![]() |
গল্পগ্রন্থ - আপেল
লেখক - ইন্দ্রনীল বক্সী
প্রচ্ছদ - প্রশান্ত সরকার
প্রকাশক – সৃষ্টিসুখ
মূল্য – ১৮০/-
বেওয়ারিশ লাশ পোড়ানোর কারখানা। চিতায় একসঙ্গে তিন চারটে লাশ জ্বলবে। লাশ
আমদানি করে এনে ড্রামে কস্টিক আর অ্যাসিড দিয়ে চুবিয়ে রাখতে হয়… এটাই ‘রাক্ষস’ গল্পের বিষয়।
“ইদ্রিস বুঝতে পারে না ওর কী করা উচিত, আনন্দ না শোক! বাড়িতে একজন ডিস্কো থাকা মানে সুদিনের
হাতছানি,
ওদের পাশাপাশি দুই গ্রাম হাটপাড়া আর মহালন্দী দুই গ্রামে
ডিস্কোরাই তো দিন ফেরাচ্ছে! পাকা বাড়ি, ছাদে ডিশ অ্যান্টেনা, মোবাইল, কারও বাড়িতে আবার মোটরসাইকেল পর্যন্ত এসে গেছে। ইদ্রিসের
কপাল ভালো নয়, ও ডিস্কো হতে পারেনি, ওর যে হাত-পা চোখ-নাক সব সালামাত রয়েছে, একটা গোটা জোয়ান গতর! ডিস্কো হতে গেলে লুলো হতে হবে, হাত-পা স্বাভাবিক থাকবে না, সরু লিকলিকে পা, ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে মাটি
ঘষটে চলবে, যত বেশি লুলো তত বেশি কদর! কেতাবি
ভাষায় যারে ‘প্রতিবন্ধী’ বলে…” এটা ‘ডিস্কো’ গল্পের যাপন কথা।
যে করম মিয়াঁ চকবাজার থেকে খরিদ করে আনে গওহরজানকে সেই মিয়াঁই একদিন গওহরজানকে
উপহার দেয় চকচকে কারুকার্যময় রুপোর পিকদানি। গল্পের নাম ‘গওহরজানের পিকদানি’। এইভাবে
বলতে শুরু করলে দেখা যাবে — যে সংকলনের প্রতিটি গল্পের জীবন এভাবে বয়ে চলেছে, বহু স্রোতে — বহু গন্তব্যে সে বই-এর নাম ‘রাক্ষস’। গল্পকার ইন্দ্রনীল বক্সী। প্রকাশক ‘সৃষ্টিসুখ’। প্রকাশকাল ২০১৮।
এর ঠিক পাঁচ বছর পর ইন্দ্রনীল বক্সীর পরবর্তী গল্পগ্রন্থ ‘আপেল’ প্রকাশ পেল আবার ‘সৃষ্টিসুখ’ থেকেই। সুতরাং
গল্পের বিষয় নিয়ে, ফর্ম নিয়ে, ডিটেলিং নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা করা ইন্দনীল বক্সীর দ্বিতীয়
গল্পগ্রন্থের গল্পগুলি পড়ার আগেই ‘রাক্ষস’ পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই ‘আপেল’ পড়া শুরু
করেছিলাম।
প্রথম গল্প ‘৫ সেম’ গল্পটির নামেই চমকে দিয়েছেন লেখক। এই বাজার সর্বস্ব
পৃথিবীতে আমরা সবাই খদ্দের। সবাই ভাগ্যের চাকার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে চলেছি। ভাগ্যের
চাকা ঘুরতে ঘুরতে কার ভাগ্যে প্রসন্নতা আসে সে কেউ বলতে পারে না। গল্পটির
প্রেক্ষাপট ইন্দনীল বক্সী নিপুণ তুলিতে এঁকেছেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘিঞ্জি জীবন।
যেখানে ছেনো-পিংকির সংসারে ভালোবাসাবাসিও আছে আর আছে অনিশ্চয়তা। “ছেনোদের পাড়ায় রাত নেমেছে সময় মতো। নিশুতি রাত ওদের পাড়ায়
সেভাবে নামে না। কোনও না কোনও শব্দ ভেসে আসেই। কোনও বাড়িতে বাচ্চা কাঁদছে তো কেউ
মদ খেয়ে রাত করে বাড়ি ফিরে খেউড় করছে। পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি করে বেড়ে ওঠা বসতির এর
ওর সংসারের রোজ-নামচা কারও কাছেই বিশেষ গোপন থাকে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে অভ্যাসের
এইসব শব্দ শুনতে শুনতে ছেনো ভাবতে থাকে কারও বাবা-মা মরার বছরে কী করে ওর কপাল
খোলে! পিংকিকে ওসব বলেনি, টাকা পেয়ে থেকে
পিংকির মুড খুব ভালো আজ।”
দ্বিতীয় গল্পে নামে না বিষয়ের উপস্থাপনায় ইন্দনীল বক্সীর কলমের জোর তারিফ না
করে পারা যায় না। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে অফিসে আটকে পরা আটজন মানুষের আতঙ্কিত
লুকিয়ে থাকা, যাকে লেখক বলছেন ‘অজ্ঞাতবাস’। “অনেকক্ষণ জল খায়নি রাজারাম। আবার ঘোলাটে আকাশের দিকে তাকায়, ঘড়ঘড় করে একটা একজস্ট ফ্যান ঘুরে যাচ্ছে কোনার দিকে, আকাশটা দেখে বলার উপায় নেই সেটা কোন শহরের আকাশ! এই
মুহূর্তে এখানে দাঁড়িয়ে ভুলে যাওয়া যায় ঠিকানা, শহর,
জন্মস্থান। নিরিবিলিতে বেশ কিছুক্ষণ লুকিয়ে থাকা যায়।” গল্পটির অসাধারণ শেষ পাঠক মনে দাগ কাটবেই। “এবার ওদের সিদ্ধান্ত নিতেই হবে ওরা কোন দলে! এই মিছিলে মিশে
যাবে,
নাকি লুকিয়ে অপেক্ষা করবে নিরাপদ আশ্রয়ে!” সুতরাং ফর্ম নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা করা গল্পকার ইন্দ্রনীল
বক্সীর কাছে এমন গল্প আরো প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয়।
তৃতীয় গল্পটির উপস্থাপনায় চমক আনলেও এই গল্পটি আরেকটু টান টান হতে পারত বলে আমার মনে হয়েছে। বরং
চতুর্থ গল্পটি অনেক বেশি স্মার্ট ও আধুনিক। গল্পটির নাম ‘অনুপমের আত্মগোপনের কয়েকটি কারণ’। ‘ইনবক্স’ গল্পের বিষয়টি খুব আধুনিক কিন্তু এতই ব্যবহৃত যে অন্য গল্পগুলির তুলনায় সেভাবে সাড়া জাগালো না। ‘আমার টুসু’ গল্পটি খুবই মানবিক
ও সহমর্মিতার গল্প। ‘আপেল’ গল্পটি প্রতীকি ও বেশ ধাক্কা দেওয়া গল্প। পরের গল্প ‘কবিতা চুরি তেমন খারাপ কাজ নয়’ যতটা ক্যাজুয়াল উপস্থাপনায় ততটায় রেশ রেখে যায় শেষ
অনুচ্ছেদে। ‘জড়ুল’ ও ‘বায়স’ গল্পদুটি খুবই
মর্মস্পর্শী। আসলে আমাদের অণু পরিবার সর্বস্ব জীবনই এই গল্পদুটিতে প্রতিফলিত
হয়েছে। মনের রঙ আপাত দৃষ্টিতে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সাদা-কালোয় পরিণত হলেও নানা রঙের
খেলা বয়স মানে না সবসময়। তা প্রতিফলিত হয় নিজ মনের আয়নায় রিপুর তাড়নায়। সে তাড়না
একটা গল্পে তুলে ধরা কম কথা নয়।
‘এসব কথা ইরার একান্ত ব্যক্তিগত…’ আর এই ব্যক্তিগত কথার পর কথা সাজিয়ে ইরার একার গন্ধযাপন অক্ষরে বুনেছেন লেখক, ‘লেবু ফুলের গন্ধ’-এ। ঠিক একই ভাবে কোভিডের সময়ের সৃঞ্জয়ের একাকিত্ব দিয়ে বুনেছেন ‘ব-দ্বীপ’ গল্পটি। চল্লিশ বছর পর দেখা হবে অমর্ত্য আর আনিন্দিতার। দেখাও হয়। ‘কিছুক্ষণ কেটে যায় দুজন প্রাচীন মানুষের ফেলে আসা স্মৃতিকাব্যের রোমন্থনে।’ ‘হলুদ আলোর গুঁড়ো’ গল্পটিকে এরপর পাল্টে দেন লেখক। হ্যাঁ পুরো উল্টে দেন দাবার এক চালে। শুধু ‘পড়ে আসা বিকেলের হলদে আলোয় দুজন হেঁটে যেতে থাকে, …’
আধুনিক সময়ের ব্যস্ত জীবনের গল্প বুনে ইন্দ্রনীল তার পাঠককে চমক দিতে চাননি।
বরং আমাদের জীবন যেমন লেখক ঠিক তেমন ভাবেই তার গল্পগুলোকে সময়ের পাতায় তুলে ধরেছেন, তাতে বিষাদ আছে, অপেক্ষা আছে, আর ছোটোগল্পের
অদ্ভুত স্বাদ আছে। এ স্বাদের ভাগ পেতে আপনাকে ইন্দ্রনীল বক্সীর ছোটোগল্পের পাঠক
অবশ্যই হতে হবে।
লটারির টিকিট খেলা দিয়ে এই বই শুরু হয়েছিল। শেষ হয়েছে ক্রিকেট খেলা দিয়ে। শেষ
গল্প ‘উইকেট কিপার’ অণুগল্প ও ছোটোগল্পের মাঝামাঝি ফর্ম। যদিও মাঝামাঝি বলে গল্পে কিছু হয়না তবু
বলি,
শুধু ক্রিজে কেন সংসারেও অজিত সরখেলরা ‘কিপিং বিহাইন্ড দ্য হোম ফ্রন্ট’ করে চলেছেন। কখনো তার বিপরীতে খেলছেন ছোটোজামাই। আম্পায়ার
সহধর্মিনী ও লেগ আম্পায়ার ছোটো কন্যা। কখনো অজিত সরখেলের মতো অনেকেই জীবনের সমস্ত
সময়ই প্লে অ্যাক্টিং করে চলেছেন, যতক্ষণ না বোল্ড
আউট হচ্ছেন। সুতরাং খেলা চলুক, খেলা নিয়ে লেখকের
গল্প লেখাও চলুক। জীবনের বাঁকে বাঁকে দাঁড়িয়ে পাঠকেরাও সেই খেলা নিয়ে দুদন্ড
মন্তব্য রেখে যাক। তবেই না খেলার মজা! 🚫
পড়ার জন্য নির্দিষ্ট শিরোনামে ক্লিক করতে হবে
👉 ৩০.০১.২০২৩ ।। গল্পমেলার পিকনিক ২০২৩
👉 ২১.০১.২৩ ।। রোহিণী নক্ষত্রের পতন
1 মন্তব্যসমূহ
পড়া ও এরকম একটি আলোচনার জন্য ধন্যবাদ মৌসুমী। শব্দ শ্রমিক হিসেবে এ আমার পরম প্রাপ্তি।
উত্তরমুছুন