রাজেশ কুমারের কলমে।। জলের মতন জলের খোঁজে ভেসে

পর্ব ২ ।। মাঝরাতের কথাবার্তা


প্রতিটা ঝড়ের পরই শান্ত হয় প্রকৃতি। উঁচু উঁচু তাল নারকোলের গাছগুলো তাকিয়ে থাকে শূন্য চোখে। বাসাহারা পাখিরা ফিরে চলে আবার থিতু হওয়ার আশায়। মানুষের মনও তেমনই। 

    সালটা ২০১৪। কর্মসূত্রে হঠাৎ চলে আসতে হয় বালুরঘাট। ক্লান্ত বিধ্বস্ত এক মন নিয়ে। ব্যক্তিজীবনের টানাপোড়েন, ঘটনা দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত সে আমি যেন এক যুদ্ধ ফেরত অবসন্ন সেনা। কোথাথেকে আসছি কোথায় যাব তার কিছুই ঠিক নেই। ট্রেন কমপার্টমেন্টে বসে আছি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে। গতরাতে কে যেন বলেছিল, ভোরবেলা মালদায় অনেকক্ষণ দাঁড়াবে। সান্টিং হবে। কোনভাবেই কম্পার্টমেন্ট মিস করবেন না। হতে পারে আপনি মালদাতেই থেকে গেলেন, বাকি ট্রেন চলে গেল বালুরঘাট। ঘটনাটা তখনও বুঝিনি। আসলে যে গৌড় এক্সপ্রেসের টিকিট কেটেছিলাম তার গন্তব্য স্টেশান মালদা। ভোরবেলা সেই গৌড় এক্সপ্রেস থেকেই কিছু বগি কেটে নিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বালুরঘাট। পুরো ট্রেনটা যায় না। ভারি অদ্ভুত লেগেছিল। এমন একটা জায়গায় চলেছি যেখানে এই সময় দাঁড়িয়েও গোটা একটা  ট্রেন যায় না। সিঙ্গল লাইন। সকালে একবার বিকেলে একবার, আপ আর ডাউন, ট্রেন চলে একটাই। তার ওপর মালদা পেরোতেই যেন এক অন্য দেশ। প্ল্যাটফর্মগুলো দাঁড়িয়ে আছে দু'দিকের খোলা মাঠে। শীতকাল, সরষেফুলে হলুদ দূর দিগন্ত, কোথাও সোনালি আলো গমের ক্ষেতে।  কোলাহলের চিহ্নমাত্র নেই। নেই কোন হুটোপাটি। একটা করে স্টেশন পার হচ্ছে আর আমি যেন একটু একটু করে এগিয়ে চলেছি অন্য এক পৃথিবীর দিকে। কলকারখানাহীন দূষণমুক্ত নীল আকাশ, গ্রামেরর মাটির রাস্তা। সবুজ প্রকৃতি। সমস্ত আলো হাওয়া জুড়ে কী যেন এক অপার আনন্দ ছুটে বেড়াচ্ছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। দু-হাত তুলে ডাকছে আমায়। যেন বহুযুগ আগে থেকেই ঠিক হয়েছিল আমার এখানে আসার কথা।  

    বালুরঘাট স্টেশানে পা রাখতেই মনটা লাট খেয়ে উঠল হাওয়ায় ভেসে যাওয়া ঘুড়ির মতো। পুরোনো জীবনের সমস্ত শিকড় যেন নিমেষে উপড়ে গেল অদৃশ্য কোন টানে। শহরের বাইরে স্টেশন। যতদূর চোখ যায় সবুজ মাঠ। কালো পিচের রাস্তা, এঁকেবেঁকে চলেছে। দুদিকে সোনাঝুরি গাছ। আত্রেয়ী নদী পেরিয়ে আমি চলে এলাম আমার কর্মস্থলে। সেখানে আগে থেকেই প্রায় হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে ভবেশ। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। রোগাপটকা শরীর। পোষাকে দারিদ্রের চিহ্ন স্পষ্ট। তবে চোখমুখ দেখলে মনে হয় বিনয়ের অবতার।  আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল, মহোদয় রাস্তায় কোন অসুবিধা হয়নি তো! ঘোর কাটিয়ে আমি চোখতুলে তাকালাম। আহা! কী অভিব্যক্তি। যেন কৃষ্ণ সেবায় নিবেদিত প্রাণ। আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর মিটিমিটি হাসছে। কেমন চিটচিটে লাগল। গা জ্বলে গেল আমার। মহোদয় সম্ভাষণ শুনেই মনে হল, অতি  ভক্তি চোরের লক্ষণ।  নিশ্চয় কোনও ধান্দাবাজি আছে। তবে সেটা ঠিক কী ধরনের তা আর তলিয়ে ভাবিনি তখন। ভাবলে বুঝতে পারতাম, আমি এমন কোন কেউকেটা নই যে কেউ আমায় ভাঙিয়ে খাবে। সে যাইহোক, ভবেশ বলল, মহোদয়, অনেকটা পথ পরিশ্রম করে এসেছেন। ক্লান্ত আছেন। আগে হাতমুখ ধুয়ে নিন। তারপর সেবা গ্রহণ করবেন। সামান্য কিছু আয়োজন করে রেখেছি আপনার জন্য। কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। অফিসেরই একজন বলল, ভবেশদা ওরকমই। নতুন কেউ জয়েন করলেই হল, সব দায়িত্ব তুলে নেবে নিজের কাঁধে।  আর নতুন কেউই বা বলি কেন! আমাদের মতো প্রাচীন বটবৃক্ষগুলোকেও দিব্যি আমোদে আহ্লাদে রেখেছে ও। যখন যা কিছু দরকার নিসঙ্কোচে বলতে পার ওকে। আমি ভবেশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম আর ভাবলাম, এই তো ফেসটুন! একে দিয়ে আবার আমোদ আহ্লাদ! ভগবান জানে কাদের মাঝে এসে পড়লাম। ওদিকে ভবেশও তাকিয়েছিল আমার  মুখের দিকে। মিটিমিটি হাসছিল। ভাবখানা এমন, যেন আমি অন্তর্যামী। তাকিয়ে থেকেই আপনার সব কথা জেনে ফেলি।  

    ধারণাটা প্রথম পাল্টালো খেতে বসে। প্রথমপাতে বেগুন দিয়ে কুঁচোমাছের তরকারি। এখানে সব বাড়িতেই অতিথি আপ্যায়নে এই পদ নাকি থাকবেই। এক কথায় অসাধারণ। ভবেশের রান্নার হাতের তারিফ করতেই হয়। খেয়ে দেয়ে প্রাণভরে একটা সিগারেট টানলাম। সহকর্মী কুন্ডুদা এসে জানিয়ে গেল  অফিসে মাঝে মধ্যেই এরকম খাওয়া দাওয়া হয়। একটা ফান্ডও আছে তার জন্য। সবাইকেই কনট্রিবিউট করতে হয় সেখানে। বোঝই তো বাড়ি ছেড়ে সব এত দূরে আছি। আমি ঘাড় নাড়লাম।  তারপর কাজে বসলাম। ভবেশ সারাক্ষণ অফিসের মধ্যেই ঘুরে বেড়ালো। কখনও এ ফাইল নিয়ে এল তো কখনও ও ফাইল। বিকেলবেলা চা এনে দিল। আবার সেই গদগদে কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, মহোদয় আপনার কি সেবা করতে পারি! সত্যি কথা বলতে কি এবার আমার হাসিই পেল। জিজ্ঞেস করলাম, ওভাবে কথা বল কেন! মহোদয় আবার কি! ভবেশ একই সঙ্গে কান মুললো এবং জিভ কাটলো। বলল, আপনারা সব গণ্যমান্য ব্যক্তি। সম্মান না দিলে চলে! 

    হ্যাঁ, সম্মান দেওয়া কাকে বলে শিখেছিলাম ভবেশের কাছে। অফিসের পর হাঁটতে বেরতাম। খাদিমপুর, সাহেবকাছারির ওই ধারটায়। সান্ধ্যভ্রমণ। মাঝেমধ্যেই দেখা হয়ে যেত ভবেশের সঙ্গে। সাইকেল চালিয়ে হয়তো ফিরছে। আমায় দেখেই নেমে পড়ত সাইকেল থেকে। তারপর সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে হেঁটে চলত আমার পিছু পিছু।  একদিন জিজ্ঞেস করলাম, সাইকেলটা তো চালানোর বস্তু ওটাকে তুমি হাঁটিয়ে নিয়ে চলো কেন! ভবেশ উত্তর দিল না। কিছুদিন পরে একদিন ওই প্রসঙ্গ উঠল অফিসে। সেদিনই জানতে পারলাম সম্মান প্রদর্শনের এই অভিনব বিষয়টি। শুধু আমি নয়, অফিসের সবাই এই সম্মান পেয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আমরা সবাই বিরাট লেখাপড়া জানা মানুষ, কঠিন কঠিন কাজ করি আর ভবেশ সামান্য একজন অস্থায়ী কর্মচারী। নামমাত্র শিক্ষিত। তাই সে কিছুতেই আমাদের আগে যাবে না।  একবার এক জুতো পালিশওয়ালাকে ধরে এনেছিল এই বলে যে, সরকার বাহাদুর ডেকে পাঠিয়েছে। আমার তো তখন হার্ট অ্যাটাকের অবস্থা। কালি জুতোয় ঘষবে কী সেই হতভাগা না আমার মুখেই ঘষে দেয়! এটা ব্রিটিশ জামানা নাকি! চাইলাম আর যাকে তাকে তলব করে বসলাম। তাছাড়া আমার ক্ষমতাই বা কি! আশ্বস্ত করল অন্যান্য সহকর্মীরা। এই অফিসের পিওন চাপরাশি থেকে বড় সাহেব সবাই সরকার বাহাদুর। তাছাড়া ওই জুতো পালিশওয়ালাও সরকার বাহাদুর ছাড়া আর কেউ ডাকলে পালিশের কাজে যায় না। ভবেশের সঙ্গে ওর বোঝাপড়া ভাল। ও নিয়ে বিন্দুমাত্র চাপ খাওয়ার দরকার নেই। বুঝলাম সরকার বাহাদুর আসলে গুরুতর কিছু বিষয় নয়, ভবেশের দেওয়া উপাধিমাত্র।  

    তা এহেন ভবেশ বাবাজী অভিনব সব কান্ড কারখানায় মাতিয়ে রাখত আমাদের। নিজেও মজে থাকত কি যেন এক স্ফূর্তিতে। হাসিমুখ ছাড়া ভবেশকে কেউ কোনদিন অন্য মুখে দেখেনি। ছেলেটা যে কোথা থেকে এত জীবনী শক্তি পায়! এখানকার জল হাওয়ার মতো ওর মধ্যেও যেন অবিরত ছুটে বেড়ায় এক অনাবিল আনন্দ। খেলা করে সীমাহীন সারল্য। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই কাজ করে কটা টাকাই বা আর পাও। সংসার চালাতে অসুবিধা হয় না! ভবেশ হাসি হাসি মুখ করে বলেছিল, মহোদয় সবই আপনাদের আশীর্বাদ। ডাল ভাত আর আলুসেদ্ধ জুটে যায়, কালিয়া কোপ্তার কথা ভাবি না।  বাবা বলে গেছিল, ভবেশ বেশি ভাববি না। জীবনে যাহোক একটা কিছু উপায় ঠিক বের হয়ে যাবে। এখনও মাঝে মাঝে শ্মশানঘাটে যাই। রাতেরবেলা। বসে বসে বাবার সঙ্গে কথা বলি। বাবা বলে, আনন্দে থাক ভবেশ, আনন্দে থাক। মানুষের মধ্যে থাক। এই মাঠ ঘাট নদী নালার মধ্যে বেঁচে থাক। 

    ভারি আশ্চর্য হয়েছিলাম। ঠিক করেছিলাম ভবেশের সঙ্গে একদিন শ্মশানঘাটে যাব। আত্রেয়ীর তীরে, পূর্ণিমার গোল চাঁদ ওঠা রাতে, কঠিন নির্জনতায়। কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। কে জানে কেন!  তবে আজও মাঝে মধ্যেই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। নানান জটিলতা ঘিরে ধরে বিছানার চারপাশ। তখন শুধু আমি আর আমার ভেতরের মানুষটা। বিছানায় উঠে বসে আমি তাকে বোঝাই। বলি,  ভবেশের মতো হ, বুঝলি ভবেশের মতো হতে শেখ। সে মুচকি হাসে। বলে, ভবেশের মতো কী চাইলেই হওয়া যায়! চাইলেই কী পারা যায় এই পৃথিবীর আনন্দ ফুর্তি গায়ে মেখে বেঁচে থাকতে! 

কথা বাড়াই না আর। এক গ্লাস জল খেয়ে শুয়ে পড়ি আবার।  

........................................................

চরিত্রের নাম পরিবর্তিত।

অলংকরণ © সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা, ব্যবহৃত ছবি শুভম কুমার সরকার

সম্পাদক রাজীব কুমার ঘোষ, রাজেশ কুমারের সঙ্গে
ছবি - সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা

জন্ম : ১৯৮০ মূলত গল্পকার। লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান, দৈনিক স্টেটসম্যান, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, তথ্যকেন্দ্র, কৃত্তিবাস, সংবাদ ৩৬৫ প্রভৃতি পত্র পত্রিকায়। এছাড়াও বাংলা লাইভ ডট কম, দ্যা ওয়াল, ইরাবতী, গল্পপাঠ-এর মতো ওয়েব ম্যাগাজিনেও। 
পেশায় - আধিকারিক, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। নেশা - লেখালেখি ও লং ড্রাইভিং।  
প্রকাশিত বই - বাউন্ডারি লাইন পেরিয়ে, সোপান পাবলিকেশান।