলি জেলা কবিতা আকাদেমি থেকে কবিতা  আকাদেমি পুরস্কার 
তানিয়া হাজরা স্মৃতি সম্মাননা  ২০১৬,
বাংলাদেশ দেশ থেকে  পল্লী কবি জসীমউদ্দীন পদক ২০১৬ , 
বাংলাদেশ কবিতা সংসদ থেকে  - কবিতা সংসদ স্মারক সম্মাননা  ২০১৬  এবং 
গঙ্গা গোবিন্দ স্মৃতি পুরস্কার ২০১৬