- - - পা ঠ প্র তি ক্রি য়া - - -

 
গল্পগ্রন্থ - গল্পপাখি এবং
লেখক - রাজেশ কুমার
প্রকাশক - বার্ণিক
প্রচ্ছদ - রাজদীপ পুরী
মূল্য - ২২৫/-

গল্পপাখি এবং…’ এই গল্পগ্রন্থটি রাজেশ কুমারের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ যারা রাজেশ কুমারের বাউন্ডারি লাইন পেরিয়েগল্পগ্রন্থটি পড়েছেন তাদের কাছে গল্পকারের কলম নতুন নয় চেনা শহরের গন্ডী ছাড়িয়ে লেখক তার পাঠকদের গল্পের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন স্থানে নিয়ে গিয়ে হাজির করান সে কথা রাজেশ কুমারের পাঠক মাত্রই জানে আর নতুন স্থানের মোড় গলি খাল-বিল স্থাপত্য নদী রাস্তা ধরে পাঠক এগিয়ে চলবেই গল্পের স্রোতে সে কথা জানিয়ে রাখলাম লেখকের নতুন পাঠকদের।
গল্পকার রাজেশ কুমার


বার্ণিক থেকে প্রকাশিত রাজেশ কুমারের এই গল্পগ্রন্থে, ২৪ টি গল্পের প্রথম গল্প নোনা জলের মাছএর বিষয় শিকড়ের সন্ধান, কর্মসূত্রে জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়া এক যুবক আর নদী নোনা জলের মাছ গল্পটি নিয়ে শুধুমাত্র এইটুকু কথা বললে ভুল বলা হবে কারণ রাজেশ কুমারেরএই গল্পটিতে কোনো নাটকীয় মোড় নেই যেখান থেকে গল্প বিষয়কে আঁকড়ে বৃত্ত গঠন করেছে বরং পাঠক নোনা জলের মাছ পড়তে পড়তে বার বার নদীতে ওঠা ঘূর্ণীর মতো জায়গায় জায়গায় এসে ঘুরপাক খাবে হঠাৎ কলকল শব্দে জল ঢুকতে লাগল নালার ভেতর বুঝলাম জোয়ার আসছে পারে বাঁধা নৌকোগুলো দুলে উঠছে এক এক করে মাঝ নদীতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাও এবার উঠে আসবে হাঁড়িতে তোলা বাগদার পিনগুলোকেপারে বসে ঝিনুকের খোলায় বাছবে…”  একটা সময় ছিল, মধ্যবিত্ত চাকরিসূত্রে বাইরে বাইরে থাকলেও এক সময়ে ফিরে আসতো নিজের ভিটেতে কিন্তু সময় পাল্টেছে, পরিযায়ী পাখিরাও এখন আর সবসময় শীত ফুরালে ফেরেনা নিজের দেশে ফিরবে কী করে, সেই ভিটের অস্বিত্বও থাকেনা প্রমোটারের দৌরত্বেরাজেশের গল্প এই সময়ে ঘুরপাক খায়,তারসঙ্গে সঙ্গে পাঠকও ঘুরপাক খায় বই কী

 প্রথম গল্পে পাঠক শেষের দিকে এসে থমকে গেলেও দ্বিতীয় গল্প শবনম সাদা ডানা গল্পে পাঠককে লেখক প্রথমেই থমকে দিয়ে ঘুরপাক খাওয়াবে এই গল্পটি অবশ্য নামকরণেই লেখক পাঠককে গল্পের বিষয় বলে দিয়েছেন তা বলাই বাহুল্য সাম্প্রদায়িকতা, ম্যাজিক রিয়েলিজম, ইতিহাস আর প্রেম দিয়ে এই গল্পটি রাজেশ সাজিয়েছেন মনোমতো করে যতই প্রেমের টোপ দিক লেখক, পাঠক কিন্তু গল্পের শেষে না গিয়ে থমকে ছবি আঁকবে এখানে এসে, দুজনে জানালা গলে পাখা মেললাম আকাশ পথে শীতের সন্ধে এমনিতেই অলস তার ওপর চারিদিক থমথমে রাস্তার ত্রিফলা আলো হালকা কুয়াশায় ভেজা সকাল থেকে তিন দফায় হানাহানি হয়ে গেছে দুবার আক্রমণ একবার প্রতি আক্রমণ লাশ পড়েছে দুটো নিরুদ্দেশ এক…” ছবি আঁকা কিন্তু সেখানেই শেষ নয় গল্পটি শেষ করে মনে মনে ভাবতে লাগলাম, রানি ভিক্টোরিয়া হাতের ইশারায়ভিকট্রিদেখালে কেমন হবে সেই ছবিটা!

পরের গল্পে যাবার আগে রাজেশ কুমারের গল্পের ভাষার কথায় আসি প্রায় প্রতিটি বাক্যের মাঝে ক্রিয়াপদের ব্যবহার  পাশ কাটিয়ে গেল দেববুড়োও

লোহার পোষ্টে ঝুলে থাকত ঝিম ধরা চোখে

ডানহাতটা কেঁপে চলে অবিরাম

এদিকে ঢুকতে দেওয়া হবে না কাউকেইত্যাদি ইত্যাদি

তৃতীয় গল্প দেবু মিত্তিরের সংক্ষিপ্ত আবেদনপত্র ছোটোগল্পের সমস্ত গুণ বজায় রেখে পাঠক-মনে রেশ রেখে যাবেই ঠিক যেমন চতুর্থ গল্পঅঙ্করা মেলে নানামকরণের সার্থকতা সহ আপাদমস্তক একটি ছোটোগল্প যে গল্পের একদম শেষে এসে লেখক নিজের কলম চিনিয়ে দেয় মাত্র একটি বাক্য দিয়েই লুকিং গ্লাসে দেখে ছেলেগুলো আস্তে আস্তে ভোল পালটে হয়ে যাচ্ছে তার বাপ ভাই বউ বন্ধু বিপিন

 ‘গল্পপাখি এবং …’ গল্পগ্রন্থটির প্রতিটি গল্পই ২০১৮সাল থেকে২০২২ সাল অব্ধি গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে সুতরাং সাম্প্রতিক মফস্বলের গল্প রাজেশ কুমারের গল্পগুলির প্রধান উপজীব্য বিষয় তা বলাই বাহুল্য এবার আসল কথায় আসি গল্পগ্রন্থটি হাতে পেয়েই সূচীপত্রে আগে খুঁজেছি গল্পপাখির গল্পটা বইয়ের নাম গল্পপাখি এবং …’ তাতে যে গল্পপাখির গল্প থাকবেই সেটাই স্বাভাবিক এবং পড়েও ফেললাম সেই গল্পটাই সবার আগে আর প্রিয় প্রিয়তর প্রিয়তমের লিস্টের শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা দিলাম গল্পপাখির গল্পটিকেই আপনারা অবশ্য কেউ কেউ বলবেন প্রথম গল্প নোনা জলের মাছঅসাধারণ গল্প আমি তবু তর্ক করে যাব আর বলব, গল্পপাখির গল্প লেখকের নিজস্ব সিগনেচার এই গল্পটিতে বল্লির বিল, তপাদারের বন্ধুত্ব, পাখপাখালি, ফাঁদ পেতে পরিযায়ী পাখিদের ধরা, সর্বোপরি গল্পপাখির খোঁজ আছে তবে আমার কাছে প্রিয়তম হবার কারণ মৃত্যুশয্যায় মা ছেলের বুকে স্বপ্ন বুনে দেবার মুহূর্তটি এই কারণেই বলেছিলাম রাজেশ কুমার তার প্রতিটি গল্পে তার পাঠককে কোনো না কোনো মুহুর্তে নিয়ে গিয়ে ঘুরপাক খাওয়াবেই এইখানেই রাজেশ কুমারের গল্প অন্যান্য গোলগল্প লেখা লেখকদের গল্পের থেকে আলাদা আলাদা শুধু গল্পে নয় আলাদা কিছু কিছু বাক্যেও, “…এত কথাবার্তার মাঝে গল্পপাখি আসতে পারে না গল্পপাখি আসার জন্য নিঝুম নিস্তেজ দুপুর দরকার একটা…” “সেই কর্পূর মেশানো চা খেয়ে ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ হয়ে গেল তপাদার হাওয়ায় মিলিয়ে গেল

রাজেশ কুমারের গল্পগ্রন্থে দুটো কিংবা চারটে নয়, সব গল্পগুলিই পাঠকপ্রিয়তা পাবে বিষয়ে কোনো সন্দেহ না রেখেই চলে যাচ্ছিশববাহী যান গল্পটিতে অপেক্ষার গল্প এটি একজন পিতা অপেক্ষা করছেন তার একমাত্র পুত্রের শব দেখার জন্য জিনিয়া গল্পটি পড়তে শুরু করেই কিন্তু যেকোন স্মার্ট মেয়ে বলবেবেশি বেশি আমি হেসে বলব স্মার্ট প্রেমের গল্প এটি এভাবে বাকি ষোলোটা গল্প পড়েই জানাবো তা ভাবলে ভুল করবেন কিন্তু তবু বলি,‘খোলা হাওয়া লতা-মোনাদের মনের হদিস খোঁজে লেখক তিনকড়ি এসেছিল গল্পটি বড়ো মায়াময় কথায় আছে,’আশার ছলনায় ভুলো না লেখক কিন্তু শেষে এসে এই কথাটা যে ভুল তা প্রমাণ করেছেন নীলুর জন্য গল্পটি মানিকের আত্মগ্লানিতে শেষ হয় শেষের অনুচ্ছেদটি গল্পটিকে আলাদা উচ্চতায় নিয়ে যায়

গল্পগ্রন্থটির প্রচ্ছদ খুব অর্থবহ গভীর ভাবনা থেকে রাজদীপ পুরী এটি সাজিয়েছেন গল্পগ্রন্থটিতে কিছু মুদ্রণ প্রমাদ থাকা সত্ত্বেও সেগুলি কখনোই গল্পপাঠে বিঘ্ন ঘটায়নি হার্ড বাইন্ডিং, যথেষ্ট সুন্দর পাতা যথেষ্ট সুন্দর বর্ণ বিন্যাস বইটি পড়তে যথেষ্ট সাহায্য করেছে কিন্তু সূচীপত্রের স্থানে অন্দরমহল বলে যে পাতাটি সাজানো হয়েছে সেখানে পর পর লাইনে কিংবা দুটি স্তম্ভে সাজানো যেত; তাতে পাঠকের গল্পের পৃষ্ঠা সংখ্যা দেখতে আরো সুবিধা হত। এটি অবশ্যই কোনো ত্রুটি নয়

কাকচান নয়, ‘পার্টি, অ্যালকোহল, ব্রেসলেটপরে রাজেশ কুমারের গল্পে অবগাহন সেরে নিলাম আবার কখনো সময় আর সুযোগ পেলে রাজেশ কুমারের গল্পের পথ বেয়ে অচেনা পরিবেশে থমকে দাঁড়াবো কয়েক দন্ড সমাজের অন্ধকার গলি দিয়ে নিয়ে গিয়ে যেভাবে লেখক পাঠককে আলোরদিশা দেয় সেভাবে হাঁটা একজন গল্পকারের নিজস্ব কৃতিত্ব একথা স্বীকার করেই বলি, রাজেশ কুমারের গল্পপাখি এবং…’ গল্পগ্রন্থটি রাজপথ ধরে এগিয়ে যাবেই বহু অচেনা পাঠকমন জয় করতে করতে    

---------------------------------------------------------------------
মৌসুমী ঘোষ


সাইন্যাপস্‌ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। নয়ের দশক থেকে লেখালেখি শুরু। ছোটো গল্পের জন্য বহুস্বর পত্রিকার পক্ষ থেকে পেয়েছেন 'অনন্ত কুমার সরকার' স্মৃতি পুরস্কার'(২০১৭)। অণুগল্পের জন্য পেয়েছেন গল্প-সল্পের আটচালা আয়োজিত 'উৎপল স্মৃতি পুরস্কার'(২০১৯)। 'মৌসুমী যে অণুগল্পগুলি লিখেছিল' এই নামেই প্রকাশিত প্রথম বই। অণু-পুস্তিকাটি সাড়া ফেলে দিয়েছিল পাঠকমহলে। প্রথম গল্প সংকলন, 'সোনালি খড়ের বোঝা' (২০২০), যুগ্ম গল্প সংকলন 'যেসব গল্পের কোনোও মানে হয় না' (২০২১)। বর্তমানে মৌসুমী আরেকটি ওয়েব পত্রিকা সম্পাদনা করছেন 'জ্বলদর্চি' পত্রিকার উদ্যোগে প্রকাশিত, ছোটোদের জন্য সাপ্তাহিক ওয়েব পত্রিকা 'ছেলেবেলা'।