পর্ব ৬ |
রাজেশ কুমারের কলমে।। জলের মতন জলের খোঁজে ভেসে
পর্ব ৬ ।। ফেরিওয়ালা হতে চাওয়া ছেলেটার রূপকথা
রাতের অন্ধকারে বাবলা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে মেয়েটি বলেছিল, কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আমি বলেছিলাম, চিন্তা করিস
না। একটা সেলসম্যানের চাকরিও জোগাড় করে নিতে পারব। ওর জন্য সার্টিফিকেট দরকার হবে
না। তখনও গ্র্যাজুয়েশন হয়নি। পার্ট টু, পরীক্ষার কিছু মাস
বাকি। মেয়েটি বলল, ভুল ভাবছিস। আমি কিন্তু তোকে বন্ধু
হিসাবেই ডেকেছি আজ। যতই হোক এসব কথা তো আর বলা যায় না সবাইকে। আমি অন্ধকারের দিকে
চোখ তুলে দেখেছিলাম। সেই অন্ধকারে মিশেছিল মেয়েটির মুখ। জীবনের সমস্ত ব্যর্থতা,
অপমান, গ্লানি যেভাবে মিশে থাকে মনের কোন
অন্ধকার কোণে, বন্ধ দরজার ভেতর। অদৃশ্য জল্লাদের হঠাৎ নেমে
আসা এক কোপে যেন দুটুকরো হয়ে গেছিল একটা সম্পর্ক। সামান্য কয়েক বছরের। তবুও ছটফট
করছিল। ঠিক যেভাবে ছটফট করে কেটে নেওয়া ব্যাধের আঙুল। কিম্বা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে
যাওয়া বোবা কোন প্রাণী।
আমি ছুটে পালাচ্ছিলাম। ঘুমন্ত পিচরাস্তা, ইলেকট্রিকের পোল, টিমটিমে আলো পেরিয়ে দূরে বহু দূরে।
খানিক আগের ফেরিওয়ালা হতে চাওয়া স্বপ্নের জগত থেকে যেন অন্য কোন জগতে। আমি জানতাম,
টুপটাপ সেই রক্ত ক্ষরণের রাতে পিছন ফিরে দেখার কিছু নেই। বিদ্ধংসী
দাঙ্গার শেষে ছাইয়ের স্তূপে অপেক্ষা করে থাকবে না কোন অবিনশ্বর প্রেম। আমার দৌড়ের
গতি দ্বিগুন হচ্ছিল। মাটিতে শুয়ে থাকা কুন্ডুলি পাকানো কুকুরগুলো ঘাড় তুলে অবোধ
দেখছিল। হঠাৎ রাস্তা আগলে দাঁড়াল কেউ। বলল, বড় বড় দেশে এইসব
ছোট ছোট ঘটনা ঘটেই থাকে। আমি চমকে তাকালাম। চেনা গলা, চেনা
ম্যানারিজম। হারতে হারতে জিতে যাওয়ার কথা বলা রূপালি পর্দার সেই নায়ক, শাহরুখ খান। মুহূর্তের জন্য যেন আলোর ঝলকানি উঠল কোথাও। হাজার আতস বাজি
তারা হয়ে ঝরে পড়ল অন্ধকার আকাশের বুকে।
গালে টোল ফেলে হালকা ঠোঁট বেঁকিয়ে বাদশাহি
কায়দায় জিজ্ঞেস করল সে, মুঝমে ভরসা হ্যায়!
জলে ভরে ওঠা লালচে দুটো চোখ ধবধবে সাদা রুমালে
রেখে ঘাড় নাড়লাম আমি।
শাহরুখ অতর্কিতে হাত থেকে উঠিয়ে নিল রুমাল।
অবাক হয়ে দেখলাম রুমাল হয়ে গেল দুধসাদা পাহাড়ের সারি। তার পাদদেশে গালিচা সবুজ
বুগিয়াল। বুগিয়ালের নিসর্গে ছোট্ট একটা ঘর। তারপর দুহাত ছড়িয়ে সে বলল, একদিন এই সবুজ বুগিয়ালে গিয়ে দাঁড়াবে তুমি। পৃথিবীর সব সাফল্য পর্দার
নায়িকার মতো বুকের মাঝে আশ্রয় নেবে। ছোট্ট ঘরটা হবে একান্তভাবে তোমার।
আমি বিষ্ময়ে তাকালাম। ম্যানডোলিনের একটা
মিষ্টি সুর খোলা মাঠে দক্ষিণা বাতাসের সঙ্গে ঢুকে পড়ল আমার বুকের ভেতর। অদ্ভুত এক সুখানুভূতি
হল। হলুদ সরষে ক্ষেতে যেন ঢেউ খেলে গেল হাওয়া। লাল সাদা গেঞ্জি, হালকা সামনে ঝুঁকে হাত নাড়িয়ে সেই বাদশাহি কায়দায় চলে গেল শাহরুখ।
ম্যানডোলিনের সুরটা ছোট্ট সোনালি মাছের মতো খেলে বেড়াতে লাগল বুকের ভেতর।
হঠাৎ-ই সবকিছু কেমন পালটে গেছিল। বসন্তের মন
কেমন করা হাওয়া যেন উড়িয়ে নিয়ে ফিরছিল হাজার হাজার চিনারপাতা। ঝরাপাতার সেই খসখস
শব্দ উড়ে বেড়াচ্ছিল মাথার ভেতর। একটা ট্রেন ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চলে
গেছিল পার্বত্য খাদ আর পাহাড় চূড়ার মধ্যের রেল লাইন দিয়ে।ঘন জঙ্গলের বুক চিরে।
একদল বানজারা নাচছিল সেই চলন্ত ট্রেনের ছাদে। যিনকে শর হো ইসককি ছাঁও পাও কি নীচে
জন্নত হোগি। নির্জন প্রান্তরে একটি ছেলে তখনও ভিজে চলেছিল হাতে চায়ের গ্লাস নিয়ে।
গ্লাসের চায়ে টুপটাপ ঝরে পড়া বৃষ্টিদানার শব্দ। যেন মিশে যাচ্ছে মসৃণ চিনির মতো।
সেই শব্দে অমনোযোগী আমি ফিরে তাকিয়েছিলাম নিজের দিকে। শিক্ষক মহাশয় বলেছিল, ‘ও তো হ্যায় আলবেলা, হাজারো মে আকেলা’। গর্বে ফুলে উঠেছিল বুক। সেই
ফোলা বুকের মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে ঢুকে পড়েছিল অভিমানের একটুকরো ঘন কালো মেঘ।
ভায়োলিনের করুণ সুরে বেজে উঠেছিল অন্ধকার রাতের সেই ভাঙা সম্পর্কের ব্যথা
যন্ত্রণা। চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছিল। ঠোঁটের কোণা কেঁপে উঠছিল তিরতির করে। মনে হচ্ছিল
মরুভূমির বুকে ধুলো উড়িয়ে ছুটে যাই হুডখোলা কোন গাড়ি নিয়ে। উদ্দাম বিটসয়ের তালে
তালে ঘাড় নাড়িয়ে, ব্যথা যন্ত্রণার উপশম ঘটিয়ে।
আমি এক বহুতলের প্যারাফিট ধরে হাঁটছিলাম।
খেলছিলাম সাক্ষাৎ মৃত্যুর সঙ্গে। হাতে ধরা গোলাপের পাপড়িগুলো ছিঁড়ছিলাম এক এক করে।
হবে নাকি হবে না! বাজি ধরছিলাম নিজের সঙ্গে নিজে। নীচে বৃষ্টিভেজা বেলায় দড়ির ওপর
হেঁটে মাদারির খেলা দেখাচ্ছিল এক বালিকা। তার চারপাশে ভিড় করে এসেছিল জনগন।
ক্যামেরা প্যান করছিল ওপর থেকে। আমি নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম সব ইন্টারভিউই দিন শেষে
সাক্ষাতমাত্র। আর সব সাক্ষাৎই শেষ পর্যন্ত কিছু না কিছু দিয়ে যায় জীবনকে।
নিদেনপক্ষে কিছু স্মৃতি কিছু অভিজ্ঞতা। জীবনে সঠিক পথে চলার নিঃশব্দ পরামর্শ।
তারপর একদিন অন্ধকার নিভে গেলে ডাকপিওনের সোনালি নিয়োগ পত্র লাল কেন্নোর মতো সবুজ ঘাসে হেঁটে ঢুকে পড়ে তালাহীন ভেঙে
পড়া ডাকবাক্সে, অন গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া ডিউটি পিঠে লিখে।
শাহরুখ খান বলেছিল, মনপ্রাণ দিয়ে ডাকলে পুরো কায়ানাত নাকি সঙ্গ দেয় মানুষের। আমি ইন্টারভিউ
বোর্ডে বসে তিনজন প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়েছিলাম। ঠিক প্রশ্নকর্তার দিকে নয়। তাদের
পিছনের বিরাট বড় উপত্যকা আর সেই সবুজ বুগিয়ালের দিকে। ঢালু পাহাড়ি জমিতে একপাল
ভেড়া বিচরণ করছিল তখন সমুদ্রতীরের অলস বালিঘড়ির মতো। সেই সমস্ত ভেড়ার ডাকে মাঝে
মধ্যেই মুখরিত হয়ে উঠছিল দূরের পাকদন্ডীগুলি। আমি সতর্ক হয়ে উঠছিলাম ক্রমশ। সেই
বুগিয়াল আর আমার মাঝে দূরত্ব শুধু তিনজন।
রাতের অন্ধকারে আল্পসের পাহাড়ি উপত্যকা এসে
দাঁড়িয়েছিল আমার দুয়ারে। সুইৎজারল্যান্ডের সেই স্বপ্নের বুগিয়াল। ঘুমভাঙা সকালে
অদ্ভুত এক আনন্দে ভরে গেছিল ভোরের বাতাস। নিয়োগকর্তার চিঠি পেয়েছিলাম আমি। ওদিকে
শাহরুখ খান তখন হয়েগেছিল এস আর কে। নিজেই নিজের এক ব্র্যান্ড। হাঁটতে হাঁটতে আমি
গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম সবুজ সেই বুগিয়ালে। দুহাত ছড়িয়ে যেন উদযাপন করতে চেয়েছিলাম
জীবনের প্রথম পার্থিব অর্জনকে। সাফারি স্যুট, পায়ে
বুটজুতো। হাঁটতে শুরু করেছিলাম ছোট্ট সেই ঘরটার দিকে। ঘরটা কাগজের নৌকার মতো তির
তির ভেসে যাচ্ছিল অদৃশ্য কোন সুতোর টানে। আমার থেকে দূরে। আরও দূরে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। সন্ধে নামার
মুখে নিস্ফল গা এলিয়ে দিয়েছিলাম পাহাড়ের ঢালু গায়ে। কে যেন হেসে উঠেছিল খোলা
আকাশের মধ্যে থেকে। বলেছিল, পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে
দোস্ত। চমকে তাকিয়েছিলাম আমি।
সে বছর তুষারপাত হয়েছিল খুব। বুগিয়ালের সমস্ত
সবুজ চাপা পড়ে গেছিল ঝুরো বরফের স্তূপে। সারা পৃথিবীটা যেন পরিণত হয়েছিল প্রাণহীন
এক সাদা সৌধে। এমনকি কাগজের নৌকো হয়ে যাওয়া সেই ছোট্ট ঘরটিও অদৃশ্য হয়ে গেছিল সাদা
পৃথিবীটার মধ্যে। আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম পিঠে রুকসাক নিয়ে। চোখে রোদ চশমা, হাতে স্টিক। ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম পাহাড় থেকে পাহাড়ে। কখনও চড়াইয়ে কখনও
উতরাইয়ে। বরফের আগুনে পুড়ছিল আমার নাকের চামড়া। গ্লাভসের নীচে ফুলে উঠছিল হাত।
শাহরুখ খান তখন গান গাইছিল, হর ঘড়ি বদল রহি হ্যায় রূপ
জিন্দেগি। ধূপ হ্যায় কভি, কভি হ্যায় ছাঁও জিন্দেগি।
আমি ভুলেই গেছিলাম ছোট্ট সেই
ঘরটির কথা। মনে পড়েছিল অনেক বছর পরে, আকস্মিক এক হৈ হুল্লোড়
সন্ধ্যায়। বন্ধুদের সঙ্গে পানশালার ব্যস্ততায়। ঝিমধরা আলোর মাঝে, বিয়াল্লিশ ইঞ্চি টেলিভিশনের পর্দায় শাহরুখ খান আর কাজলকে ছোটাছুটি করতে
দেখে। মনে হয়েছিল তুষারপাতের সময় অতিক্রান্ত। সবুজ সেই বুগিয়ালের ঢালে ঘর বাঁধা
যেতে পারে এবার। একান্ত নিজস্ব ছোট্ট একটা ঘর। সময়ের সঙ্গে যে ভেসে যাবে না কাগজের
নৌকো হয়ে।🚫
রাজেশ কুমার |
নিচের তালিকার নির্দিষ্ট লেখায় (উৎসব সংখ্যার)
3 মন্তব্যসমূহ
খুব সুন্দর। অটুট বুনন।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লিখেছো
উত্তরমুছুনগল্পের ভাষা এবং গতির সাথে লেখার মিষ্টত্ব একটি অদ্ভুত মিশেল। একটাই বলার, লেখা পড়ে মনে হলো সেই অনবদ্য জুটির ফাটাফাটি অভিনয়। শাহরুখ এবং কাজল। গল্রপকারের লেখনীকে কুর্নিশ।
উত্তরমুছুন