পর্ব ৪ |
রাজেশ কুমারের কলমে।। জলের মতন জলের খোঁজে ভেসে
পর্ব ৪ ।। না মেলা অঙ্কদের কথা
সিঁড়িভাঙা অঙ্ক বরাবর বিব্রত করে এসেছে আমায়। বিশেষত প্রথম জীবনে। একটা সহজ নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য যে জটিল ধাপগুলোর প্রতি যত্নবান হওয়ার কথা ছিল, আমি সেগুলোই ফেলে এসেছিলাম চূড়ান্ত উদাসীনতায়।
একটা সাইকেল ছিল আমার। ক্লাস এইটে কিনে দিয়েছিল বাবা। আরও পাঁচটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বাবারা সেসময় কিনে দিয়ে থাকত যেমন, প্রতিমাসের কিছু কিছু সঞ্চয় থেকে কিম্বা কোন সহকর্মীর কাছে সসঙ্কোচে হাত পেতে। শুধুমাত্র এক স্বপ্নের তাড়নায়। সন্তান পড়তে যাবে দূরে। ভবিষ্যতে মানুষ হতে সুবিধা হবে। তখন মোবাইল ছিল না। ওই সাইকেলটাই ছিল আমার একমাত্র সম্পদ। যেটা আমায় নিয়ে যেত এক অবাধ স্বাধীনতার দেশে। বাড়ি থেকে বহু বহু দূরে। শহর পেরিয়ে গ্রাম, গ্রাম ছাড়িয়ে সেই হাইওয়ের ধারে। ধুলোর মাঝে, সত্তর আশি একশো বছর পুরনো বড় বড় সব গাছের নীচে। শেষ বেঞ্চের সহপাঠিদের সঙ্গে। স্কুল পালিয়ে যেতাম আমরা, কখনও পড়তে যাওয়ার নামে। হাইওয়ের দুধারে ধু ধু মাঠ। তখন এত গাড়ি ছিল না। এত গতিও ছিল না চারপাশে। ছয় চাকার লরির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলে বেড়াত আলো হাওয়া। মানুষজনের চলাচল ছিল না তেমন। হাইওয়ের ধার যেন নিষিদ্ধ এক জগৎ। মাতাল গাঁজারু আর সাট্টা জুয়ার কারবারিদের আনাগোনা। আমরা সিগারেট ধরাতাম। বিকেলের পড়ন্ত সূর্য, গোধূলির লাল আলোর দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়তাম বুক উজাড় করে। একে অপরের পিছনে লাগতাম। নিত্যনতুন ফূর্তির উপায় খুঁজে বেরোতাম।
মূল ছবি - আন্তর্জাল |
কিন্তু খুব বেশিদিন চলল না এভাবে। কলেজ শেষের দু-এক বছরের মধ্যেই পালটে গেল সমস্ত কিছু। একটা রুক্ষ, রুষ্ট ভাব যেন ঘিরে ধরল জীবনটাকে। কিছুদিন খাতালেখার কাজ করেছিলাম এক ব্যক্তির কাছে। কথা ছিল তিন মাস পর থেকে টাকা দেওয়া হবে। বছর ঘুরে গেলেও এক পয়সা পাইনি। পরে জেনেছিলাম, এটাই পলিসি। উনি শুধু প্রতিশ্রুতি দেবেন। তাতেই জুটে যাবে আমার মতো হাজার রাম শ্যাম যদু। খুব রাগ হয়েছিল নিজের ওপর। সারা পৃথিবীর ওপর।
একদিন বিকেলে বেরিয়ে পড়েছিলাম সাইকেল নিয়ে। দিগ্বিদিক ঘুরছিলাম উদভ্রান্তের মতো। হাইওয়ের ধারের সেই অমোঘ আকর্ষণ কে যেন ছিনিয়ে নিয়েছিল আমার অজান্তেই। অনেকেই সামর্থ মতো জুটিয়ে নিয়েছিল একটা কিছু। নয়ের দশকের শুরুতেই গ্যাটচুক্তি, বিশ্বায়ন, অর্থনীতির উদারীকরণ। পৃথিবীটা যে তলায় তলায় পাল্টাতে শুরু করেছে তার খবরই রাখিনি আমি। বাংলা মিডিয়াম, অ্যাকাউন্টেনসি অনার্স- সাধারণ পড়াশোনা, মধ্যমেধার দাম নেই কোথাও। দাম পেতে হলে খরচা করতে হবে। কোর্স করতে হবে নানান রকম। ওদিকে রাষ্ট্রের ছায়াও ক্ষীণ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। রোজই সংকুচিত হচ্ছে মধ্যবিত্ত নীম্নবিত্তের নিশ্চিত আশ্রয়দাতা সরকারি ক্ষেত্রগুলো। সারা বিকেল সাইকেল চালিয়েও যেন গ্লানি কাটতে চাইছে না মনের। এমন সময় হঠাৎ মনে পড়ল অভিরূপের কথা। আমার থেকে সামান্যই বড়। কলেজে সিনিয়র ছিল। তবে কি একটা সূত্রে আগে থেকেই চিনতাম। তাই দাদা বলার অভ্যাস ছিল না।
খুঁজে খুঁজে চলে গেলাম অভিরূপের বাড়ি। উঠোনে সাইকেল রেখে কলিংবেল। বাড়ির কারও একটা ইশারা পেয়ে সোজা উঠে গেলাম সিঁড়ি বেয়ে। ছাদের ঘরে। অভিরূপ তখন সেখানে বসেছিল হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে। আমায় দেখে অবাক। কিরে! কি খবর! আয় বোস। আমি বিছানার ওপর গিয়ে বসলাম। খাটো পায়ার নীচু একটা চৌকি। ঘরের মধ্যে বসার মতো আর কোন জায়গা ছিল না। ছোটঘর, দুটো জানালা। মেঝে জুড়ে ছড়ানো ছিটানো নানান রকম বইপত্র। ম্যাগাজিন। আর ছিল একটা পুরনো টাইপ রাইটার, পর্দাঢাকা। সেটার দিকে তাকাতে অভিরূপ বলল। আগে প্র্যাকটিস করতাম। শর্টহ্যান্ড, স্টেনোগ্রাফি। কোর্টের পরীক্ষাগুলো দিতাম। এখন রেল, ব্যাংক, পি. এস.সি., এস.এস.সি.। এসবে শর্টহ্যান্ড, টাইপ লাগে না। জিকে, ইংলিশ, ম্যাথ আর কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স হলেই চলে যায়। যাক সেসব কথা। তুই কি করছিস বল!
জানতাম এই কথাটা উঠবেই। এর জন্যই হয়তো এতদূর সাইকেল চালিয়ে অভিরূপের এই ঘরে আমার এসে পড়া। কিন্তু অভিরূপই বা কেন! এ প্রশ্নের উত্তর আমি আজও পাইনি। ওর চাইতেও তো অনেক বেশি কাছের বন্ধু আমার ছিল। তাদের কারও মুখ কেন ভেসে ওঠেনি সেদিন সেই ডুবন্ত সূর্যের দিকে চেয়ে। আমি আজও ভাবি একেই বোধহয় বলে অদৃষ্টের নির্দেশ। যা মানুষকে নিয়ে যায় পূর্বনির্ধারিত অমোঘ পরিণতির দিকে। থাক সে কথা। আমি বললাম, কিছুই করছি না। কি করব ভেবেও পাচ্ছি না। ভালো লাগছে না কিছু। রোজ বিকেল হলেই বেরিয়ে পড়ি উদ্ভ্রান্তের মতো। অভিরূপ বলল, আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারিস। সন্ধেবেলা তিন-চারজন বসি। এখানেই। পড়াশোনা হয়। বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি। সরকারি চাকরি শুনেই কেমন শুকিয়ে গেল। মনে হল সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে শেষমেশ না ঘটিটাও হারায়। অভিরূপ বলল, শুরু করেই দেখ না। আড্ডাও হবে, সঙ্গে পড়াশোনা। ভালো লাগবে। সেসময় সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লেই বিষণ্ণতায় ভরে যেত মন। একরাশ একাকীত্ব ঘিরে ধরত পুরোনো অন্ধকার গঙ্গার ঘাটগুলোয়। ভেতরে ভেতরে কে যেন বলতো, চল মন এখানে না অন্য কোন খানে।
অনেকটা মনের তাড়নাতেই গিয়ে উঠেছিলাম অভিরূপের সেই ঘরে। বলা যেতে পারে ঘরটার আশ্রয়ে। প্রথম প্রথম কিছুই জানতাম না। ওরা ছিল এক একটা ডিকসেনারির মতো। জেনারেল নলেজ, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স সব ঠোঁটস্থ। অনুপাত- সমানুপাত, দূরত্ব- গতিবেগ কিম্বা বাঁদরের পিচ্ছিল বাঁশ ধরে ওপরে ওঠা নীচে নামার অঙ্ক কষে দিত মুখে মুখে। সব কিছুরই নাকি ‘শর্ট ফরমূলা’ আছে। জানতে হয়। পরীক্ষায় কষে দেখার সময় থাকে না। অঙ্ক দেখেই উত্তর খুঁজে নিতে হয় মনে মনে।
অভিরূপ আমায় সব শিখিয়ে ছিল। কিভাবে চোরাগোপ্তা ঢুকে পড়তে হয় সাফল্যের পেনাল্টি বক্সে। সাধারণ জ্ঞান ইংরাজি শব্দকোষ অঙ্কের মারপ্যাঁচ আরও যা যা সব লাগত। চমৎকার মনোগ্রাহী সেসব চর্চার বিষয়। ঝিঁঝিঁ পোকার মতো তা ঢুকে পড়েছিল আমার মাথার ভেতর। স্বপ্নের মধ্যে। আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে। তখন চার দেওয়ালের ওই বন্ধন ছাড়া কোন কিছুই ভালো লাগত না। সারাদিন বাড়িতে নিজের ঘরে রসদ সংগ্রহ করতাম। বিকেলে চলে যেতাম অভিরূপের ঘরে। অভিরূপের মা বিরাট বড় জামবাটিতে করে মুড়িমাখা দিত। চানাচুর, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজকুঁচি আর আচারের তেল। তেলটার এক অদ্ভুত গন্ধ ছিল। হাতে লেগে থাকত। তালু শুঁকলে আজও গন্ধ আসে নাকে।
এভাবেই কেটেছিল বেশ কয়েকটা বছর। অভিরূপের বাড়ির উঠোনের সজনে গাছটার শুধু বয়স বেড়েছিল সামান্য। তবুও প্রত্যাশা মতোই একদিন ফুল ফুটল তাতে। সাফল্য এল আমাদের। একে একে সবারই। কারও কারও হয়তো একটু বেশিই। গায়ে দামি পোষাক উঠল, সুগন্ধি সাবান। সমাজে সম্মান বাড়ল। বিয়ের বাজারে দাম। হল না কিছু অভিরূপেরই। মশলার অভাব ছিল না। তবুও যে মশাল জ্বালানোর আরাধনায় জীবনের এতগুলো বছর সে কাটিয়েছিল তা আর জ্বলল না সময় মতো।
একে একে আমরা ছড়িয়ে পড়লাম নানান জায়গায়। প্রথমে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হল। আস্তে আস্তে যোগাযোগও। তখন সামাজিক মাধ্যম ছিল না। সবে আসতে শুরু করেছে মোবাইল। তবে কল চার্জ লাগত ইনকামিংয়েও।
প্রায় বছর ছয়েক পর একদিন এসেছিল অভিরূপ। চেহারায় বয়সের ছাপ ধরেছে। মাথার চুলে পাক। পোশাক অবিন্যস্ত। হাতে ধরা ফাইল। বলল, এল.আই.সি র একটা পলিসি করা না। তোদের তো ট্যাক্স ছাড়ের জন্য লাগে। এই ভয়টাই আমি পাচ্ছিলাম। অলরেডি অনেকগুলো আছে। তাছাড়া এতদিনে বুঝে গেছি, সিকিওরিটি নয় আমার এখন দরকার রিস্ক বেয়ার করা। শেয়ার মার্কেট। যত ঝুঁকি তত লাভ।
অভিরূপকে ফিরিয়ে দিলাম খালি হাতে। শুধু শুধু টাকাগুলো ব্লক করার মানে হয় না। বারান্দায় একটা সিগারেট নিয়ে বসলাম। সামনের খোলা আকাশে তাকিয়ে মনে হল ছোটবেলার সেই সিঁড়িভাঙা অঙ্ক আজও মেলানো কঠিন। আজও তারা সাপলুডোর মতো পরিহাস করে ঘটমান জীবনের সঙ্গে।
একটা সিগারেট শেষ করে আর একটা জ্বালালাম। অভিরূপের মুখটা স্পষ্ট হয়ে উঠল আরও।🚫
(সব চরিত্রের নাম পরিবর্তিত)
রাজেশ কুমার |
জন্ম : ১৯৮০ মূলত গল্পকার। লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান, দৈনিক স্টেটসম্যান, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, তথ্যকেন্দ্র, কৃত্তিবাস, সংবাদ ৩৬৫ প্রভৃতি পত্র পত্রিকায়। এছাড়াও বাংলা লাইভ ডট কম, দ্যা ওয়াল, ইরাবতী, গল্পপাঠ-এর মতো ওয়েব ম্যাগাজিনেও।
18 মন্তব্যসমূহ
বাহ্! বেশ লাগল স্মৃতির সেইসব অধ্যায়, যা আজকের লেখককে পরিণত হতে সাহায্য করেছে।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনস্মৃতির সোপান বেয়ে চলে যাওয়া অনেক দূর। সে দূর কতদূর, তা জানা নেই। সুখের হতে হতে তার কেন দুঃখের হলো তাও বুঝি জানা নেই। তবে ঘটনাগুলো তো এমনই। স্বার্থপরতার মোড়কে, আমাদের জীবনচর্চাগুলো বুঝি এমনই হয়। কেউ জেতে আর কেউ হারে।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনখুব সাবলীল লেখা। ঘটনার পরম্পরা সুন্দর। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনতোমার লেখা এই প্রথম পড়লাম। খুব ভাল লাগল। আরও পড়ার ইচ্ছাটা তৈরী হল।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ। আপনার নাম জানতে পারলে আরও ভালো লাগত।
মুছুনআমাদের রাজেশ নাকি,? সহজ স্বাভাবিক সুন্দর লেখা। কতদিন দেখা হয়নি। লেখার ভেতর দিয়ে আজ দেখা হল। ভাল হচ্ছে চালিয়ে যাও।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ। নাম বলবেন তবে না দেখা হবে।
মুছুনঝরঝরে গদ্য। রাজেশের অন্য গদ্যদের মতোই। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ দাদা।
মুছুনSundar
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনঅসাধারণ একটা লেখা পড়লাম। পড়তে পড়তে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম। রাজেশ কুমারকে অনেক শুভেচ্ছা। আগামীতে এমন আরও চাই। যা পাঠে সমৃদ্ধ হই।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।।
মুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
মুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
মুছুন