পর্ব ৪

 সমীর মুখোপাধ্যায় হুগলির প্রখ্যাত গল্পকার। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলেই বোঝা যায় তিনি এক জীবন্ত মুভি ক্যামেরা বিশেষ। তার ক্যামেরায় হুগলি-চুঁচুড়া জনপদের ফেলে আসা সময় আর বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের ছবি ধরে রাখা আছে। তার আত্মজীবনীটি সাইন্যাপস্‌ পত্রিকায় ২০১৩ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। সাইন্যাপস্‌ পত্রিকা ওয়েবে প্রকাশিত হয়ে আরো অনেক বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবে আমরা আশা রাখি, তাই আমরা আবার এই ধারাবাহিক স্মৃতিকথাটি প্রথম পর্ব থেকে বৃহত্তর পাঠকদের কাছে উপস্থাপিত করছি। এবারে রইল তৃতীয় পর্ব।

পর্ব ৪

নরেনের কথা বলতে বসেছিলাম। যে কোনো কারনেই হোক ব্যানার্জি কেবিনে নরেনের উপস্থিতির সঙ্গে এই  অঞ্চলের ষাঁড়-সম্রাট স্বনামধন্য ভোলার উপস্থিতির অদ্ভুত এক যোগ ছিল। ভোলার টাইম একেবারে ঘড়ির কাঁটার অনিবার্যতার মতো। ঠিক সকাল সাড়ে-সাতটায় আসবেই। ঘড়ির মোড়ের দিক থেকে ও হেলতে দুলতে আসবে, সটান রাস্তার মাঝামাঝি দিয়ে, দরকার হলে ট্রাফিক সরে যাবে কিন্তু ভোলা নিজের অবস্থান বদল করবে না। আর ওকে দেখে ওর অসংখ্য প্রণয়িনী - গরুরা দুরন্ত গতিতে পালাবে। যদিও প্রায় প্রত্যেকের গর্ভেই ভোলার প্রবল পৌরুষের চিহ্ন ছিল। সে প্রসঙ্গ থাক।

    আমি কয়েক দশকের দূরত্ব থেকে দেখছি - ওই ভোলা ঢুকছে, গরুরা পালাচ্ছে, লরিগুলো পর পর একপাশে দাঁড়ানো, ওস্তাদজীর দোকানের মেটে চচ্চড়ির সুগন্ধি উঠেছে, প্রেমদাস পট্ট-নায়কের দোকানে দোকানে ফুল আর গঙ্গাজল বিতরণ পাট চলছে

    ... ভোলা এসে ব্যানার্জি কেবিনের সামনে ওর জন্যে রাখা টিনের কাটা ক্যানেস্তারায় মুখ ডোবালো। ওই টিনের ক্যানেস্তারায় থাকত কেবিনের যত ফেলে দেওয়া বাসি মাল - পোড়া পাঁউরুটির টুকরো, রসে যাওয়া বিস্কুট, হাতে গড়া রুটি, নষ্ট হয়ে যাওয়া, পোকায় খাওয়া কেক ইত্যাদি। সর্বোপরি যেটা বিস্ময়ের - টাইম বুঝে ওই কাটা টিনের মধ্যে একটা বড় গামলায় থাকত চা। ফলে মুখ ডুবিয়ে বিস্কুট চিবিয়ে সোঁ সোঁ করে চায়ে চুমুক দিয়ে, নাকের বড় বড় ফুটো দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সামনে এগিয়ে যেত প্রেমদাস পট্টনায়কের দোকানে। সেখানে ফোঁটা তিলক নিয়ে তারপর ভোলা সটান চলে যেত কোর্টের পিছনে বিশাল মাঠের উদ্দেশে। ঠিক ওই সময়ের একটু পরে নরেন এসে পড়ত। কখনও বা একটু আগে। ভোলার সঙ্গে নরেনের টাইমিং এর এই অদ্ভূত যোগাযোগ আমাকে নরেন সম্বন্ধে বেশ উদ্দীপ্ত করে তুলত। আমি প্রবল উৎসাহের সঙ্গে, ভোলার প্রসঙ্গ তুলতেই নরেন বলত, 'ভোলার মত প্রবল পুরুষ হতে গেলে বিশেষ সাধনার দরকার বুঝলি হতভাগা! ভোলা গতজন্মে হঠযোগী ছিল। আমার তো পুঁটিমাছের প্রাণ। ওই একজনকে নিয়েই হিমসিম খাচ্ছি।' . . . সেদিন ছিল পয়লা মে। এদিনের গুরুত্ব জানতাম। কিন্তু একজন পার্টিকর্মী এই দিনটিকে যেভাবে জানে, সেভাবে জানা ছিল আমার পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব। তাছাড়া এর একটা আঞ্চলিক কারন-ও আছে। আমাদের হুগলি জেলা মূলত কংগ্রেসি কালচারে আকন্ঠ নিমজ্জমান। কমিউনিস্ট ... শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির গুরুত্ব আমাদের কাছে ছিল একান্তই অলীক কল্পনা। কমিউনিস্ট সম্বন্ধে আমাদের দাদুদের ধারনা ছিল - কমিউনিস্ট মানে সবচেয়ে সুন্দরী নাত্‌নীর একটা রিক্সাওয়ালার হাত ধরে বেরিয়ে যাওয়া। কংগ্রেসি বাড়ির কোন ছেলে ওই দলে নাম লেখালে তাকে পাড়াশুদ্ধ একটা মূর্তিমান দুঃস্বপ্ন বলে চিহ্নিত করতেন। আমরা যখন যুবক তখন অবশ্য এই ধারণা একটু ফিকে হয়ে এসেছিল। কিন্তু মজ্জায় মজ্জায়, শোণিতের অণু পরমাণুতে এই কনসেপ্ট একেবারে দৃঢ় ভাবে প্রোথিত ছিল। তাছাড়া একথা সবাই জানে এই 'বেনোজল'কে নিয়ে আসে পূববাংলার লোকেরা। বাঙালদের যে আমরা দেখতে পারতাম না তার একটা অন্যতম কারণ ছিল এটাও, এই কমিউনিস্টি হুজুগ।

    ... কী কথা থেকে কোন কথায় এসে পড়লাম। সে যাক। সেদিন সাড়ে সাতটায় সকালে ব্যানার্জি কেবিনে এসে জানলাম, ভোলা এখনও আসেনি। ব্যানার্জিদাকে একটু চিন্তিত দেখাল। বললেন, 'ভোলা তো ফেল করে না। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। ও হয়তো ওদের হাসপাতালে গেছে, একসিডেন্ট ফ্যাকসিডেন্ট করে। ভোলার ওপর তো এ অঞ্চলের বাস ড্রাইভারদের রাগ আছে। ও ত মাঝে মধ্যেই ট্রাফিক জাম্প করে দেয়। মুহুর্মুহু হর্ন বাজালেও নড়ে না।' 

    আমি 'তাই তো' বলে ভেতরে যেতেই নরেনের খোপ থেকে আওয়াজ উঠল, 'এই যে সাহিত্যপ্রবর, আজ আমি ফার্স্ট। ভোলা আসেনি। অথচ আমি এসেছি।'

    'ভোলা থাকলে তুমি ফার্স্ট হতে পারতে না। একজনের মধ্যেই তুমি ফার্স্ট হয়েছ', কথাটা বলতে না বলতেই, কেবিনের বাইরে থেকে একটা অদ্ভুত ধরণের সমবেত সঙ্গীত শুনতে পেলাম। গানটি হচ্ছে, 'সেদিনেরে ঘিরে, উন্নত শিরে, স্নেহ প্রীতি ভালোবাসা নিয়ে এই নিশান, কোমলে কঠোরে গাঁথা এই পাখির পাখা ...' আরও কী কী যেন।

    আমি ছুটে কেবিনের বাইরে গেলাম। নরেন পেছন থেকে চ্যঁচাতে লাগল, 'আরে পাগল, তোর চা-টা যে জুড়িয়ে যাবে!' কথাটা কানে গেল, মনে গেল না। যাবে কী করে? ততক্ষণে কেবিনের বাইরে গিয়ে দেখি অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, দৃঢ় প্রস্তর কঠিন একটি মিছিলের প্রাচীর। সামনে পিছনে রক্তপতাকা। সামনের দিকেই চক্ষু ধাবিত হল। দেখলাম একটি মেয়ে, সাক্ষাৎ জোয়ান অফ আর্ক, অত্যন্ত সুশ্রী, যৌবনের তেজে একেবারে ডগমগ, সমস্ত শরীর যেন উদ্ধত আগ্নেয়গিরি, সে শ্লোগান দিচ্ছে, 'সেদিন দিচ্ছে ডাক, বদবাবুরা হো হুঁশিয়ার। চারু মজুমদার জিন্দাবাদ।' তার আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে মিছিলে অবস্থিত প্রত্যেকটি যুবক যুবতীর কন্ঠে অত্যন্ত জীবন্ত, অন্যন্ত নিশ্চিত, চূড়ান্ত পরিবর্তনকামীর ভঙ্গীতে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই একেবারে নতুন, একেবারে সাম্প্রতিক শ্লোগান।

(ক্রমশ)

আগের পর্বগুলি পড়তে হলে ক্লিক করতে হবে

আপনার মতামত নিচে 
'আপনার মন্তব্য লিখুন' শীর্ষক বক্সে লিখে 
আমাদের জানান। 
লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকে 
পাঠকদের মতামতে। 🙏