গল্পগ্রন্থ – রোহিণী নক্ষত্রের পতন
গল্পকার – যুগান্তর মিত্র
প্রকাশক – ধানসিড়ি
প্রচ্ছদ – সেঁজুতি
বন্দ্যোপাধ্যায়
মূল্য – ২৫০/-
কথায় বলে
আগে দর্শনধারী, ফের গুণবিচারী। যুগান্তর মিত্রের
গল্পগ্রন্থ ‘রোহিণী নক্ষত্রের পতন’ হাতে নিয়েই ‘বাঃ’ শব্দটি বলতেই হয়। যেমন বাঁধাই, তেমনি পৃষ্ঠা, সুন্দর বর্ণবিন্যাস, সর্বোপরি সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রচ্ছদে রঙের ব্যবহারে নতুনত্ব। এবার আসল
কথায় আসি অর্থাৎ যুগান্তর মিত্রের গল্পগুলির আলোচনায়।
যুগান্তর
মিত্রের গল্পের সঙ্গে পরিচয় ‘আত্মহননের কথামালা’ গ্রন্থের অণুগল্পগুলি দিয়ে। এই কথামালার ‘আয়না’ গল্পটি বলেছিল, ‘এখন আমরা দ্বিগুণ
দূরত্বে অপরজনকে দেখি।’ বইটি হাতে
নিয়েই পড়ে ফেলেছিলাম ‘নিজের কাছ থেকে
পালিয়ে আসার’ বেশ কিছু গল্প।
এরপর যুগান্তর মিত্রের গল্পগ্রন্থ ‘শামুকের গমন পদ্ধতি’র গল্পগুলি পড়ে
অরূপ,
বাবলু, সুবল মাঝি, সুতীর্থদের মধ্যবিত্ত মফসসলের যাপন চিত্রও ছুঁয়ে দেখেছি।
প্রতি ক্ষেত্রেই লেখক খুব সন্তর্পণে তার গল্পদের নিয়ে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অক্লান্ত
হেঁটে চলেছেন।
কলকাতা
বইমেলা,
২০২৩-এ সদ্য প্রকাশিত যুগান্তর মিত্রের গল্পগ্রন্থ ‘রোহিণী নক্ষত্রের পতন’ পড়তে বসে তাই লেখকের কলম, লেখকের গল্পের গতি, লেখকের চরিত্রদের অপরিচিত মনে হয়নি। প্রথম গল্প ‘ফুটবল’ আগে পড়াই ছিল। মানস-মানসীর কথোপকথন এই গল্পের প্রাণ। আটপৌরে কথোপকথন দিয়ে লেখক তার
গল্পকে বুনেছেন। শেষে নিপুণ গল্পকারের সিদ্ধ কলমের আঁচড়ে গোলে পৌঁছে দিয়েছেন তার
ফুটবল গল্পটিকে, “বারবার গোলপোস্টে
বল মারতে মারতে একবার ঠিকঠাক বল জালে জড়ায়। বলটা জাল থেকে ছাড়িয়ে এনে আবার বসায়
মারার জন্য। আর মারতে পারে না। হু হু কান্না ঝাঁপিয়ে পড়ে সারা শরীর থেকে। মানসী
হাঁটুমুড়ে বসে কাঁদতেই থাকে। বৃষ্টিজলে সেই কান্না মিশে যায়। আর সেই দুই জলধারাই
ফুটবলের সারা গায়ে মিশে যেতে থাকে।”
কথায় আছে
আগুন আর ঘি পাশাপাশি রাখা ঠিক নয়। ‘রোহিণী নক্ষত্রের পতন’ গল্পটি এই
প্রবাদ বাক্য মেনেই লেখক বুনেছেন। তবে রুহিমাসি চরিত্রটি বিন্দুমাত্র অতিরঞ্জিত
হয়ে ওঠেনি লেখকের শব্দ চয়নের কৃতিত্বে একথা বলতেই হবে। ‘—আমার খুব খিদা সন্তু। খুব খিদা। তুমিই পারো মিটাইতে। আসার
কামাই দিয়ো না কিন্তু।’ কাম খিদা
বড়ো বালাই। চাকরি পাবার আগে প্রাইভেট টিউশানকে জীবিকা হিসেবে আঁকড়ে ধরা সন্তু
মাস্টারের আত্মগ্লানি এই গল্পটিকে যথেষ্ট উচ্চমাত্রায় নিয়ে যায়।
চাকরি পাবার
আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রাইভেট টিউশান করা আর বাড়ি তৈরি করার আগে ভাড়া বাড়িতে কাটানো
জীবন পেরিয়ে যেসমস্ত মানুষ আজ সচ্ছল জীবনে প্রবেশ করেছেন তারা তাদের পিছনের ফেলে
আসা জীবনের গন্ধ, স্পর্শ পাবেনই
যুগান্তর মিত্রের এই গল্পেগুলির প্রায় প্রতিটিতে। প্রদক্ষিণ গল্প শুরুই হচ্ছে এরকম
একটা চেনা চিত্র দিয়ে। “এই ভাড়াবাড়িতে আসতে
তৃণার খুবই আপত্তি ছিল। বাড়িটা সেই কোনকালে রং করা হয়েছিল কে জানে! বেশির ভাগ
জায়গাতেই রংচটে গেছে। দু-এক জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। কোথাও সিমেন্ট-বালির
হাঁ-মুখ, কোথাও কালচে ছোপ। দোতলার ছাদের
কার্নিশে গাঢ় সবুজ শ্যাওলাও দেখা যায় নীচ থেকে।” তবে যে সহজ ভঙ্গীতে প্রদক্ষিণ গল্পটি শুরু করেন লেখক, সেই একই ভঙ্গীতে কিন্তু শেষ করেন না। রীতিমতো কাঁটা লাগবে
গল্পটি পড়ে। গল্পের মাঝে বেশ রহস্য সৃষ্টি হয়, “চুপচাপ শুয়ে পড়লেও নীলাঞ্জনের কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বারবার সেই দৃশ্য চোখের
সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা কী করছিল ওভাবে? ছবিটাই-বা কার? যতবার অন্যকিছু
ভাবতে চেয়েছে, ততবারই মেরুন রঙের
পর্দাটা চোখের সামনে দুলে দুলে উঠছিল। ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম নিয়ে রাত কেটেছিল তার।” সেই রহস্য উন্মোচন অবশ্যই লেখক করেছেন। রহস্য উন্মোচিত
হওয়ার পর এই গল্পের সমাপ্তি ঘটালে গল্পটি অতিসাধারণ হয়ে যেত তা বলাই বাহুল্য।
গল্পটিকে আরো উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে ‘প্রদক্ষিণ’ নাম সার্থক করে
লেখক নীলাঞ্জন চরিত্রটির মধ্যে বিবেক দংশন তুলে ধরলেন। আর এখানেই যুগান্তর মিত্র
রেখে গেলেন নিজের স্বাক্ষর।
যুগান্তর
মিত্রের এই গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্পই একে অন্যের থেকে আলাদা তবে প্রথম দিকের বেশ
কয়েকটি গল্পের প্রতিপাদ্য বিষয় নারী পুরুষের অবৈধ প্রেম। ‘নায়িকা সংবাদ’ গল্পটিতে চরিত্র মৃত্তিকার জীবনে টিনেজ প্রেম, দাম্পত্য ধর্ষণ ও শেষে প্লেটোনিক লাভ মৃত্তিকাকে দৃঢ় হতে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। গল্পটি আশারদীপ জ্বেলে শেষ
হয়েছে ঠিকই কিন্তু মনে হয়েছে হুড়মুড় করে লেখক অল্প পরিসরে পরিণতির দিকে ছুটছেন।
চরিত্রটিকে আরো একটু সময় দিয়ে গড়লে আরো আলোকিত হতো।
যুগান্তর
মিত্রের ‘বাজপাখি’
গল্পটি অন্য জঁ-এর গল্প। গল্পের উপস্থাপনা, প্রেক্ষাপট, ভাবনা অভিনব। গল্পটির নাম নিয়ে লেখক
অন্যকিছু ভাবতেই পারতেন। “সনাতন একদৃষ্টে
তাকিয়ে থাকেন বাজপাখিটার দিকে। তাঁর চোখ দেখেই পাখিটা বুঝে ফ্যালে, স্মৃতিভ্রষ্ট ফ্যারাও তার কথা বিশ্বাস করেননি। তাই সে
অনেকটা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলে যায়, রাজাদের যেমন প্রতিপত্তি থাকে, তেমনি শত্রুরও অভাব থাকে না মহামান্য। আর আপনি তো ছিলেন অল্পবয়সি এক রাজা।
হিংসা, লোভ, ক্ষমতার ঘন কালো অন্ধকার প্রাসাদের অন্দরে অন্দরে ঘুরে
বেড়াত অবিরত। রাজবাড়ির ঘটনাপ্রবাহে আমাদের জড়ানো হত না। পোষ্য হিসাবে যেটুকু
প্রাপ্য ছিল, তাতেই আমাদের মতো
ইতর প্রাণীদের খুশি থাকতে হত। তবু আপনি আমাকে অনেকটাই দিয়েছেন…” এই গল্পটিতে লেখকের ইতিহাস চেতনা, তথ্য সংগ্রহ ও সর্বোপরি চরিত্র হিসেবে বাজপাখি নির্বাচন
সাহসের পরিচয় বহন করছে।
পরের গল্প ‘রেডিয়ো এবং বন্ধুর গল্প’ পড়ে অদ্ভুত এক নস্টালজিয়ায় ভেসে গেলাম। ‘গন্ধ’ গল্পটিতে আবার অনিমেষ একটি চরিত্র যিনি সারাদিন শুধুই ভেবে যান। তিনি একজন
ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ। একাকিত্বই যার সঙ্গী। একসময় তার একটি ছাপাখানা ছিল। তারপর? তারপর লেখক পাঠককে নিয়ে ঢুকে যান অনিমেষের গন্ধ(মনো)জগতে।
মন্টুর মৃত্যু ও তার শবযত্রা ঘিরে এক পুরোনো স্মৃতি উঠে এসেছে ‘চোর’ গল্পটিতে। মন্টুদার মৃত্যুটিকে স্পষ্ট করেছেন লেখক, “গতকাল একই রাজনৈতিক দলের দুই গ্রুপের ক্ষমতা দখলের লড়াই
চলছিল। মাঝে মাঝেই এসব হয়। মন্টুদা কাজ সেরে ফিরছিল ওই পথ দিয়েই। গোলাগুলির মুখে
পড়ে যায় মন্টুদা। আর তারপরই আসে সেই অমোঘ সময়। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া।” অন্যদিকে শবযাত্রাটিকে খুব নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখিয়েছেন, “আমরা জানতাম মন্টুদা চোর। ছোটোখাটো চুরি করে, যাকে বলে হাতসাফাই। অনেকেই জানত ব্যাপারটা। তাই তারা সতর্ক
থাকত মন্টিদার থেকে। এখনও অনেকেই সতর্ক হয়ে এড়িয়ে গেল মন্টুদাকে। আর আমরা চোরের
মতোই চলেছি মন্টুদার মৃতদেহ নিয়ে। চোরের মতোই অন্ধকার গলিপথ ধরে শেষযাত্রায় চলেছে
মন্টুদাও।”
4 মন্তব্যসমূহ
কী বলব মৌসুমী। আমি আপ্লুত। আপনার মতো কোনও প্রিয় লেখক এবং অনুরাগী পাঠক যখন এইরকম ভাষ্য রচনা করেন গল্পগ্রন্থ নিয়ে, তখন খুব আনন্দ হয়। আনন্দে চোখ ভিজে ওঠে।
উত্তরমুছুনআপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাব না। ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাই।
খুব সুন্দর পাঠ প্রতিক্রিয়া দিয়েছ মৌসুমী
উত্তরমুছুনযুগান্তর মিত্র এই সময়ের একজন উল্লেখযোগ্য লেখক। যতটুকু পরিচয় তাঁর লেখার সঙ্গে তার থেকে বলতে পারি তাঁর লেখার ধ্রুপদি চলন , ভাষার মার্জিত ব্যাবহার আকর্ষণ করতে বাধ্য পাঠককে। এই পাঠ প্রতিক্রিয়া বইটিকে তুলে ধরল আরও। এই জরুরী কাজটি করার জন্য মৌসুমী আপনাকে ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনঅসম্ভব রকমের শিক্ষণীয় বই _আলোচনা হয়েছে। যেহেতু যুগান্তর _দার গল্পের কয়েকটি পড়া এবং স্মৃতিতে পর্যন্ত, তাই সম্পর্ক তৈরি হয় সহজেই। বাঙ্ময় নির্বাক এই আলোচনা বারবার পঠনযোগ্য।
উত্তরমুছুন