সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা।। কবিতা ভাবনা ২ ।। ঝিলম ত্রিবেদী

ঝিলম ত্রিবেদী ।। ছবি - লেখক

    সাইন্যাপস্ পত্রিকার একটি ধারাবাহিক কলাম কবিতা ভাবনা। প্রতি সংখ্যায় কোনো কবি কলম ধরবেন কবিতা বিষয়ে তার নিজের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করার জন্য। 

সঙ্গে থাকবে তার নিজের স্বনির্বাচিত একটি কবিতা, যা প্রতিনিধিত্ব করবে তার কবিতা-দর্শনের। সাইন্যাপস্ পত্রিকার জন্য এই কলামের দ্বিতীয় কবিতা ভাবনা লিখলেন এই সময়ের এক অনন্য প্রতিবাদী কন্ঠস্বর, কবি ঝিলম ত্রিবেদী 

জন্ম ১৯৮৪ সালের পৌষমাসে। 'দর্শন' নিয়ে পড়াশোনা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখায় প্রবেশ বেশ পরে, ২৭/২৮ বছর বয়সে। অনুভূতির গভীরে তাঁর লেখার শিকড়। তাঁর কবিতার প্রতিটি চরণ আমাদের সকলকে আয়নার সামনে দাঁড় করায়। বিষয় বৈচিত্রে, ভাষার প্রয়োগে, শব্দের ব্যবহারে ঋদ্ধ তাঁর লেখা পাঠ করা, এক অনন্য অভিজ্ঞতা। তাঁর লেখনী একাধারে যেমন চাবুকের মত উদ্ধত, তেমনই আবার ভালোবাসার মত কোমল। কবিতার পাশাপাশি চলছে গদ্য ও নাটক লেখা। ২০১৫ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'নিরুদ্দেশ সম্পর্কিত ঘোষণা' প্রকাশ। ২০২০ বইমেলায় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'বৃষ্টি পড়া বাড়ি' প্রকাশিত হয়, প্রতিভাস প্রকাশনা থেকে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখে চলেছেন। 'দেশ' অনলাইন পত্রিকায় 'নির্বাচিত কবি'-র সম্মান প্রাপ্তি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে, আমন্ত্রিত কবি হিসেবে, ৪র্থ বাংলা কবিতা উৎসবে অংশগ্রহণ। লিখতেই হয় তাঁকে ঈশ্বরের অদৃশ্য নির্দেশের মত। লিখে যাবেন, যতদিন তিনি লিখতে বলবেন।

কেন কবিতা লিখি 


ছোটোবেলা ছোটোবেলাই হয়। দুইয়ের ঘরের নামতার মত মিল নয়, অমিলগুলোই থৈ থৈ করে —

পড়ার সময় পড়তে ইচ্ছে না করা!

খাওয়ার সময় খেলতে যাওয়ার চিন্তা . . .

কিংবা

দুপুররোদে পিঠ দিয়ে, সময়ের সাথে রৌদ্র পোয়ানো, একই আকাশের তলায় . . .

ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে চাওয়া, মানুষের মনের গড়ন-পেটন

— সেলাই করতে বসে
হৃদয়-কাঁটাতারের একদিকে সূঁচ ফোটালে
সে মাথা ফুঁড়ে ওঠে, হৃদপিণ্ডের অন্যদিকের, সরকারি-পারমিশন ফুটো ক'রে!

— আর ছোটোবেলাটা খিলখিল করে হেসে ওঠে এই পণ্ডিতি দেখে !!

    এই পারাপার করতে করতে কখন যেন বড় হয়ে যাওয়া। কানে দুল, শাড়িতে সেফটিপিন আর ক্রমাগত এই নিরাপত্তাহীন জীবনে, আনসেফ হয়ে রয়ে যাওয়া!

রয়েই যাওয়া . . .

    এভাবেই শুরু হয়েছিল আমারও বয়ে চলা। পড়াশোনায় ভালো এবং বেয়াড়া একটি মেয়ের জীবন। স্কুল যেতে চাইতাম না। ইংরিজি ট্রান্সলেশন দেখলেই বিরক্তির পারদ চড়ত!

আঁক কষতে কষতে সারাজীবন, একটাও অঙ্ক মিলল না যে!

— দুহাতে সারাদিন শুধু লেগে থাকল চকের গুঁড়ো . . .

  বিকেলের সূর্যাস্ত দেখতে চলে যেতাম, ইছাপুর নবাবগঞ্জ গঙ্গার ঘাটে-
আহা . . .  সে-ছোটোবেলা থেকেই, একটা গোটা নদী পেয়েছি আমি . . .

— আঁজলা ভরে তুলে এনেছি, কত দেশের কত যতিচিহ্নহীন জল . . .

    পাশের মাঠে লাইব্রেরি। ক-ত বই সেখানে। বেয়াড়াদের তো রবিঠাকুর রোচে না। দুনিয়ার ফেলুদা, আগাথা ক্রিস্টি পড়তে শুরু করা। রহস্য রহস্য লাগত চারপাশটাকে! সিলেবাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে মন চলে যেত . . .

— যে বছর কুড়ি-বাইশের নামহীন দাদাটা, রোজ মিউনিসিপ্যালিটির নর্দমা পরিস্কার করতে আসত — আমার কৈশোর দেখে, তার মুখে লজ্জার চোরাস্রোতটুকু অনুভব ক'রে, সেই-ই ছোটবেলাতেও, হাসি পেত না তো কোনোদিন!

অশ্লীল মজা পেত না আমার!

— পরে আবার কখনও, সন্ধের পড়ার-ব্যাচ ফেরত পথে, ঐ আধারকার্ডের বাইরের পৃথিবীতে বাস করা লাজুক ছেলেটির, প্রেত দেখার মত ক'রে আমায় দেখে, অন্ধকারের আঁচলের তলায় লুকিয়ে যাওয়ার অসহায় চেষ্টা — আমায় সারারাত জাগিয়ে রাখত . . .

চোখে জলের কাঁটা বিঁধে উঠত সা-রা-টা-রা-ত!!

মনে হত —

মল, মূত্র, থুতুর মত মানুষের বেঁচে থাকার কথা!

বাঁচতে চাওয়ার শক্ত-চোয়াল দেখতে পেতাম . . .

জেগে থাকতাম কালো আকাশের মতো!

    যে মেয়েটিকে পাশের পাড়ায়, সতেরো বছর বয়সে, সারাশরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্লাস্টিক পেঁচিয়ে, ইলেকট্রিক-শক্ দিয়ে মেরে ফেলেছিল বাড়ির লোকগুলো —

তার মুখ মনে পড়ত সারাদিন . . .  সারাবেলা . . .

নীচু-জাতের ছেলেকে ভালোবেসে ফেলেছিল সেই মেয়ে — তার অপরাধ!

— প্রেমিক ভুলে গেল!
   পাড়া ভুলে গেল!
যে চিরুনি দিয়ে খেজুরছড়ি বাঁধত চুলে, সেই চিরুনিও ভুলে গেল তার কথা —

আমি ভুলতে পারলাম না কিছুতেই . . .

মনে হত,

— এই যে এত জীবনবিজ্ঞান, ভূগোল, সাহিত্যের চেরাইঘর — তাহলে ফুলের মত নরম মেয়েগুলো এত "অ-নিরাপদ" কেন? তাহলে এই স্কুল, এই লেখাপড়ার সার্কাস আসলে এমনি এমনিই ঘটে চলে সময়ের পর সময় ধরে!

— একটা মেয়ে স্কুল পালাতে পারবে না!

বিড়ি ফুঁকতে পারবে না!

একা একা ধানশীষের পাশে, বাবু হয়ে বসে, কবিতা লিখতে পারবে না কোনোদিন!!

"যোনি" বন্ধক রেখে তাকে প্রেম করতে হবে!

বিয়ে করতে হবে!

আর

সন্তান উৎপাদনের মুদ্রা শিখে নিতে হবে সারাজীবন ধরে!!

ব্যস!

তাহলেই সার্থক জনম!

— তাহলে তার নিজের সময় কখন সে অর্জন করবে? কোন বুড়ো, লোলচর্মসার বয়সে? . . .  আসলে কোনোদিন আর সে সময়, সে "গণতান্ত্রিক", "অন্য-নিরপেক্ষ" সময় তার আসে না! আসবে না। সে একা নুব্জ মনে, শাসনের সিংহাসনে বন্দী হয়ে, স্বাধীনতার গন্ধ পেতে চাইবে সমস্ত হৃদয় ভরে . . .

কিন্তু পাবে না!!



ঝিলম ত্রিবেদী।।ছবি - সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা
                                                                                 

   

    অনেকটা বয়সে লেখা শুরু আমার। আঠাশ বছর বয়স নাগাদ। হঠাৎ এক ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে শুনি, ভেতরে ভেতরে কে যেন বলছে —

আয়. . .  বোস তো দেখি এখানটায় . . .  লেখ তো দেখি দু’-চার কলম!

ব্যস, ঐ শুরুয়াৎ!

বেশি কিচ্ছু লেখাপড়া নেই!

সামান্য, অতি সামান্য পড়তে পড়তে, লিখতে লিখতে চলা . . .

    যে বিকেলমুখী মেয়েটাকে ফেলে রেখে এসেছিলাম, বেড়াবিনুনি গঙ্গারপাড়ে — আবার তার কাছে গিয়ে বসলাম। নদীর জলে ধুকপুক করে উঠল সারা পৃথিবীর ভেঙে যাওয়া, দুমড়ে ছোট হয়ে যাওয়া, আধপেটা মানুষের স্রোত . . .

— বুঝলাম এই মুখগুলো, এই পাঁজরগুলো, এই পরমায়ুহীন জীবনগুলো —

আমি আঁকতে চাই অক্ষর দিয়ে!

— তুলি ডুবিয়ে দিলাম চোখের কাজলে . . .

রক্তের ওমে!

মানুষের মুখ উঠে এল কবিতা হয়ে . . .

— আলোহীন ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে ব'সে, সন্ধের আঠায় ডুবে যেতে যেতে, ক্ষীণকায় বেঁচে থাকার প্রচণ্ড লড়াই, অসম্ভব তাগিদগুলো দেখতে পেতাম . . .

আর মন্ত্রের মত জপ করতাম —

ও মানুষ! আমিই . . .  এই তো আমিই লিখব তোমার কথা!

লিখে রেখে যাব — তুমি দেখ . . .”

    অন্ধ শিল্পীর গলার শিরা টগবগ করে উঠত আমার হাতে! গলির মোড়ে দাঁড়ানো, ছেঁড়া হাওয়াই-চটির মত বেকার ছেলেটির, অনিশ্চিত প্রেমের হাহাকার- বুকে এসে বিঁধত!

— লিখতাম! লিখে যেতাম . . .

— যখন মনে হত, একটি বাচ্চা মেয়ের তুলতুলে যোনিতে, লোহার-রড ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে আমাদের স্বচ্ছ ভারতবর্ষ— আমার মেরুদন্ড আরও ঋজু হয়ে উঠত সাহসে! কথা বলার স্পর্ধায় ফুটে উঠত জিভ . . .

আমি লিখে যেতাম . . .

— গলা চিরে রক্ত পড়লেও যে আর চুপ করে থাকা যাবে না!

চিৎকার করে বলতেই হবে —

আমাকে বস্ত্র তুমি দিও না কৃষ্ণ, শুধু শোন —

কামনা করলে ঐ লিঙ্গ আমি টেনে ছিঁড়ে দেব!!!

   

    সারা পৃথিবী আমার নিজের পৃথিবী। আমার পৃথিবী ভালো নেই। দানবীয় যুদ্ধে, ঈর্ষায়, বমির মত স্যাডিস্ট যৌনতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে . . .

— তবুও মানুষ জেগে আছে
জেগে থাকবে সে সারাজীবন . . .  আমি জানি!

তাদের সেই না-ঘুমনো চোখের তলার, নিরন্ন কালি দিয়ে, আমি লিখব সবার কবিতা . . .

লিখতেই হবে যে . . .

বাঁচতেই হবে আমাদের!

রাস্তার মাঝখানে, বেলেল্লারা আঁচল টেনে নিলে বলতেই হবে —

খবরদার! আমি কিন্তু চিৎকার করব . . .  কারণ আমি কবি!!

জেগে থাকি আমি . . .

জেগে থাকা ধর্ম বলে জানি!


প্রতিনিধিত্বমূলক স্বনির্বাচিত একটি কবিতা

অরণ্য ৩

(বিভূতিভূষণের "আরণ্যক"-এর উপর লিখিত কবিতা সিরিজ়ের একটি)

শৈলশিরার কাছে এসে বসে অমৃত মানুষ
বহেড়া, আমলকীপাতা, বুনোনিম
ছোলাসেদ্ধ খায় কিছু লোক
হরটিট্, বনটিয়া, আকাশের মাদুরের উপর
সূর্যের পাড়বোনা, কাঁথাখানি পড়ে আছে রাতের

পাখি উড়ে যায়, উড়ে আসে
পাহাড় তো হারিয়ে যাওয়ার ডাকনাম
পাহাড়ের কাছে কাছে বসে আছে অলীক দেবযান

খসে পড়ছে ঝুরোপাতা, ঝোড়োপাতা, খসখসে, অমসৃণ পাতা
তুলে নিয়ে গালে রাখলে
পুকুর পুকুর মনে হয়
সাধ হয়, বইয়ের পাতায় পাতা রাখি
দূরে চলে গেলে, চলে গেলে রূপ ছেড়ে, পাতারা... মনে রাখে না কি!

মটুকনাথের টোল থেকে, ভেসে আসে দিগম্বরী-পাঠ
মানুষের ধারাপাত, মানবের জীবনবিস্তার
বিপুল বিপুল
এই সুনিপুণ আঁধার আলোয়
মানুষটা শিক্ষক, মানুষটা ধীর লয়ে বয় . . .

সারারাত খায়নি কিছু
সারারাত উপোস করে আছে
সকালে তবুও খোলে পাঠশালা, পড়াতে বসেছে যে
অনেক সন্তানের বাবা, পিতা সে, ভেঙে যাওয়া পিঠ
তবুও
লোভীর মত এসে বসে বিদ্যালয় খুলে
যেখানে কয়েকটি ছেলে, কতগুলি খুব শূন্য পেট
পড়াই পারে না তারা, শুধু মাছি ঠোঁটে এসে বসে
তারা পড়ে
মাছি পড়ে
সমস্ত জগৎ পড়ছে
মানুষের প্রাণের কথা, সমস্ত জগৎ পড়ছে . . .

অমৃত মানুষটিও চোখ বোঁজে, মন খাড়া করে
সুদূরে শুনতে পায়, দারিদ্র্য পড়া করছে
গাছ থেকে খসে পড়ছে পাতা, খসবেই
নিঃশ্বাস বন্ধক রেখে, ওরা তবু পড়া করবেই
. . .

-----------------------------------------------------


আগের সংখ্যার কবিতা ভাবনা ১ পড়তে ছবিতে ক্লিক করতে হবে

সাইন্যাপস্‌ কবিতা ভাবনা ১ ।। রামকিশোর ভট্টাচার্য