- - - পা ঠ প্র তি ক্রি য়া - - -


গল্পগ্রন্থ মনভাসি

লেখক শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়

প্রকাশক একুশ শতক

প্রথম প্রকাশ - ২০১৯

মূল্য ২০০ টাকা 

১৯২ পৃষ্ঠা, হার্ড বোর্ড বাইন্ডিং

মনভাসিগল্প সংকলনটির কথামুখে গল্পকার গৌর বৈরাগী, শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়ের গল্পগুলিকে অন্তরালবর্তী জীবনের গল্প বলেছেন। গল্পগুলি ২০০৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিন ও কিছু বাণিজ্যিক পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। ২০১৫ তে দেশপত্রিকায় প্রকাশিত গল্প মনভাসি। তিলু নামে এক রেডিও মেকানিকের গল্প এটি। গল্পটি সমস্যা দিয়ে শুরু হলেও শেষে পাঠকের মন আনন্দে ভাসিয়ে দেন লেখক, যেতে যেতে গন্ধ বদলে যায়। তিলুর নাকে আসে শিউলির গন্ধ। কী মিষ্টি সুবাস। মাটিতে পা রেখে তিলু স্থির হয়। আকাশ এখনও অন্ধকার। একটু পরে রেডিয়োতে বেজে উঠবে মহিষাসুরমর্দিনী।

না, মনভাসি গল্পটি দিয়ে বইটি শুরু নয়। বরং উল্টোটাই। এই গল্পটি বইএর শেষ গল্প। প্রথম গল্প তাহলে কোনটি? মায়ের হাত। ২০০৫ সালে সাপ্তাহিক বর্তমানএ প্রকাশিত হয় এই গল্পটি। মনভাসিযেমন আবাহনের গল্প মায়ের হাততেমন বিসর্জনের গল্প। কী সমাপতন! বিসর্জনে শুরু আর বোধনে শেষ। মায়ের হাতগল্পটি শুরু হয়েছে মায়ের মৃত্যু শোক দিয়ে। কিন্তু মৃত মায়ের বাতিল হাতের স্পর্শে সন্তানদের শোক বিহ্বলতা লাঘবের প্রচেষ্টা করেছেন লেখক। মনস্তাত্ত্বিক এই গল্পটি সদ্য মাতৃহারা এক সন্তানের চোখ দিয়ে নিজের ভাইদের দেখানোর ভঙ্গীমা; অভিনব না হলেও পাঠক মনে দাগ কাটবেই।

ভূমিকা গল্পটির নামটি শুনে বিষয়টি কিছুতেই পাঠক কল্পনায় আনতে পারবে না, অন্যদিক দিয়ে গল্পটি পড়ে এটার নাম যে ভূমিকাহতে পারে তাও ভাবতে কষ্ট হবে। শিশির আর রজত দুই বন্ধু। দুজনেই এখন বার্ধক্যের পথ পেরোচ্ছে। সুপ্রতিষ্ঠিত ছেলের সঙ্গে রজতের সম্পর্কের টানাপোড়েন ঘিরে গল্পটি ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যান লেখক। এই গল্পে লেখক সমস্যাটি মেলে ধরেন গল্পের একদম শেষে গিয়ে। আর সমস্যাটি ক্রমে এক পরিবার থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে বন্ধুত্বের হাত ধরে অন্য পরিবারের দিকে এগিয়ে যায়। এই গল্পটি পড়লে আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে শিশির রজতের পারিবারিক সমস্যার মধ্যে ঢুকে পড়ছে, কিন্তু গল্পটি পড়ার পর পাঠক টের পাবেন শিশির নিজে এক নতুন সমস্যা ঘাড়ে করে নিয়ে ফিরছেন। এখানেই গল্পটির নতুনত্ব। গল্পটি ২০১০ সালে নবকল্লোলএ প্রকাশ পায়।

বইয়ের ব্লার্বে লেখক পরিচিতি
অপত্য গল্পটি খুব সুন্দর এক সাসপেন্সের গল্প মনে হলেও আদপেও তা নয়। শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়ের অন্য গল্পগুলোর মতোই এটিও একটি মাতৃস্নেহের গল্প, আর স্নেহ থেকেই তো অযথা আশঙ্কার জন্ম নেয় তা তো আমরা সকলেই জানি। এই গল্পে রজত দত্ত চরিত্রটি অসাধারণ ভাবে বুনেছেন লেখক। আর এই গল্পের শেষ বাক্যটি গল্পটিকে এক উচ্চাসনে বসিয়েছে তা না বললে অন্যায় হবে, “স্বস্তির দৃশ্যটিতে হাজির থাকার আকর্ষণ কোনোমতেই এড়ানো যায় না।

গল্পগুলি পড়তে পড়তে যেটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে তাহল, লেখকের ছোটো ছোটো বাক্য গঠনের প্রবণতা। সহজ সরল ছোটো বাক্যের সমাহারে প্রতিটি গল্পে এক মায়া ছড়িয়ে গল্পগুলো বুনেছেন লেখক। ছোট্ট একটা গল্প শুধু ছবি নয়। বাবা মারা যাবার পর শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়াকলাপের জন্য বাবার ছবি বাঁধানোকে উপলক্ষ্য করে এই গল্প। প্রতিটা গল্পেই লেখক খুবই সাদামাটা ঘরোয়া সমস্যাকে তুলে ধরেছেন। এই গল্পেও বাবার ছবি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গল্প ধীরে ধীরে এগিয়েছে।

  অন্বয় গল্পটির নাম নির্বাচন চমকে দেবেই পাঠককে। গল্পটি চিঠির ফর্মে লেখা। যদিও শুরুটা চিঠির মতো হলেও শেষটা নয়। অল্প পরিসরে অনেকটা সময় ধরা আছে এই গল্পে। শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়ের গল্পের আলোচনায় - সম্পর্ক আর মনস্তত্ব এই দুটি শব্দ উচ্চারিত হবে বার বার। তলে তলে গল্পে কপিল মিত্র শুধু কোয়ালিটি কন্ট্রোলে চাকরি করেন তাই নয়। তিনি একজন গল্পকার। যিনি বলেন, আমার লেখাটা হল উদ্বর্ত পত্র। সোজা কথায় যাকে বলে ব্যালান্স শিট।একজন মহিলা পাঠক গল্পের প্রথম থেকেই লেখকের সাক্ষাৎপ্রার্থী। ফোনে বার বার অনুনয় বিনয়। কিন্তু লেখক ব্যস্ত তার কর্মজীবনে। গল্পকার জীবনে ছোটো পত্রিকা থেকে উঁচুমানের পত্রিকায় লেখা প্রকাশের যে পথ তা দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে এই গল্পে। গল্পটির শেষে এক দুর্দান্ত চমক দিয়ে গল্পটি শেষ করেছেন লেখক। নাম নির্বাচন যথার্থ বলতেই হয়।

গল্পগ্রন্থের ৩০ টি গল্পই সুলিখিত। প্রতিটি গল্পেই ছোটো ছোটো পারিবারিক সমস্যা উঠে এসেছে সুন্দর ভাবে।

মহিলা তিথির দিকেই তাকিয়েছিলেন। রিং ব্যাক করতে করতে জানলার কাছে সরে গেলেন। অনুচ্চস্বরে কথা হচ্ছে। হয়তো পথনির্দেশ। আমি চেয়ারে বসে মহিলার মুখের একটা পাশ দেখতে পাচ্ছি। মধ্যাহ্নের আভায় উজ্জ্বল। আত্মজার গর্বে স্মিত। মেয়েকে বৃহত্তর বৃত্তে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াসে ক্লান্তিহীন তাঁর অবয়ব।আগামীতে এই মেয়েও একদিন যুক্ত হয়ে পড়বে বিশ্বের উন্নততর বিপণন জালিকায়। সেদিনের সেই স্বপ্নটাই বুঝি প্রসন্ন রেখেছে ওই মুখছবি।

গল্পের নাম মধ্যাহ্নে। গল্পটির বিশেষত্ব গল্পটি পড়ে যেকোন গল্পকার শিখতে পারেন কীভাবে একটি গল্প শেষ হতে পারে। ছোটোগল্প শেষ করার মধ্যে একজন সুলেখকের কলমের জোর বোঝা যায়। একজন ডোর টু ডোর সেলসম্যানের মানসিক ও পেশাগত দিক অনেকটাই তুলে ধরা হয়েছে এই গল্পে। অথচ এখানে কথক একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা। গল্পটির শেষ বিভিন্ন পাঠকমনে বিভিন্ন দিকের নির্দেশ দেবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

প্রকাশের বিশদ তথ্য, বই থেকে
  মাত্র কয়েক বছর আগেও যখন সমাজে কর্তব্য, মান, নিলজ্জতা, অনুশোচনা এই শব্দগুলোর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম তখনকার সময়ে লেখা গল্প হেয়। প্রকাশ পায় সাপ্তাহিক বর্তমান, ২০১৩ তে। নিম্ন মধ্যবিত্ত গ্রাম্যজীবনের লড়াই উঠে এসেছে এই গল্পে। নেশা, লোভ, তিরস্কার, প্রেম সবই আছে এই অল্প পরিসরের গল্পে। আছে দ্বন্দ্ব। আছে সম্পর্কের টান। পিতা-পুত্রের সম্পর্ক, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, শ্বশুর-বৌমা সম্পর্ক কোনো সম্পর্কই সরল রৈখিক হতে পারে না। তাতে অবশ্য সম্পর্কগুলো মিথ্যে হয়ে যায় না। এক না একদিন সেগুলোর সত্যতা উন্মোচিত হয়, তখন কর্তব্যের গাফিলতি, অনুশোচনার বন্যা বয়ে যায়। কান্না ছাড়া তখন আর কিই বা করার থাকে। তাই তারক তার বাবা হারানের মৃত্যুর পর হাউ হাউ করে কেঁদে চলল। গল্প এখানেই সমাপ্ত। কিন্তু গল্পগ্রন্থ নয়। আরো আরো এমন সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্প বলে পাঠককে টেনে রাখবেন লেখক শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়। সম্পর্কের এই টান শুধু গল্পেই নয় পাঠক মনেও যথেষ্ট আলোড়ন ছড়াতে পেরেছেন বলেই লেখক শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায় ২০২৩ সালে চন্দননগরের গল্পমেলার পক্ষ থেকে অনাদি স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন।

গল্পগ্রন্থ-টি শেষ করে বলতেই হয়, এই গ্রন্থের প্রতিটি গল্পই যেন আমাদের সমস্যা জর্জরিত জীবনের স্বস্তির শুশ্রূষা।  

---------------------------------------------------------------------
মৌসুমী ঘোষ


সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। নয়ের দশক থেকে লেখালেখি শুরু। ছোটো গল্পের জন্য বহুস্বর পত্রিকার পক্ষ থেকে পেয়েছেন 'অনন্ত কুমার সরকার' স্মৃতি পুরস্কার'(২০১৭)। অণুগল্পের জন্য পেয়েছেন গল্প-সল্পের আটচালা আয়োজিত 'উৎপল স্মৃতি পুরস্কার'(২০১৯)। 'মৌসুমী যে অণুগল্পগুলি লিখেছিল' এই নামেই প্রকাশিত প্রথম বই। অণু-পুস্তিকাটি সাড়া ফেলে দিয়েছিল পাঠকমহলে। প্রথম গল্প সংকলন, 'সোনালি খড়ের বোঝা' (২০২০), যুগ্ম গল্প সংকলন 'যেসব গল্পের কোনোও মানে হয় না' (২০২১)। বর্তমানে মৌসুমী আরেকটি ওয়েব পত্রিকা সম্পাদনা করছেন 'জ্বলদর্চি' পত্রিকার উদ্যোগে প্রকাশিত, ছোটোদের জন্য সাপ্তাহিক ওয়েব পত্রিকা 'ছেলেবেলা'।