গল্প ।। কাগজ ।। শ্যামলী আচার্য


       কালে যে খেতে দিতে আসে, তার মাথায় পাগড়ি। নীল রঙের। আকাশি নীল। দুপুরের লোকটা সাদা টুপি পরে। কিন্তু রাতে যে আসে, তাকে আমি দেখিনি। কোনোদিনই দেখিনি। শব্দ শুনতে পাই। টের পাই সে এসেছে। খাবার রাখল। চলে গেল। কিন্তু তখন আমার চোখ জড়িয়ে আসে। ঘুম পায়। আমি আর তাকাই না।

       আমার পাশে কে যেন কাঁদে। আশেপাশে অনেকেই। এইদিকে আমার পিঠ ঘেঁষে একটা বুড়ি। কেঁদেই চলে। একঘেয়ে। ঘ্যানঘেনে। আমি কান সরিয়ে নিই। ঘুঘুপাখির ডাক শুনতে ইচ্ছে করে। ডোবার পাশে সাত ভাই পাখির ঝগড়া। বুড়িটার গলায় বাড়ি ফেরার কান্না।   

       বাড়ির পাঁচিলের ওপর লাল্টুদের আমগাছের ডাল। একরাশ আমের মুকুল। চারদিকে মিষ্টি গন্ধ। ঝিম ধরে যায়। আমি ঝিমোই। এখানে আমার কাজ নেই তেমন। 

       একটু আগে কে এসে ডাকল। কাকে ডাকল জানিনা। বোধহয় রাতুল ডাকল। ওর চিবুকটা একদম রাতুলের মতো। কিন্তু, ও রাতুল নয়। রাতুল তো এখানে থাকে না। ও অনেক দূরে একটা অনেক বড় বাড়িতে থাকে। সেই বাড়ির ছাদে বরফ পড়ে। রাতুল যে কে, ঠিক মনে পড়ছে না। সেই বাড়িটাতে রাতুল আমার পাশে ঘুমোত। রাতুল জানালার ধারে বসে দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করত। এখন সে বড়সড় কেউ। যে এখানে এসেছে, তাকেই জিগ্যেস করব? ওকে দেখে তো আমার রাতুলের কথাই মনে পড়ল। আর মনে পড়ল, রাতুল বলেছিল, আমি চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছি। অনেক টাকা পাব। আর গ্রিন কার্ড। আমি আর ওই দেশে ফিরব না। কোন দেশ বলেনি। আর বলেনি কার্ডের রঙ সবুজ হয় কখন। নাকি বলেছিল?  

       এই ঘরের দেওয়াল ময়লা। স্যাঁতসেঁতে। আমার পিছনে বসে বুড়িটা কাশে। সারারাত কাশে। কাশে আর কাঁদে। আমার দিকে তাকিয়ে কীসব বলে। বিড়বিড় করে। আমি ওর কথা শুনি না। ও কেবল ওর বাড়ি ফিরতে চায়। কেন কে জানে? মানুষ তো যেখানে থাকে, সেটাই তার বাড়ি। আমার যেমন এখন এই গরাদঘেরা ঘরটাই নিজের বাড়ি। ও যখন কাঁদে,  আমি মন দিয়ে কাঠ চেরার আওয়াজ শুনি। পাশের খোলা জমিতে রোদে বসে ইসমাইল কাঠ জড়ো করছে। খাটের অর্ডার আছে বলছিল। ওরা এখনও ডিজাইন দেখাল না। আমাদের এই ঘরে কোনও খাট নেই। মেঝেতেই শুই। ভেজা মেঝেতে শুয়ে বুড়িটার কাশি হয়েছে। আমাকে বললে একটা খাট অন্তত বানিয়ে দিতে পারতাম। এখনও পারি। 

       কাঠের গুঁড়ো আর স্পিরিটের গন্ধ নাকে আসে। খুব জোরে নাক টানলে আরও গন্ধ। অন্য গন্ধ। সেগুলো বিশ্রি। ঝাঁঝালো। বমি পায়। আমি খুব আস্তে আস্তে নাক টানি। ধীরে ধীরে। কাঠের গোলায় কাঠ চেরার ঘসঘস। আর বার্নিশের গন্ধ। আমার চেনা গন্ধটা চেপে ধরে রাখি। আর কানের মধ্যে ভালবাসার ঘুঘুপাখির ডাক। 

       এই দেওয়ালে আঁকাবাঁকা ফাটল। পিঁপড়ে দল বেঁধে এগোয়। দাদু বলেছিল, জেলের দেওয়ালে নখ দিয়ে লেখা যায়। কাঠকয়লার টুকরো, ভাঙা পেনসিল। আমার নখ নেই। পেন-পেনসিল কিছু না। এটা জেলখানা নয়। আমাদের নতুন বাড়ি বোধহয়। ওই লোকগুলো জোর করে নিয়ে এল এখানে। 

আমার বুড়ো আঙুলে কালির দাগ বসে গেছে। বাঁ হাত। ডান হাত। দুই হাতেই। কালির ছোপ লেগে যায়। রোজ গাদা গাদা কাগজে। ওরা কাগজ দেয়। আমি ছাপ দিই। এখানে ওখানে। পড়ে দেখি না। শুধু ওরা বলে, এই দেশ তোমার নয়। তুমি অন্য জায়গার। শুনলেই বুড়িটা গজগজ করে। কেন? দেশ কি কারও নিজের হয়? একার? দেশ তো সকলের।

আমার হাতে কালির ছোপ দেখে বুড়িটা রেগে যায়। দাওয়ায় বিছোনো মায়ের সাধের শীতলপাটিতে কি দাগ দিয়েছি কখনও? ওর আঁচলেও তো হলুদের ছোপ। ওকেই বা খামোখা রোজ রোজ টিপছাপ দেব কেন?  

        দূরে ছাদের আলসেতে কে কাপড় মেলছে? খুব হাওয়া। ওর ভেজা এলোচুল ছুঁয়ে যায় কাঁঠাল গাছের ভারী পাতা। আমার নিঃশ্বাসে এখনও গুলের ধোঁয়ার গন্ধ। মাটির তোলা উনুন। মোমের মতো সাদা ধোঁয়া। নারকেলপাতার ঢিমে আঁচে ভাতের ফ্যান উথলে পড়ে। 

       কারা যেন রোজ জিগ্যেস করে। আমার বাবা, আমার মা, আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমার দেশ, আমার ঠিকানা। কবে থেকে। কোথা থেকে। কখন থেকে। জানি না। ভুলে গেছি। তারপর বলে, কাগজ কই? আমার হাতদুটোতে একরাশ কাঠের গুঁড়ো মাখানো। এখনও কোনও কাগজ বানাইনি স্যার। শুনেছি কাঠ থেকেই কাগজ হয়। আমি বানাতে পারিনি। বিশ্বাস করুন। আমি তো খাট বানাতে পারি। কাগজ বানাতে পারি না। বাড়ি বানাতে পারি না। দেশও বানাতে পারি না।  

       আমার হাতের তর্জনীর দুটো কড় আছে। ঠিক দুটো। কাঠ চেরাইয়ের যন্ত্রটা রয়েছে না? আমি অস্থির হাতে রোজ করাতের ধার পরখ করি। গত কয়েকদিন ধরে একটা বাঁকানো ইস্পাতের আংটা আমি পিছন দিকে টানতে চাইছি। প্রাণপণ চেষ্টা করছি রোজ। ওই আংটাটাকে একবার পিছন দিকে জোরে টানতে পারলেই কেল্লা ফতে।   

       অন্ধকার ঘর। চারদিক আঁকাবাঁকা। এবড়োখেবড়ো। ভাঙাচোরা। একটা লোহার মাছি। কেবল সরে সরে যায়। তবু ওটাকেই নজর করি রোজ। একমনে। বুড়িটা ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদে। এক ঝটকায় থামাই। অনেক লোক পরপর। নীল পাগড়ি। সাদা টুপি। আর যে লোকগুলো ধূসর আলখাল্লাতে সব ঢেকে পা টিপে টিপে এসে আঙুলে কালি মাখিয়ে দিয়ে যায়। সেই লোকটাও। ওরা দল বেঁধে দাঁড়ায়। ওদের সবার দিকে তাকাই। লোহার মাছিটাই এখন আমার একমাত্র লক্ষ্য। আর ওই বাঁকানো ইস্পাতের আংটা। মাছিটার দিকে চোখ রেখে ওটা এক ঝটকায় একবার পিছন দিকে টানব। ব্যস। খেলা শেষ।

       ওরা আর কেউ কোনও কাগজ দেখতে চাইবে না। সব হাপিস। কাগজ কালি সব।  🚫

(ব্যবহৃত অলংকরণ।। সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা)


সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার সম্পাদক 
মৌসুমী ঘোষের সঙ্গে শ্যামলী আচার্য
ছবি - সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা