পর্ব ৫

 রাজেশ কুমারের কলমে।। জলের মতন জলের খোঁজে ভেসে

পর্ব ৫ ।। এক না লেখকের জীবন


হারিয়ে যাওয়া বন্দর বলে যায় তার পশ্চাদভূমির কথা শূন্য পোতাশ্রয় সারাটা দিন তাকিয়ে থাকে দূর সমুদ্রের দিকে, কাল্পনিক কোন জাহাজ-মাস্তুলের খোঁজে ঢেউ আসে, ঢেউ যায় সারাদিন একঘেয়ে আসা যাওয়ার খেলা শামুকের খোলের ভেতর সমুদ্রের গোঁ গোঁ গর্জন কানে নিয়ে বসে থাকা একলা গাঁওবুড়োর চোখ দিয়ে হয়তো বা নোনাজল নামে। তারপর রাত আসলে ভেসে যায় সবকিছু। বুকের ভেতর জ্বলে ওঠে লাইট হাউস। ফিরে আসে জাহাজের ডাক। বড় বড় ডানাওয়ালা সামুদ্রিক পাখি। বন্দর জুড়ে পড়ে যায় নাবিকের আনাগোনা, খালাসির হই-হুল্লোড়, মাল-মশালার ওঠানামা।

দুর্লভপুর গ্রামে পা রেখে এমনটাই মনে হল আমার যেন ফিরে আসছে হারিয়ে যাওয়া কোন বন্দর, তার পোতাশ্রয়, তার বিস্তীর্ণ পশ্চাদভূমি। যেন কথা বলে উঠছে কবি চক্রবর্তীর প্রত্নজীবন’, ‘বীজভূমির যাপনকথা’ ‘নানা রঙের মানুষরা একটা চেনা সুর ভেসে আসছে বহুদূর থেকে। আমি উৎকর্ণ হয়ে শুনছিলাম, কে যেন হাঁক দেয়, কেরে মংলু! গলা শুনে বুঝি কানু দূর থেকেই উত্তর আসে, হয় ফের প্রশ্ন, কোনটে যাছো! আবার উত্তর আসে, পতিরাম হাঠোৎ চলতে থাকে কথাবার্তা

       ঐটা পাঁঠা-পাঁঠিরে?

       পাঁঠি

       কত দাম নিবু?

       ক্যান তুমি নিমেন?

মনে মনে হাসি পায় আমার এইবার লেগে যাবে দুই জনে কানু দশটাকা দাম দেবে মংলু বলবে, আবির এরকি মারোছিন? কানু বলবে, নিবাও তো পাঁরো, কত নিবু? দেখতে দেখতে লালুবুড়া আসে সম্পন্ন গৃহস্থ সে গোলা ভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুর ভর্তি মাছ সব, সবকিছু যেন মনে পড়ে যায় আমার কনেদেখা আলোয় একটা ছায়ামূর্তি ধানকাটা রুক্ষ মাঠ পেরিয়ে হেঁটে যায় কোনাকুনি, সেই পেটকুঁজো নীল আকাশটার দিকে দড়ি ছেঁড়া এক সাদা গরু ঢুকে পড়ে আমার মাথার মধ্যে গলা নামিয়ে ঘাস খেয়ে চলে ভোঁসভোঁস শব্দ ছেড়ে একটা জলফড়িং উড়ে উড়ে বেড়ায় তার আস্ত পিঠের ওপর আস্তে আস্তে জড়ো হয় রবি হালদার, নবীন, কালিদা- আস্ত একটা গ্রাম যেন রত্নাকরের অতল থেকে হাজির হয় সব ছায়াবাজির পুতুল

আমি গিয়ে বসলাম দুর্লভপুর প্রাথমিক স্কুলে বাউন্ডারি ঘেরা ফাঁকা জায়গায় নিঝুম আমগাছের আলো-ছায়া মাখা পেটে সাদা পাঞ্জাবি, সাদা দাড়ি, কাঁধে শান্তিনিকেতনের ঝোলা ব্যাগ পাঁচ-আটের লম্বা মানুষ মৃণালদা খানিক আগেই ঘুরে ঘুরে আমায় দেখাচ্ছিল সব কিছু স্কুল বিল্ডিং, পুকুর, উদ্যানের গাছপালা, মিড ডে মিলের নতুন ঘর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছিল, সময়ের কি বিচিত্র স্রোত যখন শুরু করি লোকে বলত যাযবর স্কুল স্থায়ী ঠিকানা ছিল না গ্রামের বধির্ষ্ণু পরিবারের বাড়িতে বাড়িতে, কখনও চন্ডীমন্ডপে চলত পড়াশোনার কাজ আমরা দু-তিনজনে মিলে চালাতাম, অবৈতনিক সেটা ষাটের দশকের মাঝামাঝি তারপর স্কুলবোর্ডের পর্যবেক্ষক সত্যান্বেষীর বেশে এলেন একদিন। সঙ্গে চেলা-চামুন্ডা। দেখতে চাইলেন খাতাপত্র। আমরা সবকিছু বের করে দিলাম অভাগার শেষ সম্বলের মতো। তাকিয়ে রইলাম তাদের মুখের দিকে। চেলা-চামুন্ডারা তা ঝোলায় পুরে নিল যে যার মতো। সত্যান্বেষী গম্ভীরমুখে চলে গেল তামাক চিবুতে চিবুতে, আমাদের দিকে আড়চোখে চেয়ে। সেটা উনিশশো একাত্তর 

অবশেষে রেকগনিশান এল একদিন,  শুধু স্কুল নয়, সরকারি স্বীকৃতী পেল যেন আমাদের পরিশ্রমও। তখন গ্রামে গঞ্জে পড়াশোনার চল ছিল না এত মাঠের কাজই সব। চাষ আবাদ, জমি নিরেন দেওয়া। সকালে উঠেই পোলাপানেরা বেড়িয়ে যেত কাজের ধান্দায়, তাদের বাবা মায়ের সঙ্গে চাষের সময় পড়ালেখার কী দরকার! ওসব বাহাদুরি না দেখালেও চলবে। স্কুল চালু রাখতে তখন আশপাশের বাড়ির সব ছেলেপিলেদের ধরে আনাই হত এক প্রকার আদিবাসি, বর্মন, মাহিষ্য সেও এক চোর-পুলিশ খেলা আগল দিতে হত সব ধারেই তখন এক এক বাড়িতে ছেলেপুলের সংখ্যা অনেক আজকের মতো একটি দুটি নয় ওদিকে বাউন্ডারি ওয়াল ছিল না স্কুলে মাটির ঘর, বর্ষায় ভেসে যেত আমাদের পরিশ্রম সব পন্ড হবো হবো করেও রয়ে যেত কোন এক অদৃশ্য সুতোর টানে আমি স্কুল বিল্ডিংয়ের দিকে চোখ তুলে তাকালাম পাকাবাড়ি, দেওয়াল, মেঝে দেওয়ালে দেওয়ালে সকালের ঘুমভাঙা সূর্যের আলোর মতো রঙিন ছবি, বর্ণপরিচয়, সহজপাঠ মৃণালদা দূরে দাঁড়িয়েই হাসল বলল, সময়ের সে চালচিত্র আর পাবে না। সেই গ্রাম, সেই স্কুল, সেই ঘটনা পরম্পরা, ভাষা, লোকাচার, বিশ্বাস-অবিশ্বাস আজ আর কিছু নেই। বিবর্তনের নামে পুরোটাই অবলুপ্ত।

স্কুলে মিড ডে মিল রান্না করা স্বনির্ভর গোষ্ঠির মেয়েটি কাপে করে চা দিয়ে গেল আজ বিদ্যাসাগরের জন্মদিন কচিকাঁচাদের নিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে খানিক আগেই আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললাম, বাস্তবের সেই অবলুপ্তি আর শিল্পের অবলুপ্তি যে এক নয় মৃণালদা আপনার প্রত্নজীবন পড়তে এসে যে অলীক গ্রামের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতাম সেই গ্রাম তত দিন থেকে যাবে যত দিন তার অলৌকিকতা ঘিরে রাখবে আমাকে অতুল, নিশি বাউল, চন্দ্রাবলীরা কথা বলবে। হাসবে কাঁদবে ঘুরে ফিরবে এই বাতাসে মৃণালদা হাসল, সেটা তুমি ঠিকই বলেছ তবুও আজকের এই রঙহীনতা বড় কষ্ট দেয় আমায় ছেলেবেলার সেই মানুষগুলো যেন এক এক রঙের এক এক পুতুল এক একটি চরিত্র, তাদের কথাবার্তা যেন এক একটি আলাদা রঙে রাঙানো আজকাল এদের বড় অভাব যেদিকেই তাকাই মানুষের মুখে শুধু রাজনীতির ভাষা বদল আর পালা বদলের দিকে লোলুপ চেয়ে থাকা আমি একটা হাঁফ ছাড়লাম বললাম, এসবও তো লেখারই উপাদান নাকি! রাজনীতি ছাড়া সমাজ আর সমাজ ছাড়া রাজনীতি কোনটাই যে সম্ভব নয়! এতো সেই প্রাচীনকাল থেকে জিভে জিভে জড়ানো নারী পুরুষের গভীর চুম্বন মুখে মুখ লাগিয়ে তাম্বূলের রস আস্বাদন 

মৃণালদা ঘাড় নাড়ল, একদমই তাই ইচ্ছে আছে বীজভূমির যাপনকথা ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে যাওয়ার সমাজজমিনে রাজনীতির নিষ্ঠুর কর্ষণ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার প্রত্নজীবনের বাউন্ডুলে অতুল সংসারি হয়েছে বীজভূমির যাপনকথায় সেও প্রায় চার দশক আগের ঘটনা তারপর আত্রেয়ীর বয়স বেড়েছে দক্ষিণা বাতাস প্রতি বছর তার চড়া থেকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে কতশত সাদা বালি। দেবীপুর, ফুলতলির খরা পার করে রাতের গাড়োয়ান গাড়িতে বলদ জুড়ে রওনা দিয়েছে  নিরুদ্দেশের পথে রাধানাথ গত হয়েছেন সেই কত চন্দ্রবর্ষ আগে রামেন, নিকুঞ্জ, বীরেন ডাক্তারও। বয়স বেড়েছে অতুলের। তারা ভরা রাতে আজকাল ঘাড় উঠিয়ে আকাশের দিকে তাকালেই পৃথিবীটা কেমন উল্টো দিকে ঘোরে, বন বন শব্দ করে। গভীর রাতে অতুল আসে। বলে, মৃণাল লিখে ফেলো সব। তোমার বাড়ি, গ্রাম, প্রতিবেশী, মাঠঘাট, যা দেখেছ তামাম এই পৃথিবীর কথা। গ্রাম শেষের শ্যাওড়াগাছটা আকাশের গায়ে হাত বুলিয়ে মুছে ফেলার আগে কলমের ডগায় ধরে নাও সব। 

আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে বসছেন না কেন! বীজভূমির যাপন কথা তো বই হয়ে বেরিয়ে গেছে অনেক দিন হল। মৃণালদা নির্লিপ্ত তাকাল। যে লেখে সে কি আর আমি! আমি তো থাকি এই স্কুল, দোকান বাজার চারধারের নানান রকম ঝামেলায় জড়িয়ে ব্যক্তিজীবনের টানাপোড়েনে ত্রিশঙ্কু হয়ে ভেসে

    

মৃণাল চক্রবর্তী 

    আমি চা শেষ করে কাপটা নামিয়ে রাখলাম নীচে বললাম, আপনি তো রিটায়ার্ড স্কুলের চাপ এখন কিসের! মৃণালদা আবারও হাসল একরাশ স্নেহ ঝরে পড়ল সকালের শিউলিফুলের মতো। ষাট পেরোলে সরকারি কাজ শেষ হয় কিন্তু যে কাজের ভার মানুষ স্বেচ্ছায় ঘাড়ে তুলে নেয় তা কি আর শেষ হয় জীবনভোর! এই যে বিদ্যাসাগরের মূর্তি উন্মোচন হল আজ এ তো আমারই তৈরি ছাঁচের মধ্যে সিমেন্ট জমিয়ে, সময় লাগে অনেকগুলো দিন খাটনি আছে লেবারের মতো। আমি হাঁ হয়ে গেলাম খনিকের জন্য বলেন কি! এখানেও আপনি! মৃণালদার চোখমুখে তৃপ্তির ছায়া ফুটে ওঠে সে বলে, এও তো এক উপন্যাস। অতুল যেভাবে ছদ্মবেশে আমার যাপিত জীবনকে তুলে ধরে, এই স্কুল, বাউন্ডারি ওয়াল, পুকুর, গাছপালা, বিদ্যাসাগরের এই মূর্তি সবই একযোগে সেই যাপনেরই সাক্ষী দেবে একদিন বহমান সময় স্থির হয়ে দাঁড়াবে বরফের টুকরোর মতো কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে মৃণালদার আমি সোজা হয়ে বসি তাকিয়ে থাকি মানুষটার দিকে

    রাত বেড়ে চলে আকাশে পূর্ণিমার গোল চাঁদ সেই চাঁদের আলো অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর মতো জানালা গলে প্রবেশ করে দোতলার লেখার ঘরে ঘুমন্ত শিশুর মতো পাশ ফিরে শোয় পৃথিবী তার মুখ দেখলে তখন বড় মায়া জাগে মনে। 

 দূরে হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে ফেরা শুকনো পাতার খসখস শব্দ মৃণালদা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় ঘরে রাখা টেবিলটার দিকে হাতে তুলে নেয় কলমখানি নিঃশব্দে হয়ে ওঠে কবি চক্রবর্তী তারপর স্মৃতির দরজা খুলে খুব সন্তর্পণে প্রবেশ করে সময়ের বসতবাড়ি ঝোলা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘুরে ফিরে দেখে হাত দিয়ে ছোঁয় মলিন হয়ে যাওয়া সব কারুকাজ ধুলো ঝাড়ে খানিক দাঁড়ায়, তাকিয়ে থাকে কোন কারণ ছাড়াই

    কবি চক্রবর্তী সজাগ থাকে ঘুমন্ত পৃথিবী যেন না জেগে ওঠে🚫

সবকটি চরিত্রের নাম অপরিবর্তিত 

মৃণাল চক্রবর্তী 
এ পর্যন্ত প্রকাশিত বই 
কাব্যগ্রন্থ 
    ১) বর্ণ পরিচয় - ১৯৮৮
    ২) মোহনায় এখন গাঢ় নিম্নচাপ - ১৪০১
    ৩) কাগজের নৌকা ভাসাই ১৯৯৬
    ৪) সাঁঝের পিদিম- ১৪০৭
    ৫) মিছিলের মুখ ১৪১১
    ৬) তৃতীয় পর্ব ১৪১১
    ৭) আজ এই গোধূলি বেলায়  ১৪১৭
    ৮) কবি ও কবিতা (সম্পাদিত কবিতা সংকলন) ১৪০৮
    ১০) ছড়ার গানের দেশে (ছড়া  নাটক) ১৪১১
    ১১) স্মরণের সিঁড়ি বেয়ে  ২০০৯
    ১২) আয়না শহর  ২০১৭
    ১৩) সাদা ক্যানভাস ২০১৭
    ১৪) ঈশ্বর ও বেইমান  ১৪২৫

কবি চক্রবর্তী নামে গদ্য
নানা রঙের মানুষ  ২০১৪

উপন্যাস 
প্রত্নজীবন  ১৪২৪
বীজভূমির যাপনকথা ১৪২৫
পরদেশি মেঘ  ২০১৯


রাজেশ কুমার


জন্ম : ১৯৮০ মূলত গল্পকার। লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান, দৈনিক স্টেটসম্যান, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, তথ্যকেন্দ্র, কৃত্তিবাস, সংবাদ ৩৬৫ প্রভৃতি পত্র পত্রিকায়। এছাড়াও বাংলা লাইভ ডট কম, দ্যা ওয়াল, ইরাবতী, গল্পপাঠ-এর মতো ওয়েব ম্যাগাজিনেও। 
পেশায় - আধিকারিক, পশ্চিমবঙ্গ সরকার। নেশা - লেখালেখি ও লং ড্রাইভিং।  
প্রকাশিত বই - বাউন্ডারি লাইন পেরিয়ে, সোপান পাবলিকেশান।

আপনার মতামত নিচে 
'আপনার মন্তব্য লিখুন' শীর্ষক বক্সে লিখে 
আমাদের জানান। 
লিটল ম্যাগাজিন বেঁচে থাকে 
পাঠকদের মতামতে। 🙏


আগের পর্বগুলি পড়তে চাইলে ক্লিক করতে হবে