সাইন্যাপস্ ধারাবাহিক কলাম
সাইন্যাপস্ ধারাবাহিক
আত্মকূটকথা।। শ্যামলজিৎ সাহা
সারে চার দশক ধরে চুঁচুড়ার কবি শ্যামলজিৎ সাহা কবিতা-জীবন যাপন করে চলেছেন। জন্ম ১৯৫৯; ম্যনেজমেন্ট পঠনের পরে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি এবং পরে ব্যাঙ্কে কর্মজীবন। আশির দশক থেকে নিরবিচ্ছিন্ন কবিতাচর্চা। প্রথম কাব্যসংকলন ‘মুগ্ধকথা’(১৯৯২)। পরের কাব্যসংকলনগুলি — ‘বীজাক্ষর’(২০০৮), ‘সময়ের সান্ধ্যপাঠ’(২০১৬), ‘অন্তর্নিহিত’(২০২৫)।একদা কবিতা লেখার পাশাপাশি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা — ‘শায়ক’। নৈহাটির আজকাল/আজকাল টাইটোনিডির কবিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। নিবন্ধ রচনা ও পুস্তক আলোচনা কবির প্রিয় বিষয়।
পর্ব এক।। কবিতা নিয়ে ভাবনা : কবিতা নিয়ে তাগিদ
বাল্যকালে একদা মা-র কাছে তাঁর পিসিমার লেখা একটি হলুদ পাতা চোখে পড়েছিল। তাতে সেই পিসিমার লেখা একটি দীর্ঘ নিখুঁত ছন্দের কবিতা পড়ে ছিলাম। কবিতাটির বিষয়বস্তু এখন আর মনে নেই; এবং পরিতাপের বিষয় তা সংরক্ষণ করার সুযোগও হয়নি। এ যাবৎ কাল সেই কবিতাটি আমি এখনও খুঁজে চলেছি কিন্তু এখনও তার হদিশ পাইনি। একাদশ শ্রেণীতে পড়তে পড়তে পাঠ্য বইয়ের কিছু কবিতা মনের ভেতরে কোথাও যেন একটা ছবি ছন্দ দোলায়মানতা তৈরি করে দিয়েছিল। চেষ্টা করতে থাকি কিছু লিখে ফেলবার, সেই বয়ঃসন্ধির সময় এমন কিছু কথা যা সহজে কাউকে বলা যায় না তাই যেন ভালোবাসার রূপকে কবিতার মতো কিছু একটা হয় — এই হলো শুরুর কথা। এ সময়ে কিছু সমমনস্ক বন্ধুবান্ধব ও মাস্টারমশাইয়ের উৎসাহে একটি পত্রিকাও বের করে ফেলি। পরে পরে সেই পত্রিকার সূত্রপাতে আরো সম্পাদক ও কবিবন্ধু জড়ো হয়। আমি ক্রমে নৈহাটির একটি পত্রিকাগোষ্ঠীতে আড্ডায়, কবিতাপাঠে এবং কবিতার বইয়ের সন্ধানে মেতে উঠি। এইভাবে মনের ভেতরের একটি গোপন স্রোত ক্রমে কবিতার খাতায় প্রবহমান হয়ে ওঠে।
কবিতাযাপনের সেই শুরু যা আজ প্রায় সারে চার দশক ধরে আমাকে নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে রেখেছে। লিখতে না পারলে বিপদ আবার লিখলেও বিপদ এক অদ্ভুত জীবন, যেচে নেওয়া কষ্ট যা অব্যক্ত, অশান্ত, অজানিত। এর কোনো বিরাম নেই; অন্তত চিন্তার কোষে হৃদয়ের রক্ত প্রাবাল্যে। সেই যে কবি বলেছিলেন না ‘কাগজ কলম নিয়ে চুপচাপ বসে থাকা আজ’। বসে থাকি, খোলা জানালার দিকে, নির্নিমেষ, সাড়হীন, কলম নড়ছেনা কোথাও। কিংকর্তব্যবিমূঢ় দিশাহীন — যেমন গত তিনমাস না লেখার ভেতরে এক নিদারুণ সময় চলেছে। তবু ভাবনার আহ্বান এড়াতে পারিনা — বিষয়ের শেষ নেই। তোমার সামনে — তোমার পেছনে; শুধু খুঁজে নিতে হয় এটাই সারাৎসার। পালানোর উপায় নেই, এই ফাঁদে যে একবার পা দিয়েছে তার পালানোর উপায় নেই।
তবে অনেক হয়েছে প্রেমের কবিতা লেখা, বৃষ্টির কবিতা লেখা, অবদমনের কবিতা লেখা। কলমই তো সেই শক্তি যা তরবারির থেকেও সময় সময় ধারালো হতে পারে। কবিতা তো হৃদয়বৃত্তির কথা বলে, সেখানে কোনো সাজানো পটভূমি নেই; একমাত্র পটভূমি যা তোমার রচনা দিয়েই তৈরি করে নিতে হয়। যেন এক গোপন অস্ত্র যা তোমার জীবনযাপন, সোজাসুজি দেখা পথ, আর সত্যকে নিয়ে চালিত হয়। সত্য ছাড়া জীবন হয়না, অহর্নিশ সত্য এবং তাকে যেভাবে দেখলাম তাই যেন কবিতার শরীর মেলে ধরে। একজন কবির জীবন সেইরকমের ভাবনার মতই হবে যা নিজচক্ষে অবলোকন করিলাম তাহাই লিখিব। কোনো বানানোর কথা তাতে লিপিবদ্ধ হবেনা, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত হতে হবে বিবেকতাড়িত, কোনো মিথ্যে সেখানে নেই; কোনো লুকোচুরি নেই; রাজনীতি সে তো অনেক দূরের ব্যাপার।
আজকাল দেখি কবিতা পত্রিকা প্রকাশ নিয়ে খুব প্যাঁচপয়জার চলে। একটু চক্ষু প্রসারিত করলেই সব বোঝা যায়। প্রচারের সবিশেষ টান, মোহগ্রস্ততা আর মাথা নীচু করে নিজের পরিব্যপ্তি বাড়ানো। এ এক নিম্নমানের অভিরুচি, কবিরাই হবেন সমাজের সব থেকে সম্মানীয় ব্যক্তি, তবে তার কেন এই মোহমুদগার স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া? আপনি সম্মানিত একমাত্র আপনার কবিতার ব্যাঞ্জনায় সেখানে অন্য কোনো তৎপরতা নিছক আত্মপ্রসাদ। অতীতের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কেন জীবনানন্দ দাশ থেকে প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত পর্যন্ত এখনও আমাদের আদর্শ উদাহরণ। প্রকৃত কবি সেইজন যিনি তাঁর আত্মমান নিছক মোহজালে সমর্পণ করেন না। এসব হলো কবি ও তার চরিত্র নির্মাণের গোড়ার কথা। এবার কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে তাগিদের কথায় ফিরি।
জন্মকথা
৫-ই কার্তিকের পরে আটান্নটা বছর কেটে গেছে।
দু'বছর পরে ষাট, তারপর, তারপর...
একজন মানুষ তাহলে কখন ইচ্ছে করবে
আত্মজীবনী লেখার! এই ভেবে আমি শুরু করি;
হাসপাতালে জন্মের মুহূর্তে আমার প্রবল চিৎকার!
আমি ফাটিয়ে দিলাম, 'এসে গেছি...'
কী লিখি এখন! শুধু চিৎকার জানালেই হল!
কথা শিখতে শিখতে ভাষা শেখার আড়ালে
আমার আত্মমোচন ঘটে, আকস্মিক বিড়াল লাফালে!
কবিতা রচনার প্রথম তাগিদ নিজের জীবনবোধ থেকেই নির্মিত হয়। তাঁর দেখা শোনা ঘটনা প্রবাহ কোনো কিছুই এড়িয়ে যাবার নয়। সামান্য কিছু লতা-গুল্ম রাস্তার একধারে দেখেছি অন্য একটি অবহেলায় বেড়ে ওঠা বড়ো গাছটিকে ধরে বেড়ে উঠছে। দৃশ্যকল্পে যেন বড়ো গাছটি মা গাছ হয়ে অন্য ছোটো লতা-গুল্মদের সন্তানের মতো স্নেহবশে আঁকড়ে রেখেছে। আবার দেখেছি এক আদিবাসী রমণী রাস্তার ওপরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন আর তাঁকে উদ্ধারের পরে সে যেন আমার ঘাড়ে মাথা রেখে আশ্রয় খুঁজেছে। এও তো সেই কবিতাই। শুধু ঘটনার কাব্যরূপ আর তাকে কিছু মানুষের কাছে কাব্যকুহকের মতো পৌঁছে দেওয়া। এর আবেদন তখনই সম্পূর্ণ হয় তা যেন সার্থক রূপে কবিতার আকার পায়। তখন চেনা জানা ছন্দ ব্যকরণ সব মিথ্যে একমাত্র সত্য শব্দের সঠিক দ্যোতনা। আমি ঘটনাকে এভাবেই লালন করি : সেখানে মিথ্যের কোনো ছলাকলা নেই আমার জীবন যাপন, সময়ের সঙ্গে অভিসার সব, সব যেন সেই কবিতার মুহূর্ত প্রতি মুহূর্তে তাকে নিয়ে ঘর করা। পল্লীগ্রামে থাকাকালীন দেখেছি কতো না পটভূমি — সেখানে প্রথম ভোরের সূর্য যে কমলা বর্ণের হয় তা জানা ছিল না, জানা ছিল না রাজহাঁসের রাস্তা চলাচল আর তাদের নিজ ইচ্ছায় সামনের সব যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া। সব যেন তাদের ইচ্ছায় আর সম্মতিতে চলে। আবার সরু সুতোর জালে খ্যাপলা মেরে মেয়েদের মাছ ধরা। কাকে দেখবো কী দেখবো — তাদের জলে ভেজা কাদায় লেপা শরীর না চুনো মাছের ঝাঁক। দূর থেকে ঝড়ের আগমনের শব্দ সব কিছুই যেন বা কবিতা। ভয়ে দরজা বন্ধ করি ভাবিএইসব দৃশ্যসমূহ ছবি না কবিতা এক অদ্ভুত শিহরণের মধ্যে সময় কেটে যেতে থাকে।
এত বছর কবিতার সঙ্গে কাল কাটানোর পর ক্রমশই নিজের
প্রতি আরো সন্দিহান হতে থাকি। কী লিখলাম এতদিনে কবিতা না ভ্রম, পড়া বা শেখার শেষ নেই; আর কবিতাপাঠ সে এক
বিশেষ অধ্যায়, ভালো কবিতা মন্দ কবিতা কতো না সংকট। সমুদ্রস্রোতের মতো এর পরিধি, কারোর কবিতা তীরে এসে ভেঙে পড়ছে কিন্তু ওই পর্যন্তই আবার
কারোর কবিতা দীর্ঘ স্রোতের ভেতরে সপ্রাণ। এই সেই ঐশ্বরিক কবিতা যা ধারণ করতে হবে শুধু কল্প জগতের
নিছক খেলা নিয়ে নয় ঈশ্বরীর কবিতা নিয়ে ধারণা সুস্পষ্ট হতে হবে। কবিতা রচনার ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় প্রায়শই মনে
আসে —
তা হচ্ছে কবিতা রচনা মানে নিভৃতির সাধনা একান্ত গোপন
চিলছাদে চুপচাপ বসে থাকা। এক এক সময় মনে হয়
কিছু লিখবো না শুধু সময়ে ভাববো এক সময় সে ধরা পড়বেই তখন সংসার, তখন ধর্ম সবই যেন
মিথ্যে একমাত্র কবিতাই সত্য। সেই শূণ্যতার অবসান থেকে কবিতার প্রকৃত শরীর খাতায় খোদিত রূপে ধরা পড়বে। এ এক ধৈর্যের পরীক্ষা তবু শেষপর্যন্ত কবিতা রচনা
এক অলৌকিক বিষয় বলেই মনে হয়।
.png)


0 মন্তব্যসমূহ