হারানো সকালের পাখি
ভাষা দিবস। সেই হ্যালো ওয়ান টু থ্রি
বিকেল
কুড়ি বছর আগের একুশে ফেব্রুয়ারি।
ঘড়ির মোড়, ঝোলানো ব্যানার, রাস্তায় পাতা
চেয়ার,
মোড়ে বাঁক নেওয়া অটো, সাইকেল, বাস, রিকশ।
মঞ্চে সেদিন গণহত্যার কিস্সা —
কেশপুর,
গড়বেতা;
প্রতিবাদে প্রকাশ্যে কবিতা —
আমার ভাইয়ের
রক্তের গান,
মাদার ডেয়ারির সামনে রাষ্ট্রীয় বিবেক
সেদিন
টুকছিল নাম।
ঠিক তখন এক কবি, শুনেছি যার ছবি
পোড়ে
না আগুনে
ছিলেন কাছেই — হাসপাতালে, ফাগুনের আঁধারে।
মাইক ক্রমশ নিভে গেলে — সরে এসে আমরা
আছন্ন কবির সামনে তুলে ধরেছিলাম
সদ্য প্রকাশিত কবিতা। অক্ষরের ঘ্রাণ
নিয়ে
জেগে উঠে,
বুকে রেখে, জড়িয়ে ধরেছিলেন শীর্ণ শির
ওঠা হাতে।
বিবিধ ভারতীতে ফিরোজা বেগম তখন গাইছিলেন,
‘এই কি গো শেষ দান…বিরহ দিয়ে গেলে…’
চৈত্রে একটি স্মরণ সংখ্যা। কিছু লেখা।
কিছু হৃদয়ের কথা কিছু বা মুন্সিয়ানা।
এরপরের কুড়ি বছর ধরে
বাংলা ক্যালেন্ডারের ছেঁড়া সেই পাতাগুলো,
সিগারেটের প্যাকেটের সাদা পিঠ, অক্ষর
মাখা
আরো যত টুক্রো কাগজ ছিল জমে
সব হাওয়ার সাথে উড়ে গেল কার্তিকের হিমে।
যে কবির ছবি আগুনে পোড়ার কথা ছিল না
তার ছবি মুছে গেল উপেক্ষার শীতঘুমে।
আমি তো ছিলাম না আপনার শব্দকূহকে মুগ্ধ।
কতবার ঠুকেছি, “শুধু ঢেউ পাখি নীলাভ
নক্ষত্র ফুল?
আগুনের ছবি নেই কেন?”
অপরিসর বারান্দা থেকে ভেসে আসত
স্টোভের
হিস্হিস্।
চা দিয়ে কি সব ঢাকা যায়?
ঢাকা যায় অন্ত্রের রক্তক্ষরণ?
আমি তো ছিলান না আপনার ‘তীব্র সজল বিন্যাসে’,
মনে রাখার দায় ছিল না — আমার।
অথচ, কুড়ি বছর ধরে কুড়িটা ভাষাদিবসে
কবির ছবি আমি দেখলাম পুড়ছে আগুনে।
ভেবেছিলাম ফিনিক্স হয়ে ফিরবেন — ফিরলেন
না।
কোন নির্জন শ্মশানে পুনর্বাসন নিয়েছেন
আপনি
যেখানে আসার কথা ছিল কয়েকটি পাখির?
তারা কি এসেছিল? তারা কি এখনো আসে?
নতুন কোনো পাখি খুঁটে খাচ্ছে আপনাকে?
এই ওয়াই-ফাই লাস্যের মুক্তাঞ্চলে,
স্টাইল বাজার, আমাজন-ফ্লিপকার্ট-স্ন্যাপডিল,
গেম অফ্ থর্নস ফেলে, বেনিয়া চুঁচুড়ার
রৌদ্র ছায়ায়
সেই সব পাখিরা কি ফিরবে পাথরে নদীর মুখে?
আগামী ভাষাদিবসে
পাখিদের আমিই শোনাব
কবিতা।
শোনাব হারানো সকালের সেই পাখিটির কথা
‘যার চোখ থেকে বিদ্যুৎ
পাওয়া যেত’।
রাজীব
কুমার ঘোষ
‘চুঁচুড়ার রাজীব’ মানেই ‘সহদেববাবুর ঘোড়া’, ‘ভীষ্মদেবের মৃত্যুমুহূর্ত’, ‘অনেক জলের শব্দ’, ‘টাওয়ার অফ্ সাইলেন্স’, ‘হিবাকুশার ছেলে’
বা ঘোষ
স্যারের গল্পগুলি — বহুচর্চিত, ভিন্নমাত্রার কিছু গল্প। জন্ম ১৯৭৭; পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা
চুঁচুড়া-হুগলি-চন্দননগর। ১৯৯৭ সাল থেকে লিটল ম্যাগাজিন কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত এবং
নিয়মিত লেখালেখি। সম্পাদিত পত্রিকা ‘সাইন্যাপস্’। আছে বেশ কিছু কবিতার বই। প্রকাশিত গল্প সংকলন ‘ঘর ও দরজার গল্প’,
‘অনেক
জলের শব্দ’, 'আমাদের আশাতীত খেলাঘর'। গল্পের জন্য
বারাসাতের বহুস্বর পত্রিকার পক্ষ থেকে পেয়েছেন ২০১৯ সালের ‘অনন্তকুমার সরকার স্মৃতি পুরস্কার’। অণুগল্পের জন্য ২০১৮ সালে চুঁচুড়ার গল্প সল্পের আটচালার
পক্ষ থেকে পেয়েছেন ‘উৎপল স্মৃতি পুরস্কার’।
পেশায় বিজ্ঞান
শিক্ষক। নেশায় পাঠক। প্রিয় অবকাশ যাপন —
পাঁচশো
বছরের পুরনো জনপদের অলিগলিতে সময়ের ভাঁজে ভাঁজে ঘুরে বেড়ানো।
1 মন্তব্যসমূহ
খুব ভালো লেগেছে! কবিতায় তো আসলে এক ব্যক্তিত্ব, এক কান্না উঠে আসে - যেমন এই লেখাটি।
উত্তরমুছুন