রাজেশ কুমারের কলমে।। জলের মতন জলের খোঁজে ভেসে

পর্ব ১ ।। অদৃশ্য কালিতে লেখা


    খনও অবিভক্ত বর্ধমান জেলা। আজকের মতো পূর্ব-পশ্চিম দুটো ভাগ হয়নি। জীবনের প্রথম চাকরি নিয়ে গিয়ে উঠলাম তৎকালীন আসানসোল মহকুমা শহরে। কয়লা আর লোহার শহর। ধুলো ধোঁয়ায় ভর্তি। রাস্তার ধারের গাছগুলোও সব ধূলিধূসর, যেন বসন্ত এসে ফিরে গেছে সেই কোন কালে। বন্ধ শিল্পের ডালি নিয়ে বসে আছে রুক্ষ শহর। বি এন আর বাসস্ট্যান্ডে নেমে খানিক হেঁটে গেলেই আমার অফিস, আদালত চত্বরের আশপাশ। 

    গ্রীষ্মকাল। গায়ের চামড়া ঝলসে যাওয়া গরম। ওদিকে নতুন অফিস বিল্ডিং, দশ ইঞ্চির গাঁথনি। এসি নেই। দোতলার ঘর যেন হিট চেম্বার। ছাদে খড় ফেলেও রক্ষে নেই। মাথার ওপর সিলিং পাখা হার মানাবে বাইরের বয়ে চলা আগুনের হলকাকেও। গরমে আমার হাতের তালুর চামড়া উঠছিল সাপের খোলসের মতো। ঠোঁট ফেটে চৌচির। সব মিলিয়ে অনভ্যস্ত পরিবেশে বেশ নাস্তানাবুদ অবস্থা। তার ওপর অফিসটাও বেশ নির্মম। নিত্য নতুন ঝামেলা লেগেই থাকে। সামাল দিতে কালঘাম। আর এরকমই এক কঠিন সময়ে দেখা হয়ে গেল শম্ভুনাথের সঙ্গে। আমাদের অফিস পিওন। কালো চিমরে চেহারা। বয়সের গাছপাথর নেই। একদিন কি একটা কাজ নিয়ে এল। ভরা দুপুর, মুখ দিয়ে ভক ভক করে বাংলা মদের গন্ধ বের হচ্ছে। শুধু মুখ দিয়েই বা বলি কেন! সারা শরীর দিয়ে। শরীরের প্রতিটা রোমকূপ দিয়ে। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই লোকটার। দাঁতগুলো বিশ্রী, পোকাধরা। সেদিকে খানিক তাকিয়ে থেকেই গুলিয়ে উঠল আমার। গন্ধে নাকি ঘৃণায় কে জানে! বললাম, বেরোন, বেরিয়ে যান এখান থেকে। ভবিষ্যতে এরকম অবস্থায় আর আমার সামনে আসবেন না। একটু উঁচুস্বরেই বলেছিলাম। লোকটা কিছু কাগজ টেবিলে রেখে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। মেঝের দিকে তাকিয়ে। 

    তারপর বেশ কিছুদিন দেখা নেই শম্ভু বাবাজীর। এদিকে অফিসিয়াল চিঠি তো আর পায়রার পায়ে বেঁধে পাঠানো সম্ভব নয়। আবার আজকের মতো ই-মেইলেরও জমজমাট যুগ নয় সেটা। সাধারণ এক মহকুমা শহর, কাগজ বইতে মানুষেরই দরকার। অগত্যা খোঁজ খোঁজ। খবর এল তাঁর নাকি গোঁসা হয়েছে। না ডাকলে আর আমার সামনে আসবেন না। মানে! অফিসটা কী মান অভিমানের জায়গা নাকি! জিজ্ঞেস করলাম এক কলিগকে। উনি বললেন, শম্ভুনাথ অফিস ছেড়ে দেবে কিন্তু মদ খাওয়া ছাড়বে না। আমি বললাম, তাহলে তো ওর নামে নালিশ করতে হয় কর্তৃপক্ষকে। ভদ্রলোক এবার হেসে মাথা নাড়ালেন। শম্ভু পকেটে রেজিগনেসান লেটার নিয়েই ঘোরে। এর আগেও যে কতবার ঝামেলা হয়েছে ওকে নিয়ে। নানান জায়গা থেকে নানান অভিযোগ। 
   
     অভিযোগ! টাকা পয়সা চাওয়ারও অভ্যেস আছে নাকি! 

    না না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। একশো শতাংশ সৎ। আপনি ভল্টের চাবি রাখতে দিন, নিজে     হারিয়ে যাবে কিন্তু চাবি হারাতে দেবে না। ওসব টাকা পয়সার ধান্দা শম্ভুনাথের নেই। যত গন্ডগোল সব ওই মদ নিয়ে। আমি মাথা নাড়লাম বিজ্ঞের মতো। সাধে কি আর বলে, নেশা মানুষকে খায়। চাকরি গেলে চলবে কি করে ভেবে দেখছে না একবারও। ভদ্রলোক বললেন, ওর ভেবে দেখার কিছু নেই। একটাই বউ ছিল। বহুদিন আগে ভেগেছে এক পড়শির সঙ্গে। দুটো ছেলে, ছোট থেকে মানুষ করেছে একা হাতে। বিয়ে থাওয়া দিয়েছে। এখন মদ খায় বলে বাপের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না ছেলেরা। এবার একটু নড়ে বসলাম।  মাতালদের সঙ্গে দায়িত্ব কর্তব্য বিষয়টা তো যায় না খুব একটা। 

    শম্ভুনাথকে ডেকে পাঠালাম একদিন, নিজের কাজ গোছানোর স্বার্থেই। ভালোভাবে বোঝালাম, কেন নেশা করা ঠিক নয়। ও চুপচাপ জী হুজুর করে গেল। জানতাম লাভ হবে না। তবুও জ্ঞান দিয়ে গেলাম একতরফা। আসলে ভেতরে ভেতরে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। সেদিনের খারাপ ব্যবহারটা ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম সুচতুরভাবে। সে যাইহোক, দু-এক দিনেই ভাবসাব হয়ে গেল আমার আর শম্ভুনাথের। আমি ওকে দিয়ে দুপুরের খাবার আনাতাম। দুটো রুটি আর তরকারি। দশ টাকা। একটা স্টিলের প্লেটে আনতো। একদিন দেখলাম, আলুর চিপস এনেছে একস্ট্রা। জিজ্ঞেস করলাম, দাম নিল নাকি! বলল, না। ভাতের হোটেল তো এমনিই দিয়ে দিল। তারপর একদিন দেখি রুটির সঙ্গে তরকারি, আলুর চিপস। আর দু-পিস বেগুনভাজা। জিজ্ঞেস করলাম কত নিল! বলল, কিছু নয়। রোজ খাবার আনতে যাই। চেনা হয়ে গেছে তাই দিল। আমি বললাম, দাম না নিলে আর নেবে না। এমনিতেই বেশি খাওয়া অভ্যাস নেই আমার। শম্ভুনাথ ঘাড় হেলিয়ে সায় দিল বটে, শুনল না। পরদিন খাবারের মেনুতে যোগ হল পোস্তর বড়া। দাম সেই একই, দশ টাকা। সোজাসুজি তাকাতে জবাব দিল, আপনার নাম বললাম দিয়ে দিল। এবার সন্দেহ হল আমার। আমি কোন হরিদাস পাল যে নাম শুনল আর দিয়ে দিল! এক একটা বড়ার দামই তো দশ টাকা হবে। সেই কলিগ ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা কি ব্যাপার বলুন তো! রোজ রোজ খাবারের আইটেম বেড়ে যাচ্ছে কিভাবে! ভদ্রলোক সব শুনে আবারও হাসলেন। বললেন, ব্যাপার আবার কি! মদ খাওয়ার খরচা। হোটেল মালিক গোপনে বেচে। ব্যাটা মাইনে পেয়ে সব টাকা জমা রাখে ওই হোটেল মালিকের কাছে। সেখান থেকেই কাটান দেয় এটা ওটা যা আনে আপনার জন্য। আমি তো হাঁ। বলেন কি, মদের টাকায় বেগুন ভাজা, পোস্তর বড়া! ভদ্রলোক বললেন, তাহলেই বুঝে দেখুন। আসলে আপনার বয়সটা তো কম, ওর বড় ছেলের মতোই হবে। তাই হয়তো….। 

    অদ্ভুত এক আনন্দ খেলে গেছিল ভেতরে ভেতরে। মনে হয়েছিল, নেশা মানুষকে খায়। ভাগ্যিস তার আবেগ অনুভূতি ভালোবাসা, ভালোলাগাগুলোকে খেয়ে নিতে পারে না।  প্রথম প্রথম সামান্য কিছু টাকা একস্ট্রা দিতে চাইতাম। শম্ভুনাথ নিত না। তারপর আর জোড়াজুরি করিনি সেভাবে। ভালোবাসার একটা আলাদা মূল্য থাকে। বেশি মূল্যবোধ সেখানে না দেখানোই ভাল। উলটো দিকের মানুষটা মিছিমিছি কষ্ট পেতে পারে। থাক সে কথা। আসানসোলে আমি একাই থাকতাম। দুপুরের টিফিনটা শম্ভুনাথই ব্যবস্থা করে দিত। তবে সেটাকে টিফিন না বলে লাঞ্চ বলাই ভাল। পরবর্তীকালে আরও অনেক পদই এসে জুটেছিল তার সঙ্গে। 

    ভালই চলছিল। সবকিছু গন্ডগোল করে দিল শম্ভুনাথের একটা ইচ্ছা। হঠাৎ বস ডেকে পাঠাল একদিন। খুব গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল, শম্ভুনাথের সঙ্গে আপনার কি সম্পর্ক। আমি থতমত খেয়ে উত্তর দিলাম, কি আবার সম্পর্ক! অফিসের যা সম্পর্ক তাই। ভেবেছিলাম বিনি পয়সায় ভোজ খাওয়ার কথা তুলবেন। কিন্তু না। পুরোপুরি চমকে দিয়ে বললেন, জানেন কী সে ব্যক্তি তার অবসরকালীন পাওনাগন্ডার নমিনি আপনাকে করতে চান। এবার আমার আকাশ থেকে পড়ার পালা। তাই নাকি! এব্যাপারে তো আমাকে কখনও কিছু বলেনি! বস মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে বলল, পাগল করে দিচ্ছে আমাকে। সুযোগ পেলেই ঘরে ঢুকে আসছে আর ওই এক কথা। আপনাকে নমিনি করবে সেটা অ্যাপ্রুভ করতে হবে আমাকে। যত বোঝাই এভাবে হয় না। সবকিছুর একটা নিয়ম কানুন আছে। নিজের লোকেদের বাদ দিয়ে এভাবে . . . কে শোনে কার কথা। একটাই বক্তব্য আমার নিজের কেউ নেই। এখন দেখুন আপনিই যদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে মাথায় ঢোকাতে পারেন বিষয়টা। 

    কী আর বলব। প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে উঠে এসেছিলাম বসের ঘর থেকে। শম্ভুনাথকে প্রশ্রয় দেওয়াটাই ভুল হয়েছে। বাড়াবাড়ির একটা লিমিট থাকা উচিত। রাগে কথা বলা বন্ধ করলাম ওর সঙ্গে। এক কলিগের পরামর্শে বসকে বলে বদলি করিয়ে দিলাম অন্য জায়গায়। শম্ভুনাথের অবসরের আর কয়েক মাসই বাকি তখন। 

    এরপর মাঝেমধ্যে আসতো আমার কাছে। কিছুক্ষণ বসে থাকত চুপচাপ। কথাবার্তা তেমন বলত না। আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখার চেষ্টা করত খুব মন দিয়ে। মনে হয় আঁচ করেছিল কিছু। আমি সোজাসুজি তাকাতাম না। 

রিটায়ারমেন্টের কিছুদিন আগে মারা যায় শম্ভুনাথ। শীতের রাতে আসানসোলের কনকনে ঠান্ডায় সারারাত পড়েছিল রাস্তায়। মদেই খেয়েছে তাকে। শুনে খারাপ লেগেছিল। 

তারও বেশ কয়েক মাস পরে শম্ভুনাথের পেনসনের কাগজপত্র এসে পৌঁছায় আমার হাতে। তাতে স্বাভাবিকভাবেই আমার নাম ছিল না। কিন্তু সব জেনেও কেন জানিনা বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল অদৃশ্য কোন কালিতে লেখা আছে। আগুনের উত্তাপে ধরলেই এখুনি স্পষ্ট হয়ে উঠবে সে নাম। 🚫

(লেখক ছাড়া অপর চরিত্রের নামগুলি পরিবর্তিত)

ব্যবহৃত অলংকরণ - সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা (ব্যবহৃত মূল ছবি - শুভম কুমার সরকার)

সম্পাদক রাজীব কুমার ঘোষ, রাজেশ কুমারের সঙ্গে
ছবি - সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা

জন্ম : ১৯৮০ মূলত গল্পকার। লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান, দৈনিক স্টেটসম্যান, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, তথ্যকেন্দ্র, কৃত্তিবাস, সংবাদ ৩৬৫ প্রভৃতি পত্র পত্রিকায়। এছাড়াও বাংলা লাইভ ডট কম, দ্যা ওয়াল, ইরাবতী, গল্পপাঠ-এর মতো ওয়েব ম্যাগাজিনেও। 
পেশায় - আধিকারিক, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। নেশা - লেখালেখি ও লং ড্রাইভিং।  
প্রকাশিত বই - বাউন্ডারি লাইন পেরিয়ে, সোপান পাবলিকেশান।