পর্ব ৭ |
রাজেশ কুমারের কলমে।। জলের মতন জলের খোঁজে ভেসে
পর্ব ৭ ।। এভারেস্ট ও হিন্দি সিনেমা
আমি ফয়জলের দাদাকে মেরেছি। সান্দারকে মেরেছি। ওই দানিশকেও। কিন্তু নিজে বেঁচে
আছি এখনও। কেন! কেন না আমি সিনেমা দেখি না। ছোটবেলায় দেখেছি ‘নমুনালোগ’ সব সিনেমা দেখত।
গঙ্গা যমুনা। সবাই চাইত দিলিপ কুমার হতে। মেয়েদের পছন্দ দেবানন্দ। তারপর হল রাজেশ
খান্না। ছেলেদের বচ্চন অমিতাভ। আর আজকাল সালমান খান। সুনীল দত নার্গিসের ছেলে
সঞ্জয় দত্। সবার মাথায় নিজের নিজের সিনেমা চলছে। সবাই চাইছে নিজের সিনেমার হিরো
হতে। শালা “হিন্দুস্থান মে যবতক সিনিমা হ্যায়
লোগ চুতিয়া বনতে রহেঙ্গে।” — গ্যাঙ্গস অফ ওয়াশিপুর- ২
কুঁজোর ইচ্ছা হয় চিৎ হয়ে শোয়ার, আরশোলার আকাশে ওড়ার। আমার হল বডি বানানোর। সালমান খান, সঞ্জয় দত্তের মতো। হাইট নেই! তাতে কী! সালমান, শাহরূখ কী এমন লম্বা। সুস্মিতা সেনের পাশে দাঁড়ালেই বোঝা যায়। কোথায় বাঁশ আর কোথায় বাঁশকাঠি। সে যাই হোক, ভর্তি হয়ে গেলাম এক গরীব ক্লাবে। গরীব, কেন না তখনও সরকারি অনুদান দেওয়া শুরু হয়নি ক্লাবগুলোকে। মাথায় টিনের চাল, দুর্বল দেওয়াল, মেঝেগুলোয় যেন পাখির ঠোকর, ঠোঁটের বিন্দু বিন্দু দাগ। ডাম্বেল বারবেলেই কাজ সারতে হত ভবিষ্যতের ব্যায়ামবীরদের। আজকের মতো অত্যাধুনিক জিম যাত্রার আয়োজন তখন ছিল না পাড়ায় পাড়ায়। ব্যতিক্রম দু-একটি বড়লোকের ক্লাব। গাড়ি দাঁড় করিয়ে হাফপ্যান্ট পরা ফ্যামিলি প্যাকেরা সব এন্ট্রি মারত সেখানে কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে। ওসব জায়গায় ভর্তি হওয়ার হিম্মত আমার ছিল না। ওই হাফপ্যান্টের দিকে তাকালেই দম বেরিয়ে যেত। অনেক পরে এক এলেবেলে বান্ধবীর কাছে থাবড়া খেয়ে জেনেছি ওগুলো হাফপ্যান্ট নয় হটপ্যান্ট। বাদ দিন। এসব লজ্জার কথা আর না বলাই ভালো। আমার ক্লাবটা ছিল গোন্দলপাড়ায়। সেই গোন্দলপাড়া যেখানে জন্মেছিলেন রাধানাথ সিকদার। এভারেস্টের উচ্চতা মেপে ধন্য করেছিলেন আমাদের। সেই গোন্দলপাড়া যেখানে নোঙর ফেলেছিলেন স্বয়ং যুবক রবীন্দ্রনাথ। মোরান সাহেবের বাগানবাড়ি। বাকি অগ্নিযুগের কথা না হয় বাদই দিলাম। বিশ্বাস করুন স্বাধীনতার ওই এক কচকচি আর ভাল্লাগে না।
“কাকা এক ভাঁড় চা দিয়ো, বিনা চিনি। একটা সিগারেট।” আর দোকানের কোণায় রাখা টিভিটা একদম বন্ধ। ওয়াশিপুরের এইসব গ্যাংস্টারদের অ্যাকসান দেখতে আর খিস্তি শুনতে ইচ্ছে করছে না এখন এই ভর দুপুরে।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, ক্লাবটা ছিল গরীব। কপিকলের ওপর পাটের দড়ি ঝুলিয়ে বানানো হতো
পুলি। ওই কাঁধের জোর বাড়ানো আর চেহারায় ইংরাজি ভি আকৃতি আনার জন্য আর কি। তা সেই
পুলি মাঝেসাঝেই ছিঁড়ে পড়ত কপিকলের ঘর্ষণে, কেবল টিভির রুগ্ন তারের মতো। কাঠের একটা ডনকাঠ ছিল বটে। কিন্তু এমন গজা যে
ক্যাঁচকোচ আওয়াজ হতো। যে কোনও মুহূর্তে
ভেঙে পড়ার চান্স ছিল। ওতে ডন টানা মানে বুক থেকে হৃদপীন্ড খুলে পড়ার জোগাড়।
মনোজ বলল, “ওসব ছোড়। নতুন এসেছিস শুধু বৌঠকি দে, স্কিপিং আর মাটিতে পুশ আপ। শরীরে তাকত আসবে তারপর হাত
ছোঁয়াবি ওসবে।”
বোঝো কান্ড, বৈঠক মানে তো সেই ওঠবস! কিছুদিন আগেও
পড়া না পাড়লে শিক্ষকদের নির্দেশে জুটত যা। সব্বোনাশ, চোখে সরষেফুল দেখলাম। একে কুঁড়ে তার ওপর মুরগির থেকে ধার নেওয়া পা। বললাম, “ইয়ে মানে একশোটা ওঠবস-এর থেকে তো দশপাক দৌড় কম কষ্টকর।”
মনোজ রোক নিয়ে বলল, “শালা সবহি চায় বুক
আউর হাত বানাতে। ছোটা ছোটা গেঞ্জি পহেনকে সব হিরো বনেগা। যিসকো ভি দেখো ষাঁড়ের মতো
কান্ধ আর পা যায়ে জহন্নমমে।”
আরেক ছোকরা রজত তাল ঠুকল, “আরে ভাই পা না খাটলে চলবে কি করে! কম্পিটিশনে গেলে প্রথমেই ভাগিয়ে দেবে।”
আমি তো হতবাক। সত্যি বলার কিছু নেই। জিনিসপত্রে যদি হাতই না দেবো, ফালতু ফালতু অ্যাডমিশন ফি দিলাম কেন! এতো সেই কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে বই মুখস্থ করে লেখার মতো হয়ে গেল। নোটস ফোটসের বালাই নেই। কিন্তু সে সব কথা বলা যাবে না। মনোজ হলো ওখানকার ট্রেনার। অনেকটা ওই হাফ-পাশ ডাক্তারের মতো। রোজ বিকেলে এসে শর্টস আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে গম্ভীর মুখে ঘোরাঘুরি করে। দু একটা ডন বৈঠক দেয়। আর অন্যকে দিয়ে একশোটা দিইয়ে নেয়। আমার মতো ছেলের খাটতে খাটতে যখন পা খুলে হাতে চলে আসার যোগাড় কিম্বা হাত জোড়া হাত ছাড়া হওয়ার, মনোজ তখন অমরীশ পুরি সেজে ঘুরে বেড়ায় সামনের বড় চাতালে। যেন ‘মোগাম্বো খুশ হুয়া’।
কিছুদিনের মধ্যে অবশ্য ভাবসাব হয়ে গেল মনোজের সঙ্গে। ওই মাছের মায়ের ভাব আর কী। জলে থাকলে যেমন হয় কুমীরের সঙ্গে। মনোজ হয়ে গেল মনোজদা। আর
আমি তার ভাই। জানলাম সে গঙ্গার ধারেই থাকে। জুট মিলের শ্রমিক বস্তি এলাকায়। জন্মসূত্রে
বিহারের হলেও ওদের কয়েক পুরুষের বাস এখানেই, কঙ্কালসার হুগলী শিল্পাঞ্চলের গোন্দলপাড়া জুটমিলকে কেন্দ্র করে। আরও জানলাম সে
গ্র্যাজুয়েট। বছর দুয়েক আগে পাশ করেছে কাছাকাছি একটা কলেজ থেকে। ছাত্ররাজনীতিতে
তখন এস এফ আইয়ের স্বর্ণযুগ। কিন্তু আমাদের তল্লাটে ওই একটা কলেজ ছিল সিপির বাপের
সম্পত্তি। মনোজ নিজেও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল কোনও ভাবে। তবে ছায়াছায়া, বুঝতে পারতাম না ঠিক। শুধু বলত, “কাউকে ভর্তি করাতে হলে বলবি। ব্যবস্থা করে দেবো।”
আমি বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নাড়তাম আর একটা একটা ডাম্বেল, বারবেল ব্যবহারের অনুমতি আদায় করে নিতাম। যদিও জানতাম কাউকে ভর্তি করাবার দরকার আমার কোনদিনই পড়বে না।
এইভাবে কয়েকমাস চলল, তারপর দুর্গাপুজোয় একটা অস্থায়ী প্রেমের হাতছানি পেতেই বডি বানানো ছেড়ে বিকেলে সাইকেল নিয়ে প্রেমিকার পাড়ায় সার্কাসের তাঁবু ফেললাম। শরীরে যে কয়েকটা পটল গজিয়েছিল ডন বৈঠক দিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই সেগুলো ঝরে গেল সার জলের অভাবে। আর সেই সুযোগে আমি বেমালুম ভুলে গেলাম মনোজের কথা। গাছেই যখন উঠব না, কাঠপিঁপড়ে গুনে কি হবে!
আমি ভুলে গেলাম বটে, পৃথিবী চলতে লাগল নিজস্ব হিসাবে। ভদ্রেশ্বরের শ্রমিক নেতা ভিখারি পাসওয়ান ফিরে এল না। কিন্তু গোন্দলপাড়া জুট মিলে দিন রাতের মতোই পালা করে আসা যাওয়া করতে লাগল খোলা বন্ধর খেলা। লক আউট বিষয়টা কেন জানি ঠিক পুজোর মুখেই এসে পড়ত। আজও আসে। বোনাসের আগে আগেই। লেবার স্ট্রাইক, মালিকের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও, ইত্যাদি ইত্যাদি। তেলিনিপাড়ায় পেটো পড়া অব্যহত রইল। গোরস্থান মাঠে বারুদের গন্ধ। বছর বছর হিন্দু মুসলমান রায়ট। হিন্দু মানে বিহারের যাদব। আর মুসলমানও প্রধানত ওদিকেরই। দুপক্ষই জুটমিলের শ্রমিক, মজুর। ঘর জ্বালানো, ধর্ষণ, খুন, কার্ফু, ফেরিঘাট বন্ধ, পুলিশ ভ্যানের ছুটে যাওয়া, অবিরাম সাইরেন। সব মিলিয়ে ঘটনাবহুল আহ্নিকগতি, বার্ষিকগতি। আর এসবের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে আমি হয়ে গেলাম গ্রাজুয়েট। তারপর কর্মসূত্রে চলে গেলাম নিজের শহর ছেড়ে অনেক দূরে।
মাঝে দু-চার বছর কেটে গেছে। ফিরে এসে দেখলাম ‘কুখ্যাত’ বদনাম নিয়ে চৌতিরিশ
বছর বিদায় নিয়েছে, বাংলাজুড়ে শুধুই
সবুজ ঘাস। ঘাসফুলের হাসি আমার শহরের সর্বত্র। কাঁঠালতলায় নতুন পার্টি অফিস উদ্বোধন
হয়েছে,
গণেশের মিষ্টির দোকান উঠে গিয়ে। শুনলাম সে নাকি নাইট
গার্ডের চাকরি নিয়ে চলে গেছে কোথায়। তা একদিন সেই পার্টি অফিসেই দেখা হয়ে গেল
মনোজের সঙ্গে। প্রথমটায় খেয়াল করিনি। গায়ে পাঞ্জাবি, গলায় উত্তরীয় হাতে ফুলের মালা।
হঠাৎ ডেকে বসল আমায়, “আরে বিশুভাই যে।”
ভয়ানক হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়ালাম, “আরে
মনোজদা তুমি! তোমার এই অবস্থা কে করল!’’
বিশ্বাস করুন কথাটা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছিল। হাতে ডাম্বেলের বদলে ফুল।
মুখে অম্বলের বদলে হাসি। আর পোষাক আসাকের বাহাদুরি না হয় বাদই দিলাম। কোন রকমে
সামলে নিয়ে বললাম, “অনেক রোগা হয়ে গেছ
কিনা তাই।”
মনোজ ভরন্ত গাল আর উঠতি ভুঁড়িতে হাত
বুলিয়ে খুশি খুশি বলল, “হ্যাঁ মাঝখানটায়
বড্ড বেড়ে গেছিল। এখন একটু ঝরেছে। আসলে সারাদিন যা দৌড়াদৌড়ি। মিটিং, মিছিল, সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠান।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। বাড়ি এসে জিজ্ঞেস করলাম। মা আতঙ্কিত গলায় প্রশ্ন
করল,
“তুই চিনিস!”
আমি বললাম, “সেই কবে থেকে।”
মা বলল, “সাবধানে মেলামেশা করবি। দুদিন
আগে ওদিকে বোম পড়েছে। শোনা যাচ্ছে ওকেই
মারতে এসেছিল। এসব লোকের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলাও বিপদ।”
বুঝলাম মা ঠিক কল্পনা করে নিয়েছে মনোজকে ঝাড়তে এসে কেউ ভুল বসতো আমাকে ঝেড়ে
দিচ্ছে। বললাম, “চাপ নিও না। কিন্তু ওকে মারতে আসবে
কেন!”
মা বলল, “ওই তো এখন এই তল্লাটের দাদা।
প্রমোটিং,
ফেরীঘাটের নিলাম, সাট্টা জুয়ার বোর্ড সবই তো ওর হাতে। এলাকার পুরনো বাড়িগুলো এক এক করে ধরছে আর
পটাপট ভাঙছে। আগে নাকে আঁচিল খোকন এসব কাজ করত। সে এখন জেলে। তারই লোকজন এসেছিল
মনোজকে মারতে। তারপর থেকেই তো ও বডির্গাড নিয়ে ঘোরে।”
মায়ের কথা শুনে মাথায় হাত। যাঃ ব্বাবা, এ তো দেখি উলটো পুরাণ। মনোজ ডন আমাকে দেখে বলে, বিশুভাই! মনে মনে নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবলাম। এ দেশে মানবতা
এখনও বেঁচে আছে তাহলে। বলতে পারেন চোখে জল চলে এল এক প্রকার।
খুব বেশি দিন কাটল না। একদিন মাঝরাতে তুমুল হই হট্টগোল। চিৎকার চেঁচামেচি।
ছাদে উঠে দেখলাম রাস্তার দুধারে জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসান দেখার ভীড়। পাড়ার ছেলেদের
জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে রে!”
সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, “পুলিশের ভ্যান
ঢুকেছে গোন্দলপাড়ায়। মনোজকে তুলবে। মহাডাঙা মার্ডার কেসে যোগ পেয়েছে থানা।”
রগড় দেখতে আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম ছাদে। খানিক বাদেই পুলিশ হাঁটাতে হাঁটাতে নিয়ে গেল মনোজকে। হাতে
হ্যান্ডকাফ। পিছনে রুলের গুঁতো। কেউ বলল, “বকলমে নাকে আঁচিল খোকনেরই কাজ। ওই ব্যাটাই জেলে বসে কলকাঠি নেড়ে থাকবে কিছু।
কেউ নিশ্চিত, ফাঁসানো হলো ছেলেটাকে। ও কোনও সাতে
পাঁচে থাকে না।”
আমি মনে মনে বললাম, “সব সিনেমা। চুতিয়া বানানো হলো পাবলিককে।”
তারও বেশ কয়েক মাস পর। মনোজ ফিরে এল স্বমহিমায়। শোনা গেল সে এখন নাকে আঁচিলেরই
পার্টনার। শুধু গোন্দলপাড়া নয়, পুরো শহরটাই তার
দখলে। এবারে নাকি ভোটেও দাঁড়াবে সে। পাবলিকের ঝাল খেয়ে আমি উত্তরদিকে মুখ করে
তাকালাম। দুধসাদা এভারেস্ট যেন গোন্দলপাড়ার
দিকে তাকিয়েই হাসছে মিটিমিটি করে। 🚫
মূল সূচিতে ফিরে যেতে এখানে ক্লিক করতে হবে
রাজেশ কুমার |
জন্ম : ১৯৮০ মূলত গল্পকার। লিখেছেন আনন্দবাজার পত্রিকা, বর্তমান, দৈনিক স্টেটসম্যান, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, তথ্যকেন্দ্র, কৃত্তিবাস, সংবাদ ৩৬৫ প্রভৃতি পত্র পত্রিকায়। এছাড়াও বাংলা লাইভ ডট কম, দ্যা ওয়াল, ইরাবতী, গল্পপাঠ-এর মতো ওয়েব ম্যাগাজিনেও।
0 মন্তব্যসমূহ